দ্রব্যমূল্য, আলোচ্য প্রসঙ্গ, মহারথীদের চিন্তাভাবনা, আমরা আম-জনতা ইত্যাদি

নৈষাদ এর ছবি
লিখেছেন নৈষাদ (তারিখ: সোম, ২৪/০৮/২০০৯ - ৮:৩০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পণ্যের দাম বাড়ার ইস্যুটা সারা বছর ধরেই থাকে, রমাজানের মাসে শুধু চরম আকার ধারন করে এই আর কি। এবার অবশ্য এখন পর্যন্ত চরম অবস্থা দেখা যাচ্ছে না। একবার এক প্রতিষ্ঠিত মধ্যম সারির ব্যবসায়ীকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর ছিল, 'ঐ একটা মাসেই তো ভাই ব্যবসা করি'। তাই? তাহলে বাকী এগারো মাস কী করেন ভাই? এটাই হয়ত ব্যবসায়ীদের সামগ্রিক চিন্তাভাবনার একটা প্রতিফলন।

বর্তমান দ্রব্যমুলের ব্যপারে মহারথীদের চিন্তাভাবনার আগে ফিরে যাই ছাত্র জ়ীবনে শোনা একটা মন্তব্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের একজন অধ্যাপক পুঁজিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বিতর্ক ভরা খুবই উপভোগ্য একটা ক্লাশে চরম উন্নাসিক একটা কথা বলেছিলেন। বলে রাখা দরকার, তিনি আমেরিকাতে পড়েছেন, তাঁর পিতা দেশের প্রশাসনের সাথে জড়িত ছিল এবং তিনি নিজে ব্যবসা জগতের সাথে অনেকদিন থেকে জড়িত, এবং পুঁজিবাদের একজন গোঁড়া সমর্থক। তাঁর মুল বক্তব্যের সারমর্ম ছিল অর্থনীতির ব্যাপারে বাংলাদেশের আম জনতার সাথে আমেরিকার আম জনতার পার্থক্য।(বলে রাখা দরকার বিতর্কে ভরা সেই ক্লাশে তিনি কিছুটা উত্তেজিত ছিলেন, এটা তার রাগের কথাও হতে পারে।) তাঁর ভাষায় আমেরিকান সাধারন জনগন ব্যষ্টিক অর্থনীতি, আরও স্পেসিফিক ভাবে বললে নিজে যে সকল পণ্য ব্যবহার করে তার ব্যাপারেই মাথা ঘামায়। ব্যাপারটাতে হয়ত আত্মতুষ্টিই প্রাধান্য পায়, কিন্তু, তাঁর মতে এতে ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত হয়। অপর পক্ষে আমাদের দেশের সাধারন জনগন, তাঁর কথায় ম্যাক্র নিয়ে খুব বেশী ভাবে। যদিও ব্যাপারটাতে দেশ প্রেমের একটা যোগ আছে বলে মনে হয়, কিন্তু এর ফলে খুব সহজেই কায়েমি স্বার্থান্বেষীরা নিজ উদেশ্যসাধনে কাজে লাগাতে পারে। আপাত উন্নাসিক মন্তব্য মনে হলেও আমার ধারনা আমি এর কিছুটা বাস্তব প্রমান পেয়েছি। শ্রদ্ধা রেখে আমাদের সাবেক অর্থমন্ত্রীর দুইটা উদাহরণ দেই। এক সময় তিনি বলেছিলেন আমাদের আগের সরকার ম্যাক্র অর্থনীতির অনেক ক্ষতি করে গেছে। নিশ্চই এর সত্যতা ছিল। কিন্তু সেই কথায় আমরা আম-জনতা এমন ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম যে সরকারের পক্ষে অনেক কিছুই, তার মধ্যে পণ্যের দাম বাড়ার ব্যপারটাও জাস্টিফাই করার সুযোগ ছিল। আমার মনে আছে ম্যাক্র অর্থনীতির সম্ভাব্য ক্ষতির ব্যাপারে একমত হয়ে চায়ের টেবিলে ঝড় তোলা একজনের কাছে এর কয়েকটা ক্ষতিগ্রস্ত সুচক এবং এর সম্ভাব্য পরিণতির কথা জানতে চেয়েছিলাম। তিনি সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, 'আপনি কী বলতে চান?' তিনি কিন্তু কোন উত্তর দিতে পারেন নাই। আরেকটা উদাহরন ছিল কোন এক বাজেটে মদ জাতীয় পানীয়ের উপরে শুল্ক কমিয়ে দেওয়া। দেশে বিশাল হৈ চৈ শুরু হয়েছিল। আমার ধারনা মাননীয় অর্থমন্ত্রী ইচ্ছাকৃত ভাবেই আমাদের মত আম জনতার দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। আমার ভাবনা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে আমাদের উপর সহজেই প্রভাব বিস্তার করার বিষয়ে তার এই প্রজ্ঞার উপর শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে যাওয়া উচিত নয়কি? তবে কি আমি একটা ভোগ-বাদী, আত্মতুষ্টিই প্রাধান্য পায় এমন মানুষের সাফাই গাইছি। অবশ্যই না। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি অন্যের দাবার বোর্ডের বোড়ে না হওয়ার ব্যাপারটা।

