বিবর্তনের নি:সঙ্গ বয়ন

ফকির ইলিয়াস এর ছবি
লিখেছেন ফকির ইলিয়াস (তারিখ: শনি, ১২/০১/২০০৮ - ৮:০৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিবর্তনের নি:সঙ্গ বয়ন
ফকির ইলিয়াস
=====================================
পিতার আদর্শ বাণীগুলো বারবার মনে পড়ে শাদিবের। তিনি বলতেন, যে মানুষ তার জীবনের শ্রেষ্ঠ যুদ্ধে বিজয়ী হয়, সে আর কখনো পরাজয়ের কাছে নত হতে পারে না। কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তাকে স্পর্শ করতে পারে না। পেয়ালাতে একটু দুধ মেশানো কফি ঢালে আবারো শাদিব। তিন তলার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে খোলা হাইওয়ের দিকে একাকী তাকিয়ে পিতার কথা বারবার মনে পড়ে আজ তার। একটি পরিমিত, অথচ বিলাসী জীবন ছিল তার পিতার। দেওয়ান হাবীব হোসেইন। এক নামে পরিচিত ছিলেন তার পিতা নিজ অঞ্চলে। তার বড় পরিচয় ছিল তিনি একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। আর তা ছিল তার একান্ত গৌরব।

শাদিবের বয়স যখন বারো বছর, তখনই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তার পিতা। আদিব আর শাদিব দুই ছেলে নিয়েই ছিল হাবীব-সুরাইয়াদের সুখের সংসার। অনেকটা, সুরাইয়ার মতের বিরুদ্ধেই যুদ্ধে গিয়েছিলেন হাবীব হোসেইন। ফিরে এসেছিলেন বীরের বেশে।হাবীব হোসেইন প্রচুর খ্যাতিমান হয়েছিলেন আখাউড়ার সম্মুখযুদ্ধে তার সাহসী অ্যাকশনের পর। ১২ ডিসেম্বর ’৭১ ছিল সে ভয়াবহ যুদ্ধ। মাত্র বিশজন গেরিলা নিয়ে পাকসেনাদের ক্যাম্পে চোরাগোপ্তা আক্রমণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু পেছনে থাকা আরেকটি পাক কমান্ডো বাহিনী তাদেরকে পাল্টা আক্রমণ করে। শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। হাবীব হোসেইনের ব্রাশ ফায়ারে পঁচিশজন পাকসেনা ঘটনাস্থলেই মারা যায়।

স্মৃতিচারণ করে হাবীব হোসেইন বলেছিলেন, যুদ্ধ শেষে ক্যাপ্টেন যুদ্ধাহত হাবীব বলেছিলেন, আমার পুরো দেশমাতৃকাই আজ বধ্যভূমি। আমি ওই নরপশুদের মৃত্যুস্খল দেখতে চাই না। সে যুদ্ধে বাঁ হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন হাবীব। তাকে ভারতের একটি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল সঙ্গে সঙ্গেই। ২০ ডিসেম্বর ’৭১ তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বিজয়ী বীরের বেশেই ছুটে এসেছিলেন নিজ অঞ্চলে। দেওয়ান পরিবারের একমাত্র সন্তান হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও ওগুলোতে হাবীবের তেমন মন ছিল না কখনোই। তিনি বলতেন, আমি একটু নিরিবিলি-অবসর জীবনযাপন করতে চাই। মাছ ধরা আর পাখি শিকার ছিল তার অন্যতম প্রিয় শখ। শাদিবের মনে পড়ে, জলটঙ্গি ঘরের বারান্দায় পোষা ঘুঘু, দোয়েল, কুড়া খুব যত্নের সঙ্গেই পুষতেন তার পিতা। পোষা দোয়েল খাঁচা থেকে ছেড়ে দিয়ে বন্য দোয়েলকে ধরতে কিইনা আনন্দ। পোষা পাখি মুনিবের পোষ মেনে বন্য দোয়েলটিকে জাপটে ধরে। তারপর মুনিব গিয়ে নিজ হাতে দোয়েল দুটিকে ছাড়িয়ে পোষাটিকে ভরে রাখেন নিজ খাঁচায়, আর বন্যটিকে অন্য খাঁচায়।

