১৯৭৬-এ খুনিদের প্রত্যাবর্তন, তোয়াবের মিশন এবং সমন্বয়ের রাজনৈতিক দর্শণ।

নৈষাদ এর ছবি
লিখেছেন নৈষাদ (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৩/০১/২০১৯ - ৮:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের পরপরই অন্য দুই বাহিনী প্রধানের সাথে তখনকার বিমান বাহিনীর প্রধান এ কে খন্দকার খুনিদের সামনে নতজানু হলেও বেশিদিন নিজের পদ ধরে রাখতে পারেননি।

আগস্টের ২৪ তারিখে জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়, আর সেপ্টেম্বরেই জার্মানী থেকে নিয়ে আসা হয় অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন এম জি তোয়াবকে। একই সাথে দু’টি প্রমোশন দিয়ে করা হয় সক্রিয় এয়ার ভাইস মার্শাল, বানানো হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান।

পাকিস্তানে ‘সিরাত-ই-জুরাত’ খেতাবপ্রাপ্ত তোয়াব পাকিস্তানের এয়ারফোর্স কমান্ডার হিসাবে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে পাকিস্তান এয়ারফোর্সে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তারপর তিয়াত্তরে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন এবং জার্মান প্রবাসী হওয়া।

কর্নেল শাফায়েত জামিল তার বইতে জানাচ্ছেন, খুনি কর্নেল রশিদ জার্মানী গিয়েছিল তোয়াবকে আনতে। উইকি বলছে মেজর ডালিম গিয়েছিল। ডালিম-রশিদ এখানে গুরুত্বপূর্ণ না, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের আগেই তোয়াবকে পরিকল্পানায় অন্তর্ভুক্ত করার সম্ভ্যাব্য আভাস পাওয়া যায় অন্য সূত্রে।

পাকিস্তানের জনৈক অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আয়াজ আহমেদ খান ১৯৯৯ সালে তোয়াবের মৃত্যুর পর একটি আবেগঘন ‘শোকবার্তা’ লিখেন, যেখান সেই সম্ভ্যাব্য গুরুত্বপূর্ন সূত্র দেন। তোয়াব ১৯৭৩ সালে জার্মানীতে প্রবাসী হওয়ার পর সেখানে একটি সংস্থায় ‘টেস্ট পাইলট’ হিসাবে যোগদান করেন। আয়াজ খান তোয়াবের ‘বিমান চালনার পারদর্শিতা’ বুঝাতে গিয়ে ১৯৭৫ সালে জুলাইয়ের একটা ব্যক্তিগত ঘটনা তুলে ধরেন, যেখানে তোয়াব মেঘাছন্ন আকাশে আয়াজকে বিমানের পারদর্শিতা দেখিয়েছিল। সময়টা খেয়াল করতে হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের আগের মাসে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সক্রিয় এক উচ্চ-পদস্থ কর্মকর্তা (আয়াজ আহমেদ খান) জার্মানীতে তোয়াবের সাথে ছিল। ঘটনা-পরম্পরা বিশ্লেষণে এটাকে কাকতালীয় ভাবার কোন কারণ নেই।

তোয়াবের পাকিস্তান-যোগসূত্র এবং দেশে তার কর্মমান্ডের ব্যাপারে বিস্তারিত হাসান মোরশেদের এই লেখাটায় পাওয়া যাবে। http://www.sachalayatan.com/hasan_murshed/8870


সেই সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত আরেকজনের ‘ক্রেডেন্সিয়্যাল’ জানাও গুরুত্বপূর্ণ। নভেম্বরের পনেরো তারিখে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ পদ, ফরেন সেক্রেটারি হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয় তবারক হোসেনকে। তিনি ১৯৭৮ এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই পদে ছিলেন এবং বিদেশি দূতাবাস গুলির সাথে যোগাযোগে এবং বৈদেশিক কূটনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন।

পেশায় কূটনীতিক এবং পাকিস্তানে ‘সিতারা-ই-খিদমত’ খেতাবপ্রাপ্ত তবারক মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় পাকিস্তানে বিশ্বস্ততার সাথে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। যদিও একাত্তরের আগস্ট মাসে আলজিরিয়ার পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত পদ পাওয়ার পরেও তাকে সেখানে পাঠানো হয় নাই, তবে তবারক জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে একাত্তরের নভেম্বরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্যের দেন-দরবারে চিনে যে দলটি গিয়েছিল, সেই দলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। এই ভুমিকাটুকু তার দায়িত্ব পালনের ‘বিশ্বস্ততার’ ব্যাপারে পাঠককে একটা ধারণা দিতে পারে।

