মধ্যমের কষ্ট

দীপ্ত এর ছবি
লিখেছেন দীপ্ত [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ০১/১২/২০১১ - ১২:৩৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজ এক নিতান্তই ব্যর্থ মানুষের গল্প বলব। না ভুল বললাম, ব্যর্থতা তো আমাদের সবারই আছে, এ বরং এমন একজনের কথা, যে আমাদের চারপাশের সবজন থেকে কিছুটা আলাদা। এই একজন রহিম-করিম-আব্দুল-জব্বার-রাম-শ্যাম-যদু-মধু যে কেউ হতে পারে। হতে পারে আজকে সিএনজি পাওয়ার সময় যে লোকটাকে দৌড়ে পিছে ফেলে আপনি প্রথম হয়েছেন সেই লোক, বা সেই লোক যে কিনা আজকে আপনার চোখের সামনে বাসে খকখক করে কাশছিল অথবা সেই লোক যে কিনা বাস ভাড়া দেয়ার সময় ২টাকার জন্যে হেল্পারের চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে এক পর্যায়ে কলার চেপে ধরে সহযাত্রীদের বাহবা কুড়িয়েছিল। অথবা ফার্মগেটে থেকে অফিসফেরত যেসব লোকেরা ঘামে ভেজা চপচপে শার্ট, বিরক্তির বলিরেখা ভরা মুখ নিয়ে প্যান্টের পকেটে একটু পরপর হাত ঢুকিয়ে মানিব্যাগের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হচ্ছে, হয়তো সে তাদেরই একজন। নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন এই সে হলাম আমি, আমারই গল্প এটা।

আমাকে আপনি প্রতিদিনই দেখেন, কিন্তু মনে রাখেন না, কারণ মনে রাখার দরকারই হয় নি কখনো। আমি রাস্তার ওই ভিখারিটা না যার বিকলঙ্গতা এই ইটকাঠের শহরেও ক্ষণিকের জন্যে আপনার মনে সহানুভূতি জাগিয়ে তোলে আবার আমি উঁচুতলার কেউ না, যে কিনা আপনাকে ঘন্টাব্যাপি যানজটে আটকে রেখে বিশাল গাড়িবহর নিয়ে সাইসাই করে চলে যায় আপনার সামনে দিয়ে আর আপনার মুখ থেকে আপনাআপনিই কোন কটুবাক্য বেরিয়ে আসে। আমি হলাম সে-ই জন যে কিনা আপনার পাশেই বসেছি হয়তো বা দাঁড়িয়ে আছি, ঘামছি, এবং মাঝে মাঝে কটুবাক্যও উচ্চারণ করছি। এইতো ধরে ফেলেছেন, আমি মধ্যম, আমিই বেশির ভাগ।

মধ্যমের আবার কি কাহিনী? মধ্যম তো জন্মাবে, খাবেদাবে, কাজ করবে, পরের প্রজন্ম গড়ে তুলবে, ব্যস তারপর বিদায়। Au revoir । আমার এই কেচ্ছা কাহিনীর তাহলে দরকার কি পড়ল? আছে, আছে দরকার আছে। অন্যের কাছে নেই, আমার নিজের কাছে আছে। হয়ত পিছে ফিরে নিজের খুব সাধারণ জীবনটাকে দেখার চেষ্টা আছে এর মধ্যে , হয়তো কিছুটা স্বীকারোক্তিও আছে যাতে আমি হালকা হতে পারি, আর নিজের যে অংশটা ততটা গর্ব করার মত নয়, যেটুকু অন্যের কাছ থেকে বহুকাল লুকিয়ে রাখতে গিয়ে নিজের কাছেই অচেনা হয়ে গেছে তা মনে করতে পারি। স্মৃতিচারণ কখনও একঘেয়ে হয়, বিশেষত আমার মত এক সরলরেখায় চলা মানুষের জীবন স্মৃতিচারণ তো বটেই, একই কাজ, একই ঘটনা, একই কথোপকথনের পুনরাবৃত্তি মাত্র। বলে রাখলাম সে কথা, পড়া আপনার দায়িত্ব। এবার শুরু করি।

ছোটবেলা থেকেই সবকিছুতেই মাঝারি ছিলাম আমি। পড়াশোনায় এত ভালো ছিলাম না, যে রেজাল্ট দেয়ার সময় আমাকে মাথায় নিয়ে নাচানাচি হবে, আবার এত খারাপও ছিলাম না যে আমার প্রতিবার রিপোর্ট কার্ড নেয়ার সময় আব্বা আম্মার ডাক পড়বে। আমি ছিলাম পুরোপুরি সেই দলের একজন, যারা ক্লাসে সংখ্যাগরিষ্ঠ, শুধু ক্লাসে কেন জীবনের সবখানেই এরাই কি সংখ্যাগরিষ্ঠ না? কিন্তু এই মেজরিটির মধ্যে থাকতে আমার ভালো লাগত না। কেন জানি না ওই শৈশবেই যাদের নিয়ে সারাক্ষণ সবাই কথা বলে, যারা খ্যাতিমান, যারা বিশেষ, দশজনের একজন না তাদের একজন হওয়ার বাসনা ছিল আমার। তারই ফলশ্রুতিতে স্কুল স্পোর্টস, ড্রয়িং, নাচ, জ্ঞান, আবৃত্তি, বিতর্ক, যেমন খুশি তেমন সাজো এরকম সবকিছুতেই নাম দিলাম আর টের পেলাম কোন কিছুতেই আমার কোন সম্ভবনা নাই। না, একবার দুবার দিয়ে দমে গেছি তা না। খ্যাতি পাবার গোপন মোহ, মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার জন্য অল্পবয়স থেকেই কোন না কোনভাবে গেঁড়ে বসা আকাঙ্খা আমাকে এসব প্রতিযোগিতায় বারবার নাম দিতে টেনে এনেছে। কিন্তু বিধিবাম, কোনবারই ভাগ্যের শিকে ছেঁড়েনি। একটু বড় হলেই আমার কাছে স্পষ্ট হল যে আমি আসলে আমড়া কাঠের ঢেঁকি, এগুলোর কোনটাতে আমার কোন প্রতিভা তো নেইই, চেষ্টা চালিয়ে গেলেও কিছু হওয়ার সম্ভবনা খুব কম। ততদিনে সবকিছুতে মাঝামাঝি থাকতে থাকতে আমি মোটামুটি বিরক্ত হয়ে গেছি। স্রষ্টাকে বললাম সবকিছুতে অর্ধেক অর্ধেক না দিয়ে কিছু একটা গুণ পুরো দিলেও তো হয়, নাকি? সেই প্রার্থনা বোধহয় আকাশের মাঝপথে গিয়ে থেমে রইল, আমার আর কোন কিছুতেই অসাধারণ হয়ে ওঠা হল না।

