মন্দ মধুর হাওয়া ০১

শামীমা রিমা এর ছবি
লিখেছেন শামীমা রিমা (তারিখ: বুধ, ২১/১২/২০১১ - ১০:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাসার সামনে রিক্সা থেকে নামতেই খালুর সাথে দেখা ।মনোয়ার সাহেব মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সুবাধে চাকুরী জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটান জাহাজে ।তাই হঠাৎ খালুকে দেখে তন্নীর খুব ভাল লাগছে ।তার ইচ্ছে করছে কিশোরী মেয়ের মতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে ।
মনোয়ার সাহেব ভাল মন্দ এইসব চিরাচরিত সৌজন্যতার ধারে কাছে না গিয়ে তন্নীকে বললেন,তোমার ছেলেটা তো বেশ বড় হয়ে গেছে ।আর কি ব্যাপার দেখ আমি কিছুই জানি না !
কথাটা শুনে তন্নী একটু হাসল।তারপর বলল,আপনি আসবেন খালা তো আমাকে বলেনি ।কাল রাতেও তো খালার সাথে কথা হলো ।
মনোয়ার সাহেব সুযোগটা হাতছাড়া করলেন না ।বলতে শুরু করলেন,তোমার খালার মতো ভুলোমনের মহিলা আমি আমার জীবনেতো দেখিইনি আমার বাবা দাদা পর্যন্ত দেখেছেন কি-না সন্দেহ আছে।আচ্ছা,গিনেস বুকে এমন কোন রেকর্ড আছে কী পৃথিবীর সবচেয়ে ভুলো মনের মানুষ কিংবা মহিলা?
আমি জানি না।
মনে হয় নেই ।যদি থাকত তাহলে তোমার খালা সবসময় নাম্বার ওয়ান পজিশন ধরে রাখত,এ ব্যাপারে আমি তোমাকে শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারি ।এই মহিলা সবকিছু ভুলে যায়,দিন তারিখ থেকে শুরু করে নিজের স্বামীর নাম পর্যন্ত ।তোমাকে কিভাবে জানাবে আমি আসব সেটা তো নিজেই ভুলে গিয়েছিল ।তাইতো আমি যখন বাসায় এলাম তখন আমাকে দেখে এমন চমকে উঠল মানুষ এক ডজন ভূত আর পেতœী একসাথে দেখলেও এমন চমকাবে না ।আর সেখানে আমি তো একটা রক্ত মাংসের মানুষ ।
তন্নীকে হাসতে দেখে মনোয়ার সাহেব আবার বললেন,তুমি হাসছ আর আমার তখন কী অবস্থা একটু চিন্তা করে দেখো ।আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি এই মহিলাকে দেখে কেন আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম?
কারণ ছোট খালা অসম্ভব রূপবতী নারী আর এরকম রূপবতী কাউকে দেখে মুগ্ধ না হওয়া মানে প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ করা।আর প্রকৃতি তার নিয়ম ভঙ্গ করাটা পছন্দ করে না ,তাই..
যাও,এখন বাড়ির ভিতরে গেলে তুমিও মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে তাকে দেখে।আর শোন,তোমার ছেলেটাকে আমার কাছে রেখে যাও।

