আজ "ব্রিক লেন" দেখলাম।

ইরতেজা এর ছবি
লিখেছেন ইরতেজা (তারিখ: শনি, ২২/০৩/২০০৮ - ৩:৫৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto

ব্রিক লেন’ উপন্যাসের লেখক বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী অক্সফোর্ড গ্র্যাজুয়েট মনিকা আলি। উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৩ সালে। ম্যান বুকার পুরস্কারের শর্ট লিস্টে মনিকা আলি প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেখক। ‘ব্রিক লেন’ নিয়ে বাংলাদেশে ও অন্য জায়গার বাংলাদেশি কমিউনিটির মাঝে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে।

২০০৬ সালের শুরুতে শুনেছিলাম সারা গেভরন ব্রিক লেন উপন্যাস অবলম্বনে একটি চলচিত্র রুপান্তরিত করছে। সেই বছরেই আগস্টে আমরা ইণ্টারনেটের মাধ্যমে জেনেছিলাম ব্রিক লেন চলচিত্র তৈরীর প্রতিবাদে লন্ডনের বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর একটি অংশ প্রতিবাদ করছে। তাদের অভিযোগটি ছিল গুরুতর, উপন্যাসটিতে নাকি বাংলাদেশের লন্ডনের কমিউনিটিকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। তথাপি উপন্যাসটি পড়ে আমার কখনও এমন মনে হয়নি। রাগান্বিত প্রতিবাদকারীর কয়জন প্রকৃতপক্ষে উপন্যাসটি পড়েছেন তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।

যুক্তরাজ্যে ‘ব্রিক লেন’ প্রিমিয়ার হয়েছে ২৬ অক্টোবর, ২০০৭। প্রায় পাঁচ মাস পড় ব্রিক লেন গতকাল ২০শে মার্চ অষ্টেলিয়াতে প্রিমিয়ার হয়েছে। বাসা থেকে সিনেমা প্যালেস কোমো মাত্র সাত মিনিট হাটার পাথ। হলের দরজার সামনে বড় বড় পোষ্টারে বাংলাদেশের গ্রামের ধানক্ষেতে ছুটে চলা কিশোরিকে দেখেই নিজের শৈশবের কথা মনের পড়ল। গুড ফ্রাইডে ছুটি থাকায় কারনেই হোক আর প্রমিয়ার শো হবার কারনেই হোক মুভি থিয়েটার ছিল প্রায় পূর্ণ। দর্শকের অধিকাংশই অষ্ট্রেলিয়ান। হাতে গোনা তিন চারটে বাঙ্গালি পরিবারও দেখলাম।

আমি মাত্র কিছু দিন আগেই ব্রিক লেন বইটি পড়ে শেষ করেছি। কোন বই পড়ে মুভি দেখতে গেলে আমার একটা বড় সমস্যা হয়। কেন জানি নিজের কল্পনার জাল বুনে নিজের মনের মাঝেই একটা ছবি বানিয়ে ফেলি। নিজের মনের ছবির সাথে বাস্তবে মিল না পেলেই হতাস হই। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ছবির শুরুটা আমার একেবারেই ভাল লাগে নি।