বড় হওয়ার সাথে সাথে হিংসা-ঈর্ষা-পরশ্রীকাতরতা এই এগুলো ঠাঁই করে নিচ্ছিল আমার মধ্যে। সহ্য হত না কারো ভালো। তা সহ্য হবে কি করে, নিজে যে আমি নেহাত সাধারণ, গোবেচারা, মধ্যম শ্রেণীর একজন। কেউ পরীক্ষায় ভালো করল, নাচ-গান-সংস্কৃতি-বিতর্ক-আবৃত্তি কোন একটাতে পুরস্কার পেল আর ওমনি আমার মন খারাপ হয় গেলো।

মধ্যমের কষ্টের কি শেষ আছে। রবিঠাকুর কবিতার ছন্দে কি সহজেই না বলে গেছেন, উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে, তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে। উঁচুতে উঠতে না পারার কষ্টে ভুগি সারাক্ষণ আবার নিচুতে নেমে যাবার ভয়ে কত কি যে এড়িয়ে চলি। তাইতো জীবন হয়ে ওঠে সংকীর্ণ, দৃষ্টিভঙ্গি ছোটো হয়ে আসে, বাঁধাধরা গণ্ডির বাইরে যেতে পারি না, ঝুঁকি নিতে গেলে ব্যর্থতার আশঙ্কায় বুক কাঁপে।

পিছনে ফিরে যখন তাকাই, খ্যাতির আশায় কি-ই না করেছি ভেবে হাসি পায়। মাঝে একবার কোন এক বাসায় গানের কলি খেলতে গিয়ে দেখলাম গান জানলে বেশ কদর পাওয়া যায়,শুরু হল গান মুখস্থ করা, পরের বার গানের কলি খেলতে গিয়ে দেখলাম মুখস্থ করা গান বড় একটা কাজে আসে না। সাহস কখনই খুব একটা ছিল না আমার, তবু পাছে ভীরু বলে পরিচিতি পাই সেই ভয়ে দেয়াল টপকাতে গেলাম একদিন, না টপকে উপায়ও ছিলো না অবশ্য, ক্রিকেট বল উড়ে গিয়ে লেগেছিল এলাকার জাঁদরেল নিজাম উকিলের বাসায়, সবাই টপকাচ্ছে তাই নিশ্চয়ই পারব ভেবে দুরুদুরু বুকে দিলাম এক লাফ, আর কারো যা হয়নি আমার সেটাই হল, পা বেকায়দা মচকে গেলো আর দুসপ্তাহ খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলা এরপর।

আর এক বিচিত্র অভ্যাস ছিল আমার। যে যেকোনো কিছুতেই ভালো করত না কেন, সেটাতে তাকে টপকানোর জন্যে অস্থির হয়ে উঠতাম। এই ধরুন, বিতর্কে সেরার পুরস্কার পেল আমাদের ক্লাসের শাহরিয়ার, আর যায় কই, বিতর্কে ভালো করার জন্যে উঠে পড়ে লাগলাম আমি, অথচ বিতর্কে ভালো করার জন্য প্রতিভা তো দূরে থাক, বিতর্কের প্রতি এর আগে কোন ভাললাগাও ছিল না আমার। ছোটবেলায় আমার পছন্দের খেলা ছিল ব্যাডমিন্টন। একবার এক ছেলে আমাকে বলল ব্যাডমিন্টন কি খেলিস রে তুই? ওসব তো মেয়েদের খেলা। কথাটা আমার মনে ধরল, আসলেই তো যে খেলায় পৌরুষ নাই তা আবার কিসের খেলা? আমার স্মার্টনেস জেগে উঠল, তাই ব্যাডমিন্টন বাদ, দুদিন ওর সাথে গেলাম ফুটবল খেলতে, তৃতীয় দিন পা ভেঙে পরে রইলাম বাড়ি।

এই করে করে বন্ধুদের হিংসা করতে থাকলাম আর নিজের অজান্তেই একটা শখহীন, গুণহীন, অনুকরণপ্রিয় মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে থাকলাম। এখন যখন পিছনে ফিরে তাকাই, এমন একটা জিনিসও খুঁজে পাওয়া কঠিন হয় যা কিনা আসলেই মনপ্রাণ দিয়ে করতে চেয়েছি আমি। সবই শুধু বৃথা প্রশংসার পিছনে অযথা সময় ক্ষয়।

শখের মধ্যে আমার ছিল গল্পের বই পড়া আর গান শোনা। বোদ্ধা পাঠক বা বোদ্ধা শ্রোতাদের দলে আমাকে কখনই ফেলা যাবে না। সাহিত্যের বড় আসরে পা রাখা হয় নি কখনও। তিন গোয়েন্দা আর মাসুদ রানা পড়তাম আমি, কিশোর, রবিন, মুসার সাথে আমার ছিল দারুণ ঘনিষ্ঠতা। একবার এক আত্মীয় বাড়ি গেছি দাওয়াতে, সাহিত্যে নিয়ে আলোচনা উঠল,দেখি সেখানে তিন গোয়েন্দার কোন স্থান নেই, মাসুদ রানার কথা তোলাও বিব্রতকর। আমার মনে হোল আসলেই তো কি সব বই পড়ি আমি, বড়মাপের কিছু হতে চাইলে তো আগে বড়মাপের বই পড়তে হবে। বাসায় ফিরেই পাশের লাইব্রেরি থেকে ৩টা ভারী ভারী সাহিত্যের বই কিনে আনলাম, ওরকমই রয়ে গেছে ওগুলো, পড়া হয়নি। আর লাভের মধ্যে বই পড়ার যে অভ্যাসটুকু ছিল তাও আস্তে আস্তে ফিকে হতে লাগলো। এখন এই বয়সে মাসুদ রানাকে তো অবাস্তব লাগেই, ভারী বইগুলো আগের মত জগদ্দল পাথর মনে হয়।

