বর্ণবাদ

ইফতেখার চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন ইফতেখার চৌধুরী (তারিখ: শুক্র, ২৭/০৭/২০০৭ - ১০:৪১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রেসিস্ট এর বাংলা বর্ণবাদ হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম সবসময়ই। কিন্তু সত্যিকারের রঙমহলে এসে শব্দটার ব্যপকতা নিয়ে আমার মনে সংশয় তৈরি হয়েছে। সংশয়টা যে ব্যাপক, সে বিষয়ে আমার সংশয় নেই। এই ধরণের একটা লেখার পটভূমি অনেক পুরোনো। কিন্তু লেখাটা নতুন করে মাথায় চ্যাগাইয়া উঠলো অরুপের ‘ট্রান্সফর্মার’ নিয়ে লেখা দেখে এবং সেই সাথে সুমন চৌধুরীর ‘পুরোনো প্রশ্নের নতুন কইরা চ্যাগাইয়া উঠন’ দেখে।

বর্ণবাদ আসলে কী? শুধুই কি ‘বর্ণ’ কেন্দ্রিক এই ইজম। মনে হয় না। ও জে সিম্পসন ট্রায়ালের উপরে হিস্ট্রি চ্যানেল একটা ডকুমেন্টারি করেছে সেটার খাবলা খাবলা দেখবার সুযোগ হয়েছিলো। এই ট্রায়ালকে বলা হয় ‘ট্রায়াল অব দ্যা সেঞ্চুরী’। মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে বেশী প্রচারিত, সর্বোচ্চ টিআরপি পাওয়া একটা ট্রায়াল। এই ট্রায়ালের পর লস এঞ্জেলেসের ক্রিমিনাল ল অনেকখানি পরিবর্তন হয়েছে, খোদ মার্কিন আইন ব্যবস্থাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে সিম্পসন। সিম্পসন সম্বন্ধে মিডিয়াতে সংক্ষেপে যেটা বলা হয় সেটা হচ্ছে, সিম্পসন হচ্ছে প্রথম অল আমেরিকান সেলিব্রিটি। সানফ্রান্সিসকোতে জন্ম নেওয়া সিম্পসন ফুটবল খেলোয়াড় হওয়ার আগে খুচরো-খাচরা মাস্তান গ্রুপে ছিলো, কারেকশন সেন্টারে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ফুটবল স্টার হওয়ার পর, খুব সচেতন চেষ্টায় একটা ইমেজ তৈরি করে। কালোদের মধ্যে আমাদেরই লোক , সাদাদের মাঝে গ্রেট জেন্ট্লম্যান, এই ধরণের একটা ইমেজ। সিম্পসনই প্রথম আফ্রিকান আমেরিকান যে সাদাদের মন জয় করেছিল স্বতস্ফুর্তভাবে। আফ্রিকান আমেরিকান ইস্যুগুলো সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছিল সিম্পসন আলগোছে। আফ্রিকান আমেরিকান ইস্যুগুলোকে নন-পলিটিক্যালি এড়িয়ে যাওয়াটা তাকে সাদাদের মাঝে করেছিল বিপুল জনপ্রিয়। কিন্তু একই সাথে আফ্রিকান আমেরিকানরা তাদের ইস্যুতে সোচ্চার হিসেবে সিম্পসনকে হয়তো পায়নি, কিন্তু সাদাদের মাঝেও বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়া আমাদের লোক হিসেবে বিপুল জনপ্রিয় ছিলো। সিম্পসন বর্ণন করলাম এ কারণে যে, এতো কিছুর পরও অন্তরীক্ষে বর্ণবাদ লুকিয়ে ছিলো।

১৯৮৯ সালে নিকোল ব্রাউন সিম্পসন, তার পতি ও জে সিম্পসনের বিরুদ্ধে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের মামলা করে। নো কনটেস্ট গ্রাউন্ডে মামলার সুরাহা করে বিবাহবিচ্ছেদ নেয় ও জে। ১৯৯৫ এ নিকোল এবং তার বয়ফ্রেন্ড খুন হয়। ও জে সিম্পসনের গাড়ীতে রক্তের যে দাগ এবং অকুস্থলের রক্তের দাগ একই ছিলো, জুতার ছাপ, ব্রঙ্কো চেইজ এবং অসংখ্য প্রমাণ সত্ত্বেও ও জে সিম্পসন বেকসুর খালাস পায়।
সে সময়কার একটা জরিপে বেরিয়ে আসে, জরিপ অংশগ্রহণকারী ৭৫% সাদা আমেরিকান মনে করে সিম্পসন দোষী, ৭৮% কালো আমেরিকান মনে করে সিম্পসন নির্দোষ, তাকে ফাঁসানো হচ্ছে। সংকটকালে বর্ণবাদের আসল চেহারা প্রকাশ পায়। সিম্পসনের ট্রায়ালের জুরিদের মধ্যে সাদা এবং কালোরা পুরোপুরি দু-ভাগ হয়ে গিয়েছিলো। জরিপের সংখ্যার ওজনই, বলে দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে বর্ণবাদের আসল অবস্থা। দুঃখজনক হচ্ছে ট্রায়ালে অনেক প্রমাণই হাজির করা যায়নি। লস এঞ্জেলেস ক্রিমিনাল এ্যাক্টের দুর্বলতার কারণে।