বাড়ির ভিতর ঢুকে তন্নী ছোট খালার রূপ দেখে মুগ্ধ না হলেও তার কান্ড দেখে বেশ সঙ্কিত হলো ।খালার রুমটা পারসোনা কিংবা উইমেন্স ওয়ার্ল্ড না হলেও তার কাছাকাছি । এতো সব জিনিসপত্র সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে,তার বেশিরভাগই তন্নী চেনে না কিছু সবজি বাদে।আর খালা মুখে একটা প্যাক লাগিয়ে কিম্ভুতকিমাকার অবস্থায় ইজি চেয়ারে আধশোয়া হয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন ।তন্নী রুমে ঢুকলে চোখ খুলে ইশারায় তাকে বসতে বললেন কিন্তু মুখে কোন কথা বললেন না ।
তন্নী কিছুক্ষণ বসে থেকে তারপর বলল,খালা তুমি তোমার সৌন্দর্য চর্চা নিয়েই থাকো আমি বরং খালুর সাথে কথা বলি ।
খালা এবার হু হু করতে শুরু করলেন ।
তন্নী বলল,কথা বলো না,চামড়ায় টান লেগে তোমার মুখের বারটা বেজে যাবে ।
খালা আবারও হু হু করতে করতে উঠে দাঁড়ালেন এবং দুমিনিটের মাথায় মুখ ধুয়ে আসতে আসতে বললেন,ঐ লোকের সাথে তুই কি কথা বলবি ?
কেন? আর খালু আবার ঐ লোক হল কবে থেকে ?
ইদানিং তার মাথাটাথা একেবারেই গেছে ।সারাদিন একা একা বকবক করতেই থাকে ।রাতের বেলাও ঘুম থেকে উঠে দেখি সে নিজের মনে গল্প করছে ।
ডাক্তারের কছে নিয়ে যাও ।
একথা বলতেই আমাকে উল্টো বলল কী জানিস ?আমার নিজের না-কি ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত ।
ভালই তো দুজনে মিলে চলে যাও ।অনেকদিন তো একসাথে বের হও না ।আর খালা তুমি কেন শুধু শুধু এইসব সৌন্দর্যচর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকো ,এমনিতেই তো তুমি সুন্দর ।
তাছাড়া আমার আর কী করার আছে বল? তবে তোর কথা শুনে তো মনে হচ্ছে তুই বেশ বড় হয়ে গেছিস ।
আমি বড় হয়ে গেছি মানে !আমি মা হয়ে গেছি না ।
আমি এটা মাঝে মাঝেই ভুলে যাই।আচ্ছা দুপুরে কি খাবি বল?
কিছু খাব না,বাসায় গিয়ে আমাকে রান্না করতে হবে ।
তোকে যেতে হবে না।তুই বরং জাহিদকে এখানে চলে আসতে বল ।জাহিদ নিশ্চয়ই আমার রান্না অপছন্দ করবে না ।আর শোন ,আজকের মেনুতে তোর প্রিয় ছোট মাছের চচ্চরিও আছে ।
শেষ পর্যন্ত তাদেরকে ছোট খালার বাসাতেই দুপুরে খেতে হলো ।কারণ খালার কাছ থেকে উদ্ধার পাওয়া গেলেও শেষরক্ষা হলো না খালুর জন্যে।মনোয়ার সাহেবের সাথে ইতিমধ্যেই রাদিফের বেশ ভাব হয়ে গেছে।রাদিফকে কোলে নিয়ে তিনি বেশ আয়েশ করে বসে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি দেখছেন ।টিভির পর্দায় বাঘ দেখে রাদিফ চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে।মনোয়ার সাহেব তাকে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই সে বাঘ ধরার জন্যে ব্যস্ত হয়ে হাত বাড়াল।