গান নিয়েও কি বিপদেই না পড়েছি সব জায়গায়। শুনতে ভালো লাগত অল্প কিছু গান আমার, আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ডের সাথে পরিচয় হয়নি তখনো, জ্যাজ, পপ আর রক-এন-রোল এর পার্থক্য বুঝতাম না। নতুন কোথায় কি অ্যালবাম বেরুচ্ছে তারও খবর রাখতাম না। বন্ধুরা যখন নতুন গানের কথা তুলত, আমি অপেক্ষা করতাম কখন ওই প্রসঙ্গ শেষ হবে আর আমিও কথা বলার মত কিছু পাবো। ভীষণ হীন মনে হত নিজেকে সময়ের সাথে তাল মিলাতে না পারার জন্য। এরপর প্রয়োজনের তাগিদে বলি আর নিজেকে স্মার্ট করে তোলার লক্ষ্যে বলি, যুগের সাথে চলা শুরু করলাম। যে গান আমার ভালো লাগে সে গান না, বরং যে গান শোনা ট্রেন্ড তাই শোনা শুরু করলাম ধীরে ধীরে। কতটা ভালো লাগা থেকে আর কতটা নিজেকে চলনসই করতে তা বলা কঠিন।

এককালে লেখক হওয়ার ভুত চেপেছিল মাথায়। কলেজে তখন ম্যাগাজিন ছাপা হত একটা। তাতে একটা লেখা ছাপা হলে কি সাড়াটাই না পড়ে যাবে এই ভেবে ঘুম হচ্ছিল না আমার। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ কি লিখব তা ঠিক করতে না করতেই সময় ঘনিয়ে আসলো। অথচ কিছু একটা লিখতেই হবে, নাহলে সারা দুনিয়াকে জানাই কি করে যে আমি স্পেশাল, আমার মধ্যে ঘুমন্ত বারুদ লুকায়িত আছে, আমাকে নাও, মাথায় তুলে রাখ, আমাকে বেশি বেশি কদর কর। এই চিৎকারটা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যেই তো এত আয়োজন, না? তাই ততদিন পর্যন্ত যত মাসুদ রানা, তিন গোয়েন্দা, আর অ্যাডভেঞ্চার গল্পের অনুবাদ পড়েছি সব অভিজ্ঞতা এক করে, আর অল্প-বিস্তর এখান সেখান থেকে টুকলিফাই করে লিখে ফেললাম এক গোয়েন্দা গল্প, কিন্তু গল্প পড়ে আমার নিজেরই কেমন যেন মনে হতে থাকল, এই গল্প কোথাও আগে পড়েছি।

সেই গল্প দিলাম তো ছাপাতে ম্যাগাজিনে আর লেখা নির্বাচন কমিটি অত সাতপাঁচ না ভেবেই দিলো ছাপিয়ে। ছাপানোর পর আমার অহঙ্কার দেখে কে, আমার লেখা ছাপার অক্ষরে ছাপা হয়েছে একি চাট্টিখানি কথা। ক্লাসে কান খাড়া করে বসে থাকলাম যদি কেউ আমার লেখা নিয়ে আলোচনা করে। নিশ্চয়ই এতক্ষণে সবাই বলাবলি করছে যে এত শিহরণে ভরা অ্যাডভেঞ্চার গল্প কে লিখতে পারে। নিশ্চয়ই সবাই আমার হঠাৎ আবিষ্কৃত লেখক প্রতিভায় রীতিমত পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে, ভাবছে কি এক অসাধারণ লেখকজন্মই না হল আজ- এই ভেবে সারাটা দিন আমি ঘামতে থাকলাম। কিন্তু কই কেউই তো একবার এসে বললও না। অথচ আমি যে কালে বিখ্যাত হব তা কে না জানে, অন্তত এতক্ষণে তো সবার বুঝতে পারার কথা। নিশ্চয়ই আমার সাথে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেই আমি। তা পাবে না কেন বড় লেখকদের যে ভীষণ দেমাক হয়। আমি যখন খ্যাতিমান হব তখন কিন্তু এত দেমাক দেখাব না- ভেবে ঠিক করে রাখি।

টিফিন পিরিয়ড চলে আসে, নাহ আর বসে থাকা যায় না। গিয়ে এক বন্ধুকে গুঁতা দিই, এইবারের স্কুল
ম্যাগাজিনটা দেখেছিস? হালকা চালে জিজ্ঞাসা করি আমি। হ্যাঁ, তুই রফিকের কবিতাটা পড়েছিস? কোন রফিক, আমাদের রফিক? আমি জিজ্ঞাসা করি। ও বলে, তা আর বলতে। কি যে ভাষা, শুনলাম স্যারেরা নাকি বলাবলি করছে যে ও কবি হবে বড় হলে। ওও, আমি একটু দমে যাই। যাওয়ার জন্যে পিছনে ঘুরতেই ও বলে, স্যারেরা বলছিল তোর লেখাটা, এটুকু শুনে মনে আশার আলো জেগে ওঠে আমার। ও ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে বলে, বলছিল যে বড় ক্লাসের ছেলেরা নাকি স্যারের কাছে বলেছে যে তুই গল্প মেরেছিস।

ঠাণ্ডা একটা শীতল শিহরণ বোধ করি আমি, তৎক্ষণাৎ সামলে নিয়ে বলি, মানে? মানে স্যার নাকি ক্লাসে ম্যাগাজিন নিয়ে গল্প করছিল, ওরা নাকি বলেছে তোরটা পুরা কপি পেস্ট। মাসুদ রানা থেকে। আমার শুন্য লাগে মাথায়, শুকনো গলায় বলি, কি বলিস? এটা আবার কি করে হয়? আমি তো মাসুদ রানা পড়িইনা। ও তাই? তাহলে মনে হয়, অন্য কারও লেখা নিয়ে হবে কথাটা- বলে মাথা ঘুরিয়ে পড়ায় মনোযোগ দেয় ও। আমার পেটে খালি খালি লাগতে থাকে, পরীক্ষার আগে আমার প্রায়ই হয় এটা, একবার মনে হয় যদি স্যার ডেকে জিজ্ঞাসা করেন তাহলে সোজা অস্বীকার করাই ভালো, আরেকবার মনে হয় নিশ্চয়ই আমাদের ক্লাসের সবাই জানে না, তাহলে এত দুশ্চিন্তার কি আছে। কিন্তু একটা অস্বস্তির কাঁটা বিঁধে থাকে, টিফিন খেতে পারি না।