ফিরে আসি বর্তমানে। সেদিন টেলিভিশনের একটা টক-শোর (রোড টু ডেমক্রেসি)কিছু কিছু অংশ দেখছিলাম (আমি সবটা দেখি নাই)। অতিথি ছিলেন ভোজ্যতেল মিল মালিক সমিতির সভাপতি রউফ চৌধুরী এবং সম্ভবত অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম। সেই পুরানো বিষয় - দ্রব্যমূল্য, এবং সেই পুরানো কথাই, নতুন কিছু নাই। জনাব চৌধুরী সিন্ডিকেটের ব্যাপারটা মানতে নারাজ। সাংবাদিক এবং জনাব ইসলাম সিন্ডিকেটের উপর দোষ দিচ্ছেন। আরেকটা ইস্যু এসছিল। জনাব চৌধুরী বললেন রমজান মাসে 'মিল থেকে' সরকারের বেধে দেয়া দামেই ভোজ্যতেল বিক্রী হবে (খেয়াল করুন ভোক্তার কাছে আসা পর্যন্ত দামের নিশ্চয়তা কিন্তু নাই)। রমজান মাসের পরে কী হবে, উপস্থাপকের এ ধরনের প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে গেলেন। গনমাধ্যমের ব্যাপারটাও আসল। করপোরেট কী তাদের কন্ট্রোল করে? তাহলে কী গনমাধ্যম সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দাড়াঁতে পারবে? উত্তর নেই। জনাব ইসলাম রেশনিং এর কথাও বলেছেন। তবে যে বিষয়টা আমাকে কিছুটা আশ্চার্যান্বিত এবং ব্যাথিত করেছে করেছে তা হল আইন বিষয়ক একটা ব্যাপার। জনাব ইসলাম আমেরিকাতে 'ফেয়ার প্রাইস' ধরনের একটা আইনের কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু জনাব চৌধুরী 'আপনি জানেন না' বলে এ ধরনের কোন আইনের অস্তিত্ব উড়িয়ে দিয়েছিলেন। ইন্টারনেটে এধরনের কোন আইন খোঁজে পেলাম না (ফেয়ার ট্রেড আইন আছে, যেটা মুলত ডাম্পিং রোধের জন্য ব্যবহৃত হয়।) কী বলতে চেয়েছিলেন জনাব ইসলাম? ব্যাপারটা তাঁর ব্যাখ্যা করা উচিত ছিল। অব্যাখ্যাত তাঁর এই কথায় তাঁর নিজের গ্রহনযোগ্যতাই কি ক্ষতিগ্রস্থ হল না?

