মোনোপোলি

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৭/০৪/২০০৮ - ১:২৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মোনোপোলি প্রথম যখন দেখি তখনও এই খেলার নেশার ব্যাপারটা বুঝিনি। বাসায় যারা একটু বড় তারা হট্টগোল করে খেলতেন। টাকাপয়সার ব্যাপার, একদিন রক্তচক্ষু স্বৈরাভিভাবকের হুকুমে মোনোপোলির সরঞ্জাম বাজেয়াপ্ত হলো। যারা মোনোপোলি খেলতেন জমিয়ে, তারাও একে একে চলে গেলেন দূরে। আমি একাই মাঝে মাঝে বোর্ডটা বার করে দেখতাম।

সেই পুরনো বোর্ড কোথায় হারিয়ে ফুরিয়ে গেলো, ক্লাস এইটের শেষদিকে উপহার পেলাম টাটকা নতুন আরেকটা। এবার আর ঘরে বসে মোনোপোলি খেলার বোকামি করলাম না, বন্ধুবান্ধবদের জানিয়ে শুরু হলো স্কুল ছুটির পর নির্জন বাড়িগুলিতে খেলা। আমরা সাধারণত ভলিবল বা ক্রিকেট খেলতাম স্কুল ছুটির পর, ফুটবল খেলার খুব ঝামেলা ছিলো বলে সেটা কম খেলা হয়েছে, মোনোপোলি আসার পর মেঘলা দিনগুলোর একটা দারুণ সমাধান বেরিয়ে গেলো।

খেলতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, আমরা এক একটা কী চীজ। রীতিমতো মারপিট লেগে যাবার অবস্থা। দরকষাকষিতে বনিবনা হচ্ছে না, একজন আরেকজনের দিকে আঙুল তুলে শাসাচ্ছে। সে এক বিচিত্র উত্তেজনার সময়। ছক্কা জোড়ার ওপর কখনো পাঁচ জোড়া, কখনো ছয় জোড়া চোখ সম্মোহিতের মতো চেয়ে আছে। কারো সেট পন্ড হলে বাকিরা উল্লাসে গর্জন করে উঠছে, কেউ সেট মিলিয়ে ফেললে তার একার হঙ্কার শোনা যাচ্ছে দূরে সদর দরজা থেকেও। দর কষাকষির ধরনও দেখার মতো। "আমি তোকে ওল্ড কেন্ট রোড দেবো। তুই আমাকে মেফেয়ার দিবি। সাথে কত টাকা দিবি বল।" যাকে বলা হচ্ছে, সে টাকা দিতে রাজি, কিন্তু সে টাকা সে গোল করে পাকিয়ে প্রস্তাবদাতার পেছন দিক দিয়ে প্রবেশ করাতে চায়। আবার কেউ হোটেলে পড়ে ভাগ্যের ফেরে সব খোয়াতে বসেছে, তাকে আবার বাকিরা মিলে চাঙা করে তুলছে, যাতে পরের দানে সেই হোটেলওয়ালা আবার কোন বাটে পড়ে। সর্বস্বান্ত হয়ে এক একজন রাগের চোটে উঠে পড়ে হনহনিয়ে হেঁটে চড়ে বসছে সাইকেলে, এখানে আর এক মূহুর্তও না!

স্কুল ছাড়ার পর মোনোপোলি আর জমেনি। সেই শৈশবের বন্ধুদের ছাড়া আর কারো মধ্যেই মোনোপোলির সেই রক্তারক্তি স্পিরিট চোখে পড়েনি। এটা যে একটা নিষ্ঠুর, কাকের-মাংস-খাওয়া-কাকের জগতের খেলা, সেই উপলব্ধি পরবর্তী মোনোপোলির আসরের বন্ধুদের মধ্যে দেখিনি।

কাসেলে এসে কিছুদিন আগে আবার শুরু হয়েছে মোনোপোলি উন্মাদনা। এখানে যাঁরা বন্ধু, তাঁদের অনেকেই বেশ পাকড়ালো খেলোয়াড়, তাঁদের সাথে খেলে স্কুলের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। আমাদের যিনি দেখভাল করে রাখেন, যাঁর কারণে একজন আরেকজনকে ধরে পিটাই না, তিনি খুবই ঠান্ডা মাথার লোক। তবে মোনোপোলির নেশা তাঁরও মারাত্মক, ভোনহাইমে রীতিমতো নেটওয়ার্কে মোনোপোলি খেলেন গভীর রাতে।

চৌধুরী আরো সরেস, নেট থেকে একটা চোরাই কপি নামিয়েছেন খেলাটার। রাতদিন খেলেন কম্পিউটারের সাথেই। তাঁর বাড়িতে গেলেই শোনা যায় টুকরো জ্যায। আমি গজগজ করতে করতে বসে পড়ি পরের গেমে।