১৯৯৭ সালে সান্টা মনিকার সিভিল কোর্ট ও জে সিম্পসনকে দুই খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে, এবং ৩৩ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করে। কিন্তু আবার আইনের ফাঁপড়। লস এঞ্জেলেসের আইন মর্টগেজ, কিংবা কোর্ট ফি আদায়ের জন্য পেনশন হড়ফ করা সমর্থন করে না। এক টাকা ও দেয়নি সিম্পসন। বাড়ী ক্রোক করবার আইন আছে ফি আদায়ের জন্য। সে কারণে আগে ভাগেই ফ্লোরিডায় অভিবাসী হয়েছে ও জে সিম্পসন। ফ্লোরিডায় কোর্ট ফি আদায়ের জন্য বাড়ী ক্রোক করবার বিধান নেই।

২০০৬ সালে সিম্পসন আবার লাইম লাইটে এসেছিলো, একটা বই লিখে। বইটির নাম ‘If I did it’। যদি আমি খুন করতাম, তবে কিভাবে করতাম। শেষ মুহুর্তে প্রকাশক বইটি বাজারে আর ছাড়েনি। চার লাখ কপি নষ্ট করে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু সদ্য ই-বে’তে পঁয়ষট্টি হাজার ডলারে এক কপি বিকিয়েছে।

রেসিস্ট শব্দটা, বর্ণবাদের চাইতে অনেক বেশী অর্থবহ মনে হয় আমার। আমার এক বন্ধু কোরিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে, ‘ফেমটোসেকেন্ড লেজারে’ গবেষণার শেষের দিকে। ও পিএইচডির কথা ভাবছে। ওকে এদিকে আসতে বলবার পর ওর বক্তব্য ছিলো আমেরিকায় এখন মুসলিমরা অনেক হ্যারাসড। ওখানে গিয়ে পরে আবার ঝামেলায় পড়বো। কথাগুলো সত্য। বিশেষত ৯/১১ এর পর থেকে সব ধরণের রেসিজমের সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। আমরা মাঝে মাঝেই আলাপ করছি, কারা বেশী রেসিস্ট এটা নিয়ে। অজি’রা, ইউরোপিয়ান নাকি মার্কিনি’রা। আমাদের এশিয়ান আলাপ মোটামুটি এই বৃত্তেই সীমাবদ্ধ। অথচ আমরা কমবেশী সবাই রেসিস্ট।

এই দেশে আসার পর কাউলা, কাল্লু শব্দ দুটো কানে একটু বেশী লাগত। আফ্রিকান-আমেরিকানের বাংলা প্রতিশব্দ এগুলো। আফ্রিকান-আমেরিকানদের জীবন যাপন, পোষাক-পরিচ্ছেদ, খাদ্যাভাস, গান, গাড়ী, মদ, নারী সব কিছুই ইউরোপিয়ান-আমেরিকানদের চেয়ে ভিন্ন। আমাদের চেয়ে ভিন্ন। এই ভিন্নতাটাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করাটাও আমাদের জন্য কষ্টকর। আমরা সবকিছুকে একটা ছাঁচে ফেলে দেখে অভ্যস্ত। একটা লোক সকালে প্যান্টের মধ্যে শার্ট গুঁজে, অক্সফোর্ড শু পরে অফিসে যাবে, এটাই আমাদের মনছবি। কেউ ঢোলা পায়জামার উপরে হাতকাটা স্পোর্টস জার্সি পরে কানে স্নুপ ডগের গান শুনতে শুনতে অফিস যাবে এটা আমরা ভাবতে পারি না। ইন্ডিয়ান এক্সেন্ট কথাটায় যতখানি বিশেষ্য গুণ আছে, তার চেয়েও বেশী আছে বিশেষণ গুণ।

আমরা ক্রমাগত আরেকজনকে হেয় করে যাচ্ছি, এবং রেসিস্ট বলছি আমেরিকানদের, অজি’দের।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা এই মূহুর্তে ৩০০ মিলিয়ন। তার মধ্যে ১৪.৭% হিস্প্যানিক, মানে ৪৭ মিলিয়ন। এটা আরো বাড়ছে। এর মধ্যে ১২ মিলিয়ন ইলিগ্যাল। ২০৫০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার ২৫% হবে হিস্প্যানিক। স্প্যানিশ হয়ে পড়বে প্রধান ভাষা।


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

আহা, চলুক না। ভাল লাগছে। বর্ণবাদ বুঝতে এই প্যাচালের দরকার আছে। আমার তা-ই মনে হচ্ছে। হাসি

.........
যত বড় হোক সে ইন্দ্রধনু দূর আকাশে আঁকা
আমি ভালবাসি মোর ধরনীর প্রজাপতির পাখা

হিমু এর ছবি

লেখক লেখাটা মাঝপথে গলা টিপে খুন করে ও জে-র মতো ভাগা মারার তালে আছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

বর্ণবাদের চেয়ে "শ্রেনী বৈষম্য" শুনতে যুইতের লাগে।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

অমিত এর ছবি

বর্ণবাদ আর শ্রেণীবৈষম্য তো মনে হয় আলাদা ব্যাপার।
____ ____________________
suspended animation...

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

এ তো ওজে থেকে সোপরানোস হয়ে গেল! মাঝপথে যবনিকা!!

ঝরাপাতা এর ছবি

হুম। হযুদাকে জাঝা।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

দ্রোহী এর ছবি

হযু, তোমারে খাইছি। গাছে তুলে মঈ কেড়ে নেবার অবস্থা!!!


কি মাঝি? ডরাইলা?

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আরে কি হলো চৌধুরী সাহেব? এমনতো কথা ছিলোনা
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।