কাল টেলিভিশনের খবরে দেখলাম অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত কয়েকটি পণ্যের দাম বাড়ার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। সিন্ডিকেটের ব্যাপারটাও বলেছেন, তবে এ ব্যাপারে তার কথায় আন্তরিক ভাবেই হতাশার সুর ছিল। সিন্ডিকেট কন্ট্রোল করা কী সরকারের ক্ষমতার বাইরে? তিনি ভোক্তাদের ক্ষোভ এবং দ্রোহের কথাও বলেছেন।

বানিজ্য মন্ত্রী টিসিবির কথা বললেন।টিসিবিকে আবার চালু করা একটা ভাল পদক্ষেপ, এখন চলতে পারলেই হল। মাননীয় মন্ত্রী এথিক্সের কথাও বললেন। আসলে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে এথিক্সের কথা শুনলে আমার কেন জানি হাসি পায়। খাদ্য পণ্যের সাথে মুনাফার জন্য বিষ মেশাতেও যেখানে যে কোন সারির ব্যবসায়ীর বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হয় না, সেখানে সামান্য দ্রব্যমূল্য নামক ব্যাপারটাতে দ্বিধার কথা চিন্তা করাতো হাস্যকরই।

সিন্ডিকেট নামক শক্তিশালী অথচ অদৃশ্য বস্তুটি আমার কাছে কৌতুহলোদ্দীপক মনে হয়। কেউ বলে আছে, কেউ বলে নেই। আমরা আম জনতা ধন্দে থাকি, শুধু পকেট থেকে টাকা চলে যায়। সরকারও এর কাছে নস্যি। অবশ্য আমাদের শক্তিশালী সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্ভবত হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল - সিন্ডিকেট কী জিনিস। তবে সব কিছুর মত এরও একটা ভাল দিক আছে। ট্রাফিক জ্যামের মত, দেড়ি হলেই যত দোষ নন্দ ঘোষ।

বিশ্বব্যাপি অর্থনৈতিক মন্দার জন্য বিদেশে দাম বাড়ার ব্যাপারটা এবার আনা যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের কিছু কিছু প্রকৃ্ত কারনের সাথে 'জার্মানীর কোলন শহরে কাঁচা লংকার দাম বেড়েছে বলে কারওয়ান বাজারে দাম তিন গুন হয়েছে' - এধরনের ব্যাখ্যা এবার ধোপে টিকবে না। মাজার ব্যাপার হল, আমাকে বছরের শুরুতে বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতির কিছু উপাত্ত পাশ্চাত্যের একটি দেশে পাঠাতে হত। (সে আরেক কাহিনী, বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক এবং Consumer Association of Bangladesh এর উপাত্তে ব্যাপক পার্থক্য, ব্যাখ্যা করতে করতে...।)। এ বছরের প্রথমে জানতে চাওয়া হল বিস্ফীতকরণের (deflation) সম্ভাবনা কত শতাংশ? বাংলাদেশে?? অর্থনীতির পাঠ নিয়ে যান আমাদের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে।

সেই বিখ্যাত কালো টাকার কোন প্রভাব থাকে কি পণ্যের দাম বাড়ার ব্যাপারে? আমার বিশ্বাস থাকে, তবে আম জনতার নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের উপর হয়ত এর প্রভাব কম। কালো-সাদা বিতর্কের সময় কিছু লোক একটা হাস্যকর যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করেছে - কালো টাকা নাকি অর্থনীতিতে আসে না। অবশ্যই আসে, ভোগ্যপণ্যে। আসলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার খারাপ দিকে ভোগ্যপণ্য কেনার ব্যাপারে যে প্রণোদনার ব্যবস্থা আছে তার সাথে, অথবা বিজ্ঞাপন-নিয়ন্ত্রিত জীবনের সাথে কালো টাকা ব্যবহারের একটা মারাত্মক সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায়।

যাক এসব কথা। মাননীয় অর্থমন্ত্রী ভোক্তাদের ক্ষোভ এবং দ্রোহের কথা বলেছেন, অধ্যাপক সাহেব বলেছেন ভোক্তার অধিকারের কথা। তার কী হবে? হয়ত সমাধান এখান থেকেই আসবে। (আমি দ্রোহের পজিটিভ দ্যোতনাই ব্যবহার করছি)। আশার কথা প্রশাসনের লোকজন সমস্যা স্বীকার করে নিচ্ছে এবং পদক্ষেপও নিচ্ছে। আশার কথা ভোগ-বাদীতা গ্রাস করেছে ছোট্ট একটা অংশকে, আবার অন্যের দাবার বোর্ডের বোড়ের সংখ্যাও নিতান্তই কম। আশায় আছি একদিন শক্তিশালী একটা ভোক্তার সমিতি গড়ে উঠবে। সবশেষে আছে আমাদের আশার শেষ আশ্রয়, আম-জনতার ভোট। ম্যাক্র নিয়ে ভাবিত আম জনতাই হয়ত এসবের সমাধান দিবে।