টিফিনের পরেই বাংলা পিরিয়ড, আর এই স্যারই আমাদের ম্যাগাজিনের লেখা বাছাই করেছেন, আমি ভয়ে সেঁধিয়ে আসি, একদম পিছনের দিকে এককোণায় চুপ করে বসে থাকি, আর নিজেকে সান্ত্বনা দেই কিছুই হবে না ভেবে। স্যার ক্লাসে এসে পড়াতে থাকেন, ৪০ মিনিট পার হয়, আমি আস্তে আস্তে ভাবছি এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। ক্লাস শেষের ১০মিনিট আগে স্যার হঠাৎ ম্যাগাজিনের প্রসঙ্গ তুললেন, আমার মনে হয় আমার কান থেকে ধোঁয়া বের হতে শুরু করেছে, আমি প্রবল বেগে জানা অজানা সব দোয়াদরুদ এক করে পড়তে শুরু করেছি, আর মনে মনে বলছি যে এই যাত্রা যদি মানইজ্জতসহ বাঁচতে পারি, তাহলে আর কক্ষনোই লেখা চুরির ধারপাশে যাবো না। ওই অসহনীয় মুহূর্তটা কি করে জানি পার হল, স্যার কিন্তু লেখা চুরি নিয়ে একটা কথাও বললেন না। ওই আমার প্রথম লেখা আর শেষ লেখা, পরে অনেক চেষ্টা করেছি নিজে কোনকিছু বানিয়েবুনিয়ে লিখতে। এককালে সাইন্স ফিকশনের লেখক হব বলে ঠিক করেছিলাম, কিন্তু কেন জানি না, আমার সব কাহিনীই আগের পড়া কাহিনীগুলোর বাইরে যেতে পারে না।

যখন ভার্সিটি উঠলাম তখন দেখলাম কবি কবি হওয়াটাই ফ্যাশন। এমন ভাব নিতে হবে যাতে প্রকাশ পায় জীবনের প্রতি আমার কোন মহব্বতই নাই, কি আছে দুনিয়ায়। খেয়াল করে দেখলাম, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি রেখে, একটা ছেঁড়া জিন্স পড়ে, সিগারেট টেনে টেনে ঠোঁটটা একটু কালো বানিয়ে ফেলে, বন্ধুদের সাথে কথা বলার সময় যদি বেশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জীবন-কালের সংক্ষিপ্ততা নিয়ে একটা ডায়ালগ ঝেড়ে দেয়া যায় তাহলে সবাই বেশ সমীহের চোখে দেখে। অভিনয় নিয়ে তো আমার কোন সমস্যাই নেই, সারা জীবন অন্যের কাজ নকল করে এসেছি আর এখন একটা বাউল বাউল সংসারছাড়া ত্যাগী সন্ন্যাসী ভেক ধরতে পারব না তা হয় কেমন করে? তা ওই বেশ নিতে না নিতেই আরেক সন্ন্যাসী এসে এক আস্তানায় দাওয়াত দিলো, আমি তো বেশ খুশি। আমার মত বাউল দুচারটা থাকলেও এই লাইনে বড় কিছু হতে তেমন খাটাখাটনি বোধ হয় নেই, ওদের চেয়ে একটু বড় সাইজের দীর্ঘশ্বাস ফেললেই চলবে। আস্তানাতে গিয়ে দেখি, সব লাল টকটকে চোখের সিনিয়র ভাই, সহপাঠীরা বসে, যেতেই একটা বোতল বাড়িয়ে দিলো। খ্যাতি পাওয়ার জন্যে আরও অনেক কিছুই করতে পারতাম, ছিচকে লেখা চুরি থেকে অন্যের শিল্পকর্ম নিজের বলে চালিয়ে দেয়া পর্যন্ত, কিন্তু নেশায় জড়ানোর মত সাহস ছিল না। তাই ওই লাইনও ছেড়ে পালানো ছাড়া উপায় রইল না।

তারপর তো এল ফেসবুক যুগ। তখন আমি যৌবনের চূড়ায়, দুনিয়ার সবকিছু জয় করে ফেলব ভাব। তখনই মঞ্চে জুকারবার্গের আগমন ঘটল। আর আমার সামনে যেন স্বর্ণদ্বার খুলে গেলো। দেখলাম আমি যেনসেন মানুষ হতে পারি, কিন্তু আমারও একটা স্ট্যাটাস আছে। আর যখন তখন পোস্ট করে কিছু ‘লাইক’ও পাওয়া যায়। তাই দিনরাত ফেসবুকে বসে গবেষণা করতে থাকলাম আর স্ট্যাটাসও দিতে লাগলাম অবিরাম। দিন কয়েক পরে দেখি আমার বন্ধুমহলের সবাই একইরকম ‘লাইক’ পাচ্ছে। সবাই যদি ‘লাইক’ পায় তাহলে আর হল কি? তাই অন্যদিকে ঝুঁকলাম। ভাবলাম অ্যালবামগুলোতে যখন এত লাইক পড়ে, তা ওরকম দুএকটা ছবি তুলে ছাপানো কি আর এমন কঠিন হবে। বাসা থেকে কায়দা করে টাকাটা নিয়ে একটা দামি ক্যামেরা কিনেই ফেললাম। আর শুরু করলাম শাটার চাপার মহড়া। যা দেখি তাই শাটার চাপি, তাই আপলোড দিই, দুইদশটা লাইক পাই, খুশি মনে শিস বাজাই। মনে হোল এবার বুঝি আমার খ্যাতিটা স্থায়ী হয়, মধ্যমের স্তর থেকে এতদিনে বুঝি আমার উত্তরণ ঘটল, কিন্তু কদিনের মধ্যেই দেখলাম যে-ই, সে-ই। দেখলাম বাস্তব জগত থেকে ভার্চুয়াল জগতে খ্যাতি পাওয়া ঢেড় কঠিন । তাই সে যাত্রায়ও রণেভঙ্গ।