কিংবা ঘুঘু শিকারের সেই দৃশ্যাবলী। বনলতা পরিবেষ্টিত ছোট্ট ঘুঘুর খাঁচাটিকে সরু বাঁশের নল দিয়ে বাঁশ-বেত বনের ঝেপে উঁচিয়ে রাখা হয়। খাঁচার সামনেই থাকে একটি গোপন জাল। খাঁচার ঘুঘুটি ডাকতে থাকে। বনের ঘুঘু সে ডাক শুনে লড়ার উদ্দেশ্যে খাঁচাটির সামনে বসামাত্রই জালটি বন্ধ হয়ে যায়। বন্য ঘুঘুটি ধরা পড়ে সেই জালে।

দুই.
টোস্টেড ক্রসেন্ট আর কফি শেষ করে বেরুনোর জন্য প্রস্তুত হতে থাকে শাদিব। ‘মুক্তিযোদ্ধা সহায়তা প্রকল্প’-এর মাসিক কিস্তির টাকাটি এ মাসে এখনো পাঠানো হয়নি। আজই পাঠাতে হবে। এই প্রকল্প ট্রাস্টটি তার পিতার হাতে এককভাবেই গড়া। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফেরা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সহায়তা করার জন্যই হাবীব হোসেইন নিজ অঞ্চলে প্রায় কোটি টাকা অর্থ সঙ্কুলান দিয়ে এই ট্রাস্ট গঠন করেন। হাবীব সবসময় বলতেন, যারা বিজয়ী বীর তারা জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়ে যাবেন­তা আমি মেনে নিতে পারি না। ছোট পরিসরে হলেও কৃষিখামার, হাঁসমুরগী-মৎস্য খামারসহ কুটির শিল্প, দোকানপাট, মিল প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছিলেন তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিজ অঞ্চলে। হাবীব হোসেইন স্বপ্ন দেখতেন, তার জীবদ্দশায় তিনি নিজ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে হাসি দেখে যাবেন। তা তিনি সম্ভবও করেছিলেন।

বড় ছেলে আদিব একজন খ্যাতিমান চিকিৎসক হিসেবে ব্রিটেনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পিতার একমাত্র বায়না ছিল, আদিব যেন মাসে মুক্তিযোদ্ধা ট্রাস্টে এক লাখ করে টাকা পাঠায়। আদিব সে অঙ্গীকার পূর্ণ করে যাচ্ছে এখনো। তারপর আইটি স্পেশালিস্ট হিসেবে শাদিব যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর পিতা তার কাছেও মাসিক কিস্তি দাবি করেছিলেন ট্রাস্টের জন্য। শাদিবও তাই তার সাধ্যমতো সে কিস্তি দিয়ে যাচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত দুই ভাই সে অর্থ দিয়ে যাবে­ তা তাদের কমিটমেন্ট।

পিতার স্মৃতির মোহনায় ভাসতে ভাসতে কৈশোরের কথা মনে পড়ে যায় শাদিবের। ঘুঘু শিকার দেখতে মাঝে মাঝে সে প্রায়ই পিতার সঙ্গে যেত। সাদিয়াদের বাড়ির পেছনের ঝোপে ঘুঘু শিকার দেখতে গিয়েই একদিন সাদিয়ার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল শাদিবের। কিশোরী সাদিয়া ঘুঘু শিকার দেখতে সেদিন হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল অন্যান্য কিশোর-কিশোরীর মতো। তারপর ট্রান্সফার নিয়ে সাদিয়া যখন শাদিবদের হাইস্কুলে নবম শ্রেণীতে এসে ভর্তি হলো, শাদিব তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। কিছুদিনের মধ্যেই একটা গভীর সদ্ভাব গড়ে ওঠে শাদিব-সাদিয়ার মাঝে।