পরে জিয়ার আমলে অল্প সময়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এবং নব্বই পরবর্তী সরকারের সময় অল্প সময়ের জন্য বিজিআইসির গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। ২০০২ তে গ্রামীণ ব্যাঙ্কে গুরত্বপূর্ণ পদে যোগ দেন এবং চেয়ারম্যান হিসাবে ২০১০ সাল পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন। তার মৃত্যুর পর ইউনূস সেন্টারের মুখপাত্র লামিয়া মোরশেদ বিডিনিউজ২৪-কে বলেন, “তিনি গ্রামীণ ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান এবং মুহাম্মদ ইউনূসের ‘প্রিয় বন্ধু’ ছিলেন”। (সূত্র বিডিনিউজ২৪ – ২ মে ২০১৮)

অবশ্য, পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে প্রচুর পাকিস্তান পন্থী সিভিল-মিলিটারি আমলাদের পুনর্বাসিত করা হয়। এমনকি পাকিস্তান পন্থী সিভিল-মিলিটারি আমলাদের নিয়ে ‘কাউন্সিল অভ অ্যাডভাইজারস’ গঠন করা হয়। (উদাঃ শফিউল আজম, [প্রাক্তন ইস্ট পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি], যিনি পঁচাত্তর পূর্ববর্তী সময়ে বরখাস্ত হয়েছিলেন, জিয়ার আমলে আবার নিয়োগ পান)। তবে তবারক প্রাথমিক ভাবে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করেন।


যদিও পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে পররাষ্ট্র নীতির মূল উদ্যেশ্য ছিল ‘ইসলামিক দেশ’ গুলির সাথে ভ্রাতৃত্ব উন্নয়ন, তবারক ডিসেম্বরেই ভারত এবং সোভিয়েট ইউনিয়ন ভ্রমন করেন। ভারতে তার সফর নিয়ে তেমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে সোভিয়েট রাশিয়া ভ্রমনের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের কাছে ‘ডি-ব্রিফিং’ করতে হয় যার বিবরন বোস্টার স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠান। সেখানে তেমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়না। তবে, সোভিয়েট রশিয়া যে ‘চরম ডান এবং চরম বাম (চীনপন্থী)’ নিয়ে কিছুটা শংকিত সেটা বুঝা যায়।

আবার সোভিয়েট রাশিয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত টোসেল রাশিয়ার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ফাইরুবিনের (FIRYUBIN) সাথে দেখা করে স্টেট ডিপার্টমেন্টে বিস্তারিত বিবরন পাঠান। এত বিস্তারিত আলোচনা করলাম না। তবে, সোভিয়েট রশিয়ার ব্যবহার করা কয়েকটা ‘শব্দ’ পাঠকের বুঝার জন্য তুলে ধরা হল। যেমনঃ মুজিব হত্যাকান্ডে ‘বাইরের হাত’ এবং ‘তৃতীয় পক্ষ’। ভবিষ্যতে কী হতে পারে এর উত্তরে, “রাশিয়া কোন প্রফেট নয়” কিংবা “অনলি গড নোজ”।


ফিরে আসি তোয়াবের কথায়। পঁচাত্তরের শেষদিকে অথবা পরের বছরের শুরুর দিনে তোয়াব ‘পারিবারিক কাজের’ ছুতায় জার্মান গিয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারীর ৪ তারিখ ত্রিপোলি (লিবিয়া) থেকে স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানো লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রবার্ট চার্লির একটা তারবার্তা (1976TRIPOL00003_b) বেশ কৌতূহলোদ্দীপক।

জানুয়ারীর ২ তারিখে (ছিয়াত্তর) বাংলাদেশ দূতাবাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ‘জমির’ মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ‘জরুরী আলোচনার’ জন্য বাসায় আসতে আমন্ত্রণ করেন। রাষ্ট্রদূত সেখানে নিয়ে তোয়াবের দেখা পান। তোয়াব জানান তিনি ঢাকা থেকে জার্মানী হয়ে আগের দিন ‘গোপনে’ ত্রিপোলি এসেছেন।
তোয়াব প্রথমে বলেন তিনি পুরানো বন্ধু জমিরের সাথে দেখা করতে এবং ‘Boys’ (অর্থাৎ নির্বাসিত খূনী মেজরদের) দের অবস্থা জানতে এখানে এসেছেন। বিস্তারিত বিবরণে তোয়াবের বৈঠকের মূল কারণ জানা যায়।

তোয়াব মার্কিন অর্থনৈতিক এবং মানবিক সাহায্যের জন্য রাষ্ট্রদূতকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। ‘রাজনৈতিক স্থিতাবস্থার’ উপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি মার্কিন ‘পরিমিত সামরিক সাহায্যের’ জন্য আবেদন করেন। ‘রুশ-ভারত’ হস্তক্ষেপের থেকে বাংলাদেশকে রক্ষাকরে স্থিতাবাস্থার জন্য এর বিকল্প নেই সেটা নিশ্চিত করতে চান। এই ‘পরিমিত সামরিক সাহায্যের’ স্বরূপ অবশ্য জানা যায় না।

তোয়াব এই বৈঠকের গোপণীয়তার ব্যাপারে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ করেন। তিনি নিশ্চিত করেন এই ব্যাপারটা শুধুমাত্র প্রেসিডেন্ট, সামরিক এবং নৌ-বাহিনীর প্রধানই জানেন।

