আমি রুমির কথা বলছি

ঝরাপাতা এর ছবি
লিখেছেন ঝরাপাতা (তারিখ: বুধ, ০১/০৮/২০০৭ - ১১:০৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার মেয়ে রুমি। বয়স আট বছর। খুবই দুরন্ত আর ছটফটে। সকাল বেলা ওর চেঁচামেচিতে ঘর খুব সরগরম হয়ে ওঠে। এই যেমন আজো মায়ের সাথে বায়না ধরেছে- এটা খাবোনা, ওটা বানাওনি কেন, মামার বাসায় কখন যাবে বলো...। এর মাঝে দু'বার এসে আমার বিরুদ্ধেঅভিযোগ পেশ করে গেছে- 'বাপি, তোমার জন্য আমার স্কুলের দেরী হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। ' আমি হেসে সম্মতি জানাই। সকালবেলার চোটপাট শেষে ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার পথে ওকে স্কুলে পৌঁছে দিই। স্কুটার থেকে নেমে ও বিশাল ওজনের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে সহপাঠীদের সাথে হাসতে হাসতে ক্লাশে ঢুকে পড়ে। শেষমুহুর্তে পেছনে ফিরে আমার দিকে ছোট্ট হাতটি নেড়ে বাই জানাতে কখনো ভুল করে না। আমি ওর এই বিদায়ী সম্ভাষণটা খুব উপভোগ করি।

আজ হঠাৎ কেন জানি ফেলে আসা দিনগুলির কথা মনে পড়ছে। আমার দুরন্ত শৈশবের পাঁচমিশালী দিনগুলো কেটেছে চিরসবুজ এক গ্রামে। যেখানে আকাশের অসীম নীল হাতছানি দিয়ে ডাকত সারাটা দুপুর, নদীর শীতল জল গভীর মমতায় ধুয়ে দিতো সারা শরীরের কান্তি, সবুজ ধান-খেতের আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে ঠিক পৌঁছে যাওয়া যেত দূর পাহাড়ের পাদদেশে, মন খারাপ করা কোন এক পড়ন্ত বিকেলে সাগর পাড়ে বসে কষ্টগুলোকে উড়িয়ে দেয়া যেত বিষন্ন সীগালের ডানার পালকে মেখে। স্কুল থেকে এসেই চলে যেতাম খেলার মাঠে। ফুটবল, ক্রিকেট হাডুডু, ডাংগুলি, বউচি কোনকিছুই বাদ রাখিনি। কখনো বা নদীর তীরে জমজমাট ফুটবল খেলার আসর বসাতাম। মাঝে মাঝে স্কুলে যেতে ভালো লাগতো না। তখন খুব করে চাইতাম, একটু অসুখ করুক। জ্বর হওয়ার অজুহাতে কয়েকদিন স্কুল যাওয়ার যন্ত্রণা হতে রক্ষা পেতে কতবার ইচ্ছে করেই বৃষ্টিতে ভিজেছি! কিন্তু জ্বর আসেনি। সম্ভবত প্রকৃতি তার সন্তানদের এভাবেই আগলে রাখে। শীতের মৌসুমে পড়শীর গাছ থেকে রস চুরি করে খাওয়ার মজা ভুলতে পারিনি আজো।

বছরের শেষের দিকে মেলা বসত গ্রামে। আমরা সারাবছর ধরে সঞ্চয় করতাম সেই মেলার জন্য। উপরন্তু বাবা-মার কাছ থেকে কিছু বোনাস আদায়ের চেষ্টা। আহ! কি বর্ণিল ছিল সেই দিনগুলি। জ্যোৎস্নাভরা রাতে মায়ের কোলে শুয়ে রূপকথার গল্প শুনতাম। শুনতে শুনেতে কখন যে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতাম টেরই পেতাম না। স্বপ্নের রাজ্যে ডালিমকুমার হয়ে কতো রাজকন্যাকে যে উদ্ধার করেছি তার কোন ইয়ত্তা নেই। মাঝে মাঝে ভাবি- সেই সোনালি দিনগুলো যদি আবার ফিরে পেতাম!

