দাসপার্টির খোঁজে # খসড়া পর্ব-৩

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: সোম, ০৮/০৬/২০১৫ - ১:১৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১ লা মে ২০১৫।
সালেহ চৌধুরীর উত্তরার বাসায় উপস্থিত হই আমি ও নজরুল সকাল ঠিক দশটায়। এর আগে এসেছিলাম ফেব্রুয়ারীর ২৩ তারিখে, প্রথমবারের মতো। মাঝখানের এই দিনগুলোতে আমি এই অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংশ্লিষ্ট বই ও প্রকাশনাগুলো সংগ্রহ করে পড়ার চেষ্টা করেছি। দাস পার্টির অপারেশন সমুহের উল্লেখযোগ্য একটি স্থান সাচনা ও জামালগঞ্জ ঘুরে এসেছি, কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে আলাপচারীতা হয়েছে যারা অন্য গ্রুপের হলে ও একই সাব-সেক্টর টেকেরঘাটে ছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন মাধ্যমে চেষ্টা করেছি বানিয়াচঙ্গ, আজমিরীগঞ্জ, শাল্লা দিরাই অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দাস পার্টির জীবিত গেরিলাদের সন্ধান নেয়ার, বিশেষ করে ইলিয়াসের- যিনি শুরু থেকে একেবারে শেষযুদ্ধ পর্যন্ত কমান্ডার জ্যোতির সাথে ছিলেন।
দুমাস সে অর্থে দীর্ঘ সময় নয়। কিন্তু এই সময়ের ব্যবধানেই সালেহ চৌধুরীকে বেশ ক্লান্ত লাগে। নিজ থেকেই জানান পা ও কোমরের ব্যথায় ভুগছেন। চেয়ারে বেশীক্ষন বসে থাকতে পারছেন না। কুশল বিনিময়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমি তাকে গত দুমাসের আমার কাজের অগ্রগতি জানাই।

সাচনা- জামালগঞ্জ যাবার পরিকল্পনা করেছিলাম তার সাথের গত আলাপচারিতা থেকে। তিনি বলছিলেন জামালগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব এর কথা। প্রায় নিরক্ষর আইয়ুব গেরিলা যুদ্ধে খুবই পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন, নৌ পথের যুদ্ধে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন এবং জগতজ্যোতির শেষ যুদ্ধে তিনি আহত হয়েছিলেন। জামালগঞ্জ গিয়ে দুর্ধর্ষ গেরিলা আইয়ুব এর খবরই শুধু পেয়েছি,সাক্ষাৎ করতে পারেনি। কারন বছরখানেক আগেই তিনি মারা গেছেন চরম দরিদ্র অবস্থায়।
সালেহ চৌধুরী বিমর্ষ হন তার সহযোদ্ধার চলে যাওয়ার সংবাদে। ৪৩ বছর চলে গেছে, আর বেশী দিন নেই একে একে এঁরা সবাই চলে যাবেন।
আইয়ূব এর মৃত্যু সংবাদ শুনার পর কয়েক মুহুর্ত চুপ থেকে তিনি হঠাৎ করেই আরশ আলীর কথা বলেন। আরশ আলী একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা যিনি টেকেরঘাট সাব-সেক্টরেরই অন্য একটা গ্রুপে [ ভাটিপাড়ার কমান্ডার মানিক চৌধুরীর গ্রুপ] ছিলেন। এরা জয়কলসের দিকে কালনী নদীতে পাকিস্তান আর্মি ও রাজাকারদের টহল নৌকাগুলোতে আক্রমন করতেন। এরকম একটা অপারেশনে কালনী নদীর তীরে বাইবনা গ্রামে শহীদ হন এই কিশোর যোদ্ধা।
[ কাকতালীয়ভাবে ৪ মে তারিখে শহীদ আরশ আলীর সহযোদ্ধা ব্রজগোপাল সরকারের ভাষ্যে তাঁর ছেলে সুশোভন অর্ক সচলায়তনে আরশ আলীর আত্মদানের বর্ননা দিয়ে একটি লেখা পোষ্ট করেন ]