তোয়াব নিশ্চিত করেন যে তিনি জার্মানীতে কয়েকদিন থাকবেন, এর পরে দূতাবাসের কর্মকর্তা জমির জানে কিভাবে তার সাথে যোগাযোগ করা যাবে। তিনি এই ব্যাপারটাকে এগিয়ে নিতে যেকোন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমনের পরিকল্পনার কথা নিশ্চিত করেন।

রবার্ট চার্লির অবশ্য ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিংবা ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে এ আলোচনা না করে লিবিয়াতে তার সাথে গোপণ আলোচনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন। তোয়াব জানান, ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে আলোচনা করলে ‘রুশ-ভারতের’ কাছে খবর চলে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। এদিকে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতও বিশ্বাসভাজন নয়। (ব্যাপারটা বোধগম্য, যুক্তরাষ্ট্রে তখনকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন আওয়ামী লিগের কর্মী এবং প্রাক্তন মন্ত্রী এম, আর সিদ্দিকী)।

রবার্ট চার্লি অবশ্য তারবার্তায় তার সমাপনী বক্তব্যে কূটনীতিকসুলভ একটা ‘ইঙ্গিতপূর্ণ’ মন্তব্য করেন। তিনি লিখেন, “ত্রিপোলি এমন একটা জায়গা, যেখানে কেউ শুধুমাত্র বাংলাদেশি কিংবা মার্কিন লোকজনের সাথেই না - পাকিস্তান, এবং সর্বোপরি লিবিয়ার লোকজনের সাথেও আলোচনা করতে পারে’। এই ‘ইঙ্গিতপূর্ণ’ মন্তব্য ধারনা করা যায় তোয়াব পাকিস্তানি এবং লিবিয়ানদের সাথেও কোন ব্যাপারে আলোচনা করেছিলেন।

ছিয়াত্তরের ১৭ মার্চ তারিখে পাঠানো বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের তারবার্তায় (1976DACCA01369_b) তোয়াবের ১৮ মার্চ তারিখে দশদিনের বিদেশ সফরের পরিকল্পনার ক্থা জানা যায়। বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার কে, এম হারুন-উর-রশিদ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে এব্যাপারে অবহিত করেন।
বিস্তারিত বিবরনে জানা যায়, তিনি প্রথমে যাবেন যুক্তরাজ্যে। সেখানে ‘কাজ শেষ’ করে যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন। তবে হারুন-উর-রশিদ অনুরোধ করেন এ ব্যাপারটা যেন স্টেট-ডিপার্টমেন্ট কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের দূতাবাসকে না জানানো হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী যথাসময়ে যুক্তরাজ্যের দূতাবাস আমেরিকাকে এ-ব্যাপারে জানাবে।

অবশ্য এর পরপরই, এপ্রিলের শেষের দিকে (ছিয়াত্তর) তোয়াব তার পদ থেকে ইস্তেফা দিয়ে জার্মানী প্রত্যাবর্তন করেন।


কর্নেল হামিদের বইতে (এবং অন্যান্য বইতেও) জানা যায় ১৯৭৬ এর মার্চে প্রথমে কর্নেল রশিদ, এবং পরে ফারুক এসে ঢাকায় উপস্থিত হয়। ফারুক ঢাকায় আসলে সাভারে অবস্থিত ফার্স্ট ক্যাভালরির (পূর্বতন ফারুকের অধিনের বেঙ্গল ল্যান্সারের একাংশ) সৈন্যরা তাকে বরণ করে। (পূর্বতন বেঙ্গল ল্যান্সারের আরেক অংশকে ১৪টি ট্যাংক সহ বগুড়া পাঠানো হয়)। পরে ফারুককে বগুড়ায় পাঠানো হয়।

তবে কূটনৈতিক বিভিন্ন তারবার্তায় দেখা যায় রশিদ, ফারুক এবং ডালিম তিনজনই ছিয়াত্তরের প্রথমার্ধে ঢাকা এসেছিল।

তিনজনকেই অবশ্য সে বছরের প্রথমার্ধেই দেশ ছাড়তে হয়। কর্নেল রশিদ এবং মেজর ডালিম প্রথমে দেশ ছাড়েন। রশিদ ব্যাংকক হয়ে লিবায় চলে যান। ডালিম যান যুক্তরাজ্যে। (যুক্তরাজ্যের এই ভূমিকাটা বেশ - তার প্রাক্তন কলোনির সব খুনি, চোর-বাটপারদের অভায়ারণ্য করে রেখেছে।)

আরেক কুশলীব হেনরি কিসিঞ্জারের তারবার্তায় রশিদের বরাতে কিছু কিছু গুরত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। রশিদ যখন দেশ ছাড়েন তখনও তিনি তোয়াবের ইস্তেফা দেবার খবর জানতেন না। তবে রশিদ যুক্তরাষ্ট্রকে বলেন এই খবরে তিনি মোটেও আশ্চর্য্য হননি।