গাড়ির হর্নে সম্বিত ফিরে পাই। ছুটে চলি অফিসে। বেশ কিছুক্ষণ ফাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করি। না, আজ কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছি না। কেমন জানি নস্টালজিক হয়ে উঠেছে মনটা। দুপুর হলে ছুটি নিয়ে বাসায় ফিরে আসি। ঘরে ঢুকতেই দেখি- রুমি পা ছড়িয়ে দিয়ে কোলের উপর বই রেখে পড়া মুখস্থ করছে। আমাকে দেখে ও উল্লসিত হয়ে ওঠে আর শমর্ী একটু চিন্তাগ্রস্থ হয় অসময়ে আমার প্রত্যাবর্তনে। 'কি, শরীর খারাপ করেনি তো তোমার?' না, আমি ঠিক আছি বলে রুমির পাশে গিয়ে বসি। ওকে জিজ্ঞেস করি। মামণি, আজ স্কুলে কি পড়াল? রুমি এক বিশাল বর্ণনা দিতে থাকে আর আমি খুব আগ্রহভরে শুনতে থাকি। আমি বলি- মামণি স্কুল থেকে এসেই তো পড়ছো- চলো একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি। শমর্ী বাধা দিয়ে বলে- 'ও পড়ছে না। এই রোদের মধ্যে বাইরে যাবে কি? বাইরে থেকেই তো এলো।' আমি দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। একটু হাঁটব- ঘন সবুজ কোন রাস্তা দিয়ে এক চিলতে নীল আকাশ দেখতে দেখতে অনেকটা পথ একলা হেঁটে যাব। তেমন রাস্তা কি আছে কোথাও এই ব্যস্ত শহরে? হয়তো আছে, হয়তো নেই!!!

ঘন্টাখানেক পরে ফিরে আসি। রুমি তখন ওর মায়ের সাথে গানের ক্লাশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই সময় ওর প্রতিদিন নাচ, গান, আবৃত্তি, ড্রয়িং এসবরের কোন না কোন ক্লাশ থাকে। সেখান থেকে ফিরলেই ওকে বসতে হবে টিউটরের কাছে। তারপর গানের রেওয়াজ, নাচের প্র্যাকটিস, হোম টাস্ক, স্কুলের পড়া এসব শেষ করে ঘুমোতে যেতে যেতে প্রায় বারোটা বাজে। আমি আমার মেয়ের এই যান্ত্রিক জীবনটাকে শুধুই অবলোকন করতে পারি আর কিছুই না। আমি জানি- আকাশের নীল রং ওর মনে কোন ছায়া ফেলে না, সবুজের স্নিগ্ধতা কখনো আলোড়ন জাগায় না, পাখির গান বা ফুলের সমারোহ ওকে খুব একটা পুলকিত করে না । ওর জীবনের সবটাই যান্ত্রিকতা- এমনকি স্বপ্নগুলোও। ওর স্বপ্নে কখনো ডালিমকুমারের পঙ্খীরাজ পাখনা মেলে না, সেখানে যতসব সায়েনস ফিকশন আর জেমস বন্ডের রোমহর্ষক, দুধর্ষ কাহিনির ঘনঘটা।

আমি আর ভাবতে পারছি না। আমি আমার মেয়ের এই কষ্টকর জীবন আর সহ্য করতে পারছি না। আমি ওকে সবুজের কাছে নিয়ে যাবো- মাটির সোঁদা গন্ধের অনুভূতি শেখাব, নদীর কলকল রবে সত্যের স্বরূপ উপলব্ধি করতে শেখাব, আমি ওকে ফুল-পাখি-প্রকৃতির কাছে নিয়ে যাব। খুব কাছে, খুব।

আমি বলি- মামণি, চলো আজ সবাই মিলে তোমার দাদা বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। শমর্ী বাধা দিয়ে বলে- 'কি যে বল তুমি? ওর গানের ক্লাশ আছে না?' আমি রুমিকে আবার বলি- মামণি যাবে? রুমি বলে- না বাপি, ওখানে কারেন্ট নেই, নোংরা মাটিতে হাঁটতে আমার বিচ্ছিরি লাগে!