মন্তব্য

রিয়াজ উদ্দীন এর ছবি

সুমন ভাই খুব দরকারি লেখা দিয়েছেন।
প্রথমে সিন্ডিকেটের কথা বলছিঃ

  • সিন্ডিকেট আছে কি নাই সেটা উপাত্ত ছাড়া বলা কঠিন। তবে সিন্ডিকেট যদি থাকেও সরকারের সেটা ভাঙ্গার চেষ্টা করার কোন দরকার আছে বলে মনে করিনা। অন্তত সরাসরি তো নয়ই। বরং যারা সিন্ডিকেট করতে পারে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার পরিবেশ ঠিক আছে কিনা লক্ষ্য রাখাই যথেষ্ট।
  • তবে সিন্ডিকেট আছে কিনা প্রশ্নের উত্তরে একটা তথ্য হয়ত দেয়া যেতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার জান-প্রাণদিয়ে চেষ্টা করছিলেন সিন্ডিকেট থামাতে কিন্তু যতই চেষ্টা করছিলেন ততই মূল্যস্ফিতি বেড়ে যাচ্ছিল। কারন কি?
  • দ্রব্যমূল্য জোর করে তেমন নিয়ন্ত্রন করা যায়না। সেই চেষ্টা করা হলে যোগান কমে যায় এবং দাম অনেক ক্ষেত্রে বেড়েই যায়। সেটাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুঝতে পারছিলেন না কেন আমার মাথায় ঢোকেনি। তাদের পরিষদে আমার জানামতে বাজার অর্থনীতির আচরনের সাথে পরিচিত একাধিক অর্থনীতিবিদ ছিলেন। তবে আমার মনে হয় তাহারা সেনাবাহিনির জ্ঞানের চাপে হয়ত কাবু হয়ে ছিলেন।
  • নির্বাচিত সরকার আসার পর দ্রব্যমূল্যের দাম যখন আপনা থেকেই কমে আসল অনেকে ভাবলেন বঙ্গবন্ধু কন্যার সাফল্য আবার অনেক গবেষনা প্রতিষ্ঠান ভাবল তাদের সাজেশন নিয়েই এটা করা গেল।
  • কাজেই দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রন তেমন কাজে আসবে না। তা সে রোজার মাসে হোক আর যে সময়ই হোক।
পারলে আবার বিস্তারিত আলোচনা করব আপাতত এখানে থামছি।

নৈষাদ এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ রিয়াজ উদ্দীন ভাই। সিন্ডিকেট ভাঙ্গা না, তবে কন্ট্রোলের ব্যাপারে ভুমিকা থাকা দরকার মনে করি। বিস্তারিত পরে লিখব। ধন্যবাদ।

রিয়াজ উদ্দীন এর ছবি

যেসব দ্রব্যেমূল্যে সমস্যা সেগুলোর বাজার কাঠামো বিশ্লেষন করা দরকার। এসব দৃষ্টিভঙ্গীতে বাংলাদেশে গবেষনা তেমন হয়না বলেই মনে হয়। যা হোক বাজার কাঠামোর কথা বলছিলাম। যেমন ভোজ্য তেলের কথা ধরুন। এখানে বিক্রেতা, আমদানিকারক, বিপননকারিদের সংখ্যাগত কাঠামোটি দেখা দরকার। অর্থাৎ সিন্ডিকেট তখনি সম্ভব যখন অল্পকিছু ব্যক্তি এইসব কাজে যুক্ত থাকে (Oligopolistic structure)। সেক্ষেত্রে নানা ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে মূল্য নিয়ন্ত্রন না করেও। সরাসরি মূল্য নিয়ন্ত্রন বাজারে ব্যবসায়ীদের প্রবেশ এবং প্রতিযোগীতাকে বাঁধাগ্রস্ত করে ফলে মূল্য নিয়ন্ত্রন টেকসই হয় না। আর সিন্ডিকেটের সম্ভাবনাকে আরো জোরদার করা হয়। এটা একটা দুষ্টচক্র। বাজারের ক্রিয়াকলাপ বিশ্লেষন না করে নিয়ন্ত্রনের ছড়ি দিয়ে দ্রব্যমূল্যকে বাগ মানান সম্ভব নয়। অন্ততঃ দীর্ঘমেয়াদে তো নয়ই।