কিসিঞ্জারের তারবার্তায় আরও জানা যায়, রশিদ বাংলাদেশে ১০ দিন অবস্থানকালে জিয়া-তোয়াব-এম, এইচ খান সহ উচ্চপদস্থ সামরিক কর্তাদের সাথে দেখা করেন। তার মূল উদ্যেশ্য ছিল নির্বাসিত খুনিদের দেশ ফিরিয়ে আনা।

কিসিঞ্জারের বার্তায় জিয়া-তোয়াবের দ্বন্দ্বের মূল কারণও বুঝা যায়। তোয়াবের দর্শণ ছিল সরাসরি – বাংলাদেশকে ইসালামিক রিপাবলিক ঘোষণা, অন্যান্য ইসলামিক দেশগুলির সাথে যুক্ত হওয়া, এবং সরাসরি ভারত-বিদ্বেষী দর্শণ গ্রহন করা। জিয়া এর সরাসরি সমর্থক ছিলেন না। তাছাড়া তোয়াব খুনি মেজরদের সরাসরি সাপোর্ট করছিলেন, জিয়া তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার সমস্যাটা বুঝতে পারছিলেন। রশিদের বক্তব্যে জানা যায়, জিয়া যে ‘থিম’ নিয়ে ৭ নভেম্বরে ক্ষমতায় এসেছিলেন (ভারত-বিদ্বেষ), তা থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছেন। রশিদ-জিয়ার সাক্ষাতে জিয়া এমনও বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ সবসময় ভারত-বিদ্বেষী হয়ে টিকে থাকতে পারবে না’।

এটাও পরিষ্কার, খুনিদের সহায়তায় জিয়া ক্ষমতায় আসলেও আন্তিমে ফারুক-রশিদ জিয়াকে বিশ্বাসঘাতক হিসাবেই ধরে নেয় (খুনিদের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দিলেও )। একই ভাবে জাসদও জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারটা ১৯৭৬এই বুঝতে পারে।


কোন কোন পাঠকের হঠাৎ করে মনে হতে পারে, “জিয়া কি তবে ভারত-বিদ্বেষ কিংবা ইসলামিক স্টেটের থিম থেকে সরে এসেছিলেন”? মোটেই না, এর বিশ্লেষণ করা যাবে। তবে তিনি যে পরষ্পর বিরোধী মতাদর্শ সমন্বয়ের যে অদ্ভুত রাজনৈতিক দর্শণের সূচনা করেছিলেন, বিএনপি আজও তার লিগ্যাসি বহন করে চলেছে। (মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি কিন্তু জামায়তে ইসলামিকে ছাড়া যাবে না)।

এই অদ্ভুত রাজনৈতিক দর্শনের জন্য তাকে অন্তিমে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। ১৯৮১ সালে, তার মৃত্যুর মাত্র দুই মাস আগে দ্য নিউ নেশন পত্রিকা তাকে নিয়ে একটা বাক্য লিখেছিল, পাঠকের সুবিধার্থে সরাসরি ইংরেজিতে তুলে ধরলাম, “ He (Zid) is a prisoner of his own mixed-up, cross-bed political system and of the various vested intents which have been created during past few years. … so what is in the store for us in the coming months?”


জিয়ার কল্যাণে তার আমলের শুরুর দিক থেকেই পাকিস্তান-পন্থী সিভিল-মিলিটারি আমলাদের আধপত্য শুরু হয়। অ্যান্ডারসন বলেছেন, “জিয়ার শাসন আমল মূলত আইউব খানের ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ স্টেটের’ পূনরুত্থান। তিনি আরও বলেছেন, “ There was a striking resemblance between Bangladesh after 1975 coups and East Pakistan before its collapse in 1971” [Robert S Anderson, Pacific Affairs, 1976]।

তবে শেষের দিকে তিনি সিভিল-মিলিটারি আমলাদের আধপত্য থেকে সরে আসতে শুরু করেছিলেন… কিন্তু, সেই যে prisoner of his own mixed-up, cross-bed political system।

একই ভাবে স্বাধীনতার সপক্ষের লোকজনকে সরিয়ে পাকিস্তান-পন্থীদের ক্ষমতায়ন শুরু হয়। অনেক উদাহরণ দেয়া সম্ভব, শুধু একটা উদাহরণ দেয়া যায়। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মোট ৫০ জন মেজর জেনারেল এবং ব্রিগেডিয়ারের মধ্য মাত্র ২ জন ছিল যারা ৭১এ সরাসরি যুদ্ধ করেছিল। (Marcas Franda: Ziaur Rahman and Bangladesh Nationalism]