কাহিনীর কি আর কমতি আছে। আগেই বলেছি, সব এক দফায় বলতে গেলে পাঠকের বিরক্তিই শুধু কুড়োব। তাই এককথায় বলি, এই করে করে মধ্যমের আবর্তেই ঘুরপাক খেয়েই কাটছে জীবন এখনও পর্যন্ত। এখন এক নিপাট ভদ্রলোকের মত জীবন পার করছি। ঘর আছে, ঘরণী আছে, ঘর আলো করা শিশুও আছে। সকালসন্ধ্যা কাজ করি, রাতে ঘুমাই, বা ঘুমানোর ভান করি। কারণ ঘুমের সময়ই কেন জানি না সব কষ্টগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, এই মাঝামাঝি জীবন, এই সুখের অভিনয়, সবার অজান্তে পৃথিবীতে এসে চুপিসারে জীবন শেষ করে টুপ করে ঝড়ে পড়া, এ বড়ো কষ্টের। তাই ভাবি, দিই একটা লাফ দিয়ে ছাদ থেকে, সারা দেশে না হোক, অন্তত সারা পাড়ায় তো একদিনের জন্যে বিখ্যাত হয়ে উঠতে পারব, চায়ের টেবিলগুলা আমাকে নিয়ে আলোচনায় মুখরিত থাকবে। কত কথাই না রটবে আমাকে নিয়ে, তা রটুক না কিছু খারাপ কথা, হয়তোবা খারাপ কোন কুৎসা পারিবারিক জীবন নিয়ে। একজনও কি নেই যে আমার কবিমন থেকে উদ্ভূত নিঃসঙ্গতাকে আমার আত্মহননের কারণ হিসেবে ভেবে নেবে, ভাববে খুব গোপন কোন কবিসত্তা হয়তো ছিল আমার মাঝে। এপারটা মধ্যম হয়ে কেটেছে, ওপারের শুরুটা অন্তত একটু ব্যতিক্রমী হোক, অনেকের চেয়ে আলাদা। ভাবতে ভাবতে বুঝি আমার স্নায়ুগুলো সজাগ হয়ে আসছে, বুঝতে পারি আমার ভীরু, দুর্বল, কাপুরুষ, অক্ষম মনেও কেমন ঝিমঝিম করছে, নিজেকে বিলীন করে দেয়ার পুরো চিন্তাটা আমার মাথার মধ্যে জাঁকিয়ে বসছে, পায়ের তালু থেকে ঠাণ্ডা এক শীতল শিহরণকে মেরুদণ্ড বেয়ে উপরে উঠতে অনুভব করি আমি। এক অচেনা অনুভূতি হয়, জ্যোৎস্না রাতে ভীষণ অপার্থিব আলোয় চারদিক ভেসে যেতে থাকে যখন, তখন হঠাৎ নাম না জানা অদ্ভুত স্বরের এক পাখির ডাক শুনে যেমন ঘোরগ্রস্তের মত লাগতে থাকে, সেই অনুভূতি।

কিন্তু সে কেবলই ক্ষণিকের জন্যে, বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আমাকে এক টানে বাস্তবে নিয়ে আসে। আজ রাতে বাচ্চার কাঁথা পালটানোর কথা না আমার? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে ঢুকে যাই। ভাবি কখনই বোধহয় আর মধ্যমের বেড়ি টপকাতে পারলাম না।

-দীপ্ত


মন্তব্য

গাড়ি এর ছবি

অসম্ভব ভাল লেগেছে দীপ্ত ভাই। লেখা লিখির লাইনেই থাকুন না কেন ?!
আস্তে আস্তে হয়ে যাবে দেখবেন।
আপনার লেখা তো প্রকাশিত হল। আমার একটাও হয় নাই এখনও।
শুভকামনা রইল।

দীপ্ত এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।
লেখালিখি তো আনন্দ লাগে তাই করি। লেখা ছাপা হলে কার না ভালো লাগে বলুন, কিন্তু ছাপা না হলেই বা কি? নিজে লিখে আনন্দ পেলে সেটা কি কম?

রাসেল এর ছবি

লেখালেখিতে ভাই আপনি বেশ উত্তম।

দীপ্ত এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।

হাসান এর ছবি

দারুন হয়েছে লেখাটা। আপনার সমস্যায় আমিও ভুগেছি প্রচুর। এই যে আপনি "অন্যে ছোট মনে করবে" ভেবে অকপট সত্য কথা লেখা থেকে পিছিয়ে আসেন নি, এই সাহস টাই আপনার লেখাটাকে চমৎকার করে তুলেছে। একবার এর স্বাদ কেউ পেয়ে গেলে সে আর হোঁচট খায় না। আপনার নিজের যা করতে ভালো লাগে, করে যান; দেখবেন আস্তে আস্তে অনেক ক্ষেত্রে আপনার স্বকীয়তা তৈরী হবে। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। বিফলে মুল্য ফেরত।

দীপ্ত এর ছবি

মন্তব্যে ধন্যবাদ।
এটা কিন্তু নেহাতই গল্প ছিল, নিজে এরকম হলে অতটা অকপট হতে পারতাম কিনা সন্দেহ। তবে সময়ে সময়ে নিজেকে মধ্যম আমরা কেই না ভাবি না?

KamrulHasan এর ছবি

বদলে যাউ - বদলে দাউ - হাউ মাউ হাউ মাউ খাঁউ।
ভাল্লাগছে। চলুক

দীপ্ত এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
একটা কথা, এটা গল্প, ট্যাগটাও তাই দিয়েছি। কিন্তু বলার স্টাইলের জন্যেই কিনা, আত্মজীবনীমূলক মনে হচ্ছে কি?

salim এর ছবি

ভালো লিখেছেন

দীপ্ত এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।

salim এর ছবি

চিন্তিত

উচ্ছলা এর ছবি

কষ্টের কাহিনী ভাল লেগেছে। একটা গান উপহার নেনঃ

শিশিরকণা এর ছবি

লেখার লাইনে লাইনে হাহাকার।

পাছে লোকে কিছু বলে এই ভয়েই আমরা সারাজীবন মাঝারি থেকে গেলাম। আশা, হতাশা, ভয় সব ছেড়ে নিজের মনে চলেন। খেতা পুড়ায় দেন দেঁতো হাসি