আমাদের আগের আলাপচারিতা শেষ হয়েছিলো সালেহ চৌধুরীর আজমিরীগঞ্জ অপারেশন দিয়ে। তাঁর সাথে তিনজন কমান্ডার মানিক চৌধুরী, নজরুল ও রমেশ পান্ডের নেতৃত্বে ত্রিশজনের মুক্তিযোদ্ধা দল ছিলো। আজিমিরীগঞ্জ অপারেশনের পর পরই তাকে বলা হয় জয়কলস রাজাকার ঘাঁটি আক্রমনের জন্য যেখানে সাত্তার এর নের্তৃত্বে শক্তিশালী রাজাকার বাহিনী গড়ে উঠেছে, এরা জয়কলস ব্রীজ এবং আহসান মারা ও ডাবর সেতু পাহারা দেয়, এ ছাড়া সিলেট- সুনামগঞ্জের এই হাইওয়ে ধরে পাকিস্তান আর্মির ও নিয়মিত টহল থাকে। জয়কলস টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অধীনে নয়, বালাট সাব-সেক্টরে। বালাট থেকে কয়েকটা গ্রুপ এর মধ্যে চেষ্টা করলে ও জয়কলসের সফল অপারেশন সম্ভব হয়নি কারন বালাট থেকে যে পথে আসতে হয় সেদিকে রাজাকারদের সতর্ক পাহারা। সালেহ চৌধুরী পরিকল্পনা করেন দিরাই থেকে হাওর পাড়ি দিয়ে পেছন দিক থেকে সিলেট-সুনামগঞ্জ হাইওয়েতে উঠে জয়কলসের দিকে আক্রমন করার। পরিকল্পনামতো তার তিন কমান্ডারের ত্রিশজন যোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগ নেতা কুদ্দুস সহ রওয়ানা দেন মাঝরাতে দিরাই থেকে। হাওরের মাঝখানে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টিতে সময় বেশী লাগায় জয়কলসের আগে হাইওয়েতে পৌঁছতেই তাদের সকাল হয়ে যায় যদিও পরিকল্পনা ছিলো ভোর বেলা মুল আক্রমনের। হাইওয়েতে নামার সাথে সাথে শুরু হয় রাজাকারদের গুলী বৃষ্টি। মুক্তিযোদ্ধাদের সবার হাতে রাইফেল আর কমান্ডার নজরুলের সাথে ছিলো এলএমজি। গুলী পালটা গুলী চলতে থাকে দুই পক্ষেই। রাজাকাররা সড়কে আর মুক্তিযোদ্ধারা ধানক্ষেতের ভেতর নৌকায়। রাজাকারদের নেতৃত্বে ছিলো একজন আনসার কমান্ডার। সেই আনসার কমান্ডার ও একজন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ‘সিওর শট’ গুলী বিনিময় হয়। সৌভাগ্যক্রমে রাজাকারের গুলিটি মুক্তিযোদ্ধার শরীরে বিদ্ধ না হলে ও রাজাকারটি গুলীবিদ্ধ হয়। দিনের আলো ফুটে যাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে নিরাপদে হাওরের দিকে প্রত্যাবর্তন করেন। পরে জানা গিয়েছিলো সেই কমাণ্ডার সহ আরো কয়েকজন রাজাকার গুরুতর আহত হয়েছিলো এই অপারেশনে।

