নিজস্ব ধাঁচের গণতন্ত্রঃ ৩

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি
লিখেছেন ইশতিয়াক রউফ (তারিখ: শুক্র, ১৩/০৬/২০০৮ - ১২:০০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পর্ব ১,২

৩. জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ বনাম দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ
দেশটা বড় ভয়ে আছে। চারিদিকে শকুনের ছড়াছড়ি। দেশটাকে খাবলে খেতে চায় শুধু। যা-কিছু জাতীয়, তার প্রতিই খুনে দৃষ্টি এদের। নিজের বলে যদিও বা কিছু আছে, আপন বলে কিছু নেই আর। এরকম অবস্থায় ‘মাই ডিয়ার কান্ট্রিমেন’ কিংবা ‘দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থরক্ষায় ক্ষমতা গ্রহনে বাধ্য হচ্ছি’র মত আইয়ুবীয় বক্তব্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে এসব কিছু ছাপিয়ে উঠে এসেছিল একটি কথা, ‘এই সেনাবাহিনী পাকিস্তান আমলের সেনাবাহিনী নয়, এটা বাংলাদেশের সেনাবাহিনী’। ক্ষমতা নেবার নাকি কোনই খায়েশ নেই আজকের আর্মির। শুনে আমিও টোপ গিলেছিলাম আরো অনেকের মত।

প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব ডঃ ইয়াজুদ্দিন আহমেদকে দেবার নীলনকশা যে ডঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে হটাবার সময় থেকেই তৈরি, সেটা দেরিতে বুঝতে পেরে মউদুদ-তারেক-হারেস-বাবরদের কূটচিন্তার প্রশংসা না করে পারিনি। পরোক্ষ সেনাশাসনের দেড় বছরের মাথায় এসে আরো একবার অবাক হয়ে স্বীকার করে নিচ্ছি আমার দৃষ্টির সংকীর্ণতা, প্রশংসা করতে বাধ্য হচ্ছি সেনাশাসকদের কূটকৌশলের। গৃহপালিত সুশীল সমাজ আর আজ্ঞাবহ সংবাদপত্র থাকলে আইয়ুব শাহীও এযুগে গান্ধী হয়ে যেতেন। পাকিস্তানের সেনাশাসকেরা নিজের দেশ দখল করে, নিজের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতে তারকার সংখ্যা বাড়ান। এবারেও তেমনি ভাবে জনগণকে চূড়ান্ত বোকা বানাবার পর সেনাপ্রধান নিজেকে চতুর্থ তারকাটি দিয়ে পুরস্কৃত করলেন। সেলুকাস, এক জলপাই সংবিধানকে মুসলমানি দেয়, তো আরেক জলপাই বুকের উপর আতশবাজি নিয়ে ঘোরে!

আমার মত বেকুব জনগণের বৃহত্তর স্বার্থরক্ষায়ই নাকি জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ প্রয়োজন। আলুর জিলাপি খেতে না পেয়ে মরে যাওয়া সাধারণ মানুষের মৃতদেহের উপর শকুনের উৎসব ঠেকাতেই নাকি এই পরিষদ। প্রস্তাব মতে এই পরিষদে থাকবেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যবৃন্দ, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধানবৃন্দ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, বিরোধীদলের নেতা, উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীবৃন্দ, প্রমুখ। সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রপতি নাকি প্রজাতন্ত্রের পিতা। তাঁর উপস্থিতিতে যা-কিছু ঘটে, তার সবকিছুরই তিনিই কর্তা। প্রধানমন্ত্রীশাসিত গণতন্ত্রের নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান তবে কে হবেন? শুধু তাই নয়, প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধানদের যদি সংযুক্ত করতেই হয়, তাহলে কি দেশের চূড়ান্ত সংকটের মুহূর্তে আমাদের তাকাতে হবে এরশাদের মত পতিত স্বৈরাচারীর দিকে? নাকি শিফন-বনাম-জর্জেট ঝগড়া দেখবো খালেদা-হাসিনার মধ্যে? অন্ধকারতম সময়ে যদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতেই হয়, তাহলে এ কেমন গণতন্ত্র? শুধু তাই নয়, যেকোন সচেতন রাষ্ট্রপ্রধান তো নিজে থেকেই এঁদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন দুর্যোগমুহূর্তে। তবে কেন ঘটা করে নতুন একটি পরিষদ গঠন?