ব্যপারটা বরং এমন যে এটাকে যত নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করা হবে এটা ততই বাড়তে থাকবে। হাসি

রেজওয়ান এর ছবি

দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধিতে আমাদের দেশের জনগণেরও কিছুটা হাত আছে। আমাদের দেশে বাজার দর ওত দ্রুত উঠানামা করে যে ট্র্যাক রাখা মুশকিল। আপনারা যারা বাজার করেন তারা পাড়ার মুদি দোকান আর বাজারের বড় মুদি দোকানের দামের পার্থক্য নিশ্চয়ই জানেন। এখন এ ক্ষেত্রে আমাদের ক্রয় অভ্যাসটি সাধারণত: কি হয়? আমরা আমাদের সুবিধামত (বাড়ির কাছের) জায়গা থেকেই কিনে থাকি। ধরুন তেলের দাম ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা হয়ে গেল এবং এই দাম কেউ চাইল। আপনি কিন্তু প্রথমে দু একটি গালি দিলেন তারপর সেই পাড়ার মুদি দোকান থেকেই বেশী দামে কিনলেন। কিন্তু কষ্ট করে ১০ মিনিট হেটে আপনি বাজারের বড় মুদি দোকানে দামটা যাচাই করলেন না। আপনি বেশী দাম দিয়ে কেনার ফলে দোকানদার ওই দামটি প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পেল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে দামটি কি সত্যিই বেড়েছে? ছোট মুদি দোকানে নিশ্চয়ই স্টক পুরোনো ছিল কিন্তু সে হয়ত দাম বাড়ার তথ্যটি হাতে পেয়ে দাম বাড়িয়ে আপনাকে বোকা বানিয়ে দিল। এতে ক্ষতি কার হল? যার ২০টি টাকা বেশী দিলে মাসের খরচে কুলোবে না তাদেরই। আপনার হয়ত তেমন গায়ে লাগল না।

এখানে তথ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই ইন্টারনেট ও মোবাইল কমিউনিকেশনের যুগে একটি কেন্দ্রীয় কনজিউমার সাইট থাকা উচিত যেখানে প্রতিদিনকার মূল্য যাচাই করার সুযোগ থাকবে। এবং বিভিন্ন বাজার থেকে মোবাইলের মাধ্যমে তথ্য সন্নিবেশিত ও আপডেট করার সুযোগ থাকবে। তাহলে যেটা হবে যে ধরুণ ওয়েবসাইটে দেখা গেল যে (এটি অন্য মাধ্যম দ্বারাও প্রচার করা যেতে পারে) কারওয়ান বাজারে তেলের দাম ১৩৫ টাকা এবং হাতিরপুল বাজারে ১৪৫ টাকা। তাহলে হয়ত আপনি বেশী পরিমাণ তেল কিনতে কারওয়ান বাজারেই চলে যাবেন। ফলে বেশী দাম যারা হাকবে তাদের পণ্যের চাহিদা কম হওয়ায় বা বিক্রি না হওয়ায় তার মূল্যও কমাতে বাধ্য হবে।

আমি ভারতীয় একটি এনজিওর কথা জানি যারা কৃষকদের ও ভোক্তাদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার জন্যে মধ্যস্বত্বভোগীদের নির্মূল করার উদ্যোগ নিয়েছিল। তাদের অস্ত্র ছিল পরিবহন ও গ্রামে গ্রামে একটি করে অফিস। সেই অফিস থেকে কৃষকরা মোবাইল ফোনে জেলার বড় বাজারের ক্রেতাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে অর্ডার নিত এবং স্বল্প মূল্যে সমষ্টিগত এই পরিবহনের ট্রাক সরাসরি জেলার ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিত। ফলে কৃষকরা ন্যায্য দাম পেত এবং জেলার ক্রেতারা দালাল দের টাকা না দিতে হওয়ায় কম দামে কিনে ভোক্তাদের কাছে কম দামে বিক্রি করতে পারত।

সেরকম উদ্যোগ আমাদের দেশে কই। আমাদের এত এনজিও ওরা কি করে?