আবারও টের পাই, মোনোপোলি একদম অন্য একটা আমাকে বার করে আনে। লোভী, অস্থির করে তোলে আমাকে। খেলার সময় মাঝে মাঝে বিস্মিত হই, আসলেই কি আমি এমন? টাকার প্রয়োজন সবসময়ই ছিলো আমার, এখনও আছে, কিন্তু টাকার লোভ ব্যাপারটা কখনোই কাজ করেনি মনে। মোনোপোলি খেলতে বসে আমি যেন কালচে একটা আয়নায় অন্য এক আমার ছায়া দেখি, যে ছক্কা ছুঁড়ে মারে রূদ্ধশ্বাস আশা নিয়ে, গোপন হিসেব কষতে থাকে জমির দলিল নিয়ে, বোর্ডের বাকিদের ভিটেমাটি চাঁটি করে ঘটিবাটি বিক্রিতে বাধ্য করে। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই খেলার ওটাই নেশা। সেই কালচে আয়নার অন্য ছায়াটাই টানতে থাকে মানুষকে। গেম শেষ হয়ে গেলে বিষণ্ন লাগে, স্বস্তিও ফিরে পাই, মনে মনে ধন্যবাদ দিই কাকে যেন, সেই ছায়াটা সত্যি নয় বলে। তবুও মনে হয়, অনিচ্ছাসত্ত্বেও আরো ছায়াচ্ছন্ন কোন মোনোপোলির খেলায় ঢুকে পড়েছি জীবনে। নিস্তার নেই ওটার হাত থেকে, নিষ্কৃতি নেই, খেলা ছেড়ে উঠে যাবার উপায় নেই।


মন্তব্য

তানভীর এর ছবি

ও এটা দেখি আসলেই খেলার গফ! শিরোনাম আর লেখক দেখে ভাবছিলাম শিঙ্গালো টাইপ কিছু হবে খাইছে

=============
"আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম"

দ্রোহী এর ছবি

চমৎকার লেখা হিমু। নিঃসন্দেহে জীবনটা একটা মোনোপোলি খেলা।


কি মাঝি? ডরাইলা?

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍ভয়ংকর নেশা ধরে যায় এই খেলায়।

আমার সৌভাগ্য, সময়ধ্বংসী যাবতীয় খেলা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। এখনও পর্যন্ত।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
নিজেকে জয় করার অর্থ বিজয় না পরাজয়? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

তীরন্দাজ এর ছবি

খেলা হিসেবে মনোপলি একবার দু'বার খেলেছি। তেমন ভাল লগেনি। দাবা বেশী পছন্দ করি।

তবুও মনে হয়, অনিচ্ছাসত্ত্বেও আরো ছায়াচ্ছন্ন কোন মোনোপোলির খেলায় ঢুকে পড়েছি জীবনে। নিস্তার নেই ওটার হাত থেকে, নিষ্কৃতি নেই, খেলা ছেড়ে উঠে যাবার উপায় নেই।

এই মনোপলি সারা জীবন ধরেই খেলে যাচ্ছি!
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- আমি বারকয়েক ট্রাই দিছিলাম। ক্ষুদে ভাতিজি আর ভাতিজার কাছে সর্বস্বান্ত হয়ে উঠে গিয়ে এক মগ ধোঁয়া ওঠা গরম কফিতে চুমুক দিয়েছি। ধৈর্য্য ব্যাপারটা বুঝি কমই আছে আমার নানা পদের হিসাব কিতাবে!
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

পরিবর্তনশীল এর ছবি

মনডা কইছিল... কিছু একটা হবে... মনোপলি দেইখা। কিন্তু পইড়া দেখি আসলেই মনোপলি মন খারাপ

তয় দারুণ লাগল। বিশেষ করে শেষের প্যারাটা।

সেই কালচে আয়নার অন্য ছায়াটাই টানতে থাকে মানুষকে। গেম শেষ হয়ে গেলে বিষণ্ন লাগে, স্বস্তিও ফিরে পাই, মনে মনে ধন্যবাদ দিই কাকে যেন, সেই ছায়াটা সত্যি নয় বলে। তবুও মনে হয়, অনিচ্ছাসত্ত্বেও আরো ছায়াচ্ছন্ন কোন মোনোপোলির খেলায় ঢুকে পড়েছি জীবনে। নিস্তার নেই ওটার হাত থেকে, নিষ্কৃতি নেই, খেলা ছেড়ে উঠে যাবার উপায় নেই।

---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

কনফুসিয়াস এর ছবি

এইরকম উপলব্ধি মনে আসি আসি করে, জোর করে খেদিয়ে দিই- ভাগ শালা!
কিন্তু যত যাই করি, এই আজব দুনিয়ার মনোপলিতে যে ঠিকই ঢুকে বসে আছি, না চাইলেও সেটা টের পাই প্রতি মুহুর্তেই, আর মন খারাপ হয়ে যায়।

-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

আপনার লেখার ভঙ্গি অতি জীবন্ত! কলেজ ফার্স্ট ইয়ারে মনোপলি খেলতে গিয়ে শ্রীমঙ্গলের এক বাংলোতে বসে তিন বন্ধুর সঙ্গে চূড়ান্ত মারামারি হবার অবস্থা। এখন ভুলেও গেছি, কীভাবে খেলতে হয় এবং এখন ভেবে অবাক লাগে, কেন এই বন্ধুদের সাথে মারামারি করতে গিয়েছিলাম! এই খেলার নেশাটা আসলেই বিশেষ সুবিধাজনক না, কিন্তু জীবনকে ছেঁনে দেখার আরো একটা জিনিস... নিজের ভেতরের ক্রুঢ়তাকে নিজের চোখে দেখতে পাওয়া একটা বিশাল বড় ব্যাপার...

