মনোটোনাস মনোলোগস (০/৫)

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: শনি, ০৪/০৪/২০১৫ - ২:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মানুষ স্মৃতির কাছে ফেরে।
ফেরার কি কোন মাত্রা বা পরিধি থাকে? বর্তমান থেকে অতীতের এই এতোটুকু নাকি সবটুকুতেই ফিরতে পারে মানুষ? স্মৃতিতে ফেরা একটা ভ্রমনই বটে।
ত্রিশবছর আগে যে উচ্চবিদ্যালয়ে বিদ্যার্থী হয়ে প্রবেশ করেছিলাম তার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশাল আয়োজন ছিলো। ব্যক্তিগত ব্যস্ততা ছিলো প্রবল। এরই ফাঁকে ৪০ মাইল দূরের সেই ছোট্ট শহরে গিয়েছিলাম। সেই শহর আমার প্রথম অনেককিছুই জানে। শৈশবের প্রায় পুরোটা এবং কৈশোরের অনেকটুকুই সেখানে। এইসব আয়োজনে প্রথামাফিক অনেককিছুই থাকে। আমি প্রথা যথসামান্য মেনে বের হয়ে গিয়েছিলাম একটু পুরনো মন্দিরের কাছে। আমাদের শৈশবে মন্দিরটা জরাজীর্ণ ছিলো, একটা টিলার উপর, পাশ দিয়ে নির্জন একটা পায়ে হাঁটা পথ আর স্রোতস্বীনি নদীর দুর্দান্ত একটা বাঁক। মন্দিরের টিলায় উঠলে উত্তরে দীর্ঘ পাহাড়ের নীল হাতছানি। কোন কোন রোদেলা দিনে সেই পাহাড়ে ঝর্ণা ও দেখা যেতো। মন্দিরে উঠার কোন সিঁড়ি ছিলোনা তখন, অনেকগুলো তেঁতুল গাছ ছিলো। পুরহিত মশায়ের প্রায় ভেঙ্গে পড়া একটা চালাঘর ছিলো। তার ছেলে প্রদীপ ছিলো আমাদের বন্ধু।

আমি সেই মন্দির টিলায় দাঁড়িয়েছিলাম কাল বিকেলে। দূরের নীল পাহাড় দৃশ্যমান হবার কাল আসেনি এখনো। নদী আগের মতোই আছে, ওপাড়ে বিশাল একটা ফ্যাক্টরী হয়েছে। মন্দিরের পাশ দিয়ে যাওয়া নির্জন রাস্তা এখন ব্যস্ত এখন, অটোরিক্সার স্টেশন হয়েছে। মন্দিরে উঠার পাকা সিঁড়ি।আগের সেই জরাজীর্ণ মন্দির নেই, একেবারে সিরামিকের বাঁধাই আর টাইলসের বানানো চুঁড়ো। পুরোহিত মশাই বদলেছেন, সেই প্রায় ভেঙ্গে পড়া চালাঘর ও নেই। তেঁতুল গাছগুলো ও নেই। আমি বাঁধানো চাতালে বসেছিলাম। সজ্জন পুরহিত মশায় একটা কাঁসার থালায় অনেকগুলো কলা এগিয়ে দিয়ে আপ্যায়ন ও করেছিলেন।