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

দীপ্ত এর ছবি

জীবনে কি আছে, যাতে ভালো লাগে, যা করে আনন্দ পাই, তাই করি, করতে চেষ্টা করি।
ও হ্যাঁ, এটা গল্প ছিল। কিন্তু উত্তম পুরুষে লেখা বলেই কিনা, অনেকের কাছেই মনে হয়েছে, আমার ঘটনা বুঝি। আমি নিজেও মধ্যম, তবে তাতে অখুশি নই একেবারেই। যতদিন নিজের যা ভালো লাগে টা করতে পারছি, ততদিনই আনন্দ ভীষণ।
মন্তব্যে ধন্যবাদ ।

শিশিরকণা এর ছবি

অনেকেই আপনার নিজের কাহিনী ভেবে আপনার কল্যান কামনা করছে, এইটা কিন্তু লেখক হিসেবে আপনার সার্থকতা। Don't appologize for the confusion, Be proud হাসি

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

অন্যকেউ এর ছবি

মধ্যমের কথাগুলো এতো সুন্দর করে গুছিয়ে লিখেছেন! অপূর্ব!

কষ্টের কাহিনিতে উত্তম জাঝা। লেখনী চালু থাকুক পুরোদমে। চলুক

_____________________________________________________________________

বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।

দীপ্ত এর ছবি

অনুপ্রেরণার জন্যে ধন্যবাদ। যতদিন আনন্দ লাগে ততদিন লিখব আশা করি।

তৌফিক জোয়ার্দার এর ছবি

বড় বা আলাদা কিছু হতে হবে এ ধরণের হিনমন্যতাজাত অবিমৃশ্যতাই বড়/আলাদা হবার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। আর তা হতে গিয়ে যদি অন্ধ অনুকরণে গা ভাসিয়ে দেয়া যায় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। তাই বলি- আলাদা কিছু নয়, নিজের মত হবার চেষ্টা করুন। ব্যক্তিত্বের সেটাই সবচেয়ে বড় trait; নিজের মত হওয়া। অন্যের গুণ বা দোষ বিশ্লেষণ না করে নিজের সীমাবদ্ধতা এবং সামর্থ্যকে অনুধাবন করার চেষ্টা করুন। আপনার ভেতর নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে যা অন্যের ভেতর আপনার মত নেই। যেমন: কেই লেখায় ভাল, কেউ বলায়, কেউ খেলাধুলায় পারঙ্গম, তো কেউ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে। শিক্ষার আধুনিক প্যারাডাইমে 'মাল্টিপল ইন্টেলিজেন্স' কে স্বীকৃতি দেয়া হয়। অর্থাৎ আমাদের মত কেবল অঙ্ক আর সাহিত্যকেই মেধার মানদন্ড না ধরে মানুষের আরো অসংখ্য (আমার জানা মতে ৯ টি ভাগে এখন পর্যন্ত মেধাকে শ্রেণীবদ্ধ করা গিয়েছে; এর বাইরেও থাকতে পারে) সুপ্ত প্রতীভাকে মেধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে গৎবাঁধা কতগুলো কুশলতাকেই মেধার পরিচায়ক ধরা হয়; যা আজ আধুনিক বিচারে পরিত্যক্ত হয়েছে। আমাদের আরেকটি সমস্যা হল আমরা ছেলেবেলা থেকেই কাউকে কোন কাজে উৎসাহ দেইনা; বরং সমালোচনা করি; বাঁধা দেই। এতে তার সুপ্ত প্রতিভাগুলোর বিকাশ হয়না। তাই আপনাকে বলি- নিজেকে চিনুন, বুঝুন, সময় দিন। অন্যেরা কিরকম বা কি করে অসাধারণ হয়েছে তা না ভেবে নিজের potential কে capitalize করুন। আরেকটা কথা, আপনার সন্তানকে সব কাজে উৎসাহ দিন। তাকে তার মন মত বেড়ে উঠতে দিন। সে কখনোই নিজেকে আপনার মত mediocre ভাববেনা। আপনার সাথে সরাসরি কথা বলতে পারলে ভাল লাগত।

shafi.m এর ছবি

চলুক

শাফি।

দীপ্ত এর ছবি

সময় নিয়ে মন্তব্য করার জন্যে ধন্যবাদ।
আসলে হয়েছে কি, এটা স্রেফ গল্পই ছিল। না না, এখন এড়িয়ে যেতে চাইছি না। ট্যাগটাও গল্পই দিয়েছি, আত্মজীবনী না। কিন্তু উত্তম পুরুষে লেখা তাই আপনি একাই নন, অনেকেই ভাবছে আমার কাহিনী। অর্থাৎ, গল্প বলার ঢংটা ওরকম হয়ে গেছে। সেটা লেখকের ব্যর্থতাও বলা যায়।
আপনার উদবিগ্ন হওয়ার কারণ কিছুটা বুঝতে পেরেছি, শেষ প্যারায় আত্মহত্যাকেন্দ্রিক কি? আদপে, সন্তান দূরে থাক, দোকলাই হওয়া হোল না এখনও। সে যাই হোক, তথ্যপূর্ণ মন্তব্যের জন্য আবার ধন্যবাদ। শিখলাম অনেক কিছু।

তৌফিক জোয়ার্দার এর ছবি

চলুক

ইফতি এর ছবি

দীপ্তকে ধন্যবাদ। মধ্যবিত্তের সঙ্কট, কমপ্লেক্স , মানসিকতা কোনটাই আমার জন্য অপরিচিত নয়। তবুও ভেবে ভালো লাগে আমরা যারা মধ্যম, মানে সমাজের চোখে, তারাই বরং বেশি সুখি নিম্ন র উচ্চদের চেয়ে। নিন্মরা জীবনের লড়াইয়ে খুঁজছে বেঁচে থাকা, উচ্চরা জীবন মাড়িয়ে জীবনের লাশে পা রেখে সুখ খুঁজে ফেরে। আর এর ফাঁকে নানান প্রতিঘাত, টানাপড়েন নিয়ে আমরাই বেঁচে থাকি ঢের সুখে।