ছোটখালার বাসা থেকে তারা যখন বের হলো তখন প্রায় সন্ধ্যা । রিক্সায় উঠার অল্প কিছুক্ষণ পর রাদিফ ঘুমিয়ে পড়ল।তন্নী তার ঘুমন্ত মুখখানার দিকে তাকিয়ে বলল,একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ ?
কি,খালু খুব বেশি কথাবার্তা বলছেন ?
এটা নতুন কিছু না।খালার সাথে কোন কারণে ঝগড়া হলেই খালুর এ সমস্যা দেখা দেয় ।ঝগড়া মিটে গেলেই সব ঠিকঠাক হয়ে যায় ।
ওনি পারেনও বটে ।এই বয়সেও তার ঢংয়ের কোন কমতি নেই ।
সবাইতো আর তোমার মতো না ।
কেন? আমাকে কি তোমার বেরসিক মনে হয়?
সেটা তুমিই ভাল জানো । আর শোন,ছোটখালু মানুষ হিসেবে যথেষ্ঠ ভাল একেবারে গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ার মতো ।
জাহিদ কিছু বলল না ।শুধু তন্নীর দিকে তাকিয়ে একটু বাঁকা হাসি হাসল ।
তুমি তাকে দেখতে পার না এটা আমি জানি ।তার কারণ ওনি তোমার সম্পর্কে উদ্ভট কিছু তথ্য পেয়েছিলেন।সেসব শুনে অবশ্য আমিই হেসে ফেলেছিলাম ।
সেই জন্যে না ।প্রতিটি মানুষের বিচার করার ক্ষমতা এবং মানদন্ড আলাদা।যেমন ধরো,তোমার একটা বিশেষ গুনের জন্য আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি।আবার দেখবে তোমার ঠিক এই গুনটা আরেকজনকে এভাবে মুগ্ধ করতে পারছে না ।আমি ওনাকে অপছন্দ করি তা না।ওনি আমাদের বিয়েতে রাজি ছিলেন না বলে এখনো তার উপর থেকে আমার রাগটা কমেনি।
দেখো,এক কথা বলতে গিয়ে কত কথা বলে ফেললাম ।
বলো,সমস্যা কোথায় ? কথা বলতে তো আর টেক্স দিতে হয় না ।
রাদিফকে দেখো,ওর নাকটা একদম তোমার মতো ।
যা বলার বলেছ,রাফাত আর তার বউয়ের সামনে এটা বললে তো তুলকালাম কান্ড বেঁধে যাবে।ওদের ডিভোর্স পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে তোমার এই এক কথাতে।
তন্নী জাহিদের রসিকতা বুঝতে পেরে শব্দ করে হেসে ওঠল আর সেই হাসির শব্দে রাদিফ চোখ মেলে তাকাল।

প্রায় মাস পাঁচেক হলো রাদিফ তন্নী আর জাহিদের সাথে আছে ।রাদিফ জাহিদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাফাতের ছেলে।রাফাত আর তার স্ত্রী দুজনেই চাকরি করে একটা প্রাইভেট ফার্মে ।আর ওখান থেকেই তারা দুজনে ৬ মাসের একটা ট্রেনিংয়ে দেশের বাইরে গেছে।পালিয়ে বিয়ে করেছিল বলে রাফাতদের বিয়েটা এখন পর্যন্ত দু’পরিবারের কেউ মেনে নেয়নি ।তাইতো কার কাছে রেখে যাবে ছেলেটাকে এই নিয়ে যখন চিন্তায় মাথার চুল ছেঁড়ার মতো অবস্থা তখন তাকে উদ্ধার করলো জাহিদ ।তবু তন্নীর অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন ছিল ।আর যাইহোক বাচ্চাটার দেখভালের দায়িত্বতো তন্নীকেই নিতে হবে ।বাচ্চাটাকে দেখে তন্নীও বেশ খুশি মনে এই দায়িত্ব পালন করতে রাজি হয়েছিল।এতে করে তন্নীর সময় বেশ ভালই কাটছে ।এখন জাহিদ তাকে কম সময় দিলেও খুব একটা খারাপ লাগে না তার ।রাদিফই তাকে বেশ ব্যস্ত রাখে সবসময়।
বরাবরের মতো আজ রাতেও বিছানা ভিজিয়েছে রাদিফ ।সকাল বেলা উঠেই সেগুলো নিয়ে বাথরুমে ঢুকেছে তন্নী।ওদিকে আবার রাদিফ কান্নাকাটি শুরু করেছে ।কালরাতে তার গা একটু গরম ছিল।মনে হচ্ছে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে ।জাহিদ তার কান্না থামাতে পারছে না তাইতো বারবার বাথরুমের দরজার কাছে এসে তন্নীকে তাড়া দিচ্ছে বের হবার জন্যে ।অবস্থা বেগতিক দেখে তন্নী হাতের কাজ শেষ না করেই বের হয়েছে ।রাদিফকে কোলে নেয়ার কিছুক্ষণ পরই কোন বিচিত্র কারনে তার কান্না থেমে গেল ।এবং তার কিছুক্ষণ পর বাচ্চাটা ঘুমিয়েও পড়ল।তন্নী তাকে আলতো করে বিছানায় শুইয়ে দিল।রাদিফ ঘুমিয়ে আছে তার হাত দুটো মুঠি করে মাথার দুপাশে রাখা,তবে কান্নার রেশটা তার চোখেমুখে এখনো রয়ে গেছে ।চোখের কোনে এক ফোঁটা জলও লেগে আছে।তন্নী খুব যতœ করে তা মুছে দিতেই সে মুখটা সরিয়ে নিল তারপর তন্নীর গায়ের সাথে নিজের গা লাগিয়ে শুয়ে রইল । তন্নী আপন মনে বলে ফেলল,আরে বাবা, তুই তো আমার পিঠের নিচে চলে যাচ্ছিস ।
জাহিদ ইতিমধ্যে নাস্তা সেরে অফিসে যাবার জন্যে তৈরী হয়েছে।এ ঘরে এসে তন্নী আর রাদিফকে শুয়ে থাকতে দেখে বলল,তুমি তো দেখছি একদম মা হয়ে গেছো।
তন্নী বলল,কেন চেহারা দেখে কী বুঝা যায় কে মা ?
জাহিদ বলল,চেহারা দেখে বুঝা খুব কঠিন ।তবে বাচ্চা কাছে থাকলে অনেকটা সহজ হয় ।
কথা বলতে বলতে তন্নী রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে ।জাহিদের চা খাওয়াটা এখনো বাকি ।

