অবশেষে

কৌস্তুভ এর ছবি
লিখেছেন কৌস্তুভ (তারিখ: শুক্র, ২৬/০২/২০১০ - ৩:৫৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সন্ধ্যার বাসে অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে বন্যা। অনেকটা দূরে অফিস তার, বাড়ি ফিরতে ঘন্টাখানেকের উপর লেগে যায়। তবু তাই নিয়ে অভিযোগ নেই তার। বছরখানেক আগে যখন চাকরিটা পেয়েছিল, হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল সে। অন্যান্য মেয়েদের মত ঘরকন্না শিখে শেষে বিয়ের আশায় হাপিত্যেশ করে বসে থাকা, এমন জীবন কখনোই সে চায় নি। মাইনে অল্প হলেও, অনেকটা দূরে রোজ একা যাতায়াত করতে হলেও, স্বাবলম্বী হয়ে বাঁচতে পারার আনন্দই আলাদা। তার বাবা এমনিতে রক্ষণশীল হলেও, আশ্চর্য, মেয়ের চাকরিতে বেশি আপত্তি করেন নি।

অফিস-ফেরতা বাসে রোজই ভিড় হয়, প্রায়ই বসার জায়গা পায় না বন্যা। আজও পায়নি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ যাত্রার বিরক্তি কাটাতে চারিদিকের মানুষদের দেখছিল সে। কিছুদূরে একটা ছেলে আর মেয়ে পাশাপাশি বসে। মনে হচ্ছে নতুন প্রেমিক-প্রেমিকা। মৃদু হাসিতে কানে কানে এ-ওকে কি সব বলছে। ছেলেটা একবার মেয়েটার কাঁধে একটা হাত রাখল, মেয়েটা লজ্জা পেয়ে সরিয়ে দিল। বোঝা যাচ্ছে, প্রকাশ্যে ঘনিষ্ঠতার উষ্ণতাটুকু পোয়াতে এখনো তাদের সঙ্কোচ। একটু পরে নেমে গেল মেয়েটা। ছেলেটা বসে রইল একা। বন্যা ভাবছিল, এরা হয়ত কলেজে পড়ে। অথবা চাকরি করে। তারই মত। হয়ত একসাথে। কিংবা তাও নয়, এই বাস যাত্রার সময়টুকুই দুজনে কাছাকাছি পায় দুজনকে। তার নিজের কথা মনে হচ্ছিল। চাকরি থেকে বেরিয়ে হয়ত আধ ঘন্টা কাছের পার্কে কি খাবারের দোকানে কাটাতে পারে অরূপের সাথে। তারপরেই বাড়ি ফিরতে হয়। বেশি দেরি হয়ে গেলে বাড়িতে ধরতে পেরে যাবে। চাকরিটুকু মেনে নিলেও, একটা ছেলের সঙ্গে মেয়ে সময় কাটাচ্ছে এটা মোটেই মেনে নেবেন না বাবা। চাকরিই ছাড়িয়ে দেবেন হয়ত, বাড়িতে বসিয়ে রাখবেন। আর চাকরিটা কিছুতেই ছাড়তে চায় না বন্যা, অন্তত আপাতত। যদি অরূপের সঙ্গে বিয়েটা হয় তার, তখন হয়ত ছেড়ে দেবে। পুরোদমে ঘরসংসার করবে। সুখী গৃহকোণের স্বপ্নটুকু সেও দেখে।

তারপর আরো তিনটে বছর কেটে গেছে। বন্যার সঙ্গে অরূপের বিয়েটা অবশেষে হয়েছিল, অনেক কষ্টে বাড়িতে রাজি করানো গিয়েছিল। বন্যা কিন্তু চাকরিটা ছাড়তে পারে নি। শোনা যায়, কেবলমাত্র মেয়েরও একটা সম্মানজনক চাকরি আছে শুনেই অরূপের মা কুঁচবরণ কন্যা আর মেঘবরণ চুলের শখ ছেড়ে শ্যামলা মেয়েতে মত দিয়েছিলেন। মাইনে বিশেষ বেশি না হলেও, একটা স্থায়ী সংস্থান তো। বরং এই ক’বছরে কাজে দায়িত্ব আরো বেড়েছে। সংসারের সব দায়িত্বও এসেছে বন্যার উপর। কিছুদিন আগে একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে তার। মাস ছয়েক বয়েস, ছোট বাড়িটা মাতিয়ে রাখে সে-ই। তাকে ফেলে অফিসে যেতে বড় কষ্ট লাগে বন্যার। সকালে যখন বেরোতে হয়, মেয়ে হয়ত ঘুম থেকেই ওঠে নি, শ্বাশুড়ির কাছে রেখে যেতে হয়। সারাদিন তাকে ফেলে যদিও বা থাকা যায়, ফেরার সময়টুকু যেন বড়ই দীর্ঘ মনে হয়।