অবশ্যই মুভি শুরু হয়েছে মুল চরিত্র নাজনিনের ( তানিস্থ চট্টোপাধ্যায়) বাংলাদেশের গ্রামের শৈশবের দৃশ্যাধারণ দিয়েই। নাজনীনের বেড়ে উঠা, ধানের ক্ষেতে ছুটে চলা, পুকুরে সাতার কাটা, বৃষ্টিতে ভেজা, বন্ধুদের সাথে খেলা করা, নাজনীনের মার পুকুড়ে ডুবে আতহত্যা, নাজনীনের বাল্য বিবাহ এত কিছু সব মাত্র ৪- ৫ মিনিটে দেখিয়েছেন। এভাবে তাড়াহুড়া করে দেখানোর কোন দরকার ছিল না। আমি জানি বড় একটা বইকে ১০১ মিনিটে দেখাতে গেলে কিছুটা কাটছাট করতেই হবে। কিন্তু পরিচালক সারা গেভরন হয়ত মুল কাহিনীর উপর অধিক মাত্রায় সিনেমাটিক লাইসেন্স নিয়ে ফেলেছেন। উপন্যাসের শুরুর দিকের ঘটনা, নাজনীনের বেড়ে উঠা, তার বিবাহ আরো বিস্তারিত করে দেখানো উচিত ছিল। নাজনীনের সাথে চানুর (সতিশ কৌশিক) বিবাহ যেভাবে দেখানো হয়েছে যারা বইটি পড়েন নি সে সব বিদেশীদের কাছে অদ্ভুত এবং অবিশ্বাস্য লাগবে। নাজনীনের সাথে তার ছোট বোন হাসিনার সাথে তার সম্পর্কটা আরো গভীর ভাবে দেখানো জেত। হাসিনার চরিত্র মুল উপন্যাসে অত্যান্ত গুরুত্বপুর্ন। নাজনীনের আবেগ, আদর্শ, বোনের প্রতি তার ভালোবাসা, নিজের ফেলে আশা গ্রামের প্রতি তার পিছুটান ইত্যাদি বইটি থেকে মুভিতে বিশ্বাসযোগ্যভাবে অ্যাডাপ্ট করার জন্যই ৪-৫ মিনিটের স্থানে অন্তত ১৫- ২০ মিনিট ফুটেজ দাবী রাখে।

ছবির টাইটেল, অভিনেতাদের নাম দেখাতে দেখাতেই নাজনীন দুই টিনেজ মেয়ে সাহানা আর বিবির মা আর চানু আহমেদের আদর্শ পত্নি। চানু আহমেদ তার দুই মেয়ে আর পত্নি নিয়ে পুর্ব লন্ডনের ব্রিক লেনে বসবাস করেন। ব্রিক লেন ইস্ট লন্ডনের ঘিঞ্জি এলাকা। চানু তার আর্থিক দৈন্যতার কারনে একটা নোংরা অ্যাপার্টমেন্টের পুর্ব প্রান্তের সস্তা দুই রুমের ছোট ফ্লাটে থাকেন। চানু আহমেদ আর নাজনীনের বয়সের অনেক পার্থক্য। নিজের পরিবারের আয় বাড়ানোর জন্য নাজনীন বাড়িতেই মেশিন কিনে সেলাইয়ের কাজ শুরু করে। প্রতি কাপড় সেলাই করে সে এক পাউন্ড পায়। সে কল্পনা করে এভাবে অম্প অম্প করে পাউন্ড জমিয়ে যে তার প্রিয় বাংলাদেশে আসবে। তার ছোট বোন হাসিনাকে দেখতে যাবে। ১৭ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়ে আসার পর সে একবারের জণ্য হলেও হাসিনাকে দেখে নি। হাসিনার সাথে তার সব সময় চিঠিপত্র আদান প্রদান হয়। নিজের মনে সব কথা, সব স্বপ্ন নাজনীন হাসিনাকে লিখে পাঠায়।

সেলাইয়ের কাজ করতে গিয়ে দেখা হয় করিমের( ক্রিষ্টোফার সিম্পশন) সাথে। করিম ব্রিটেনে জন্মগ্রহণকারী আধুনিক, হেন্ডসাম, পরিশ্রমি যুবা। নাজনীনের সমবয়সি ও স্থানীয় কাপড়ের ব্যবসায়ি। তাদের মাঝে একটা সম্পর্ক তৈরী হয়। করিম স্থানীয় মুসলিম কমিউনিটির এখন উঠতি নেতা। করিম চায় নাজনীন চানুকে তালাক দিয়ে তার সাথে বাস করতে। এর মাঝেই ১১ই সেপ্টেম্বরের হামলা হল। স্থানীয় সমাজে একটা দাঙ্গা হবার আশঙ্কা দেখা দিল। এর মাঝেই চানু সিদ্ধান্ত নিল সে আর এই দেশে থাকবে না পুরো পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে ফেরত যাবে। বইটি না পড়ে থাকলে ছবির শেষ অংশটি অপ্রতাশিত মনে হওয়া খুবি স্বাভাবিক।