শাদিব মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে স্খানীয় কলেজে গিয়ে ভর্তি হয়। এক বছর পর সাদিয়াও এসে ভর্তি হয় সেই কলেজে। ভাব, এক সময় প্রেমে পরিণত হয় দুজনের মাঝে। এভাবে গড়িয়ে যেতে থাকে সময়। শাদিব তারপর ভর্তি হয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর সাদিয়া বেছে নেয় বিজনেস ম্যানেজমেন্ট।

শাদিব-সাদিয়ার প্রেমে এক সময় প্রতিকুলতা হয়ে দাঁড়ায় তাদের উচ্চাভিলাষ। শাদিব মনে করে তার এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে বাকি। এক সময় দুজনের সম্পর্ক ফ্যাকাশে হয়ে আসতে শুরু করে। শাদিব মাইগ্র্যান্ট নিয়ে পাড়ি জমায় যুক্তরাষ্ট্রে।

তিন.
সাদিয়া হঠাৎ করেই সম্প্রতি আবার শাদিবের ভাবনার কারণ হয়ে উঠেছে একটি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলে দেশব্যাপী মেধাবী শিল্পী অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পর। প্রযুক্তির কৃপায় বাংলাদেশের প্রায় সবকটি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালিদের ঘরে ঘরে। একটি চ্যানেলে যেদিন থেকে বাছাইপর্ব শুরু হয় সেদিন থেকেই মনোযোগ দিয়ে পর্বগুলো দেখছে শাদিব।

সাদিয়া স্কুলজীবন থেকেই টুকটাক গান গাইতো। কিন্তু সে এমন সুর সাধানায় মনোযোগী হয়ে চর্চা অব্যাহত রেখেছে তা শাদিবেরও জানা ছিল না। প্রাথমিক বাছাই পর্বে সাদিয়াকে দেখে শাদিব তো আনন্দে আতহারা। সে আরো উৎফুল­ হয়ে ওঠে যখন সাদিয়া দ্বিতীয় থেকে ক্রমশ তৃতীয় পর্বে উন্নীত হয়। তৃতীয় পর্বে উন্নীত সকল প্রতিযোগীর পারিবারিক খণ্ডচিত্রের তথ্য উপস্খাপন করেছিলেন উপস্খাপক। সাদিয়ার সঙ্গে আজ কে কে এসেছেন, সে প্রশ্নের জবাবে সাদিয়া যখন তার স্বামীকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল তখনই শাদিব বুঝতে পারে সাদিয়া এখন বিবাহিতা।

কিন্তু শাদিব আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে সাদিয়া যখন সব সিঁড়ি ডিঙিয়ে ‘টপ টেন’ অর্থাৎ সেরা দেশে উন্নীত হলো এরপর থেকে আর কখনো তার স্বামীকে তার সঙ্গে দেখা যায়নি। এমনকি সেরা পাঁচে আসার পর পাঁচজন শিল্পী যখন তাদের নিজ নিজ পরিবারের সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন তখন সাদিয়ার স্বামীকে কিন্তু আর তার সঙ্গে দেখা যায়নি। বিষয়টি দিয়ে বেশ দ্বন্ধে কাটিয়েছে শাদিব।

এর মধ্যে মিডিয়ায় যখন ঘোষিত হয়ে যায় প্রতিযোগী ‘টপ টেন’ শিল্পীদেরকে নিয়ে উত্তর আমেরিকায় কনসার্ট হবে, তখন শাদিবের টেনশন আরো বেড়ে যায়। তাহলে সাদিয়ার সঙ্গে তার আবার দেখা হয়ে যাচ্ছে! স্মৃতি-মিলন-বিরহের রংবর্ণ শাদিবের বুকের গভীরে খাবি খায় বারবার, জিয়ল মাছের মতো।