ছিয়াত্তর ১লা মে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জিয়াউর রহমানের ভাষণ ছিল বড় সমাবেশে সরাসরি ভাষণ দেয়ার প্রথম প্রচেষ্টা (এর আগে ছিল শুধু টেলিভিশনে কিংবা ছোট জনসভায় ভাষণের অভিজ্ঞতা)। এর আগে রেডিও-টেলিভিশনে নিজেকে ‘সৈনিক’ বলে দাবী করেছিলেন। ১লা মে নিজেকে বললেন ‘শ্রমিক’। সেখান প্রদত্ত ভাষণের মূল ‘থিম-গুলি’ ছিল ঃ

১। ভারত-বিদ্বেষী দেশ-বাঁচাও থিম - ‘দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন, এর রক্ষার জন্য জনগনের একতা প্রয়োজন’। ভারত-বিদ্বেষী এই বক্তব্যে ভারতের ব্যাপারে সরাসরি কোন অভিযোগ ছিল না। ‘ভেইগ-টার্মে’ ফারাক্কা ইস্যুও এসেছিল।
২। পূর্বতন সরকারের গীবত।
৩। ‘ধর্ম-নিরপেক্ষতা আসলে ধর্ম-হীনতা নয়’ – আগের সরকারের আমলে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কেউই ধর্ম পালন করতে পারে নাই।

তার আগেই, ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর Bangladesh Collaborators (Special Tribunal) Order 1972, যা কিনা Collaborators Act, 1972 নামেই পরিচিত, যার মাধ্যমে যুদ্ধপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তা বাতিল করা হয় (যদিও তখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন আবু-সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, ডি-ফ্যাক্টো সর্বময় ক্ষমতার অধিকারি ছিলেন জিয়াউর রহমান)। উন্মুক্ত করে দেন ধর্মাশ্রয়ী দলগুলোর রাজনীতি করা সুযোগ।

জিয়াউর রহমানের দেশকে উল্টোপথে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া ছিল সূক্ষ এবং তা ছিল পরষ্পর বিরোধী মতাদর্শ সমন্বয়ের সেই অদ্ভুত রাজনৈতিক দর্শণের মধ্যমে। পাঠক সংবিধানের পরিবর্তন গুলি লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন।

এই প্রক্রিয়ার বিস্তারিত লেখা যাবে অন্য কোন দিন। তবে পাঠকের সুবিধার্থে সেই সূক্ষ পরিবর্তনের শুরুটা বুঝার জন্য ডান-পন্থী বুদ্ধিজীবি আমেনা মোহসিনের আর্টিক্যাল, “Religion, Politics and Security: The Case of Bangladesh” থেকে সরাসরি কয়েকটা লাইন তুলে দিলাম ...। স্থূল পরিবর্তন গুলি নিয়ে আলাপ করা যাবে পরে।

“With the change of regime (that is after 15 August 1975), nationalism in Bangladesh also took an explicit turn toward religion. The coup leaders obviously wanted to capitalize on the existing public mood, which was increasingly enthusiastic about the adoption of Islamic values. The coup leaders therefore used Islam to secure—and to a certain extent legitimize—their position. It is therefore not surprising that the coup of August 1975 was declared in the name of the “Islamic Republic of Bangladesh.”

“ … Bangladeshi nationalism, as it evolved in 1975, was in essence a reassertion of Muslim identity for Bengalis in Bangladesh. Accordingly, changes were brought about in the mass media, the education sector and the constitution to expedite and legalize the process of this new construction. The change was first apparent in the mass media. Simultaneous recitals on radio and television from the holy books of different religions continued as before, but the time allotted to the reading from the Holy Quran (the Holy Book of the Muslims) increased from five minutes to fifteen minutes. While no religious citation had been made at the closing of the programs during the Mujib regime, the programs now closed with recitations from the Quran only. Moreover, quotations from the Quran and the Hadith (the Prophetic Tradition) were now frequently broadcast between programs. Education too acquired an Islamic orientation. Islamiat was introduced to class I to VIII as a compulsory paper for Muslim students only and from class IX to X as an elective subject. Islamic ideals were also incorporated into the constitution...”.


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

আয়াজ-তোয়াব অধ্যায়টা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর শীর্ষভাগকে ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে পাকিস্তানের প্রস্তুতির দিকে ইঙ্গিত করে।

দীনদয়াল গরিবনেওয়াজ ইউনূস আঙ্কেলের বন্ধুগুলো যেন কেমন কেমন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে লিবিয়ার ভূমিকা কি শুধু খুনী মেজরদের আশ্রয়দানেই সীমাবদ্ধ, নাকি আরো বেশি কিছু?