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

নৈষাদ এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধিতে আমাদের দেশের জনগণেরও ভুমিকার ব্যাপারে সহমত। জনগণ কখনো কখনো প্যানিক সৃষ্টি করেও দাম বাড়ায়। আমার এই লেখাটা বিস্তারিত, এবং ভাবনা চিন্তা করে লেখা না - আংশিক ভাবনা। ভাল থাকুন।

রিয়াজ উদ্দীন এর ছবি

আপনারা যারা বাজার করেন তারা পাড়ার মুদি দোকান আর বাজারের বড় মুদি দোকানের দামের পার্থক্য নিশ্চয়ই জানেন। এখন এ ক্ষেত্রে আমাদের ক্রয় অভ্যাসটি সাধারণত: কি হয়? আমরা আমাদের সুবিধামত (বাড়ির কাছের) জায়গা থেকেই কিনে থাকি। ধরুন তেলের দাম ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা হয়ে গেল এবং এই দাম কেউ চাইল। আপনি কিন্তু প্রথমে দু একটি গালি দিলেন তারপর সেই পাড়ার মুদি দোকান থেকেই বেশী দামে কিনলেন। কিন্তু কষ্ট করে ১০ মিনিট হেটে আপনি বাজারের বড় মুদি দোকানে দামটা যাচাই করলেন না। আপনি বেশী দাম দিয়ে কেনার ফলে দোকানদার ওই দামটি প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পেল।

আপনার ব্যখা ঠিক আছে। তবে এটা একটা সার্বজনীন ব্যপার। একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত আয় কাঠামো এক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা রাখে। আর্থাৎ এইযে দশ মিনিট (কখনও তারচেয়েও বেশি) হেটে বড় দোকানে যাবে এটার একটা সুযোগ মূল্য (Opportunity Cost) রয়েছে। একটু ব্যখ্যা করার দরকার বোধহয়ঃ

ধরুন আপনি ঠিক করলেন আপনি দাম যাচাই করে দেখবেন। এখন ১০+১০=২০ মিনিট সময় ব্যয় করে আপনি যে বাজারে যাবেন তখন দাম যে ১২০ টাকাই হবে সেটার কোন নিশ্চয়তা নেই। নিশ্চিত থাকলে অন্য কথা ছিল। কিন্তু না থাকলে বিপদ।

আর এই যে ২০ মিনিট সময় এবং শক্তি খরচ করলেন তারো একটা সুযোগ মূল্য আছে। এটাকে যদি অন্যকাজে ব্যয় করেন তাহলে সেটা থেকে আপনি যে উপযোগ পেতেন তা হয়ত যা সাশ্রয় হত তার চেয়ে বেশি।

একারনেই যাদের আয় বেশি তারা বাজারে বেশি সময় ব্যয় করে দাম-দর যাচাই করতে চায়না। আবার বেশি আয়ের লোকেরা হয়ত বাজার করার জন্য আলাদা লোক রাখে। এই রকম সময়ের পিছনে দৌড়ান একটা শ্রেনী আমাদের সমাজে গড়ে উঠেছে বলেই এখন বড়-বড় সব ডিপার্টমেন্টাল স্টোর গড়ে উঠছে।

কাজেই মুদির দোকানদার এইযে বেশি দামটুকু রাখছে এটা আপনার আয়ের ওপরও নির্ভর করবে। এই হিসাবে ধরে নিলে উচ্চ আয়ের এলাকার মুদির দোকানদার নিম্ন আয়ের এলাকার দোকান দারের চেয়ে বেশি আয় করে। এই ব্যপারটা ট্রিকল ডাউন এফেক্ট এর একটা উদাহরন।

