নষ্ট সময়-৪

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি
লিখেছেন জুলিয়ান সিদ্দিকী (তারিখ: বিষ্যুদ, ৩১/০৭/২০০৮ - ৩:০০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একটানা সে কাজ করল বেলা একটা পর্যন্ত। শেষ পাইপটার থ্রেড কাটা হয়ে গেলে সালামকে বলল সব গুছিয়ে আলাদা ভাবে রেখে দেবার জন্যে। বিকেল পাঁচটার দিকে পার্টি আসবে মাল নিয়ে যেতে।

তারপর মজিদকে ডেকে বলল, 'মজিদ ভাই হুইনা যাও!'

মজিদ এসে পাশে দাঁড়াতেই সে চোখ তুলে বলল, 'মাহাজন তোমারে জানি কত ট্যাকা দিবো কইছিলো?'

একগাল হেসে মজিদ বলে, 'তুমিই দিয়া দিবা না কি?'

সাগর বলল, 'কইয়াই দেখ না!'

'আমি তো সাতাইশ'শ ট্যাকাই চাইছিলাম!'

ড্রয়ার খুলে পুরো সাতাশ'শ টাকা গুণে মজিদের হাতে দিয়ে সাগর বলল, 'গুইণা লও!'

মজিদ কিছুটা অবাক হয়ে টাকাগুলো হাতে নেয়।

তারপর আঙুলে থুতু লাগিয়ে গুণতে থাকে।

সাগর টালি খাতাটা বের করে তারিখ আর মজিদের নাম লিখে টাকার অংকটা বসায়। মজিদকে বলল, 'ট্যাকা ঠিক মত পাইছো?'

মজিদ বলল, 'পাইছি!'

'এইবার দস্তখত কর! বলে, সাগর টালি খাতাটা মজিদের দিকে ঘুরিয়ে দেয়।

মজিদ বিস্মিত হয়ে বলে, 'আগে ত কোনোদিন দস্তখত করতে অয় নাই!'

'মহাজন থাকলে অসুবিদা অইতো না। আমি নতুন মানুষ বইল্যাই তোমার দস্তখত করতে লাগবো!'

'ঠিক আছে।'

মজিদ কলম না ভেঙে কোনোরকমে দস্তখত সারে।

তারপর বলে, 'আমি তাইলে অহন বাইত্যে যাইতাছি! আইতে কিছু লেইট অইবো!'

সাগর বলল, 'মহাজন এই কথা জানে?'

'জানে। তবু জিগাইলে তুমি কইও!'

'আইচ্ছা কমুনে!'

সাগরের সম্মতি পেয়ে কাজ ফেলে রেখেই প্রায় দৌঁড়ে বেরিয়ে যায় মজিদ।

সাগর দেখল, মজিদ কাজটা শেষ করতে পারেনি। আসলে জীবনের দৌঁড়ে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো সবাই মজিদের মত। দায়িত্বহীন। ড্রয়ারে তালা দিয়ে চাবি পকেটে ফেলে এগিয়ে যায় সে মজিদের মেশিনের দিকে।

তারপর মেশিন চালু করে নিজেই শুরু করে দেয় মজিদের অসম্পূর্ণ কাজটা। আর একবার কাজ আরম্ভ করলে তার সময়ের হিসেব থাকে না।

বাতেন বলল, 'খাইতে যাইবেন না ওস্তাদ?'

'যামুনে!' মেশিনের লিভার ঠেলে দিয়ে বলল, 'তুই খাইয়া ল!'

'আমার খাওয়া অইছে হেই কোন সময়!' বাতেন বলে, 'বেলা দুইটা বাজতাছে খেয়াল আছে?'

সাগর তার কাজ থেকে দৃষ্টি না ফিরিয়েই বলে, 'হাতের কামডা শেষ কইরা লই! তুই ক্যাশের দিক খেয়াল রাখিস!'

বেলা তিনটায় সাগরের কাজ শেষ হয়।

রুমালে কপালের ঘাম মুছে ভাবে, আইজ আর বাইরে গিয়া কাম নাই।

তারপর বাতেনকে বলল, 'আইজ আর খাইতে যামু না। তুই আমারে পরাটা আর ডাইল-ভাঁজি আইন্যা দে!' বলে, সে পকেট থেকে টাকা বের করে দেয়।

বাতেন টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেলে সাগর খুব ক্লান্তি নিয়ে ক্যাশের কাছে টুলটায় বসে।

দু’হাতের ডানা ব্যথা হয়ে গেছে। এমন ভারী কাজ সে অনেকদিনই হলো করে না। ভারী আর মোটা কাজগুলোর তদারক করে শুধু। যেসব কাজে মেধা আর পরিমাপের সূক্ষ্মতার ব্যাপারগুলো জরুরি তা-ই সে আজকাল করে। দু'হাত উপর-নিচ করতে করতে ভাবে, আজকে তার জীবনের একটা বিশেষ দিন। কারণ স্বাধীনভাবে কাজ করার যে আনন্দ, অন্যকে সহযোগীতার যে অহংকার তা বেশ অনুভব করতে পারছে সে।

বাতেন খাবার নিয়ে আসতেই সে খাওয়া আরম্ভ করে দেয়। খাওয়ার মাঝপথেই মহাজন জমির উদ্দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাহের সর্দার আসে। বলে, 'কি মিয়া মাহাজন কোই?'