অনেক ধন্যবাদ এরকম চমৎকার একটা লেখার জন্য!

ৎৎৎৎৎৎৎৎৎৎৎৎৎৎৎৎৎৎৎৎৎৎৎ
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

জাহিদ হোসেন এর ছবি

মনোপলি খেলাটি প্রথম দেখি আশির দশকে আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে। তার কোন এক বন্ধু আমেরিকা থেকে তাকে এনে দিয়েছিল। আমি সে বাসায় গেলে তার ছেলেমেয়েরা আমাকে ধরে খেলতে বসায়। প্রথম দিনেই খেলাটি দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর বহুদিন সে বাসায় গেছি শুধু খেলাটির জন্যে।

প্রতিবারই খেলাটি ভাল করে খেয়াল করি, কেননা এই খেলাটি আমার চাইই চাই। ঢাকাতে বা অন্যকোথাও যেহেতু এই খেলা কিনতে পারা যাবে না, অতএব এই খেলাটি আমাকে বানাতে হবে।

কিছুদিন পর খুলনাতে চলে গেলাম ছুটিতে। সেখানে গিয়ে ছোট ভাইবোনদের বললাম যে আমি এক ভয়ানক মজার একটি খেলা বানাবো। আর্ট পেপার কিনে প্রথমে ছকটি আঁকলাম, সেখানে খোপ কেটে আঁকা হোল ঘরগুলো। আসল মনোপলির নামগুলো মনে ছিলনা বলে ইচ্ছামত নাম দিয়েছিলাম। অনেক দোকান ঘুরে ঘুরে রঙীন কাগজ কিনে বানানো হোল বিভিন্ন মানের টাকা। এখন গুটি বানাবো কি দিয়ে? শেষমেশ দাবার গুটি দিয়েই সে কাজটি সারলাম। বোড়েকে ধরা হোল বাড়ি হিসেবে, আর কিং-কুইনকে ধরা হোল হোটেল।

তারপর সবাইকে দিলাম খেলাটির উপর একটি ক্রাশ কোর্স। সবাই তো শুনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। এত নিয়ম-কানুন মেনে খেলতে হবে? তার চেয়ে সাপ-লুডুটাই কি সহজ ছিলনা?

কিন্তু একবার যখন খেলা শুরু হোল, তখন দেখা গেল ধুন্ধুমার অবস্থা। প্রতিদিন দুপুর বেলা ভাত-টাত খেয়ে আমরা খেলতে বসতাম। সেই খেলা চলতো প্রায় সন্ধ্যে অবধি। আমাদের আনন্দ দেখে পাশের বাড়ীর ছেলেপেলেরাও চলে আসতো। ভয়ানক মজার সময় ছিল।

আমার বানানো সেই বোর্ডটিতেই মনোপলি খেলেছি শুধু। বিদেশ থেকে প্রথম বার দেশে যাওয়ার সময় একটা আসল মনোপলি গেম নিয়ে গেছিলাম। কিন্তু সেটা খেলতে কেউই তেমন আগ্রহী হয়নি। সবাই বললো,"হাতে বানানো মনোপলিটাই বেশী ভাল ছিল।"

বাঙালীর চিরাচরিত উদ্ভট কথা!
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

অতিথি লেখক এর ছবি

মনোপলি খুব বেশি মনে ধরে নাই আমার, তবে দেখছি স্কুলে পড়ার সময় হাতে বানানো মোনোপোলি খেলতে যেয়ে বন্ধুদের ঝগড়া-ঝাটি হাসি

-
কৈলাশ

মূলত পাঠক এর ছবি

দারুণ লাগলো পড়ে।

ছোটোবেলায় দেশে খেলতাম, তার নাম ছিলো 'ব্যবসায়ী'। একই খেলা, শুধু নাম সব বাংলায় লেখা আর নামগুলো দেশের শহরের, কানপুর নাগপুর লক্ষ্নৌ এই সব। তখন বেশ নির্দোষ আনন্দের খেলা মনে হতো। বড়ো হয়ে মোনোপলি খেললাম মার্কিন মুলুকে এসে, এক ছোটো ভাইয়ের মতো ছেলেকে ঠিক ঐ রকম বদলে যেতে দেখলাম, হাতে অদৃশ্য ভোজালি অবধি। বেশ ঘাবড়ে গেসলাম! খেলায় আমি নেহাতই গরীব মানুষ, মঙ্গলার হাটে গামছা বেচি টাইপ, বাকিরা কেউ কেউ জিঘাংসু হয়ে গিয়ে অবধি খেলাটাকে বিশেষ সমঝে চলি।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

আহা হিম্ভাই, কতকিছু যে মনে করিয়ে দিলেন!
১২/১৪ বছর পর ধুম করে...মনে পড়ে গেল...আহা...!
____________________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ !

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।