অকারণ লজ্জা কাটিয়ে কখনো নিজের সিদ্ধান্তকেও প্রাধান্য দিতে হয়

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি
লিখেছেন জুলিয়ান সিদ্দিকী (তারিখ: রবি, ১৩/০৭/২০০৮ - ১২:২৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তখন ক্লাস থ্রির ছাত্র আমি। কারণে অকারণে ক্লাসের বাইরে যাওয়া আমাদের নিত্যদিনকার স্বভাব। কেউ পানি খাবো। কেউ পেশাব করবো, কেউ কফ-থতু ফেলবো ইত্যকার নানা তালবাহানার শেষ ছিলো না। অবস্থা দেখে আমাদের উপর নতুন আইন জারি হলো ক্লাসের বাইরে বেশি যাওয়া চলবে না। একদিন ক্লাস ক্যাপ্টেন মোশাররফ এলো না। এমনকি একজন শিক্ষক না আসাতে একটি ক্লাস অফ। সেই ক্লাসটি নিতে হেডমিস্ট্রেস জেবুন্নেসা আপা এলেন। কিন্তু কিছু না পড়িয়ে ফাইভের একটি ক্লাস নিতে যাবেন বলে আমাদের শান্ত থাকার উপদেশ দিলেন। আমাকে ক্লাস ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব দিয়ে বললেন, 'যখন তখন কাউকে বাইরে যেতে দিও না।'

অল্প পানির মাছ বেশি পানিতে পড়লে যা হয় আর কি! কারণে অকারণে লাফায়। আপা বেরিয়ে যাওয়ার পর আমিও কারণে অকারণে হল্লা-চিল্লা ধমকা-ধমকি শুরু করে দিলাম অবিরাম। পাশের ক্লাস থেকে দু’বার অভিযোগ এলো আমার গলাটা বেশি বাজে। অন্যদিকে আপার হুকুম আর আমার হাউকাউ, দু'য়ে মিলে দুর্বলচিত্তের পোলাপান এমনিতেই চুপসে গিয়েছিলো। এমনকি পানি পানের জন্যও কেউ তেমন ব্যস্ত হলো না। কারণ এরই মধ্যে খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে তাতে "পানি খাওয়া নিষেধ হও" লিখে বেড়ার উপর লাগিয়ে দিয়েছি।

মোহাম্মদ আলি বাবু বললো, 'পানি খাওয়া নিষেধ করা ঠিক না। আল্লায় গোনা দিতে পারে!'

গোনার ভয়ে সেটা তখনই খুলে ফেললাম। পানি ছাড়া প্রাণ বাঁচে না। আর তার উপর নিষেধাজ্ঞা! বাবুর কথায় সত্যিই খুব ভয় পেয়েছিলাম সেদিন।

আমাদের ক্লাসেরই একটি মেয়ে দেখতে খুবই রোগা পাতলা। তার মা আবার একই স্কুলের শিক্ষিকা। তিনি আমাদের ক্লাস নিতেন না বলে তাঁকে তেমন একটা ভয় পেতাম না। (আসলে পাত্তা দিতাম না বলাটাই ভাল।) দেঁতো হাসি

সঙ্গত কারণেই আপার নাম এবং আমাদের ক্লাসে অধ্যয়নরত তাঁর কন্যার নাম উল্লেখ করছি না। মেয়েটি একবার মিনমিন করে বললো, যে সে বাইরে যাবে। আর তা শুনেই আমি খেখিয়ে উঠলাম, 'হেডমাস্টার আপা কি বললো শোনো নাই? কেন বাইরে যাবা?'