তারপর সালেহ চৌধুরীকে ডেকে পাঠানো হয় সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার টেকেরঘাট। তখন সম্ভবতঃ জুলাই এর তৃতীয় সপ্তাহ। টেকেরঘাট গিয়ে দেখতে পান একটা টিমকে ব্রিফ করছেন ভারতীয় একজন লেফটেনেন্ট। সাব-সেক্টরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর ভাট তাকে জানান এটাই সেই বিশেষ টিম যারা পরে তার সাথে যোগ দেবে নদীপথ দখলের যুদ্ধে। মাত্র স্পেশাল ট্রেনিং শেষ করে এসেছে, জগতজ্যোতি দাসের নেতৃত্বে এরা প্রথম অপারেশনে যাবে জয়কলস ব্রীজ উড়িয়ে দিতে। এদের গাইড হিসাবে যাবেন কমিউনিষ্ট পার্টির কর্মী স্কুল মাষ্টার নজির হোসেন ( ইনি ১৯৯১ সালে কমিউনিষ্ট পার্টি থেকে সংসদ সদস্য হন এবং পরে বিএনপিতে যোগ দেন)। মেজর বাথ সালেহ চৌধুরীকে অনুরোধ জানান ব্রিফিং এ অংশ নেয়ার জন্য। টেকেরঘাট থেকে হাওর ও নদীপথে সরাসরি জয়কলসের দিকে রাস্তা নজির হোসেনের ভালো চেনা কিন্তু সালেহ চৌধুরী পরামর্শ দেন এই পথ এড়িয়ে দিরাই চলে আসার। দিরাই থেকে হাওর পাড়ি দিয়ে পেছনের পথে আক্রমন করলে সফল হবার সম্ভাবনা বেশী। তার পরামর্শ গৃহীত হয় এবং এই অনুযায়ীই পরিকল্পনা হয়।
নজির হোসেনের গাইডেন্সে জগতজ্যোতির দলটি প্রথম অপারেশনের জন্য আসে উত্তর –পশ্চিম দিরাই’র দত্তগ্রাম এ। গাছপালা ঘেরা এই গ্রামটি মুক্তিযোদ্ধা দলগুলির হাউড আউট হিসাবে ব্যবহৃত হতো। পরিকল্পনা মতে সদরপুর ব্রীজের নীচ দিয়ে দেখার হাওর হয়ে জয়কলস আক্রমনের কথা থাকলে ও গাইড নজির হোসেন আবার তার চেনাপথে একটা খাল পাড় দিয়ে কালনী নদী ধরে সংক্ষিপ্ত পথে জয়কলসের দিকে এগিয়ে যেতে চান কিন্তু অতোটুকু যাওয়ার আগেই নদীতে টহলরত রাজাকারদের বাধার মুখে তারা পড়ে যান এবং দুইপক্ষের গুলাগুলি শুরু হয়। মুল ক্যাম্পের রাজাকাররা ও সতর্ক হয়ে যায়।
তখন তারা পিছিয়ে এসে হাওর ঘুরে আবার বইয়াখাউরি নামে একটা গ্রামে অবস্থান নেন এবং এখানে কমান্ডার জগতজ্যোতি সিদ্ধান্ত নেন যেহেতু জয়কলস আর যাওয়া সম্ভব নয়, সদরপুর ব্রীজ উড়িয়ে দিতে হবে, শূন্য হাতে ফিরে যাওয়া যাবেনা। সিলেট- সুনামগঞ্জ হাইওয়েতে জয়কলস এর কয়েক কিমি আগেই সদরপুর ব্রীজ, এটি ও রাজাকারদের কড়া পাহারায়। কিন্তু একটা ও গুলী ব্যয় না করে কৌশলে এখানে রাজাকারদের বন্দী করা হয় এবং এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয় সদরপুর ব্রীজ।
একটার বদলে অন্য টার্গেট হলে ও প্রথম অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন করে সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার টেকেরঘাট ফিরে যায় কমাণ্ডার জগতজ্যোতি দাসের নেতৃত্বে দাস পার্টির মুক্তিযোদ্ধারা।

এরপর তারা অংশ নেন আগষ্টের প্রথম সপ্তাহে সাচনা-জামালগঞ্জের যুদ্ধে। এই যুদ্ধে তাদের সাথে ছিলো মোজাহিদ ও ইপিআরের আব্দুল হাই এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের দুইটি দল। এই যুদ্ধেই হন শহীদ হন আব্দুল হাই এর সেকেন্ড ইন কমান্ড বীরবিক্রম সিরাজুল ইসলাম।