ধন্যবাদ অশেষ আবারো আপনাকে।

ন এর ছবি

চলুক

দীপ্ত এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

ধ্রুবনীল এর ছবি

দারুণ লিখেছেন, ভালোলাগা জানিয়ে গেলাম। লেখালেখি চলুক।
ধন্যবাদ।

দীপ্ত এর ছবি

ধন্যবাদ ধ্রুবনীল, পড়ে এবং ভাললাগা জানানোয়।

তিথীডোর এর ছবি

চলুক
তবে এই লেখাটা আসলে আমার লেখা উচিৎ ছিলো। মন খারাপ

সবচেয়ে খুশি হতাম একটা ছোট্ট মফস্বল শহরে লাইব্রেরিয়ান হতে পারলে। সারাদিন বসে বসে বই পড়া যেত.. কিংবা বাচ্চাদের ইশকুলে ড্রইংটিচার-- আপেল রঙ করা শেখাতাম, কাগজ কেটে সজারু বানিয়ে দিতাম।
মাঝারি মানের গাধা হয়ে কর্পোরেট কেরানিগিরির পেছনে দৌড়াতে ভাল্লাগে না... অ্যাঁ

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

দীপ্ত এর ছবি

দারুণ সুন্দর মন্তব্য। কাগজ কেটে সজারু বানানো, ওয়াও! একটা পোস্ট দিয়েন তো, ওরিগ্যামি যে কি ভালো লাগে, কিন্তু নৌকা আর প্লেন বাদে কিছু বানাতে পারি না। মন খারাপ
আর সবসময় আনন্দ পাওয়া, এরকম কাজের পেছনে সবাই কি ছুটতে পারে? যেটুকু সময় পারি, ওইটুকুই প্রাপ্তি।

আশরাফ এর ছবি

ধরেন আজকে এই মুহূর্ত থেকে আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন প্রতিদিন অন্তত তিনটা অর্থপূর্ণ কাজ করবেন। এটা হতে পারে কারো মন ভাল করে দেয়ার মত কথা বলা/কাজ করা, একটা কুকুরকে বিস্কিট খেতে দেয়া কিংবা পথে পড়ে থাকা কলার খোসাটা তুলে ডাস্টবিনে ফেলা। দেখবেন আস্তে আস্তে আমিত্বময়তা থেকে বের হয়ে আসতে পারলে পৃথিবীটা অনেক সুন্দর মনে হবে।

দীপ্ত এর ছবি

ধন্যবাদ আশরাফ ভাই।
সুন্দর কথা বলেছেন, কিন্তু সেটা আমার গল্পের চরিত্র শুনতে পারলে তো হতই।
নিজের কাহিনী এটা না, গল্প ট্যাগেই লিখেছি, তারপরও ডিসক্লেমার দিয়ে নেয়া উচিৎ ছিল কিনা ভাবছি।
আর আমিত্বময়তা, যা আমাদের সবার মধ্যেই আছে, ঝেড়ে ফেলতে পারলে কি ভালই না হত!

ইফতি এর ছবি

ভালো লাগলো আপনার ধারণা টা। আমি আমি করেও আমরা তো আমিকে আর খুঁজে পাইনা।

মারুফ মনিরুজ্জামান এর ছবি

আপনার লেখা পড়ে না লিখে পারলাম না। আপনার লেখা ভাল লেগেছে- আপনার লেখার হাত খুব ভাল। লেখালেখি চালিয়ে যান।

কিন্তু আপনার লেখার বিষয়বস্তুর সাথে আমি একমত না। (আশা করি ব্যক্তিগতভাবে নিবেন না।)। আরেটা কথা আপনি মধ্যমদের নিয়ে লিখেছেন- তবে নিজে অবশ্যই মধ্যমদের দলে পড়েন না। তাহলে আপনার লেখা আমার চোখে পড়ত না :)।

এখন বিষয়বস্তুর বিষয়ে আসি। সফলতা আপেক্ষিক- সফল বলতে আমি বোঝাচ্ছি নিজের লক্ষ্যে পৌছতে পারাকে। সেটা একেকজনের কাছে একেকরকম। আমি নিজে যা হতে চাই তা যদি হতে পারি তাহলে আমি নিজেকে সফল বলব। সেই হিসাবে মধ্যম শ্রেণীর একজন অনায়াসে নিজেকে সফল বলতে পারে। একটা জিনিস যেটা পৃথিবীতে অনেক মানুষ করেছে (এইটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট) সেইটা করার চেষ্টা করে সফল হয়নি এমন কাউকে আমি এখন পর্যন্ত দেখিনি। একজন কতটুকু চেষ্টা করার পর আপনি আসলে বলতে পারেন যে সে চেষ্টা করেও সফল হয়নি? সংখ্যাটা ১০ হাজার ঘন্টা। এর কম চেষ্টা করে কেউ যদি আমাকে বলে আমি চেষ্টা করেছি কিন্তু সফল হইনি- তার কথায় আমি গুরুত্ব দিতে রাজি না। ১০ হাজার ঘন্টা মুখের কথা না। এটা করতে ৩ থেকে ৭ বছর লাগতে পারে (আমার লেগেছে ৪ বছর ১৯৯৯-২০০২) আর তারপর ফল পেতে আরও ৩/৪ বছর লাগতে পারে। কেউ কি আমাকে একজন মানুষ দেখাতে পারবেন যে ১০ হাজার ঘন্টা কোন বিষয়ে চেষ্টা করে সেই বিষয়ে বিফল হয়েছে? ওহ আরেকটা কথা যা করতে চেষ্টা করছি সেটা আমি আসলেই করতে চাই কিনা সেটা অনেক বড় ব্যাপার। নাহলে চেষ্টা হবে আধখেচড়া।

ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজের জন্য খুব বড় স্বপ্ন দেখি না- এটা একটা কারণ অবশ্য হতে পারে যে- যা করতে চেয়েছি তা করতে পেরেছি।

দীপ্ত এর ছবি

মারুফ ভাই, এত বড় চমৎকার মন্তব্যে ধন্যবাদ।
কিন্তু হয়েছে কি, এটা তো আমার কাহিনী না। না, আসলেই গল্প মাত্র। তাই গল্পের যে নায়ক (প্রধান চরিত্র?) সেই আমি, লেখক আমি না। কিন্তু এখন ভাবছি, হয়তো লেখাটার ঢংতাই কিছু ভুল আছে, নতুবা প্রায় সবাই তাই ভেবেছে কেন?
আর ১০হাজার ঘণ্টা পরিশ্রম করে আপনি যে অর্জনের কথা বললেন, তাতে আপনার অধ্যবসায়ের প্রশংসা না করে পারছি না।