মুভিটির চিত্রায়ন হয়েছে ভারত ও লন্ডনের নানা স্থানে। মুভিতে নাজনীন চরিত্রে অভিনয় করেছেন তানিস্থ চ্যাটার্জি, চানু চরিত্রে অভিনয় করেছেন সতিশ কৌশিক। এই ছবিটি একেবারেই তানিস্থা চট্টোপাধ্যায়ের ছবি। তানিস্থা ভারতীয় থিয়েটার গুনি অভিনেতা। শুনেছি সে দুই একটা হিন্দি মুভিও করেছে। সফল ভাবেই জটিল একটা চরিত্র আভিনয় করেছে। তার সাধাসিধে ইংরেজী উচ্চারন একেবারেই চরিত্রের নাজনীনের সাথে মিশে গেছে। ব্রিক লেন দেখে মনেই হয়নি সারা গেভরন পরিচালিত প্রথম ছবি। সারা গেভরন এত ঝড় ঝাপটার মাঝেও ছবিটি যত্নশীল হয়ে সমাপ্ত করেছে তার জন্য তার বাহাবা প্রাপ্য।

ভাল লাগে নি
১। নাজনিনের শৈশব আরো ফুটেজ দেওয়া উচিত ছিল। ( অন্তত আমার কাছে মনে হয়েছে)
৩। হাসিনার চিঠি পড়ার সময় ইংরেজীতে পড়ানো হয়েছে। হাসিনা বাংলাদেশে থাকে তার ইংরেজ়ি চিঠি লেখার কোন কারন নেই। বাংলায় পড়ে নিচে ইংরেজী সাবটাইটেল দিলেই হত।
২। বিরতির আগের ১৫ মিনিটের গতি খুব ধীর ছিল।

ভালো লেগেছেঃ
১। কাহিনী এবং সংলাপ।
২। চমৎকার আবহ সঙ্গিত ( জোসেলিন পোককে এত দিন শুধুমাত্র প্রতিভাবান ভায়োলিন বাদক হিসেবেই চিনতাম।)
৩। তানীশা চট্টোপাধ্যায়, ক্রিষ্টোফার সিম্পশন,সতিস কৌশিকের অনবদ্য অভিনয়।
৪। অসাধারন সিনেমাটোগ্রাফি।

আমি ব্রিক লেন মুভিটিকে সাড়ে ৩ ষ্টার দিলাম ( ৫ এর ভিতর)

ব্রিক লেন অফিসিয়াল ওয়েব সাইট
ব্রিক লেন মুভি ট্রেইলার


মন্তব্য

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

লেখাটি আগে এখানে দিলেই হতো। তাহলে কষ্ট করে পুরনো লেখাটা সামহোয়ারইনে কাট-পেস্ট করতে হতো না। যাই হোক, চমত্কার আলোচনার জন্য ধন্যবাদ।

আমার পোস্টটার লিংক মন্তব্যে দিয়ে দিলাম।
-----------------------------------------------
Those who write clearly have readers, those who write obscurely have commentators.--Albert Camus

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

ইরতেজা এর ছবি

শোহেইল মতাহির ভাই আমি প্রায় একি সাথে সামহোয়ারইন আর এখানে দিলাম। আমি অনেক দিন পরে ব্লগ লিখেছি। সচলে পোষ্ট দেবার আগে অন্য কোথাও দেওয়া যাবে না কথাটি আমার মনে ছিল না। আপনার কথায় মনে পড়ল। আমি আমার ভুলের জণ্য দুখ প্রকাশ করলাম। আগামীতে খেয়াল রাখব। পড়ার জণ্য ধন্যবাদ। আপনার লেখাটি আগে পড়ি নি। এখন পড়ছি।

_____________________________
টুইটার

মুশফিকা মুমু এর ছবি

হুম, Interesting, সিডনিতে দেখালে দেখব। হাসি

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

শামীম এর ছবি

ইরতেজা তাহলে বেঁচে আছেন ... ...

সমালোচনাটা ভালো লেগেছে। চলুক
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

রিভিউ ভালো লাগলো।
ছবি দেখার সময় পয়েন্টগুলো মাথায় থাকবে।
ধন্যবাদ।

শিক্ষানবিস এর ছবি

মুভিটা না দেখেই বলছি, রিভিউটা অসাধারণ হয়েছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

পুরো ছবিতে সবকিছু খুব সিম্পলি দেখানো হয়েছে, এটাই ভাল লেগেছে। কোন অতিরঞ্জন নেই...

রিজভী

--------------------------------
কেউ যাহা জানে নাই- কোনো এক বাণী-
আমি বহে আনি;

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।