সাচনা জামালগঞ্জ যুদ্ধের পর পরই মেজর ভাট তার প্রিয় গেরিলা দল দাসপার্টিকে পাঠিয়ে দেন সালেহ চৌধুরীর কাছে দিরাই এ। কমান্ডার জগতজ্যোতি দাস, সেকেন্ড ইন কমান্ড তাহিরপুরের আলী আমজদ এর নেতৃত্বে ৩৬ জনের গেরিলা দল। এই দলেই ছিলেন সালেহ চৌধুরীর আপন ভাই জুবের চৌধুরী যিনি আবার যুদ্ধ শুরুর আগে সুনামগঞ্জ কলেজে জ্যোতির সহপাঠি ছিলেন।
এর আগে সালেহ চৌধুরীর নেতৃত্বে দিরাই ও ঘুঙ্গিয়ার গাঁও ( শাল্লা) থানা দখল করা হয়েছে। তার খোঁজে দাস পার্টি প্রথমে ঘুঙ্গিয়ার গাঁও চলে গিয়েছিলো, সেখানে তাকে না পেয়ে তারা দিরাই ফিরে আসে। দিরাই আসার সময় তারা দেখতে পায় কার্তিকপুর নামে একটা গ্রামে ডাকাতি হচ্ছে। ডাকাতদের বাধা দেয়া হবে কিনা এটা নিয়ে তাদের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা ছিলো কেননা নির্দেশ ছিলো এই এলাকায় সালেহ চৌধুরীর পরামর্শ ছাড়া কোন অপারেশন না করার। জগতজ্যোতি এটাকে বিচ্ছিন্ন ঝামেলা মনে করে এড়িয়ে যান এবং দিরাই এসে রিপোর্ট করেন। সালেহ চৌধুরীর কাছে ও সংবাদ ছিলো যে একদল লোক মুক্তিযোদ্ধা নাম নিয়ে ডাকাতি করছে।
জগতজ্যোতি আসার পর তাকে ক্যাম্পের দায়িত্ব দিয়ে সালেহ চৌধুরী তার পূর্ব নির্ধারিত অপারেশন শ্যামার চর যান। শ্যামার চরে একটা পুলিশ ফাঁড়ি ছিলো পাঁচটা রাইফেল সহ। উদ্দেশ্য ছিলো এই রাইফেলগুলো দখল করা এবং শ্যামার চরের দালাল খালেককে আটক করা। দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ তিন থানার সংযোগ স্থল শ্যামা সুরমা নদীর তীরে শ্যামার চর একটা উল্লেখযোগ্য জনপদ। হিন্দু প্রধান এলাকা হলে ও পিডিপি নেতা খালেকের বিশাল প্রতিপত্তি। সে তার আত্মীয় স্বজন সহ দুইশোজন নিয়ে বিরাট রাজাকার বাহিনী গড়ে তুলেছিলো এই এলাকায় এবং এখানে পাকিস্তান আর্মির স্থায়ী ঘাঁটি গড়ার জন্য ও সে তৎপরতা চালাচ্ছিলো। ( ডিসেম্বরে শ্যামার চর অপারেশনে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন এবং ২৭ জন সাধারন মানুষকে গুলী করে হত্যা করেছিলো খালেকের বাহিনী । এই গনহত্যার আলাদা অনুসন্ধান করবো আমরা পরে)।
সালেহ চৌধুরী ও তার মুক্তিযোদ্ধারা শ্যামার চর পৌঁছার পর পরই দুই পক্ষে গুলাগুলি শুরু হয়। রাইফেল সহ ফাঁড়ির পুলিশ ও রাজাকার খালেক হাওর ধরে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় শুধু তার ঘোড়াটি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।

শ্যামার চর অপারেশন শেষে ক্যাম্পের কাছে ফিরে এসেই সালেহ চৌধুরী খবর পান যে জগতজ্যোতি বারোজনের একটা দলকে আটকে রেখেছেন। ক্যাম্পে গিয়ে দেখেন এলএমজি রাইফেল সহ বারোজনের একটা দল, নেতৃত্বে বয়স্ক একজন সুবেদার মেজর। তারা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা দাবী করে জানায় যে, এপ্রিলের শেরপুর যুদ্ধে মেজর সিআর দত্তের নেতৃত্বে তারা যুদ্ধ করেছে। শেরপুরের পতন ঘটলে পরে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং বিগত দুতিন মাস তারা নবীগঞ্জ, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং অঞ্চলে রাজাকারদের সাথে যুদ্ধ করছে। গতকাল ও তারা একদল রাজাকার ধরে কোন এক জায়গায় বেঁধে রেখে এসেছে। এখন এখানে এসেছে এই মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে যোগ দিতে এবং তাদেরকে ঐ বন্দী রাজাকারদের কাছে নিয়ে যেতে।
সালেহ চৌধুরী তাদেরকে জানান- দিরাই বাজারে তার একটা নির্ধারিত সভা আছে রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে। ঐটা শেষ করে এসে তিনি তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। এই সময়ে তারা ক্যাম্পে বিশ্রাম নিতে পারেন কিন্তু নিয়ম মতো অস্ত্র জমা রাখতে হবে ক্যাম্প প্রধান জগতজ্যোতির কাছে।
তিনি বাজারে গেলে একটা লোক দৌড়ে এসে তাকে জানায় গতরাতে তার বাড়িতেই ডাকাতি হয়েছে এবং মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ঐ ডাকাতদের দেখে এসেছে। সালেহ চৌধুরী দ্রুত ক্যাম্পে ফিরে দেখেন জগতজ্যোতি সেই বারোজনকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলছেন কারন তার ও সন্দেহ হচ্ছিলো এরাই গতরাতে তাদের দেখা সেই ডাকাত দল।

