একটি খুনের স্বপ্ন : : অনেকদিন আগে পড়া একটি বই নিয়ে গল্প

ইমরুল কায়েস এর ছবি
লিখেছেন ইমরুল কায়েস (তারিখ: রবি, ২৫/০৫/২০০৮ - ১০:৩৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সেদিন একজনের সাথে কথা হল । তিনি আমাকে বললেন গল্প -উপন্যাসের প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই । সবই নাকি ফ্যান্টাসি লাগে । পড়তে ধরলেই নাকি মনে হয় এসবের কিছুই কখনো বাস্তবে হয় নি , বিশ্বাস করার কোন কারন নেই । গল্প নিছক গল্পই । আর আগ্রহ পান না পড়ার । এসব আর কি ?

পরে আমি ওনার কথাগুলো নিয়ে ভাবতে থাকি । আসলেই কি এগুলো ফ্যান্টাসি ? বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে কি অত্যধিক মাত্রায় অনুভূতিপ্রবণও নয় । এরকম ভাবতে পারলে হয়ত সামান্য কিছু লাভ হতে পারত , অন্তত আমার ক্ষেত্রে । কিছু কিছু বই পড়ে যন্ত্রনাও পেতে হয় । যন্ত্রনাটা প্রখর হয়ে ওঠে যখন সেটা সাময়িক মানে দু -এক ঘন্টা না স্থায়ী না হয়ে কয়েকদিনব্যাপি স্থায়ী হয় । আজকে আমি সেরকম একটা বই পড়া বিষয়ক যন্ত্রনার কথাই বলব ।

আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি । হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে চারিদিকে প্রচুর হইচই হচ্ছে । আমিও এই হইচইয়ে যোগ দেই । নীলক্ষেত থেকে আজাদের যত বই আছে একে একে কিনে পড়ে ফেলতে থাকি । ওনার কবিতাগুলো ভাল লাগতে থাকে , মুগ্ধ পাঠক হয়ে উঠতে থাকি ওনার কবিতার । কিন্তু উপন্যাস যে দু একটা পড়ি (শ্রাবনের বৃষ্টিতে রক্তজবা , ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ ) এগুলোকে একঘেয়ে মনে হয় । কেমন জানি উপমার বাহুল্যতা আর গায়ে পড়ে অশ্লীল কথাবার্তা শোনানোর মত মনে হয় উপন্যাসগুলো । কিছুতেই টানতে পারে না উপন্যাসগুলো ।

আজাদের উপন্যাস কিনবনা কিনবনা করেও একদিন আরেকটি কিনে ফেলি ," একটি খুনের স্বপ্ন" । একশো বিশ বাইশ পৃষ্ঠার ছোট একটি বই , ভালমত পড়তে তিন -চার ঘন্টার বেশী লাগার কথা না । উপন্যাসের ঘটনা তারচেয়েও সামান্য । সহজভাবে বলতে গেলে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের প্রেম কাহিনীর বর্ণনা । কিন্তু আজাদের হাতে এই সামান্য কাহিনীই অসামান্য হতে শুরু করে । প্রেমিকা সুফিয়ার জন্য নায়কের অনূভূতি , তাকে পাওয়ার আকুলতা সর্বোপরি নায়কের স্বাভাবিক জীবনযাপনে প্রেমিকার উপস্থিতি এবং তৎসংলগ্ন প্রভাবের বর্ণনা পড়ে আমি মুগ্ধ হতে থাকি । অনবরত বলতে থাকা উপমাগুলোকে আর অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না ।

বইয়ের অর্ধেক অংশজুড়ে এই রোমান্টিসিজমের পর ঘটনা একটু অন্যদিকে মোড় নেয়া শুরু করে । স্বাভাবিক পাঠকমাত্রই বুঝতে পারছেন বিচ্ছেদ হবে আরকি ? কিন্তু আজাদ এই বিচ্ছেদের বর্ণনাটা দেন একটু অন্যভাবে ।

তোফাজ্জল নামক এক কথিত ভাইয়ের সাথে নায়ক পরিচয় করিয়ে দেয় প্রেমিকার । ধীরে ধীরে তোফাজ্জল চর্তুপাশ ঘিরে উঠতে থাকে সুফিয়ার । নায়কের অজান্তে যায় সুফিয়ার বাসায় , নানান ধরনের উপহার দিতে থাকে সময়ে অসময়ে । তোফাজ্জল আর সুফিয়ার মধ্যে গড়ে উঠতে থাকে আরেকটি সম্পর্ক । নায়কের বুঝতে প্রথমে একটু অসুবিধা হলেও একদিন সে সরাসরি বুঝতে পারে । বুঝতে পারে একদিন সকালে তোফাজ্জলের বাসায় । আজাদের বর্ণনা অনুযায়ী