আমার মাথার ভেতর একটাশব্দ অনুরন তুলছিলো। 'নস্টালজিয়া'
যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে এটী গ্রীক শব্দ- 'নস্টস' আর 'আল্গোস' এর যৌগ। নস্টস মানে বাড়ি ফেরা আর আল্গোস মানে বেদনা। নস্টালজিয়া মানে কি তবে 'বাড়ি ফেরার বেদনা'? মানে বাড়ি ফিরে আসার জন্য যে মানসিক আকুতি সেটাই নস্টালজিয়া? বাড়ি মানে স্মৃতি? স্মৃতির কাছে ফেরত আসার ভ্রমন মাত্র?
যুদ্ধজয়ী ইউলিসিস বাড়ি ফিরছিলো, ইথাকায় ফিরছিলো তার জনগন আর স্ত্রী পেনোলোপির কাছে। বাড়ী ফেরার পদে পদে ঝড় ঝঞ্চা বিপদ আপদ, বাধা বিপত্তি। যতো বিপত্তি ততো তার আকুলতা, ততো ইউলিসিসের দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা।
মাঝপথে আশ্চর্য্য দ্বীপের মায়াবিনী সার্সির সাথে প্রণয়। সার্সির সাথে যখন সে মিলিত হয় তখন কী স্মৃতিতে পেনোলোপি লুপ্ত হয়েছিলো?
সার্সি তাকে নিজের সাথে সাথে দ্বীপের মালিকানা দিতে চাইলেও ইউলিসিস ইথাকায় ফিরে আসার স্বপ্ন ত্যাগ করেনি।
সাইরেনদের জাদুকরী সুর উপেক্ষা করে ইউলিসিস যখন ফিরে আসা ইথাকায়, তখন দশটি বছর পেরিয়ে গেছে। প্রজারা তখনো অপেক্ষমান, পেনোলিপি তখনো প্রতীক্ষায়?
কিন্তু দশবছর আগের ইউলিসিস আর প্রজাদের সম্পর্কের যে সমীকরন সেটা কি প্রত্যাশামতো একই থাকে? প্রজারা যে ইউলিসিস এর জন্য অপেক্ষায় ছিলো অনেক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাওয়া ইউলিসিস কি সেই একই ব্যক্তি অথবা দশবছর আগে ইউলিসিস যে প্রজাদের চিনতো তারা কি বদলে যায়নি অনেক? এ প্রসঙ্গে আমরা হয়তো ২৫শে মার্চ ১৯৭১ আর ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ এর শেখ মুজিবকে ভাবনায় আনতে পারি।

পেনোলিপি এবং ইউলিসিস পরস্পরের জন্য নিশ্চয় আকাংখাটুকু তীব্র ছিলো নয়তো এতো দীর্ঘ প্রতীক্ষাসম্ভব হতোনা, সম্ভব হতোনা ইউলিসিস এর ঘটনাবহুল, বিপদসংকুল স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। ইউলিসিস যখন যাত্রা শুরু করে ট্রয় থেকে ইথাকার উদ্দেশ্যে, ইথাকা তখন নস্টালজিয়া, পেনোলপি তখন বাড়ি ফেরা তাড়না। দশবছর পর ইথাকার পেনোলিপি'র গভীরে যখন ইউলিসিস- তখন কি তার আবার মনে পড়ে আশ্চর্য্য দ্বীপের মায়াবিনী সার্সি'কে? সার্সি তখন আবার নস্টালজিয়া, আবার ঐ বাড়িতে ফিরে যাবার তাড়না?

যারা প্রবাসী হয় তারা দিনযাপন করে এই সংকটে। যারা প্রবাস থেকে ফিরে আসে তাদের সংকট হয় উভমুখী। তারা হয়তো নস্টালজিয়ার এক অভেদ্য চক্রের ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে অবিরাম।


মন্তব্য

সুমন চৌধুরী এর ছবি

নস্টালজিয়া জিনিসটা প্রেমের মত। তালিকা শুধু বড় হইতে থাকে। স্বদেশপ্রবাস ব্যাপার না।

মনের দীর্ঘ ‌ছায়া বড় হয়।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

ওডিন এর ছবি

খুব সাহসের একটা কাজ করেছেন মোরশেদ ভাই। হাসি

অনেক স্মৃতিময়তায় ঘেরা কোন জায়গায় অনেক অনেক দিনে পরে ফিরে যাওয়ার মতো সাহস এখনো করে উঠতে পারি নাই।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

স্মৃতি এক অদ্ভুত জিনিস। স্মৃতির কাছে ফিরলে অবাক লাগে মাঝে মাঝে নিজেকেই চিনতে পারি না। পেছনের সব কিছু এত দ্রুত বদলে যায় ভেবে যখন অবাক হই, তখন আয়নার সামনে দাঁড়ালে দেখি আমি নিজেই কতটা বদলে যাচ্ছি প্রতিদিন।