নৈষাদ এর ছবি

আয়াজের ব্যাপাটা এরকমই মনে হয়েছে। এই লোক কিন্তু এই উপমহাদেশের বিমান বাহিনীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদমর্যাদার আধিকারী।

পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক বাহিনীর পরিবর্তনগুলি খোঁজে বের করার চেষ্টা করছি। এইযে, স্বাধীনতা যুদ্ধে কোন সংশ্লিষ্টতা ছাড়া একজনকে বিমান বাহিনীর প্রধান করে দেয়া হল, সামরিক বাহিনীতে কোন রিপার্কাশনও বুঝা গেল না। শাফায়ত জামিলের বই অনুসারে তোয়াব এই সময়ের মধ্যেই গোপণ মিশনে পাকিস্তান এবং লিবিয়া গিয়েছিল। তোয়াবের পাকিস্তান ভ্রমনের কোন বিবরন পাওয়া গেল না।

পঁচাত্তরের আগে এবং পরে পাকিস্তান এবং যুক্তরাজ্যে বৈঠক হয়েছে এমন ধারনা করি, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন প্রমান পাইনি (খুনিদের যুক্তরাজ্যে অথবা তখনকার ব্রিটিশ কলোনি হংকঙ্গে পাঠানোর আলোচনা হয়েছিল)। লিবিয়ার সংশ্লিষ্টতাও বুঝতে চেষ্টা করছি। খুনিদের লিবিয়া পাঠানোর সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতটা বুঝতে পারলে লিবিয়ার সংশ্লিষ্টার ব্যাপারে বুঝা যাবে।

এক লহমা এর ছবি

দরকারী লেখা।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নৈষাদ এর ছবি

ধন্যবাদ।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

১। যত দূর জানি, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসার পর তোয়াব যখন পশ্চিম জার্মানী চলে যান তখন তিনি সেখানে ন্যাটো'র বিমান বাহিনীতে 'ডেমোনেস্ট্রেটর' ধরনের পদে যোগ দেন। আয়াজকে পাকিস্তান বিমান বাহিনী থেকে ন্যাটোতে প্রশিক্ষণের জন্য পশ্চিম জার্মানী পাঠানো হয়েছিল। এই বিষয়গুলো কাকতালীয় নয়। অন্তত তোয়াবের বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে প্রবল প্রত্যাবর্তন ও রাজনৈতিক তৎপরতা তার সাক্ষ্য দেয়।

২। সামরিক-বেসামরিক আমলাদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় পাকিস্তান সরকারের 'মোস্ট ওবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট' হিসাবে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী পুনর্গঠনের ডামাডোলে তাদের অনেকে নিঃশব্দে বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রে ঢুকে পড়েছেন। বাকিরা ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে প্রবল প্রতাপে ফিরে এসেছেন। যুদ্ধাপরাধ প্রসঙ্গে এদের নাম আলোচিত হয় না। এদের বিচার করার প্রসঙ্গও আলোচিত হয় না। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তীকালে এইসব 'দক্ষ' আমলাদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করে সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের বসালে দেশের ইতিহাস অন্য রকম হতে পারতো। এই ব্যাপারে ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন। বাকিটা ইতিহাস।

৩। সম্ভব হলে টোসেলের বিবরণ নিয়ে পরে আলাদা পোস্ট দিন। এই বিবরণ বিস্তারিত জানতে ইচ্ছুক।

৪। আপনার লেখা পড়ে 'লিবিয়া' ব্যাপারটা একটা ভিন্ন মাত্রায় হাজির হলো। এই ব্যাপারে পড়াশোনা করতে হবে দেখছি। ঠাণ্ডা যুদ্ধ, 'Anni di piombo', 'সাওরাত আল-আহ্‌দার' ইত্যাদির প্রভাবে মুয়াম্মারের চিন্তাভাবনা প্যান-আফ্রিকানিজমের সীমা ছাড়িয়ে আরও দূর প্রসারিত হয়েছিল কিনা খুঁজতে হবে।

৫। ১৯৭৬-এর এপ্রিলের ক্যু নিয়ে আমার অল্পস্বল্প পড়া আছে। পরে সুযোগ হলে এই ব্যাপারে পোস্ট দেবো। এই ঘটনায় উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে তোয়াবকে সাইজ করা হয়েছিল।

৬। ১৯৭৯-৮০ সালের দিকে জিয়াপন্থী লোকজনের হাতে বাংলায় অনুদিত কিম ইল সুঙ-এর রচনাবলী দেখেছি। 'আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র' ধরনের কথাবার্তা হতো। অন্যদের কেউ কেউ আবার 'ধর্ম-কর্ম-সমাজতন্ত্র'র কথা বলতেন। খুব শীঘ্রই সেগুলো কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। জেনারেল জিয়ার ক্রমাগত সার্বিক অবস্থান পরিবর্তনের কারণ সম্ভবত নিরাপত্তাহীনতা, অবিশ্বাস ও আদর্শ সম্পর্কে অস্পষ্টতা।

৭। জেনারেল জিয়ার আমলে রাজনৈতিকভাবে সবচে' ক্ষতিগ্রস্থ দলটির নাম আওয়ামী লীগ। কিন্তু আওয়ামী লীগ ১৯৮১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত জেনারেল জিয়ার গোটা আমলকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে তার প্রকৃত ইমেজটি সাধারণ্যে প্রতিষ্ঠিত পারেনি। ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রয়াত জেনারেল জিয়া এক বিশাল ইমেজ হিসাবে আবির্ভূত হয়ে আজও প্রবল প্রতাপে টিকে আছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নৈষাদ এর ছবি

