জাপানের দিনগুলি - ময়লা ফেলা

শামীম এর ছবি
লিখেছেন শামীম (তারিখ: রবি, ৩০/০৯/২০০৭ - ৮:৪৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জাপানে আসার আগে থেকেই একটা ব্যাপারে এম্বেসি থেকে বলে দিয়েছিলো, সেটা হলো ময়লা ফেলার নিয়মকানুনের ব্যাপারে জেনে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা। কারণ জাপানের প্রায় সব শহরেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে ময়লা ফেলার কিছু নির্দিষ্ট নিয়মকানুন রয়েছে যা অবশ্যই পালন করতে হবে, তা না হলে ক্ষেত্র বিশেষে জরিমানার সম্মুখীন হতে হয়। তাই শুরুতেই গিয়ে ঐ ব্যাপারে জানতে আগ্রহী হয়েছিলাম। কিন্তু উঠেছিলাম আন্তর্জাতিক ডর্মিটরিতে যেখানে ময়লা ফেলার সময় সম্পর্কে তেমন কোন বাধ্য বাধকতা ছিল না। তবে ময়লা বেছে প্রকারভেদ অনুযায়ী ফেলতে হত। পরবর্তীতে যখন ডর্মিটরি ছেড়ে ভাড়া বাসায় উঠলাম তখন ময়লা ফেলার জন্যও নির্দিষ্ট সময়ের বাধ্যবাধকতা ছিলো। বেছে প্রকারভেদ অনুযায়ী ময়লা ফেলার ব্যাপারটা আমার জন্য অন্য যে কোন নবাগতের (এমনকি অনেক জাপানির চেয়েও) সহজ ছিল কারণ এ বিষয়েই আমি লেখাপড়া করেছিলাম।

ময়লার প্রকারভেদটা বললে পুরা ব্যাপারটা আরও সহজবোধ্য হবে। প্রকারভেদ: দহনযোগ্য (burnable), অদহনযোগ্য (non burnable), প্লাস্টিক/পলিথিন (plastic), পূণর্ব্যবহারযোগ্য (Recyclable), কাঁচ ও ধাতব পাতওয়ালা (bottles and cans), পেটবোতল (PET bottles), কাগজ (newspaper), হার্ডবোর্ড (cartoon), অতিরিক্ত বড় ময়লা (oversized) ইত্যাদি। প্রতি প্রকারভেদ ময়লা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট প্রকারের ব্যাগ আছে যা এলাকার দোকানে পাওয়া যায়।

দহনযোগ্য ময়লা হচ্ছে সমস্ত পচনশীল বস্তু। রান্নাঘরের যাবতীয় উচ্ছিষ্ট, গাছপালার ডাল/পাতা, ঘাস, ছোট ছেড়া কাগজ, চামড়ার ছোট বস্তু, জুতা, স্যান্ডেল, ছোট কাপড়ের টুকরা ইত্যাদি সবই এই প্রকারভেদের মধ্যে পড়ে। ঐতিহাসিকভাবে এই ধরণের ময়লাগুলোকে বর্জ্যভূমিতে (landfill) বা সহজ ভাষায় মাটিতে গর্ত করে তাতে ফেলা হত। কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক বছরের মধ্যেই এগুলো পচে নিরাপদ মাটিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। কিন্তু প্রচলিত এই পদ্ধতিতে পচনকালে কিছু গ্রীনহাউজ গ্যাস (মিথেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড) উৎপন্ন হয়। অপরপক্ষে এই ময়লাগুলোকে পুড়িয়ে ফেললে এথেকে উৎপন্ন ছাইয়ের পরিমান/আয়তন মূল আবর্জনার প্রায় এক দশমাংশে কমে আসে। ফলে ঐ ছাই নিষ্কাশনের ফলে বর্জ্যভূমিতে চাপ কম পড়ে আর এগুলো সেখানে পরিবর্তিত হয়ে নিরাপদ মাটিতে পরিবর্তনের সময় তেমন ক্ষতিকারক গ্যাসও উৎপন্ন হয় না। সর্বোপরি ময়লা পুড়ানোর ফলে উৎপন্ন তাপ ব্যবহার করে বিদ্যূৎ উৎপন্ন করা হয়।