সমুদ্র এর ছবি

আমদানি করা পণ্যের কথা বাদ দিচ্ছি। দেশি পণ্যগুলো কৃষক এর হাত থেকে ঢাকায় আমজনতার কাছে পৌঁছানোর যে দীর্ঘ এবং ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা, সেইটাকে ঠিক করার উদ্যোগ নেয়া হয় না কেন সেইটাই আমার কাছে বড় প্রশ্ন মনে হয়।

"Life happens while we are busy planning it"

নৈষাদ এর ছবি

সহমত। বার বার দৃষ্টি আকর্ষন করা হলেও কিছুই হয়নি।

দুর্দান্ত এর ছবি

আবারো একটি সুচিন্তিত লেখা দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

আমার মতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, অন্তত খাদ্যের দাম কম রাখার একমাত্র উপায় ছোট কৃষকের হাতকে শক্ত করা। লক্ষ করুন, দেশের শুল্ক কাঠামো যতটা শুল্ক আয় রক্ষায় পটু, ততটা স্থানীয় উতপাদন বৃদ্ধির সহায়ক নয়। এক্ষেত্রে সার নির্ভর উফশী বীজের ওপর নিচু করের পাশাপাশি পশুখাদ্যোপযোগী শস্যের ওপর উচ্চ করের কথা বলা যায়। কৃষক যদি ভাল দাম পায় তাহলে সে উতপাদন বাড়াবে।

আরেকটা সমস্যা হল আমাদের খাদ্য আমদানীর সময়। ঠিক যে সময়ে দেশের চাল ডাল পিয়াজ বাজারে আসবে, ঠিক সে সময়ই সরকারে অবিবেচনায় আমদানিকৃত বিদেশী চাল ডাল পিয়াজ এ বাজার সয়লাব হয়। এতে বাজারে দাম ঠিক এমন সময়টাতেই কমে যায়, যখন দেশী কৃষকের গাইটে দুটো পয়সা আসার কথা। এই পয়সাটা পেলে পরের মরশুমে সে তার উতপাদন বাড়ানোতে উদ্যোগী হয়।

আমেরিকার উদাহরনটি (মোমেনের নাকি বগির বক্তব্য?) র বাস্তবতার প্রমান পাই ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রেও। সিন্ডিকেট যদি আর কোথাও থাকে তাহল তা আছে এখানেই। কারা এই সিন্ডিকেটের সদস্য? বিডিআর এর ঘটনার আগেরদিন মানে ২০ তারিখের সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেশের বানিজ্যমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে যে ১২ জন ব্যাবসায়ীর দরবার হয়, সেই ব্যাবসায়ীদের তালিকা দেখলে কিছুটা ধারনা হতে পারে। বলবার অপেক্ষা রাখেনা, যে বিডিআর এর ডাল-ভাত অপারেশন বন্ধ হয়ে যাবার পর ঐ ফাকা জায়গাটি ভরতে টি সি বি এর ইন্ডেন্ট কারা পাবেন এটা ওখানা আলাপ হয়েছিল। দুষ্ট জনে প্রশ্ন করতে পারে পারে যে বিডি আরের ঘটনার আগেই ডাল-ভাত অপারেশন বন্ধের পর কি ঘটবে তার আলোচনা কেন? সেটা এখানে আলোচ্য নয়। লিন্ক দেবার ইচ্ছা ছিল, কিন্ত ১৯-২২ তারিখের সমকাল, যেখানে খবরটি পড়েছিলাম, সেটা আর আর্কাইভে নেই।

নৈষাদ এর ছবি

মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। আমেরিকার উদাহরনটি বগির (রাইটলি স্পটেড)।
আমার এই লেখাটা বিস্তারিত ভাবনা চিন্তা করে লেখা না - আংশিক ভাবনা। কিছুই পরিস্কার ভাবে বলতে চাইনি। আরও অনেক ব্যাপার আছে।

আপনার সাথে কখনো তেল গ্যাস বিষয়ে কথা বলবার ইচ্ছে আছে।

ভাল থাকুন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।