আমি নিঃশব্দে ভিতরে ঢুকে প্রথমে অন্ধ হয়ে যাই , তারপর আমার চোখে আলো জ্বলে ওঠে , অন্ধকার থেকেও যা উজ্জ্বল , মহাবিশ্ব ভেঙে পড়ার পর দেখা যাবে যে -আলো ,আমি তাদের কাছে এগিয়ে যাই ; বিকট সিল মাছের মত কালো নগ্ন তোফাজ্জল ভাইয়ের আবর্জনাস্তূপের মতো দেহের ওপর একটি পা রেখে নগ্ন সুফিয়া ঘুমিয়ে আছে , সিলটি পড়ে আছে লাশের মত সুফিয়ার মুখটি পূর্ণিমার চাঁদের মতো জ্বলছে , সরস্বতী ও অসুর জড়িয়ে আছে একে অন্যকে , দুজনেই গভীর ঘুমে নিমজ্জিত , হয়ত একাধিক সঙ্গমের তারা ক্লান্ত সুখনিদ্রায় লুপ্ত হয়ে আছে , জেগে উঠে আবার সঙ্গম করবে পশু ও সুন্দরী ।

এরপর নায়ক একটি খুনের স্বপ্ন দেখা শুরু করে , যা সে দেখতে পায় স্বপ্নে । প্রথমে সে বিব্রত বোধ করা শুরু করে ভয়ও পায় খানিকটা কিন্তু পরে সে এটাকে একটা অর্পিত দায়িত্ব ভাবা শুরু করে যেন অবশ্যই পালন করতে হবে । নায়কের মাথায় একটি স্বপ্ন জেগে থাকে - একটি খুনের স্বপ্ন ।

আমি উপন্যাসটি পড়া শেষ করি । আমার প্রচন্ড আক্রোশ তৈরী হতে শুরু করে তোফাজ্জলের উপর , সুফিয়ার উপর। কিছুই ভাল লাগে না । আমি বারবার নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করি আরে এটাতো সামান্য একটা উপন্যাসই , লেখকের মনে হয়েছে লেখক লিখেছে । কিন্তু সান্ত্বনায় কোন কাজ হয়না । আমি বারবার ভুলে যেতে থাকি এটা একটা উপন্যাস । আমার মনে হতে থাকে নায়কের চরিত্রে আমি দাড়িয়ে আছি । নগ্ন সুফিয়া সামগ্রিক ঐশ্বরিক সৌন্দর্য নিয়ে বাহুবন্ধনে পড়ে আছে তোফাজ্জলের । আমার রাগ বাড়তে থাকে । রাগ বাড়তে থাকে তোফাজ্জলের উপর , রাগ বাড়তে থাকে সুফিয়ার উপরও । আমি পলাশী বাজারে যাই , চা খাই । সেসময় সিগারেট খেতাম না কিন্তু সিগারেটও ধরাই একটা । একটা যন্ত্রনা আমার মাথার মধ্যে কাজ করে । আমি যন্ত্রনাটাকে সরাতে চেষ্টা করি কিন্তু এটা মাথার মধ্যে গেড়ে থাকে আরো দু তিনদিন । অজান্তে আমিও একটি স্বপ্ন দেখতে শুরু করি , নিতান্ত ছেলেমানুষি স্বপ্ন - একটি খুনের স্বপ্ন ।
(এটা লেখাটা নিতান্ত মাত্রাতিরিক্ত আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয় , পাঠকদের বলে নিলাম । বই পড়ার মধ্যে যে একটা যন্ত্রনা আছে সেটা সেই কয়েকদিন বুঝেছিলাম )
eru

-------------------------------------
pause 4 exam


মন্তব্য

স্বপ্নাহত এর ছবি

সব বই পড়েই ফ্যান্টাসি মনে হয় কথাটা মেনে নিতে পারলাম না লোকটার মত করে। কত বই পড়ে মন ভাল হয়ে গেছে আবার কত বই পড়ে সারাটা দিন মন খারাপ করে রেখেছি সে হিসাব করতে গেলেও কম সময় লাগবেনা কিন্তু।

---------------------------

থাকে শুধু অন্ধকার,মুখোমুখি বসিবার...