একটা বিরাট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বেরিয়ে আসি। ব্যর্থতার হাহাকার। আমার মেয়ে তার আধুনিক মায়ের সব বৈশিষ্ট্যই আস্তে আস্তে রপ্ত করছে। আমার শুধু সুমনের একটা গানই মনে পড়ছে -

ইস্কুলের পড়ার সঙ্গে আছে পাড়ার গানের স্কুল
নিয়ম করে শিখতে হবে রবীন্দ্র নজরুল।

** স্থানান্তার প্রক্রিয়া, হাসান মোরশেদের দেখাদেখি।


মন্তব্য

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- রুমি কার মেয়ে?
ঐ কে আছে আমারে ধর, পোলাপাইন বেবাক গুলার মাথায় ধূয়া চাপছে।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

মৃন্ময় আহমেদ এর ছবি

হু। আগেও পড়েছি আবারও পড়লাম। শুধু একটা চমতকার ছবি ছিলো, সেটা দেখছি না। যাহোক, স্থান বদলালো। মন্তব্যও।

'

=========================================
নিজেকেই নিজে চিনি না, পরকে চেনার মিছে বাহানা

ঝরাপাতা এর ছবি

হুম, জাতির কাছে প্রশ্ন। রুমি কার মেয়ে?

মৃন্ময়,
আবারো পড়ার এবং মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম! আপনার সত্যি ৮ বছরের মেয়ে আছে?

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

ঝরাপাতা এর ছবি

হা হা হা। মা.মু. ভাই লাখ টাকা দামের প্রশ্ন করেছেন। আমি হুমায়ুন আহমেদের হোটেল গ্রেভার ইনের মতো উত্তর দেই।

লোকে যখন আমাকে প্রশ্ন করে আপনি কি ওই তরুণীকে এক ডলারের বিনিময়ে চুমু খেয়েছিলেন? আমি কোন উত্তর দিই না। স্বাভাবিক থাকি। যে যেভাবে এর উত্তর ভেবে নেয়।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

মৃন্ময়ের মতো আমার ও সেই চমৎকার ছবিটার কথা মনে পড়লো ।

-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ঝরাপাতা এর ছবি

ছবির কথাও মনে রাখার জন্য কৃতজ্ঞতা।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

লেখাটা পড়তে পড়তে ABBA-র এই গানের লাইনগুলি মনে পড়লো:

Schoolbag in hand, she leaves home in the early morning
Waving goodbye with an absent-minded smile
I watch her go with a surge of that well-known sadness
And I have to sit down for a while
The feeling that I'm losing her forever
And without really entering her world
I'm glad whenever I can share her laughter
That funny little girl

Slipping through my fingers all the time
I try to capture every minute
The feeling in it
Slipping through my fingers all the time
Do I really see what's in her mind
Each time I think I'm close to knowing
She keeps on growing
Slipping through my fingers all the time...

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

ঝরাপাতা এর ছবি

অসাধারণ সুন্দর গান। অনেক অনেক ধন্যবাদ এই রকম সুন্দর উপহারের জন্য।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

সৌরভ এর ছবি

হায় হায়, বলে কি?
শেষ পর্যন্ত আট বছরের মেয়ে আছে এমন কাউকে বিবাহ করলেন বুঝি?
ভালো ভালো।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

ঝরাপাতা এর ছবি

সবার দেখি আগ্রহ আট বছরের মাইয়া লইয়া। আর সৌরভ তো একধাপ আগাইয়া আমারে একটা ফ্রি মাইয়া ভি দিয়া দিলো।

নারে ভাই, আংকেল ডাকার অনেকে আছে, কিন্তু আব্বা ডাকার কেউ নাই।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।