অধমের মত আধা-শিক্ষিত তড়িৎপ্রকৌশলীকে অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন করতে দিলে যা হবে, তাই হচ্ছে আর কি। আমি কাজের মধ্যে জানি শুধু ম্যাটল্যাবে সিমুলেশন তৈরি করতে। রোগী মারা যাবার উপক্রম হলেও আমি প্রথমে বিভিন্ন রকম মডিউল সহকারে একটি সিমুলেশন দাড় করাবো। এতে রোগীর ওজন থেকে ছুরির ধার পর্যন্ত সব কিছুই নানান রকম প্যারামিটার দিয়ে প্রকাশ করা হবে। সবশেষে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট লিখিত হবে লেটেক-এ। কোন কালে যুদ্ধে জড়াবার ভয় না থাকলেও কিংবা মানুষ মরে লাশ হয়ে যাবার পর তাকে শকুনের হাত থেকে বাঁচাবার প্রয়োজন না থাকলেও দিব্বি বলে বেড়ানো হচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ তৈরির কথা। ঐ যে, ছাগল দিয়ে হালচাষ করানো। হুমকি দিয়ে বাজার রুদ্ধ করে রেখে কিংবা উৎপাদনের দিকে নজর না দিয়ে জোর করে দাম নির্ধারণ করে দিয়ে যে অর্থনীতিকে সচল রাখা যায় না, সেটা ছুঁচো পর্যায়ের রাজনীতিক জানলেও উচ্চপদস্থ সেনাকর্তাদের অজানা। অতঃপর রক্ত দেখার ভয়ে সিমুলেশনের পর সিমুলেশন।

ক্ষমতায় যদি ভারসাম্য আনতেই হয়, তাহলে আমার মতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা যায়। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের ধারণার মত এটিও একক স্বেচ্ছাচারিত্ব রোধ করবে, তবে ক্ষমতায় থাকবেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ। নিম্নকক্ষ থাকতে পারে বর্তমান সংসদ ব্যবস্থার মতই। অর্থসংশ্লিষ্ট যেকোন প্রস্তাবে নিম্নকক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচ্য করা যায়। জনগণের টাকা দিয়েই সরকারের টাকশাল গঠিত। এই তহবিলের যাতে কোন রকম তছরুপ না হয়, তা দেখার জন্যই প্রত্যক্ষ ভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে এর ভার দেওয়া। চাষা থেকে স্কুল শিক্ষক পর্যন্ত যে-কেউ তাঁর এলাকার মানুষের মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে পারেন, পারেন সরকারী অর্থের সুবন্দোবস্ত নিশ্চিত করতে।

রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের মতের প্রতিফলন থাকা যেমন জরুরী, জনগণকে নতুন পথ দেখানো ও নিত্যনতুন স্বপ্ন দেখানোও তেমনি জরুরী। উচ্চকক্ষের হাতে দেওয়া যায় আইন প্রণয়ন ও সংশোধনের বিধান। নিম্নকক্ষে নির্বাচিত হবার ক্ষেত্রে বয়স ও নাগরিকত্ব ছাড়া কোন বিধিনিষেধ রাখার প্রয়োজন নেই। ‘সংবেদনশীল’ জনপ্রতিনিধি হতে তেমন কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে না। পক্ষান্তরে অনেক বছর ধরেই অনুভূত ‘শিক্ষিত’ জনপ্রতিনিধি পাবার আশার প্রতিফলন ঘটানো যায় উচ্চকক্ষে নির্বাচিত হবার বেলায় কিছু শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিয়ে। অর্থসংশ্লিষ্ট নয়, এমন যেকোন আইন সরাসরি বাস্তবায়নের অধিকার দেওয়া যায় উচ্চকক্ষকে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় অল্পদিন আগে বাতিলকৃত অভিনয় নিয়ন্ত্রন আইনের কথা। এই ধরণের ঔপনিবেশিক আইনের ছড়াছড়ি আছে আমাদের আইনের বইগুলোয়।

অক্ষরজ্ঞানহীন গুন্ডাদের হাত থেকে এভাবে হয়তো আইনকে রক্ষা করা যাবে, হয়তো কোন ভাবে ছুঁড়ে ফেলা যাবে ঔপনিবেশিক আমলের জড় আইনগুলো। শতকরা ৪০ ভাগ নেতিবাচক ভোটের শর্তে উচ্চকক্ষে প্রণীত কোন আইনের সরাসরি বাস্তবায়নের অধিকার রোধ করতে পারে নিম্নকক্ষ।

(চলবে)


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আর চিন্তা নাই... ভিতরে ভিতরে সমঝোতা হয়া গেছে... গত কয়দিনের ঘটনাচক্রেই সব পরিষ্কার... আমরা বেকুবরা অচিরেই নয়া নাটক দেখতে যাইতেছি মনে হয়।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

সেটাই... শুধু নাটকই দেখে গেলাম। কাজের কাজ কিছু করতে পারলাম না দেশটাকে নিয়ে।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আপনে কি করবেন? আজিব কথা বলেন? এইটা কি আপনের দেশ? এই দেশে জনগন এখন কেবলই আমজনতা... যেমনি নাচায় তেমনি নাচি পুতুলের কি দোষ?
(এই রে... কেউ আবার ভাইবেন না ব্লগার পুতুলরে নিয়া এই বাক্য রচনা করছি)
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

করবো, করবো। সময়েই দেখবেন। দেখি কোন শালা আমার দেশ আমার কাছ থেকে নিয়ে নেয়। আম দেখছে, আমের আঁটি দেখে নাই।

পছন্দের গান মনে করিয়ে দিলেন। শুনতে বসি এখন। আর শেষের কথাটুকু পুরা পাংখা!