স্মৃতি হোক আর বাস্তব হোক, ফিরে আসার ব্যাপারটাই কেমন যেন ঘোলাটে। অনেক অনেক প্রতীক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন পরে মানুষ যেখানে ফিরতে চায়, হোক সে স্বদেশ বা প্রিয়জন, তখন দেখতে পায় যে স্বদেশের কাছে সে ফিরতে চায়, যে প্রিয়জনকে ফিরে পেতে চায়, তারা অনেক বললে গেছে। যে ফিরে আসে সেও হয়ত বদলায়। তাই মানুষ যেখানে ফিরতে চায় সেখানে আসলে ফেরা হয় না কখনই। তবুও মানুষ ফেরে, ফিরতে চায়, হয়ত কিছুটা আপোষে, কিছুটা ভালোবাসায়।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

মাসুদ সজীব এর ছবি

শৈশব কেন এত মধুর হয়? সবচেয়ে সহজ উত্তর বোধহয় শৈশবে বইতে হয় না স্মৃতির জাদুঘর। শৈশবে থাকেনা উদিগ্ন কোন ভবিষ্যত ভাবনা, থাকেনা কোন অনিশ্চিত বর্তমান। শৈশব মানেই তাই নিশ্চিত বর্তমান, শৈশব মানেই বিস্তৃত মুগ্ধতা। স্মৃতিহীন, ভবিষ্যত ভাবনা হীন আর দায়িত্বের বোঝাহীন একটা জীবনের চেয়ে সুখকর আর কিছু কি আছে? নেই বলে জীবনের ঘরে শৈশবের অধ্যায়টি সবচেয়ে প্রিয় ভূমি প্রত্যেক মানুষের কাছে। তাই শৈশব নিয়ে আমাদের একবুক বিষন্নতায় ভরা ভালোলাগার গল্প সবারি আছে।

আর সেই শৈশবের সাথে যদি গ্রাম থাকে অষ্টপৃষ্ঠে তাহলে ভালোলাগার বিষন্নতাটা আরো গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে থাকে।

বড় হওয়া মানেই স্মৃতির ভারে নতজানু হও, দায়িত্বের চাপে ব্যস্ত হও আর দিনশেষে স্মৃতির পাতায় ভেসে ভেসে অতীতের কাছে ফিরে যাও।

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

..............................

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

হাসিব এর ছবি

মানুষ স্মৃতির কাছে ফেরে।
ফেরার কি কোন মাত্রা বা পরিধি থাকে?

আমি ঢাকা গেলে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করি। তবে সেইটা একা একা। আমার পরিধিটা ঐ সঙ্গহীনতায়। যাদের সাথে পড়তাম তাদের অনেকেই এখন কুপমন্ডুক ধরণের। আমি কী বলবো, কী করবো, কী ভাববো সেটা ঠিক করে দিতে চায়। তাদের সাথে কালেভদ্রে বসলেও বহু আলাপ তাদের সামনে করবো না এইটা চিন্তা করতে হয়। আর যারা আমাদের পড়াতো তাদের সিংহভাগকে আমি অশ্রদ্ধা করি। তাদের সামনে যাবার কোন কারণই নেই।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

আপনে একা হাঁটেন বিষয়টাতো সত্য না! আপনার সঙ্গে কমবয়সী বালিকাদের দেখা যায় বলে জনশ্রুতি আছে!

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

এক লহমা এর ছবি

চলুক
ফেরা হয়না।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

দেবদ্যুতি

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগলো। আর কিছু বলার নাই। ফেরা শব্দটাই ঝামেলার। কেউ কি ফেরে কখনো? মনে হয় না। ফিরছে বলে সে যা করে, তাও এক ধরনের যাওয়াই, অগ্রসর হওয়া, তাও আরেক সংযুক্তি। ‘সে এক সময় ছিল, ছাদের কিনারে পা দুলিয়ে দিয়ে অতীত খুঁড়ে খুঁড়ে দেখতাম’- এওতো আরেকটা স্মৃতির নির্মাণই। সুতরাং কী হইলো?- স্মৃতি আর ফেরা দুইটাই গোলমেলে ব্যাপার।

ভাল লাগছে লেখাটা।

স্বয়ম

অতিথি লেখক এর ছবি

বড় প্রাঞ্জল ভাষা। পরবর্তী পর্বগুলো পড়ে দেখার ইচ্ছা রইল।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

কী চমৎকার করেই না লিখেছেন!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।