মঈনুল এর ছবি

দারুন লাগলো।এই যে আপনার সীমানা ছাড়ানোর আকাংখা এটা খুব জরুরী।জিন থেকে জিনে ছড়িয়ে পড়বে।

শীর্ষেন্দুর একটা ছোট গল্পের কথা মনে পড়লো।নাম-" আমাকে লক্ষ্য করুন "।

দীপ্ত এর ছবি

সীমানা ছাড়ানোর আকাঙ্খা যদি কারও থাকেই, সেটা গল্পের চরিত্রের, আমার না। কারণ গল্পের চরিত্রের আমি আর লেখক আমি আলাদা। উপরেরটা নেহাত গল্প মাত্র, আমার নিজের কথা না।
শীর্ষেন্দুর গল্পটা খুঁজে পড়ে দেখতে হবে তো।
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।

কালো কাক এর ছবি

জীবনের একটা সময় পর্যন্ত বেশ কেউকেটা ধরণের ছিলাম। এখন মধ্যমকাল অতিক্রম করছি। আশা আবারো উত্তমের কাতারে যেয়ে বসার। কিন্তু উত্তম হওয়া বিরাট কষ্টের কাজ। আপাতত কষ্টমষ্ট করতে ইচ্ছা করছে না, মধ্যম থাকাটা বেশ আরামদায়ক মনে হচ্ছে দেঁতো হাসি

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

চলুক

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

ধুরো বোকা মানুষ! আমরা কেউই মধ্যম না। কে কী বলে তাতে কিছু এসে যায়? আপনার স্ত্রীর কাছে আপনি মধ্যম কি? নাকি আপনার সন্তানের কাছে? নিজেকে মধ্যম ভেবে হাহুতাশ করা নিজের অপমান! সুন্দর লিখেছেন লেখাটা, আর এতেই কিন্তু আপনার ইউনিকনেস বোঝা যাচ্ছে! হাসি

লেখা চালিয়ে যান!

[আর অফটপিকঃ আপনার নাম আর আমার ভাইয়ের নাম দেখি একই!]

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

দীপ্ত এর ছবি

এখন বুঝছি যে উত্তম পুরুষের বদলে নাম পুরুষে (আমির বদলে সে) দিয়ে লিখলেই বোধ করি বেশি ভালো হত। গল্পের 'আমি' যে লেখক আমি না সেটা অনেকেই ধরতে পারেন নি, সেটা লেখনীর ব্যর্থতাও বলা যায়। গল্পের 'আমি' আমার কল্পনার সৃষ্টি, নিজে যদি ওরকম হতাম তাহলে কি আর এত সহজে বেদনার কথা লিখতে পারতাম? মনে হয় না। আর স্ত্রী- বাচ্চা প্রসঙ্গে- ওটা নেই আপাতত, পরের কথা পরে। চোখ টিপি
পড়ে মন্তব্য করার জন্য অনেক ধন্যবাদ দুষ্ট বালিকা।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

গল্পের 'আমি' যে লেখক আমি না সেটা অনেকেই ধরতে পারেন নি

এটাই আসলে লেখার সার্থকতা

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

ইফতি এর ছবি

আপনার কথায় নাড়া খেলাম একটু না, অনেক বেশি।আসলেই আমি মধ্যম না। আমার পরিবারের কাছে, প্রিয়জনের কাছে, অপেক্ষমান অনেকগুলা চোখের সারির কাছে। এটা ভেবে বাঁচতে ভালো লাগে অনেক দিন। ধন্যবাদ আপনাকে চেনা জিনিসটা মনে করিয়ে দেবার জন্য।

তাপস শর্মা  এর ছবি

খুবই ভালো লেগেছে। আর এত হতাশার কি আছে গুরু, চালিয়ে জান। আর বেশী মন খারাপ করলে আমাদের উদাস ভাই এর লেখা পইড়া লাইয়েন। আর আমাদের সাথে একটু আড্ডা দিয়েন। এইবার কাজের কথায় আসি - লেখার স্টাইল আপনার খুবই ভালো। এই আঙ্গিকে লেখা চলতে থাকুক, আপনার লেখার হাত খুবই ভালো। নেক্সট লেখা ছাড়েন তো মিয়া, আর চিন্তা নাই। লেখা না ছাড়লেই চিন্তা। হাসি হাসি

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

গল্প ভালো লেগেছে। লিখতে থাকুন।

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

ইঁদুর এর ছবি

ওরে দীপ্ত-চালায় যা!=)-লেখা লেখিতে একটা কু খ্যাতি লাভ করে ফেলবি একদিন এটুকু নিশ্চিত!

rabbani এর ছবি

ভালো লাগলো

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

সত্যিই ভাল লেগেছে।

মর্ম এর ছবি

অনেকে গল্পের 'আমি'র সাথে আপনার 'আমি'কে গুলিয়ে ফেলছেন। তাতে আবার আপনাকে চিন্তিত হতে দেখছি। এতে অবাক হবার কিছু নেই আসলে।

আপনার লেখার চরিত্র তৈরি দুর্দান্ত লাগলো- আত্মকথনের সুর থাকাতে পাঠকের মন কাড়তে সমস্যা হল না।

আমার তো মনে হল, লেখক হিসাবে আপনার সার্থকতা এখানেই!

সচলে স্বাগতম। আপনার কী-বোর্ড থেকে আরো অনেক ভাল লেখা পাব, এ আমি নিশ্চিত!

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

জাদুকর এর ছবি

দীপ্ত আপনার লেখাটা অসাধারন লাগলো। আমরা বেশিরভাগ মানুষই মধ্যম এর দলে, সেজন্য অনেক কিছু আমাদের জীবনের সাথে মিলে যাচ্ছিলো বলে লেখাটা বেশী ভালো লাগলো। আপনার অন্যান্য দিকের কথা জানি না তবে লেখক হিসাবে আপনি অনেক উত্তম। আরো লেখা পাবার আশা ও শুভকামনা রইলো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।