১। তোয়াবের পশ্চিম জার্মানীর কাজ নিয়ে বিভিন্ন ভারসান পাচ্ছি। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে কৌতূহলোদ্দীপক মনে হয়েছ। আরও জানার চেষ্টা থাকবে।

২। পাকিস্তানের ‘খিদমতের সিতারা’ সামরিক-বেসামরিক আমলাদের পূনর্বাসন, এবং একাত্তর পরবর্তী আমলা-অ্যাকাডেমিকদের সাইডলাইন করে দেয়ার প্রক্রিয়া ভালভাবেই চলছিল। আরও জানার চেষ্টা থাকবে। আপনার সাত নম্বর পয়েন্টা গুরুত্বপূর্ণ। এই মূহূর্তে হাতের কাছে বই নেই, জিয়াউর রহমানের ‘কাউন্সিল অভ অ্যাডভাইজারে কাজী আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে যেকয়জনে পূনর্বাসন করা হয়েছিল, অন্তর্জাল খোঁজে কোথাও পেলাম না।

৩। চেষ্টা থাকবে।

৪। ১৯৭৫ পরবর্তী লিবিয়াতে কিন্তু অনেক কিছু হয়েছে – জানতে চেষ্টা করব। (যমন খুনিদের দ্বারা পরিচালিত ট্রেনিং সেন্টার, সবুজ বইয়ের অনুবাদ, টাকা-পয়সার লেনদেন ইত্যাদি।)

৫। এপ্রিলের ক্যু নিয়ে পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।

৬। এসব নিয়ে লেখা পাওয়াই যায়না।

“জেনারেল জিয়ার ক্রমাগত সার্বিক অবস্থান পরিবর্তনের কারণ সম্ভবত নিরাপত্তাহীনতা, অবিশ্বাস ও আদর্শ সম্পর্কে অস্পষ্টতা” – এ ব্যাপারটা অনেকের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। জিয়া হত্যার সময় চট্টগ্রামের ডিসির লেখা বইতে রাজনৈতিক নেতাদের ‘তাচ্ছিল্য’ করার প্রচুর প্রমান পাওয়া যায়। আবার শেষের দিকে সিভিল-মিলিটারি আমলাদের থেকে ‘পলিটিক্যাল লিডারদের দিকে’ ধীরে অবস্থান পরিবর্তনের কারণে সিভিল-মিলিটারি আমলাদের পক্ষ থেকেও অবিশ্বাসের আভাস পাওয়া যায়।

৭। একদম ঠিক। পঁচাত্তর পূর্ববর্তী ‘ইমেজ’ দারুনভাবে ‘কনস্ট্রাক্ট করা হয়েছে’ । কিন্তু পরবর্তী সার্বিক ইতিহাস অনেকটাই ‘মিথের’ উপর দাঁড়ানো।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

২। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস আলোচনায় কাজী আনোয়ারুল হক একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। কিন্তু কখনোই তার প্রসঙ্গ আলোচনায় আসে না। আন্তর্জাল দূরে থাক শক্ত বইপত্রের দুনিয়াতেও কাজী আনোয়ারুল হক কর্তৃক পুনর্বাসিত আমলাকূলের নামের তালিকা পাওয়া যায় না। আমি এটা নিয়ে ২০১৬-১৭ সালে কিছু দৌড়ঝাঁপ করেও কিছু পাইনি। পাকিস্তান থেকে আগত অনেক সামরিক লোককেও সিভিল প্রশাসনে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল।

৪। আমার প্রশ্ন হচ্ছে খুনী মেজরকুলের সাথে কর্নেল মুয়াম্মারের বন্ধুত্বের সূচনা হলো কী করে? তাছাড়া সুদূর বাংলাদেশের ব্যাপারে লিবিয়ার এতো মাথাব্যথা হলোই বা কী করে! সবুজ বইয়ের বঙ্গানুবাদ কার করা সেটা নিয়েও নাকি এক রহস্য আছে। খুনী মেজরকুলের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন ও রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসনের কৃতিত্ব জেনারেল এরশাদের। তার অনুগ্রহে পিপলস ফ্রিডম পার্টি গঠন, ১৯৮৬'র রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ফারুক-হুদার দাঁড়ানো, ১৯৮৮'র সংসদ নির্বাচনে হুদা আর রশীদের ভাইয়ের এমপি হওয়া - সব সম্ভব হয়েছে। বিনা লাভে এরশাদ এসব করার কথা না। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, খুনীদের বিদেশে পুনর্বাসনের দায়ে জেনারেল জিয়ার প্রাপ্য সমালোচনা করা হলেও তাদেরকে বাংলাদেশে এনে পুনর্বাসন ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠার দায়ে জেনারেল এরশাদের কোন সমালোচনা করা হয় না।