চার.
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। নিউইয়ার বরণ উৎসবে মেতে উঠেছে গোটা যুক্তরাষ্ট্র। আজ শনিবার। উইক এন্ড আমেজে একটু দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস শাদিবের। আজ তার মেয়ে বন্ধু লীনার সঙ্গে ডেটিং আছে। লীনা সুইডিশ মেয়ে। তারই ডিপার্টমেন্টে ডাটা এন্ট্রি এক্সপার্ট হিসেবে কাজ করে। লীনার সঙ্গে শাদিবের বন্ধুত্ব তিন বছরের। কবিতাপ্রেমিক শাদিব আজ দুপুরে লীনাকে নিয়ে নিউইয়র্কের খ্যাতিমান ‘ক্যাফে ৯২ ওয়াইতে’ লাঞ্চ খাবে। সেখানে ‘কবিতা ও বর্তমান বিশ্ব’ সম্পর্কে একক ভাষণ দেবেন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ডবি­উ এস. মারউইন। মারউইন স্পষ্টবাদী-নান্দনিক কবি হিসেবে বিশ্বে সমকালে ভীষণ সমাদৃত। শাদিব, লীনা এবং তার নিজের জন্য উচ্চ মূল্যে টিকিট ক্রয় করে রেখেছে অনেক আগেই। খুবই ছিমছাম প্রোগ্রাম। কবি পৌনে এক ঘন্টা বক্তব্য রাখবেন সূচি অনুযায়ী। তারপর ২টায় লাঞ্চ। প্রোগ্রাম শেষ করে শাদিব এবং লীনা কাছেই সেন্ট্রাল পার্কে কাটাবে আজকের বিকাল। সাধারণত ডিসেম্বরে প্রচুর ঠাণ্ডা পড়ে নিউইয়র্কে। কিন্তু গে­াবাল এনভায়রনমেন্টে পরিবর্তনের কারণে এ বছর ঠাণ্ডা নেই বললেই চলে। আজকের তাপমাত্রা ৮৪ ডিগ্রি। যা অনেকটা গ্রীষ্মের মতোই। আবহাওয়াবিদরা বলছেন গেল একশত ত্রিশ বছরের মাঝে নিউইয়র্কে এমন আবহাওয়া পরিলক্ষিত হয়নি। পরিবেশের এই আবর্তন গোটা বিশ্বব্যাপী এখন আলোচনার বিষয়।

প্রাগ্রাম এবং লাঞ্চ সেরে শাদিব ও লীনা পার্কের উদ্দেশে বের হয়। চমৎকার লাগছে আজ লীনাকে। স্কাই ব­ু বে­জারের সঙ্গে একটি খয়েরি হালকা কোট পরেছে সে। হাঁটতে হাঁটতে দুজন পার্কের মধ্য প্রাìেত গিয়ে বসে। সেন্ট্রাল পার্কটি খুবই সুপরিকল্পনার সঙ্গে নির্মিত। মাঝে মাঝে ছোট ছোট টিলা। বিþতৃর্ণ ঢালু জায়গা। কৃত্রিম তৈরি লেক-ফোয়ারা। উষä আবহাওয়ার কারণে দুচারটি গাছের ডালে আগাম বাসìতী কলি ফুটতে শুরু করেছে। কথায় বলে, অকালের কিছুই পরিপক্ব হয় না।