জেরার মুখে বয়স্ক দল প্রধান স্বীকার করে সে পাকিস্তান আর্মির সুবেদার মেজর এবং তার ভাগ্নে নায়েক- দুজনেই শেরপুর যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল কিন্তু যুদ্ধ থেকে তারা এলএমজি ও রাইফেল নিয়ে পালিয়ে যায়। নবীগঞ্জের এক কুখ্যাত ডাকাত তার দল নিয়ে যোগ দেয় তাদের সাথে, আরো কিছু রাইফেল জোগাড় করে নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা দল পরিচয় দিয়ে ঘুরতে থাকে। দিনের বেলা বিভিন্ন গ্রামে মানুষের আদর আপ্যায়ন নিতে থাকে আর রাতের বেলা ডাকাতি। কয়েক শো বছরের পুরনো বিথঙ্গল আখড়া এরাই লুট করে এবং নারী সেবায়েতদের ধর্ষন করে। এখানে আসার আগে একটা বড় বাজার লুট করেছে তারা। বয়স্ক লোকটা তার লুটের ভাগের পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলো স্ত্রীর কাছে জমা রাখতে। কিন্তু তার স্ত্রী প্রবল ঘৃনায় তাকে প্রত্যখ্যান করলে মাটি চাপা দিয়ে টাকা লুকিয়ে রেখে এসেছে বাড়ির আঙ্গিনায়। এদিকে আসার পর রাজাকার দলের সাথে তাদের যোগাযোগ হয়। রাজাকারদের পরিকল্পনামতোই এখানে এসেছে মুক্তিযোদ্ধাদের রাজি করিয়ে মিথ্যে অপারেশনে নিয়ে যেতে। নির্ধারিত স্থানে যাওয়া পর বাইরে থেকে রাজাকার দল আর ভেতর থেকে তারা যৌথ আক্রমন করে মুক্তিযোদ্ধা দলটি শেষ করে দেবে।