৫। এপ্রিলের ক্যু নিয়ে খুব বেশি কিছু লেখার উপায় নেই। কারণ, তথ্যের অভাব। আমি চেষ্টাচরিত্র করেও খুব বেশি জানতে পারিনি। বিভিন্ন বইয়ে যে ছিটেফোঁটা তথ্য পাওয়া যায় সেগুলোর উৎস সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। এমন হাওয়াই গল্প নিয়ে পোস্ট দেয়া কঠিন।

৬। বাম হঠকারীদের মধ্যে সামরিক শাসকদের প্রতি ভালোবাসা পুরনো ব্যাপার। অমন ভালোবাসা থেকে অনেক বাম জেনারেল জিয়ার পক্ষ্মপুটে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের আশা ছিল আফ্রিকান জেনারেলদের মতো জিয়াও লাল পতাকা ওড়াবেন। এসব কারণে ইউপিপি, জাগমুই, সাম্যবাদী দল ইত্যাদিরা জিয়ার কাছাকাছি এসেছিল। কিন্তু পাকমনপিয়ারুদের প্রবল স্রোতে বামরা আর হালে পানি পায়নি।

সব জেনারেলই ক্ষমতা দখলের সময় রাজনীতিবিদদের আদ্যশ্রাদ্ধ করেন, কিন্তু দেশ চালাতে গিয়ে অচিরেই তাদেরকে রাজনীতিবিদদের দ্বারস্থ হতে হয়। এবং তখন আগের আমলের থেকে আরও নীচ রাজনীতিবিদরা ক্ষমতাকেন্দ্রে চলে আসে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নৈষাদ এর ছবি

২। কোন একটা বইতে পড়েছিলাম ১৯ জন প্রাক্তন আমলাকে নিয়ে কাউন্সিল অভ অ্যাডভাইজার করা হয়েছিল (নাম সহ ছিল), যার প্রধান ছিলেন কাজী আনোয়ারুল হক। কোন ভাবেই মনে করতে পারছি না... ।

কাজী আনোয়ারুল হক কিছুটা পাজল... পিতা কাজী ইমদাদুল হক প্রগতিশীল লেখালেখি করতেন (পড়িনি যদিও)। শুদ্ধস্বর কাজী ইমদাদুল হকের রচনাবলী নিয়ে একটা বইও প্রকাশ করেছিল, মূখবন্ধ লিখেছিলেন গান্ধীবাদী আবুল মকসুদ। কাজী আনোয়ারুল হক, নিভৃত জীবনযাপন করতেন এবং ‘আন্ডার থ্রি ফ্লেগস’ নামে ঢাউস একটা আত্মজীবনী লিখেন। খুব অল্প সংখ্যক কপি ছাপা হয়েছিল ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে। আমার কাছে এক কপি ছিল (অথবা এখনও সিলেটে বইয়ের স্তুপে পাওয়া যাবে হয়ত।) তেমন কোন গুরুত্বপূর্ন তথ্য নেই, অনেক আগে পড়া স্মৃতি থেকে বলছি - কিংবা বইটার ব্রিটিশ চ্যাপ্টারগুলিই বেশি মনোযোগ দিয়েছিলাম? ( কিন্তু বইটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারত)। বাংলাদেশে অবস্থানরত দুই পুত্রকে কখনই ‘রাজনৈতিক আলাপে’ এনগেজ করা যায়নি, এমনকি পিতার বইয়ের ব্যাপারেও কোন কথা বলতে চায়নি কখনও।

আগের লেখার আপনার মন্তব্য থেকে জিয়াউর রহমানের সাথে ‘জনতা পার্টির’ যোগাযোগের একটা হিন্টস পেয়েছিলাম, বিশেষকরে কাদের সিদ্দিকী এবং জিয়াউদ্দিনের বিদ্রোহ দমনের ব্যাপারে। জনতা পার্টির যোগাযোগের ব্যাপারটা নিয়ে পড়ার চেষ্টা করছি।

Emran  এর ছবি

পিতা কাজী ইমদাদুল হক প্রগতিশীল লেখালেখি করতেন

ইনি কি আবদুল্লাহ উপন্যাসের রচয়িতা কাজী ইমদাদুল হক?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

হ্যাঁ, ইনিই 'আবদুল্লাহ্‌'র জনক কাজী ইমদাদুল হক


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

'কাউন্সিল অভ অ্যাডভাইজার'-এর কথা মনে পড়ছে না। তবে আমি বলতে চেয়েছি কাজী সাহেবের তত্ত্বাবধানে বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানপন্থীকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এদের কেউ কেউ তার আগে চাকুরীচ্যুতও হয়েছিলেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নৈষাদ এর ছবি

'কাউন্সিল অভ অ্যাডভাইজার' নিশ্চিতভাবেই করা হয়েছিল, যার কনভেনর ছিলেন হক সাহেব। উনি ছিলেন মোর অভ আ 'এলিট', ধর্মের ধারে কাছেও ছিলেন না।

মুস্তাফিজ এর ছবি

তোয়াব এর বউ ছিলো জার্মান বংশদ্ভুত।

...........................
Every Picture Tells a Story

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।