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

একটি সুন্দর প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন।

একেক পাঠকের ধারণক্ষমতা একেক রকমের। আপনার কথিত ভদ্রলোক হয়তো এমন কোনো গল্প-উপন্যাসের সাক্ষাৎ কখনো পাননি যার সঙ্গে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা-অনুভূতি রিলেট করতে পারেন। এই রিলেট করার ব্যাপারটাই মূখ্য বলে আমার ধারণা। যেমন সাই-ফাই ধরনের কাহিনীর সঙ্গে আমি নিজেকে কিছুতেই মেলাতে পারি না বলে ঐ ধরনের সাহিত্যের সঙ্গে আমার দূরত্ব কোনোকালে ঘুচলো না।

আপনার নিজের উদাহরণ থেকেই দেখা যাচ্ছে, হুমায়ূন আজাদের এই উপন্যাসটির সঙ্গে আপনি নিজেকে যতোটা একাত্ম বোধ করেছেন, অন্যগুলির সঙ্গে তা হয়ে ওঠেনি। সেগুলি আপনার কাছে 'একঘেয়ে' লেগেছে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অতিথি লেখক এর ছবি

হতে পারে । ভাল মতামত দিয়েছেন। ধন্যবাদ।
eru

-------------------------------------
pause 4 exam

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍হুমায়ূন আজাদের গদ্যের অসম্ভব ভক্ত আমি। তবে তাঁর গোটা দুয়েক উপন্যাস পড়ে আমি আশানুরূপ তৃপ্তি পাইনি। "একটি খুনের স্বপ্ন" অবশ্য পড়া হয়নি। তবে ইচ্ছে জাগলো আপনার লেখাটি পড়ে।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- ভালো বর্ণনার একটি গল্প, একটি কবিতা, একটি উপন্যাস অবশ্যই পাঠকের ভেতরে একটা আন্দোলন আনতে সক্ষম। ঠিক যেমনটা সক্ষম টিভির কোনো অনুষ্ঠান, নাটক, এমনকি কোনো কার্টুন ফিল্মও।
ন্যুনপক্ষে এর যেকোনো একটির দ্বারা আমরা প্রভাবিত হতে পারি, ক্রোধ, ভালোবাসা, হিংসার জন্ম নেয়া উপলব্ধি করতে পারি।

আবার

আমরা রোবটের মতোও আচরণ করতে পারি। দিনের পর দিন পেপারে খুন, ছিনতাই, রাহাজানীর কথা পড়ি-শুনি। পড়ি, আবার তার পরক্ষণেই ভুলে যাই, মনে থাকে না, রাখার দুঃসাহস করিনা। জহির রায়হানের মতোই বোধহয় অনুভূতিগুলি ভোঁতা হয়ে যায় একসময়। কে জানে, হয়তো এই অনুভূতিশূন্য মানুষের সংখ্যাই দিন দিন বেড়ে চলেছে!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

আপনার প্রতিক্রিয়াটাই তো অসাধারণ লাগল! বইটা পড়ার জন্য মন ছটফট করছে। আজাদের এই লেখাটার ধরনও তো অসাধারণ... নিজের নিষ্পাপ চেহারা প্রেমিকাকে কোনো কুৎসিত যুবকের আলিঙ্গনে আবিষ্কার করা তো বিশাল বেদনাদায়ক ঘটনা! এই ঘটনাকে "সরস্বতীর সঙ্গে অসুরের" মেলবন্ধন হিসেবে আবিষ্কারের এই চোখ একমাত্র আজাদেরই আছে।
ইরু, ধন্যবাদ আপনাকে। বই যাদের নাড়া দেয়, সেসব মানুষদের ভারী পছন্দ করি আমি।
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

স্নিগ্ধা এর ছবি

ইরু, আমি নিজেও অনেক সময়ই বই পড়ে অনেক রকম আবেগ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি কিন্তু আপনার মতো এত তীব্র প্রতিক্রিয়া কখনোই হয় নি! আপনার মতো সংবেদনশীল মানুষের খুব ভালো লিখিয়ে বা শিল্পী হওয়ার কথা কিন্তু হাসি

"ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ" আমার সবসময়কার পছন্দের উপন্যাসগুলোর একটা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।