শাদিব এবং লীনা যে ঢালু জায়গাটিতে বসেছে তার কাছেই একটি মজবুত প্রþতর ফলক। কালো লোহাতে সাদা মার্বেল পাথরে লেখা কটি কথা। শাদিব এবং লীনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রায় মাটির সঙ্গে ফ্ল্যাট করে মেশানো সেই ফলকটি। দুজন খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকে। বাংলা তর্জমা করলে বাক্যগুলোর অর্থ যা দাঁড়ায়, তা হচ্ছে­
প্রিয় মানব-মানবী, তোমরা জেনে রাখো
দীর্ঘ পাঁচ বছর প্রেম-প্রতীক্ষার পর আমরাও
হাত ধরাধরি করে প্রথম দেখায় বসেছিলাম
এই স্খানে। এই বিনম্র ঘাসের গালিচায়
মিশিয়ে দিয়েছিলাম আমাদের সঞ্চিত স্মৃতি
প্রেম ও প্রতীক্ষা বিন্দু: যা তোমরাও করছো আজ।’
(মার্ক ব্যারন জন্ম-১৯০১, মৃত্যু ১৯৭৫/অ্যাশলি ব্যারন জন্ম-১৯০৩, মৃত্যু ১৯৭০)

ফলকটি পড়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকায় শাদিব-লীনা। মার্ক এবং অ্যাশলি আজ নেই। নিশ্চয়ই তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কেউ এই স্মৃতি ফলকটি এই নির্দিষ্ট স্খানে স্খাপন করেছে। সিটি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে তা যুক্তরাষ্ট্রে করা যায়। এজন্য সিটিকে একটি বড় অংকের ফি প্রদান করতে হয়। কেউ কেউ পার্কের পরিব্রাজকরা খানিকটা বসে জিরোনোর জন্য চেয়ার বা বেঞ্চ স্খাপন করে দেয় নিজ নিজ নামে। দাতার নাম চির অমর করে রাখার এই প্রচেষ্টা!

আমাদের স্মৃতিগুলো ধরে রাখতে তুমি কি তেমন কিছু করবে? লীনা জিজ্ঞাসা করে। আনমনা শাদিব বলে, স্মৃতি কি কখনো অমরতা পায়? কেন পাবে না? লীনার কঠিন প্রশ্ন।

শাদিব কথা ঘুরিয়ে দিতে চায়। বলে আমার আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা করছে। তুমি খাবে লীনা? হাঁটতে হাঁটতে দুজন পার্কের কোনায় আইসক্রিম ভ্যান্ডরটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

পাঁচ.
স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলে অংশ নেওয়া ‘টপ টেন’কে নিয়ে গোটা উত্তর আমেরিকায় কনসার্ট করার ঘোষণা দিয়েছে তাদের নিজস্ব প্রমোশনি সংস্খা। তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এখন তুমুল হইচই। স্খানীয় পত্রিকা টিভি চ্যানেলে বাহারি বিজ্ঞাপন। দর্শক-শ্রোতার নজর কেড়ে মুনাফা অর্জনের আপ্রাণ চেষ্টা।
শাদিব কনসার্টগুলোর সূচিতে নজর রাখছে খুব গভীরভাবে। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে হবে আলোচিত এই কনসার্ট। এতে অংশ নিতে সাদিয়াও যুক্তরাষ্ট্রে আসছে। শাদিব নিজের অজান্তেই ভেতরে একটি টানটান উত্তেজনা এবং ভাঙচুর অনুভব করছে। তাকে তো সাদিয়ার মুখোমুখি হতেই হবে। কিভাবে হবে? কোথায় হবে?

শাদিব একবার ভাবে ‘টপ টেন’-এর শিল্পীরা যেদিন জেএফকে বিমান বন্দরে আসবে, সেদিনই ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির হবে সাদিয়ার জন্য। কিন্তু তা কি ঠিক হবে? সাদিয়া কি চিনতে পারবে শাদিবকে!

