কবিতা আর মাছওয়ালার হাসি

দীপ্ত এর ছবি
লিখেছেন দীপ্ত [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ০৮/০৬/২০১২ - ৮:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কি এমন ঘটল যে আমাকে ছেড়ে চলে গেল ও? বা অন্যভাবে বললে, আমরা দুইজনে মিলে, অথবা ও একাই যে ঠিক করল যে আমাদের আর একসাথে থাকা হচ্ছে না, তা কেন? আমাদের মধ্যে নাকি সেই স্ফুলিঙ্গটা নেই, ও বলেছিল।

সেই যে আগুনের কণা, যেটা সব জ্বালিয়ে দেয়, সব ক্ষোভ, সব দুঃখ, সব বেদনা, সব অপ্রাপ্তি আর অনুযোগকে উড়িয়ে দেয় ফু দিয়ে, রিং বানিয়ে সিগারেটের ধোঁয়ার মত। আমি ভেবেছিলাম বলি, তোমার চোখে এখনও সমুদ্রের গভীরতা দেখি আমি। কিন্তু এতগুলো বছর পর ভারী বেমানান লাগত সেগুলো, অনেকদিন না বলে অভ্যাসও চলে গেছে। এসব বলতেও যে অভ্যাসের দরকার হয়, সেদিনই ভেবে দেখলাম। আগে মনে হত, স্বতঃই আসে বুঝি ওগুলো। তা মনে হবে না কেন, ওকে দেখলে আসলেই কিভাবে কিভাবে জানি কবিতা আর গানেরা মাথায় এসে ভিড় করত। সেই কোন আমলে শোনা গান, তা মস্তিষ্কের কোন কোণায় লুকিয়ে ছিল তা যে বাঁধ।ভাঙা জলের মত ছুটে আসত, শুধু ওকে মুগ্ধ করতেই। ওর প্রতি কথাতে মিলিয়ে মিলিয়ে কবিতা জুড়ে দিতাম। ও রাগ করত। না ভুল বললাম, ও রাগ করার ভান করত, মনে মনে ভারী খুশি হয়ে উঠত। বাইরে বলত, ভাবের রাজ্য ছেড়ে কবে যে একটু বাস্তবে আসবে তুমি। আমি জানতাম, ও চায় না যে বাস্তবে আসি আমি কখনই। ও এমনই, যা চায় না তা বলবে, যা চায় তা বলবেনা। এবং তখন এসব বুঝে নিতে কোন কষ্টই হত না আমার।

তারও অনেক দিন পরে। তখন আমার কবিতা আসতো না মোটেই, কিন্তু সে জন্যে আমি ভারী চিন্তিতও ছিলাম না, কারণ তখন কবিতার বদলে টাকা আসতে শুরু করেছে, আর কে না জানে যে বাজারে কবিতা দিলে সব মাছওয়ালাই বিরস মুখ করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু টাকা দিলে সেই একই মুখে হাসির মাধুর্যে ভরে ওঠে। তাই কবিতাকে কালেভদ্রের খাতায় তুলে দিয়ে মনোযোগ দিয়ে টাকা কামাচ্ছি, ঠিক তখনই ও বলে বসল যে আমাদের মাঝে নাকি স্পার্ক নাই, স্ফুলিঙ্গ নাই। সব নাকি ভীষণ ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেছে। কি কাণ্ড, ভীষণ চেষ্টা করেও কবিতা আসল না, ম্যাড়মেড়ে সাথে মিল করে কিছুই মনে আসল না, ধ্যাড়ধেড়ে, ক্যাড়কেড়ে সবকিছুই কেমন যেন বেখাপ্পা শোনাতে থাকল। প্রাণপণে কাব্য ছেড়ে গদ্যের আশ্রয় নিলাম। বললাম, আর কয়েকদিন চেষ্টা করলে হয় না? ও বলল, তুমি সত্যি করে বলো তো, তোমার কি মনে হয় আমাদের মাঝে আর কিছু অবশিষ্ট আছে। আমার মাথা অবশিষ্টের সাথে মিল করে কবিতা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। আমি মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে পথভ্রষ্ট নিউরনকে পথে আনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কবিতাতে যা সহজে বলা যায়, গদ্যে তা বলা বেশ ঝামেলার। আমি বললাম, দুই সপ্তাহ সময় চাই, যেমন করে বসকে বলি কাজ শেষ না হলে যখন ঝাড়ি দেয় তখন। ও আমার দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল অবিশ্বাসে, আমি তখনই জানতাম দুসপ্তাহে কিছুই হবে না। তারপরেও অলৌকিকে অবিশ্বাসী আমি তাকেই জাপটে ধরে ভাবলাম, যদি কিছু ঘটেই যায়। কে জানে, যে কবিতা আমার অবহেলায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তাকে সাধ্য সাধনা করে যদি ফিরিয়ে আনা যায়। ওকে যা বহুদিন বলিনি তা বলতে পারার মত ভাষা যদি কোন এক দৈবে ফেরত আসে নিউরনে।

শেষে যা হল: নায়ক যেমন পাহাড়ের ঢাল থেকে পরে গিয়ে স্মৃতিশক্তি ফেরত পায় তেমন কিছুই ঘটেনি। কবিতাও ফিরে আসে নি, ওও না। ও চলে যাওয়ার পরে, পাহাড়ে গিয়েছি কয়েকবার, কিন্তু এতো উঁচু যে লাফ দিতে ভয় লাগে। সে যাকগে, দু সপ্তাহ না, এক সপ্তাহ পরেই ও চলে গিয়েছিল। এক সপ্তাহ সময় লাগিয়েছিল, কারণ আমাদের অনেক দলিল দস্তাবেজ ছিল, ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট ছিল, ওর-আমার নামে, আরও জানি কি সব যৌথ ব্যাপার স্যাপার ছিল। কয়েক জায়গায় সাইন দিয়ে সব চুকিয়ে দিলাম, সব ডকুমেন্ট ওই গুছিয়ে রেখেছিল। সই দেয়ার সময়েও ভেবেছি, না বলি আশা করেছি যে এসবের কোন একটা কিছুতে নিশ্চয়ই আটকে যাবে ও। দৈব দুর্বলের সহায় হয় না- এই আপ্তবাক্যকে সত্য করে আমার আশা পূর্ণ হয়নি। ও চলে যাওয়ার পরও কবিতা হাতড়েছি আমি, মস্তিষ্কের প্রতিটা কোঠরে। খুঁজে পাইনি। এখন কবিতাও নেই, ও-ও নেই, খালি মাছওয়ালার হাসি আছে।

দীপ্ত


মন্তব্য

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুণ!!

চলুক

তাপস শর্মা এর ছবি

খুবই ভালো লাগল। একটা মোচড় দিয়ে গেলো!

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক
কড়িকাঠুরে

অতিথি লেখক এর ছবি

বেশ লাগল। চলুক

তারেক অণু এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ সবাইকে যারা পড়েছেন, মন্তব্য করেছেন, শেয়ার করেছেন। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
দীপ্ত

অতিথি লেখক এর ছবি

"আমাদের মাঝে নাকি স্পার্ক নাই, স্ফুলিঙ্গ নাই। সব নাকি ভীষণ ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেছে। " এরকমই হয়।

যাই হোক। বেদনা ভালো লাগার কথা নয়। কিন্ত গল্প ভালো।

শুভেচ্ছা

মিনাশিক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।