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আমি খেয়াল কইরা দেখলাম সচলদের মধ্যে দুইমাত্র আপনের আর আমার প্রোফাইলেই হাসি হাসি চেহারা আছে... আপনের টা দাঁত খোলা আমারটা বন্ধ... আমরাই দুইমাত্র হাস্যজীবি সচল... হাস্যকর না কিন্তু চোখ টিপি
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

খেয়াল করি নাই তো আগে!! আসেন কোলাকুলি হয়ে যাক। বাকি দুনিয়ে দেখুক চেয়ে "খুশি"(?) আমাদের। দেঁতো হাসি

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍আমার চেহারা হাসি হাসি নয়?

@ নজরুল ইসলাম
আপনার তিনটে ছবি দেখেছি আজ পর্যন্ত। সবগুলোতেই আপনার হাসিমুখ। আপনি সত্যিকারের হাস্যজীবী। দেশে গেলে আপনার হাসি দেখতেই আপনার সঙ্গে দেখা করবো। সত্যি বলছি।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

'হাসি' না, আপনার চেহারা (ওম) শান্তিময়!

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

হ তাই তো... তাইলে আমরা তিনজন হাস্যজীবী সচল। কিন্তু তার আগে কন তো আপনে এইসব দারুন দারুন ইমোটিকন কইত্থে পান? জটিল জিনিস।
আর দেশে আসলে অবশ্যই দেখা হবে। এখন থেকে কোনও সচল দেশে এসে আমার হাস্যকর চেহারা না দেখে ফেরত যেতে পারবে না। আমি এয়ারপোর্টের নিকটেই থাকি... বেড়া দিমু।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

দ্রোহী এর ছবি

সময় নিয়ে পড়লাম। পুরো সিরিজটাই আগুন হচ্ছে।

চলতে থাকুক ব্যবচ্ছেদ!!


কি মাঝি? ডরাইলা?

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

ধন্যবাদ। আক্ষরিক অর্থেই দুরু দুরু বক্ষে লিখছি এই সিরিজটা। আদার ব্যাপারী তো, জাহাজের খবর রাখলেও জাহাজ নিয়ে কথা বলতে ভয় লাগে।

দ্রোহী এর ছবি

আর আমি তো আদার গন্ধ শোঁকা পাবলিক। কেনার ও ক্ষমতা নাই!


কি মাঝি? ডরাইলা?

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আমি তো আদা কেনা ছেড়ে দিয়েছি। জিনিসপত্রের যা দাম! যেই সপ্তাহে পেয়াঁজ কিনি, সেই সপ্তাহে দুধ কিনি না। মাথার ঘাম তলপেট পর্যন্ত না নামলে এসি ছাড়ি না। দিন দিন মহান হচ্ছি আর কি। ঐ যে নজরুল বলে গিয়েছিলেন, সেই মত। যত দারিদ্র্য, তত মহান! খাইছে

দ্রোহী এর ছবি

হায়রে দারিদ্র্য!
কপাল ফেরাতে মাথার ন্যাড়া করার দশা!!


কি মাঝি? ডরাইলা?

স্পর্শ এর ছবি

পড়লাম সময় নিয়ে।
আপনারা এরকম ভাবেন বলেই ইতিবাচক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখি একদিন।
....................................................................................
অতঃপর ফুটে যাবার ঠিক আগে হীরক খন্ডটা বুঝলো, সে আসলে ছিল একটা মামুলি বুদবুদ!


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আপনারা সময় নিয়ে পড়েন বলেই হয়তো ভাবনার সাহসটুকু পাই। যে যা বলুক না কেন, পরিবর্তন আসবেই। সময় হলে ডাক পড়বে, তখন ইতস্তত করবেন না যেন।

স্পর্শ এর ছবি

হাসি ডাক শোনার অপেক্ষায়.....
....................................................................................
অতঃপর ফুটে যাবার ঠিক আগে হীরক খন্ডটা বুঝলো, সে আসলে ছিল একটা মামুলি বুদবুদ!


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আগ্রহ নিয়ে পড়ছি।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।