একটি দ্বন্দ্বের নি:সঙ্গ বয়নে বিবর্তিত হতে থাকে শাদিবের হৃদয়। নাকি সাদিয়া যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগেই তার সঙ্গে দেশে যোগাযোগ করবে? কিছুই সিদ্ধাìত নিতে পারে না শাদিব।

ভাসমান মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে আজকাল সে তার নিজের জীবনের দেনাপাওনার হিসাবে মেলানোর চেষ্টা করে খুব বেশি। একটা সময় ছিল, যখন কর্মধ্যানে ডুবে পনেরো-ষোলো ঘন্টা প্রত্যহ কাটিয়ে দিতে খুব ভালো লাগতো তার। এখন আর তেমনটি ভালো লাগে না। মনটা যেন একটু বিশ্রাম চায়। একটু ছোঁয়া চায় পরিবর্তনের। স্পর্শের প্রজ্বলনে মনটা মিশে যেতে চায় শিকড়ের সঙ্গে।

কিন্তু এই দূর পরবাসে সবকিছু থাকলেও একটি তীব্র শূন্যতা সব সময়ই যেন কাতর রাখে শাদিবকে। ‘হাউ আর ইউ’, ‘আই অ্যাম ফাইন’­শুনতে শুনতে জীবনটা যেন মেকি গ্রহের মতোই স্থির হয়ে আছে কোনো অন্য আকাশে। যারা প্রতিদিন বলে ‘আই অ্যাম ফাইন’ তারা আসলে কতটুকু ‘ফাইন’ জীবনযাপন করতে পারছে, এমন একটি জিজ্ঞাসা খুব তীব্র হয় এখন তার মনে।

ছয়.
পড়ìত বিকালে মেঘের সঙ্গে সূর্যের ভাসা-ডোবা। আজ নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে বহুল আলোচিত সেই ‘টপ টেন’ কনসার্ট। শাদিব নিজের জন্য একটি ভিভিআইপি টিকিট সংগ্রহ করে রেখেছে অনেক আগে থেকেই।

বিএমডবি­উ গাড়িটিকে সপ্তম এভিন্যুতে গ্যারেজে পার্ক করে অনুষ্ঠান শুরুর বেশ আগেই পৌঁছে যায় ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই হল ভর্তি হয়ে যায় দর্শক-শ্রোতায়। উপস্খাপিকা ঘোষণা করেন শিল্পীরা এক্ষুনি পেছনের ডার্ক রুমে প্রবেশ করবেন। শাদিব উদ্যোক্তাদের পূর্ব পরিচিতের সুযোগে ডার্ক রুমের প্রধান ফটকেই গিয়ে দাঁড়ায়।

শিল্পীদের একেক জনকে সাদরে ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হচ্ছে। এগিয়ে আসছে সাদিয়া। কালো জমকালো ড্রেসে দারুণ লাগছে তাকে। দুটি চোখ স্খির করে শাদিব সাদিয়ার মুখোমুখি দাঁড়ায়।
শা-দি-ব! সাদিয়ার মৃদু চিৎকার।
আমাকে চিনতে পারছো? শাদিব বলে।
কেন পারবো না। কি যে বলছো তুমি!
হ্যাঁ ­আজ প্রাণ ভরে তোমার গান শুনবো।