পলিথিন ও প্লাস্টিক জাতীয় বস্তুগুলো পুড়ালে এ থেকে ক্ষতিকারক কিছু ক্ষতিকারক গ্যাস উৎপন্ন হয় (ডাই-অক্সিন) যা মারাত্নক বায়ু দূষণ করতে পারে। তাছাড়া এগুলো সহজে পচনশীল দ্রব্য নয়। তাই মাটিতে বা বর্জ্যভূমিতে ফেললেও এগুলো সহজে নিরাপদ মাটিতে পরিনত হবে না বরং জমা হয়ে থাকবে। তাই প্লাস্টিক বা পলিথিন বস্তুগুলোকে আলাদাভাবে সংগ্রহ করে পূণরায় ব্যবহারোপযোগী করে তোলা হয়। এই বস্তুগুলোর মধ্যে শপিং করে প্রাপ্ত পলিথিন ব্যাগ, যে কোন পলিথিন জাতীয় প্যাকেট/দ্রব্য, প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থে তৈরী যে কোন বোতল (তেল, শ্যাম্পু ইত্যাদি) বা বস্তু এজাতীয় পদার্থের মধ্যে অন্তর্গত। নির্দেশাবলী আছে যে, যে কোন প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ ফেলার আগে সেগুলো ভাল করে ধুয়ে তাপপর ফেলতে হবে। যে কোন বস্তু কিনলেই সেটার গায়ে ওটা কোন জাতীয় ময়লা সেটা লেখা থাকে।

বিভিন্ন ছোট ধাতব পদার্থ, যেমন কোল্ড ড্রিংকসের ক্যান, টিনজাত খাবারের ক্যান এবং কাঁচের বোতল ইত্যাদি আলাদাভাবে ফেলতে হয়। তবে ফেলার সময়ে এগুলোর গায়ে কোন লেবেল লাগানো থাকলে সেগুলো তুলে ফেলতে হয়। লেবেলগুলো সাধারণত প্লাস্টিক বা দহনশীল হিসেবে ফেলতে হয়। বোতলের মুখগুলো ধাতব না হলে সাধারণত প্লাস্টিক হিসেবে ফেলতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন কোল্ড ড্রিংকসের বোতলগুলো সাধারণত PET বোতল হিসেবে আলাদা ভাবে ফেলতে হয়। বোতলগুলোর লেবেলে সেটা PET বোতল কি না সেটা লেখা থাকে। বোতলগুলো ঐ প্রকৃতির হলেও বোতলের ক্যাপ/মুখগুলো কিন্তু প্লাস্টিক ময়লার সাথে ফেলতে হয়। আর বোতলের লেবেলগুলোও ছিড়ে আলাদাভাবে ফেলতে হয় - প্লাস্টিক বা দহনযোগ্য হিসেবে।

জাপানে প্রায় প্রতিদিনই প্রচুর কাগজ (বিজ্ঞাপন) ময়লা হিসেবে আসে (ময়লা: যেহেতু ওতে কী লেখা আছে তা আমি পড়তে পারি না!)। এছাড়া পত্রিকা, টেলিফোন ইনডেক্স বই ইত্যাদি পূণর্ব্যবহারযোগ্য হিসেবে আলাদা ভাবে ফেলতে হয়। সম্ভবত ওগুলো থেকে আবার মণ্ড প্রস্তুত করে কাগজ উৎপন্ন করা হয়, কারণ বেশ কিছু বস্তুর প্যাকেটে লেখা দেখেছি যে এটা পূণর্ব্যবহারযোগ্য কাগজে তৈরী (made by recycled paper)। এছাড়া কাগজের তৈরী দুধ অথবা পানীয় জুসের প্যাকেটগুলোকেও আলাদা ভাবে নির্দিষ্ট আকারে কেটে তারপর একসাথে বেঁধে ফেলতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন বস্তুর হার্ডবোর্ড প্যাকেট বা কার্টনগুলোকে ভাঁজ করে আলাদাভাবে নির্দিষ্ট দিনে ফেলতে হয়।

সাধারণত প্লাস্টিক ও অন্য পূণর্ব্যবহারযোগ্য ময়লা বাদে অপচনশীল দ্রব্যগুলোকে অদহনযোগ্য বলা হয়। অদহনযোগ্য ময়লা যেমন: সিরামিকের থালাবাটি, ধাতব হাড়িপাতিল, ছুরি, চামুচ ইত্যাদি।

এছাড়া এক মিটারের চেয়ে বড় কোন বস্তু ফেলতে হলে ওগুলোকে বড় ময়লা হিসেবে আলাদাভাবে ফেলতে হয়। কারণ ময়লা সংগ্রহের গাড়ির কম্প্রেসরে ওটা আঁটবে না বলে ঐ গাড়িতে ওটা নেয়া যাবে না। এগুলো ফেলার জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম আছে, তাছাড়া নির্দিষ্ট দিনও আছে যখন ট্রাক এসে এগুলো নিয়ে যাবে। আর নির্দিষ্ট দিনের বদলে অন্য সময়ে ফেলতে চাইলে ফোন করে ময়লা সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানে খবর দিতে হবে।