আজকে আবার বাসে দাঁড়িয়ে ফিরছিল বন্যা। সামনের সিটে এক স্বামী-স্ত্রী বসে, ছেলেটার কোলে একটা বাচ্চা। কয়েক মাসই বয়স হবে। হঠাৎ কান্না শুরু করে দিল বাচ্চাটা, বিব্রত হয়ে তার বাবা দিয়ে দিল মায়ের কোলে। একটা চাদরের আড়াল দিয়ে মা দুধ খাওয়াতে লাগল তাকে, বাচ্চাটা পরম প্রশান্তিতে আঁকড়ে ধরল তার মাকে। একবার মেয়েটা সামনের দিকে তাকাল, চোখাচোখি হয়ে গেল বন্যার সঙ্গে, অল্প হাসল মেয়েটা। হাসতে গিয়েও কেমন যেন কষ্ট হল বন্যার। তার মেয়েটাও তো সারাদিন এতটুকু পায়নি মায়ের স্নেহরস। বাড়িতে ফিরেই রোজ রাণু বলে একটা ডাক দেয় বন্যা, মেয়েটা ছটফটিয়ে ওঠে, আর ঠাম্মা কি দাদুর কাছে থাকতেই চায় না। তাকে একটুকু ছুঁয়েই বাথরুমে ছুটতে হয় বন্যাকে, সারাদিনের ধুলোকাদা থেকে মুক্ত হতে। এই সময়টাই সবচেয়ে কষ্টের, এক ঝলক মাকে দেখলেও তাকে কাছে পেতে পারে না মেয়েটা, অনবরত কেঁদে চলে। বেরিয়ে মেয়েকে একটু কোলে নিতে না নিতেই তাকে আবার ছুটতে হয় সংসারের হাঁড়ি ঠেলতে। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি-স্বামী-দেওর আর নিজের খাবার রান্না করে বেড়ে খাইয়ে নিজে খেয়ে হাঁড়িপাতিল সাফ করে যখন ঘরে আসে ততক্ষণে হয়ত মেয়ে বাবার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। রোজকার এই ঘটনা মনে পড়ে যায় বন্যার, নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগে তার। এরকম আর কতদিন? সংসারের পেছনে খাটতে আপত্তি নেই তার, তার মা-ঠাকুমাদের চিরকাল তাইই করে আসতে দেখেছে সে। কিন্তু সারাদিনই একমাত্র সন্তানকে ছেড়ে থাকার কষ্ট আর সহ্য হয় না তার। মা হিসাবেও তো তার একটা দায় আছে। ভাবে, এবার তাকে চাকরিটা ছাড়তেই হবে...

-----------
কৌস্তুভ


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

শেষ হইয়াও হইলনা শেষ

ঘুম পরী

নাশতারান এর ছবি

যে চাকরি ছিল বন্যার ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতীক, সেটি ছাড়ার স্বাধীনতাও নেই তার। দুঃখজনক।
আপনার লেখা ভালো লাগছে। নিয়মিত লিখুন।

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

অতিথি লেখক এর ছবি

ঘুম পরী আর বুনোহাঁস, মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

ঘুম পরী, ঠিকই বলেছেন। এটা আসলে দু-টুকরো বাস্তব জুড়ে লেখা। আর বাস্তব কোথায় আর সবসময় গল্পের মত একটা সুন্দর ক্লাইম্যাক্স দিয়ে শেষ হয়।

বুনোহাঁস, আসলে বন্যা কিন্তু কোনদিনই চাকরিটা ছাড়তে পারে নি...

কৌস্তুভ

মাহবুব লীলেন এর ছবি

মা হিসাবেও তো তার একটা দায় আছে। ভাবে, এবার তাকে চাকরিটা ছাড়তেই হবে...

এই চিন্তাটা সমর্থন করতে পারলাম না
মেয়েদের আগাগোড়া বাচ্চাপালক আর গৃহিণী হবার চিন্তা কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব সত্যি। এইটাই বন্যাও শুরু থেকে ভেবে এসেছিল, এখন অবস্থার চাপে সে অন্যরকম ভাবতে বাধ্য হচ্ছে।
তবে যে লিখলাম, বাস্তবের বন্যা কিন্তু কোনদিনই চাকরিটা ছাড়তে পারে নি...
ধন্যবাদ লীলেনদা আপনার মন্তব্যের জন্য।

কৌস্তুভ

তিথীডোর এর ছবি

আরে, কৌদা যে গল্পও লিখেছেন তাতো জানতাম না। চোখ টিপি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।