সাদিয়া মঞ্চে চলে যায়। একে একে পাঁচটি গান গেয়ে শোনায়। ‘যেজন প্রেমের ভাব জানে না: তার সাথে নেই লেনাদেনা’: সাদিয়ার কণ্ঠের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুরো গার্ডেন যেন কাঁপছে একই সুরে। এতে সাড়ে বারোটায় অনুুষ্ঠান শেষ হলে আবার মুখোমুখি হয় দুজন। তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে শাদিব। সাদিয়া বলে। তোমার সব কথা শোনার জন্যই উদগ্রীব আমি। শাদিবের চোখে গভীর জিজ্ঞাসা। তাহলে কাল সন্ধ্যায় তোমার সঙ্গে আমার দেখা হোক। পরদিন সন্ধ্যায় সাদিয়াকে তাদের সঙ্গীত ক্যাম্প থেকে নিয়ে যায় শাদিব। কুইন্স বরো ব্রিজ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে তার বিএমডব্লি­উ। তুমি কেমন আছো শাদিব! সাদিয়া জানতে চায়।
যেমন ছিলাম: শাদিবের সহজ উত্তর।
সিক্সথ অ্যাভিনিউর ম্যারিয়ট হোটেল। শাদিব আগে থেকেই একটি স্যুইট বুক করে রেখেছিল। লবি থেকে সুই্যটের চাবি নিয়ে দুজন এলিভেটর দিয়ে পনেরো তলায় চলে যায়।
জানালা দিয়ে তাকালে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিঙের সুউচ্চ চূড়া চোখে পড়ে। সাদিয়া নীরবে তাকিয়ে থাকে।
শাদিব তার মোহভঙ্গের চেষ্টা করে। কি ভাবছো সাদিয়া?
না কিছু নয়। বলে সে পাশ কাটাতে চায়।
বলো না কি ভাবছো?
ভাবছি, সত্যি কি আমি তোমার পাশে বসে আছি! নাকি স্বপ্ন!
শাদিব, সাদিয়ার আরেকটু পাশ ঘেঁষে বসে।
তুমি কি আমাকে মনে রেখেছো? শাদিব জানতে চায়।
সাদিয়া চোখ তুলে তাকায়। দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে সাদিয়ার চোখ থেকে।
সাদিয়ার ডান হাত মুঠোয় নিয়ে শাদিব তার চিবুক স্পর্শ করে। সেই কিশোরী সাদিয়া: সেই ঘুঘু শিকারের দিনে প্রথম দেখা। চোখের গ্রহজালে নিবন্ধিত স্মৃতিকণা।
প্রয়াত পিতার মুখ মনে পড়ে যায় শাদিবের। পিতা তাদেরকে ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন পাঁচ বছর আগে। পিতার মতোই সৎ আর আয়েশী হয়ে উঠতে গভীর ইচ্ছাটি আবারো উঁকি দেয় তার মনে।
মানুষ তো স্মৃতি রেখেই চিরবিদায় নেয়। যেমন নিয়েছে মার্ক ও অ্যাশলি। জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে প্রেম, মিলন ও বিরহের পরিণত পরিণাম একই। বিবর্তনের নি:সঙ্গ বয়নে সবই একই সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে যায়। হেডলাইট বন্ধ করে শাদিব পাশের ডিমলাইটটি জ্বালিয়ে দেয়। আরেকটু গভীর করে সাদিয়াকে কাছে টানে।

তুমি আমাকে কোনো প্রশ্ন করো না। মাই হার্ট ইজ বিলংস টু ইউ শাদিব! আমি তোমার জন্যই এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। সাদিয়ার চোখে আনন্দ-অশ্রু। অর্ধ চাঁদ তখন নিউইয়র্কের আকাশ থেকে পর্দার ফাঁক দিয়ে দুজনকে স্বাগত জানাচ্ছে।
--------------------------------------------------------


মন্তব্য

শেখ জলিল এর ছবি

সত্যি না কল্পনার মিশেলে গল্প?
প্রথম ক্লোজআপওয়ানের টপ টেনের একজনই কী সাদিয়া?
....বর্ণনায় অনেকটা মিলে গেলো যে! যাক, গায়িকার নামটা বোধ হয় জানি।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

অতিথি লেখক এর ছবি

সত্যি , না কল্পনা - তা যে বলা যাবে না !
গল্প তো গল্পই । আপাতত সেটুকুই থাক !!!
ধন্যবাদ @ শেখ জলিল

সুমন সুপান্থ এর ছবি

ভালো লাগলো ইলিয়াস ভাই । ধন্যবাদ ।

---------------------------------------------------------
নীল সার্ট নেই বলে কেউ আমাকে নাবিক বলেনি !
অথচ সমুদ্রে-ই ছিলাম আমি

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

অতিথি লেখক এর ছবি

বিনীত ধন্যবাদ ,প্রিয় কবি সুমন সুপান্থ
---- ফকির ইলিয়াস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।