এ্যাত কিছু দেখে কেন এই ময়লা বাছাই - মনে এই প্রশ্ন আসাটা খুবই স্বাভাবিক। এর পেছনে কারণ হল ময়লা ব্যবস্থাপনা। ... ... এটা খুব ভালভাবে বুঝতে হলে ময়লাগুলো শেষ পর্যন্ত কিভাবে বর্জ্যভূমি বা অন্যকোথাও ফেলা হয় সেটা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা জরুরী। আমার সীমিত জ্ঞান থেকে যেটা বুঝি যে দহনশীল বস্তুগুলোকে ময়লা পুড়ানোর চুল্লীতে নিয়ে যাওয়া হয়। অন্যগুলোকে ভিন্নভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয়। প্লাস্টিক বা কাগজগুলোকে অন্য বস্তুর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত করার জন্য সরাসরি কোন প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। ময়লা সব একত্রে ফেললে সেই ময়লা থেকে বেছে ওসব আলাদা করা খুবই কঠিন এবং প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। কারণ অন্য পূণর্ব্যবহারোপযোগী ময়লাগুলোও নোংরা হয়ে যাবে এবং ব্যবহারোপযোগীতা হারাবে। তাই ময়লা প্রক্রিয়াজতকরণ কেন্দ্রের বদলে সমস্ত জনগন এই প্রক্রিয়াতে কিছুটা অংশগ্রহন করে পরিবেশ উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখছেন।

ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট সময়সূচীর কারণও পরিবশে সুন্দর রাখা। সাধারণত সপ্তাহে দুই দিন দহনযোগ্য ময়লা সংগ্রহ করার ট্রাক আসে। ময়লাগুলো সব নির্দিষ্ট ব্যাগে ফেলা হয় বলে ওখান থেকে কোনরকম রস বা কিছু বের হয়ে আশেপাশে বা ডাস্টবিনকে নোংরা করতে পারে না। ট্রাক আসার নির্দিষ্ট সময়ের ৩/৪ ঘন্টা আগে থেকে ময়লা ফেলতে হয়। আরো আগে ফেললে কাক বা বিড়াল জাতীয় প্রাণী এসে ওগুলো হাচড়িয়ে ব্যাগ ছিড়ে ময়লা চারপাশে ছড়িয়ে ফেলবে ফলে চারপাশটা সহজে পরিষ্কার রাখা যাবে না।

আরেকটা ব্যাপার আমাকে অবাক করেছে। বছরের নির্দিষ্ট কয়েকটা দিনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা থেকে সবচেয়ে নিচু পদে কর্মরত সকলেই বাইরে এসে চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা ময়লা পরিষ্কার করেন। সকলের হাতে থাকে একটা বড় পলিথিন ব্যাগ আর একটা বড় ধাতব চিমটা। পড়ে থাকা কাগজের টুকরা, সিগারেটের মাথা, বোতল, চকলেটের মোড়ক ... যাই থাকুক না কেন ওগুলো ওনারা তুলে পরিষ্কার করে ফেলেন আর নির্দিষ্ট ময়লা ফেলার জায়গায় ফেলে দিয়ে আসেন। আমি যেই এপার্টমেন্টে থাকতাম ওখানেও একইভাবে প্রতিমাসের প্রথম রবিবারের সকালে আধাঘন্টা কিংবা একঘন্টা চারপাশ পরিষ্কার করতাম সকলে মিলে। আশেপাশের প্রতিবাসা থেকে একজন করে প্রতিনিধি আসতো। এতে যেমন সকলের সাথে দেখা হত তেমনি পরিষ্কার করার পরে মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠতো।

আমি অবাক হয়েছি ময়লা ব্যবস্থাপনার এরকম চমৎকার ব্যবস্থা দেখে। মাঝে মাঝে ময়লা বাছাবাছি করতে বিরক্ত লাগলেও সামগ্রিক পরিবেশের জন্য যে এটা কত উপকারী সেটা ভেবে বিমোহিত হয়েছি। পরিচ্ছন্ন আর চমৎকার জাপান গড়ার পেছনে এরকমভাবে ১‌৩কোটি হাত অনবরত ময়লা পরিষ্কার করে যাচ্ছে -- তাইতো জাপান এ্যাত সুন্দর। বাংলাদেশকে কি আমরা অত সুন্দর করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করতে পারি না?


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।