তাকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: মঙ্গল, ০৩/১০/২০০৬ - ৪:৩৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


[1]
দোলনচাঁপা আমার ভীষন প্রিয় ।
ভেজা পাঁপড়ি গুলো যেন প্রেমিকার চিঠি।
ঠিক এই মুহুর্তে অবশ্য আর কোন প্রেমিকার মুখ মনে পড়েনা।
কেবল বাসি দোলনচাঁপার ঘ্রানের মতো আমার শৈশব ফিরে ফিরে আসে।

বসত-ভিটার অাঁচল ভিজিয়ে ছল ছল বয়ে যায় এক নদী। আমি আমার মায়ের কোলে চরে আরো কত পথ ঘুরে ঘুরে এসে বসত গড়ি এই নদী তীরে।
মাথার উপর এক বিশাল শূন্যতা। নাম তার আকাশ। রং তার নীল। এখানে সূর্য উঠেনা। সূর্য আসে সাতটি ঘোড়ার রথে চড়ে।

উনুনে হাড়ি চাপিয়ে ধোঁয়া আর আগুনের মাঝে সারাদিন বসে থাকে মা। হাড়িতে কেবল জল ফোটে টগবগ সারাদিন। আমার পেটে ক্ষিধে ফোটে টগবগ সারাদিন। ক্ষিধের চোটে কান্না আসে। জল ভর্তি হাড়ি থেকে কেবল ধোঁয়া বেরোয়। ভাত নয়।

অবশ্য কোন কোন রাতে এসে হাজির হন কোন কোন খলিফা। মা তখন জোর করে অন্ধকারে আমাকে খেলতে পাঠায়। খেলা শেষে ফিরে এসে দেখি হাড়িভরা সাদা সাদা ভাত। দোলন চাঁপা ফুলের মত সাদা। আর দেখি মায়ের শাড়ী ভরা লাল লাল দাগ। রক্তের মত লাল।

মা নিজ থেকে বলে- 'ভয় পাসনে খোকা, ওটা ভাতের দাম'

তারপর মা অনেকক্ষন নদীর জলে ডুবে থাকে।
অনেকক্ষন পরে উঠে এসে ব েল--
:বলতো খোকা নদী কোথায় যায়?
: কোথায় যায় মা?
: নদী সমুদ্্রে যায় রে ছেলে ।
:সমুদ্্র কি মা?
:যে সব পাপ ধোয়ে নেয়, সবার সব পাওনা
পাওনা ফিরিয়ে দেয় ।
: আমি বড় হয়ে সমুদ্্র হবো মা ................

[2]
ইদানিং আরেক হাসান, হাসানের ছায়া প্রায়শ:আমাকে চোখ রাঙায়।
: আজকাল বড় বিশ্রীভাবে তুমি নিজেকে গুটিয়ে
নিচ্ছো ।
: হ্যাঁ নিচ্ছি। মনে হয় আর মানুষ নেই । গুটি
পোকা হয়ে যাচ্ছি ।
: এসবের কোন মানে হয় না !
: হয়তো হয়, হয়তো হয় না ।

আমি আয়নায় নিজের চেহারা দেখি। ঠোঁটের কোনে ক্রুর হাসি যেন শয়তানের উল্লাস। নিজের কাছেই নিজেকে বড় অচেনা মনে হয়। আমার নির্মোহতার ছায়ায় প্রতীতির লাশ।
: আশ্চর্য! মেয়েটা তোমাকে সব দিয়ে যাচ্ছে। অথচ
তুমি তার কেউ না ।

আমি বেশ জোর গলায় নিজেকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলি
" আসলে আজকাল আমি কোন কিছুতেই আগ্রহ
পাই না। না ভালবাসায়, না ঘৃনায়! সব সম্পর্ক
গুলো বিমূর্ত মনে হয় । আছে , অথচ নেই ...."

: ছি -তুমি এরকম। বিশাস হয় না!
আামি এবার হাতের কব্জি ঘুরিয়ে নিজের কাঁধে রাখি। বলি
: বিশ্বাস করতে শেখো। ঐ তাকিয়ে দেখো
গাছের পাতাগুলো সব ক্রমশঃ হলুদ ।
লোভাতুর নদীর জলে ভাসমান মাটির প্রদীপ,
সাতটি সুরের ছিদ্্র, ভালোবাসার মগ্ন ধ্যান....

আরেক হাসান, হাসানের ছায়া এবার অাঁতকে উঠে। চিৎকার করে বলে--
:থামাও এসব। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ।
:আমারো হয়। খুব কষ্ট হয় রে! বিশ্বাসে
অনুভবে, প্রতীতি তে ...

[3]
নদীর নাম স্বপ্নভূক।

আমি বসে থাকি তার তীরে। নদীর জলে পাপ দেখি। ভাসমান পাপ, সমুদ্্রগামী পাপ।
লাল, নীল, হলুদ।

আমারতো সমুদ্্র হবার কথা। সব পাপ মুছে দেবার, সব পাওনা ফিরিয়ে দেবার আশৈশব প্রস্তুতি আমার।
কিন্তু ভাল্লাাগেনা।

জলের ছায়াকে বলি---
:আচ্ছা জীবনটাকে বদলে ফেলা যায় না?
:হ্যাঁ যায় ইচ্ছে করলেই বদলে ফেলা যায় ।
:তাহলে চলো!
:কোথায়?
: তুমি তোমার পরিনতিকে অস্বীকার করো।
আমিও সমুদ্্র হবার বদলে উজান হেঁটে চলে
যাবো উৎস মুখে।
: কেন?
: আমি আসলে সব কিছুর ূরুটা দেখতে চাচ্ছি ।

মাঘী পূর্ণিমার রাত শেষ হতে থাকে। আমি বসে থাকি একা। দেখি ভোরের একটু আগে আমার মা এর মতো অন্য কেউ আবারো ভেজেন জলজ অনুতাপে।
পাপ ভেসে যায়।
আমিও ভাসতে থাকি ক্যানাবিস এর ধোঁয়ায়,উজান কিংবা ভাটিতে ।।

ছবিসূত্র : নেট


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।