শামীমা রিমা


মন্তব্য

Guest_Writer নীল কমলিনী এর ছবি

তন্নির বানান কি তন্বী?

শামীমা রিমা এর ছবি

আমি পরের বানানটা লিখেছিলাম ।কিন্তু কেন এমন হলো বুঝতে পারছি না।

Guest-Writer নীলকমলিনী এর ছবি

লিখতে হবে তন্বী (Tonwee)।

উচ্ছলা এর ছবি

গল্পটায় কি কোনো হিডেন টুইস্ট আছে নাকি? চিন্তিত

শামীমা রিমা এর ছবি

গল্পটা এখনো শেষ হয়নি,উচ্ছলা ।

তাপস শর্মা এর ছবি
শামীমা রিমা এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

হু হু মনে হয় নাক নিয়ে নাক গলানোর বিষয় আছে। ভাল লেগেছে, পরের পর্বটা দিন।

শামীমা রিমা এর ছবি

ধন্যবাদ ।পরের পর্বটা শীঘ্রই দিব।

রাসেল এর ছবি

ভাল লেগেছে আপু চলুক

শামীমা রিমা এর ছবি

দেঁতো হাসি দেঁতো হাসি দেঁতো হাসি

আফরিন এর ছবি

ভাল লেগেছে, পরের পর্বটার অপেক্ষায় রইলাম হাসি

শামীমা রিমা এর ছবি

পরের পর্বটা তাড়াতাড়িই দিয়ে দেব। হাসি হাসি

holudhimu এর ছবি

ভালই...।তবে বাচ্চা টা যে তন্বীর না সেটা কি তার খালা খালু কেউই জানে না ? কেন ? আশা করি পরের পরবো গুলতে সব পরিস্কার হবে...।! অপেক্ষা সুরু......।।ভাল থাকবেন।

শামীমা রিমা এর ছবি

খালা রুপ চর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় খালুকে বলার সময় পাননি।
আপনার অপেক্ষার সমাপ্তি তাড়াতাড়িই হবে আশাকরি ।
হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।