মেয়েটি আর মুখ খুললো না। এরই মধ্যে আরো কয়েকজন জোট বেঁধে এসে বলতে লাগলো, খুবই পেশাব চেপেছে। কারো খুবই তৃষ্ণা পেয়েছে। আমার একই কথা, 'না। আগে ঘন্টা পড়ুক।'

আমি সহপাঠিদের নিবৃত্ত করতে খুব করে বোঝাচ্ছিলাম। এমন সময় মেয়েদের বেঞ্চ থেকে হাততালি আর হে হে শব্দ ভেসে এলো। আমি এগিয়ে যেতেই দেখি যে মেয়েটি কিছুক্ষণ আগে বাইরে যাবে বলেছিলো, সে পানির উপর বেঞ্চে বসে আছে আর কাঁদছে।

আমার অবাক দৃষ্টি লক্ষ্য করে কেউ কেউ বললো, ‘পেশাব!’ আর সে কথা শুনেই আমি মরমে মরে যেতে লাগলাম। কেন যে ওকে বাইরে যেতে দিলাম না!

তারপর মন খারাপ করে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে থাকলাম। যথারিতী অনুশোচনা আমাকে একবারে স্তব্ধ করে দিয়েছিলো যেন। সেদিন আর কোনো উচ্চবাচ্য করিনি।

আজ এতকাল পর যখন মাঝে মাঝে এ কথা ভাবি, তখন নিজের কাছে নিজেই লজ্জা পাই। ছোট হয়ে যাই। মনে মনে ক্ষমা চাই আমার সেই সহপাঠিনীর কাছে। আর এও ভাবি যে, সব সময়ই অন্যের সিদ্ধান্তের উপর চলতে হয় না। কখনো নিজেও সিদ্ধান্ত নিতে হয়। নিজের বিবেচনাকেও প্রাধান্য দিতে হয়।

সেদিন যদি আমার সিদ্ধান্তে সহপাঠিনী মেয়েটি বাইরে যেতে পারতো কিংবা মুখ ফুটে লজ্জা কাটিয়ে তার প্রয়োজনটা সে বলতে পারতো, তাহলে এমন বিব্রতকর অবস্থায় তাকে পড়তে হতো না। আমাকেও আজ অবধি অপরাধী থাকতে হতো না। ইয়ে, মানে...


মন্তব্য

ধুসর গোধূলি এর ছবি
জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

হয়নি। তারপরই সে স্কুল বদলালো। তা ছাড়া পিচ্চি পোলাপান ছিলাম বলে ক্ষমার ব্যাপারটি মাথায় আসেনি। তাই এখন গায়েবানা ক্ষমা চেয়ে নিলাম। ইয়ে, মানে...

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

আসিফ মোহাম্মদ আদনান এর ছবি

ম্যানেজমেন্ট থিওরী পড়ানোর সময় স্যার একবার বলেছিলেন, "না কাঁদলে মা-ও দেন না!"; অতএব গলা উঁচিয়ে চাইতে হবে।

আকাশের সীমানা ভাঙ্গতে চাই!

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

শত ভাগ ঠিক বলেছেন!

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

রায়হান আবীর এর ছবি

ভালোই তো লীডারবাজি করছিলেন হাসি *****

---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

তাই তো এখনও পস্তাইতাসি!

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

আরে, আপনার সহপাঠিনীর জন্য তো খুবই মন খারাপ লাগছে!
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

আপনার আজ মন খারাপ। কিন্তু আমার অদ্যাবধি...

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

কীর্তিনাশা এর ছবি

হায় হায় ! আপনে এইরম কাম ক্যামনে করলেন জুলিয়ান ভাই!!
------------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

ইয়ে, মানে...

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

আলমগীর এর ছবি

ব্যাপার না।
একটা দুইটা অঘনট না ঘটলে জীবনে শেখা হয় না।
এতদিন পর যে ঘটনা মনে করে সবার সাথে শেয়ার করছেন, সাধুবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

@আলমগীর
আসলে পাঠকরাই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। আমি নই। শেয়ার করলাম বলে অপরাধের বোঝাটা হালকা মনে হচ্ছে। ধন্যবাদ।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

জুলিয়ান ভাইয়ের লিডারবাজী দেখে আমার ক্লাস ক্যাপ্টেনগুলার কথা মনে পইড়া গেল। তবে ওরা অবশ্য আলাদা ছিল। ঐগুলাই ছিল ক্লাসের বড় বড় বান্দর। তাই আমাদেরও বদমাইশি করতে কোনও সমস্যা হতোনা।

--------------------------------------------------------

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।