কয়েকদিন আগের একটি ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষোভ ও শোকে ক্ষিপ্ত ছিলেন। জামালগঞ্জের কুখ্যাত রাজাকার লাল মিয়া তার সঙ্গীদের নিয়ে আটজন মুক্তিযোদ্ধাকে ঘেরাও করে ধরেছিলো এবং শুধু মাত্র লাথি দিতে দিতে অত্যন্ত নৃশংসভাবে তাদের হত্যা করা হয়েছিলো। মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ডাকাতি করছে এবং রাজাকারদের সাথে হাত মিলিয়ে পরিকল্পনা করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করার- হাতের কাছে এই দলটিকে পেয়ে সহযোদ্ধাদের হারানোর ক্ষোভ আরো উথলে উঠে। তারা সালেহ চৌধুরীর কাছে অনুমতি চান এদেরকে বিনা অস্ত্রে হত্যা করার। শুধু মাত্র বয়স্ক দলনেতাটিকে বয়স বিবেচনায় বাদ দিয়ে বাকীদের জন্য অনুমতি প্রদান করা হয়। এরপর যখন এই ডাকাত দল মরে গেছে বা মৃতপ্রায় কবর খুঁড়ে তাদের দেহ মাটি চাপা দেয়া হয় এবং বয়স্ক লোকটির কাছ থেকে তাদের সকল কৃতকর্মের লিখিত বক্তব্য নেয়া হয়। বাকীদের কবর দেয়া হয়ে গেলে সালেহ চৌধুরী তাকে বলেন- বয়স এবং তার পেশাগত দক্ষতা বিবেচনায় তিনি তাকে আরেকটা সুযোগ দিতে চান তার সাথে থেকে যুদ্ধ করার জন্য। কিন্তু সেই লোকটি ভুগছে চরম আত্মপীড়ন ও অনুশোচনায়। সে শুরু করেছিলো একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে, মুক্তিযুদ্ধের মতো মহৎ দায়িত্ব পালন না কোঁড়ে সে ডাকাতি লুট নারী ধর্ষন করেছে, এমনকি নিজের স্ত্রীর কাছে ও সে ঘৃণ্য। বাকী যে এগারোজন চরম শাস্তি পেয়ে মারা গেছে তার অপরাধ এদের থেকে কম নয় বরং বেশী কারন সে একজন প্রশিক্ষিত সৈনিক, একজন বয়স্ক মানুষ। চমৎকার ইংরেজিতে সে সালেহ চৌধুরীকে বলে ‘ Please don’t do it. If I survive that would be very very bad precedence. What I’ve done after al lthat man cant have a right to exist. Please kill me, spare a bullet. ‘
মিঃ চৌধুরী কাঁধের স্টেনগান তুলে দিলেন জুবের চৌধুরীর হাতে। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো- কোথায়? কথা না বলে সে আঙ্গুল দিয়ে কপাল ঠুকে দেখালো। একটা মাত্র বুলেট। গড়িয়ে পড়লো তার দেহ।

মুক্তিযোদ্ধা দলনেতা সালেহ চৌধুরী ৪৩ বছর পর ও প্রশংসা করেন লোকটার গাটস এবং আত্মউপলব্ধির।

[ সালেহ চৌধুরীর সাথে দীর্ঘ আলাপচারীতার কিছু অংশ এখানে তুলে দিলাম। এই অংশে বর্ণনা আছে দাসপার্টি কর্তৃক ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনাক্তকরন ও দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি প্রদানের ঘটনা। ধৈর্য্য থাকলে পাঠক শুনে দেখতে পারেন]


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

What I’ve done after al lthat man cant have a right to exist. Please kill me, spare a bullet

এই উপলব্ধিটুকু আমাদের রাজাকার শিরোমনিদের হলো না কোনোদিন

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

চমৎকার কাজ। গুরু গুরু

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

শান্ত এর ছবি

চলুক মোরশেদ ভাই।

__________
সুপ্রিয় দেব শান্ত

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ কাজ... গুরু গুরু

স্বয়ম

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নীড় সন্ধানী এর ছবি

চমৎকার হলো অডিও সংযোজনের ব্যাপারটা! চলুক

মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ডাকাতি করছে এবং রাজাকারদের সাথে হাত মিলিয়ে পরিকল্পনা করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করার-

এই জাতীয় 'মুক্তিযোদ্ধা' সারাদেশেই অল্পবিস্তর ছিল। চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনায়ও পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং ও অস্ত্র নিয়ে এসে ডুয়েল এজেন্ট হিসেবে কাজ করা এরকম বদমাশগুলোর কথা। কিন্তু চিহ্নিত করার মতো কোন তথ্য উপাত্ত না পাওয়াতে লিখতে পারছি না তাদের কথা। এদেরকে নিয়ে কাজ হওয়া দরকার। কেননা সেদিনের ভেজাল চারা পরবর্তীকালে মহীরূহ ভেজালে পরিণত হয়ে গেছে। সব লেভেলেই কিছু কিছু খন্দকার মোশতাক ছিল বলে মনে হয়।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

মাসুদ সজীব এর ছবি

চলুক
অগোচরে থাকা ইতিহাস কে তুলে আনার চেষ্টার জন্যে কৃতজ্ঞতা। পাঠক অংশগ্রহন করুক আর না করুক ভালোবাসা থেকে করে যাওয়া এ কাজের সাথে আছি সব সময়।

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

মাসুদ সজীব এর ছবি

গুরু গুরু

অগোচরে থাকা ইতিহাস কে তুলে আনার কাজের জন্যে সাধুবাদ এবং কৃতজ্ঞতা। চলুক ইতিহাস খুঁজে আনার কাজটি।

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।