'আহেন! খাওয়া অবস্থায় সালাম দিতে পারলাম না। কিছু মনে কইরেন না।!'

তাহের সর্দার বললেন, 'ঠিক কথা কইলা না মিয়া! তয় তুমি এইখানে লাঞ্চ করতাছো ক্যালা?'

'মাহাজনের শরীরটা ভালা না। তার লেইগা উনি আইজ আইতে পারেন নাই!'

'তাইলে তো খুবই মুশকিলই হইলো!'

তারপর সাগরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার বললেন, 'আইচ্ছা তুমিই কও দেহি কি বুঝতাছ?'

সাগর অবাক হয়ে তাকায়।

তাহের সর্দার হাতে ইশারা করলে, রিকশাঅলা চটে মোড়ানো একটি জিনিস এনে করে টেবিলের ওপর রাখে।

সর্দার মোড়কটা খুলে সাগরকে বললেন, 'এই ডাইসটা নতুন আনতে গেলে তিরিশ হাজার ট্যাকা লাগবো! আর যদি বানাইতে পারো, আমার খরচা হইবো নয় হাজার ট্যাকা! চিন্তা কইরা দেখছি যে, পারলে তুমিই পারবা! আর না পারলে আরেকটা নতুন কিনন ছাড়া উপায় নাই!'

সাগর পরাটা চিবোতে চিবোতে জিনিসটা উল্টে-পাল্টে দেখে।
বেশ কিছুক্ষণ মাথা খেলিয়ে বলল, 'খুব শক্ত কাম সন্দেহ নাই! তয় পারা যাইবো!'

তাহের সর্দার বলে উঠেন, 'আলহামদোলেল্লা। সাবাস ব্যাটা! আমি জানতাম তোরে ছাড়া এই কাম হইবো না!'

সাগর খেয়াল করে, সর্দার খুশিতে তাকে তুই করে বলছেন।

উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েন তাহের সর্দার। বলেন, 'না পারলে নয় হাজার ট্যাকা আমার লস্ হউক অসুবিধা নাই আর পারলে তোরে কেবল বখশিশই দিমু পাঁচ-হাজার ট্যাকা!'

সাগর বলল, 'অহনই কতা দিতাছি না! তয় জিনিসটা বুঝতে টাইম দিতে অইবো।'

'এই হইলো গিয়া খাঁটি ওস্তাদি কথা!'

খাওয়া শেষ করে সাগরে বলে, 'কম কইরা অইলেও আমারে দশদিন সময় দিতে আইবো!'

'তোরে আমি পনের দিন সময় দিলাম। এই কামডা পারলে পরতেক মাসে তুই অন্তত আট-দশটার অর্ডার পাবি। ব্যাটা মালিয়াত হইতে তোর সময় লাগবো না!'

সাগর সাথে সাথেই একটা অভাবনীয় কাজ করে বসে। সে তাহের সর্দারের পায়ে হাত ছুঁইয়ে বলে, 'দোয়া কইরেন!'

'তোর কর্মটাই মনে করিস আমার দোয়া!' তিনি সাগরের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।

সাগরের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে পানিতে।
এত স্নিগ্ধ ছোঁয়া সে আর কখনো পায়নি। তার মনে হয় বাবার আদর বুঝি এমনই!

'কাইল তোরে মাল পাঠাইয়া দিমু! এইবার একটা নতুন কিনা লইগা!'

তারপর বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন, 'তুই ভাল কইরা বুইঝা লইস। তার বাদে দেখিস কেমুন কইরা তোর কামের অর্ডার পাঠাই!'

সাগর কেমন বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সর্দারের দিকে।

তাহের সর্দার আবার বললেন, 'জমিরুদ্দিরে বাইত্যে পাওয়া যাইবো না?'

'যাইবো।'

'অখন যাই! জমিরুদ্দির লগে দ্যাখা কইরা যামুগা!'

তাহের সর্দার চলে গেলে সাগরের চোখ আবার পানিতে ভরে উঠতে চায়।

(চলবে..)


মন্তব্য

রাফি এর ছবি

পড়লাম। এবার একটু কষ্ট কম হল........।...।

---------------------------------------
অর্থ নয়, কীর্তি নয় ,স্বচ্ছলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

কীর্তিনাশা এর ছবি

চালিয়ে যান জুলিয়ান ভাই। ভালোই লাগছে।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।