নষ্ট সময়-৫

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি
লিখেছেন জুলিয়ান সিদ্দিকী (তারিখ: শুক্র, ০১/০৮/২০০৮ - ৮:৩৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

খুব ভাল লাগছিল সাগরের।

ভাদ্র মাসে যখন তাল পাকা গরম পড়ে, মানুষ তো পরের কথা জন্তু জানোয়ারও অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে গরমে। সে সময় কয়েক মিনিটের তুমুল বৃষ্টি জুড়িয়ে দিতে পারে প্রকৃতির কোল। রাস্তায় লাগিয়ে দিতে পারে হাঁটু-জল। তেমনি অন্যান্য দিনের চাইতে আজকের দিন কাজ হয়েছে ডবল। কাজের অর্ডারও হয়েছে বেশ। পুরোটা সপ্তাহ জুড়ে কাজ করেও সব অর্ডার সময় মত ডেলিভারি দিতে পারবে না বলে মনে হয় তার।

সন্ধ্যার দিকে জিআই পাইপের পার্টি তাদের মাল ডেলিভারি নিতে এসে কাজের মান দেখে বেজায় খুশি। তারা তার সঙ্গে একটি চুক্তিতে আসার প্রস্তাব করলো।

সাগর মনেমনে সেটা লুফে নিলেও বলল, 'মালিকের লগে একবার আলাপ করলে ভাল করতেন না? হয়তো কিছু কমেও কাজগুলা করাইতে পারতেন!'

ওরা বলল, 'এমনিতেই ভাল কাজ চাই আমরা! সস্তার কাজ আমরা ভাল মনে করি না! সামনের সপ্তাহে আমরা ডিড লিখে নিয়ে আসবো। আপনার মালিকের পছন্দ হলে চুক্তিতে আসবে। না চুক্তি হলেও ক্ষতি নেই। কাজ আমরা এখানেই করাবো!'

সাগর বলল, 'কাজ যেইখানে ভালা অইবো সেখানেই তো করাইবেন। আমরা ত চ্যাষ্টা করি পাট্টি যাতে ভাল কাম পায়!'
খুশি মনে ওরা চলে গেল। পাওনা বাকি রাখল না একটা টাকাও।

ততক্ষণে মজিদ ফিরে এসেছে। অবস্থা দেখে বলল, 'সাগর মিয়া, তোমার হাতে বরকত আছে। আল্লায় তোমার ভালা করুক। ট্যাকাটা আইজ পাওয়াতে খুব উপকার হইল। তোমার ভাবির ব্যাথা উঠছিল আমি যাওনের একটু আগে। হাতে ট্যাকা থাকনে সব কাজই খুব সোন্দর মতন হইছে!

'পোলা না মাইয়া?'

জানতে চায় সাগর।

মজিদ বলল, 'তোমার ভাতিজা অইছে!'

'এইডা কত নম্বর?'

'পরথম!'

'কি নাম রাখবা?'

কিছুটা লাজুক হেসে মজিদ বলে, 'সাগর!'

'সাগর ক্যান?'

'তোমার নামে নাম অইলে তোমার মতন বড় মনের হইবো!'

'পোলার নাম আতর আলি রাখলে কি তার গতর থাইকা আতরের বাস আইবো মনে কর? যদি আমার মতন কপাল তার হয়, তাইলে জীবনে বহুত কষ্ট পাইবো!'

'আরে কয় কি? কষ্ট না পাইলে মানুষ ঠিক মত মানুষ অয় নাকি?'

মজিদের কন্ঠে যেন কিছুটা উত্তাপ ঝরে পড়ে।

কথাগুলো যাতে অন্যদিকে মোড় নিতে না পারে সে জন্য সে নিজে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকে। সে লক্ষ্য করে যে, মজিদ চুপ করলেও কেমন যেন বিমর্ষ ভাবে তাকিয়ে থাকে। সেটা পাত্তা না দিয়ে সে শেষবারের মত আজকের সব কাজ আর অর্ডারের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বলল, 'সবাইত্ত গেছে গিয়া। তুমি আর দেরি করতাছো ক্যান? আমি মাহাজনের বাইত্যে যাইতাছি!'

মজিদ বলল, 'হাচাই কইতাছ?'

'তুমি কি আমার দুলাভাই লাগ নাকি যে, তোমার লগে মস্কারি করুম?'

মজিদ কাঁধের গামছাটা দড়িতে ঝুলিয়ে দিয়ে দেয়ালে আটকানো একটা আয়নার ভাঙা টুকরায় তাকিয়ে চুল আঁচড়ায়।

তারপর সাগরের দিকে ফিরে বলে, 'সাটার বন্ধ করবা না?'

'করতাছি!' বলে, সাগর ক্যাশের সমস্ত টাকা আর টালি খাতাটা নিয়ে বলল, 'তোমার বাসা তো ওই দিকেই?'

'হ!'

'তাইলে চল একলগেই যাই! আমারে নামায় দিয়া তুমি রিকশা নিয়া যাইবাগা!'

তারপর নিচু কন্ঠে বলে, 'লগে মোটামুটি ভালা ট্যাকাই আছে! একলা যাওন ঠিক অইবো না!'

'ঠিকই কইছো!'

মজিদ সায় দেয় সাগরের কথায়।

ভেতরের লাইট নিভিয়ে দিয়ে সার্টার বন্ধ করে তালা আটকে দেয় সাগর।

তারপর সেগুলোকে আবার টেনেটুনে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে মজিদকে বলল, 'আগ বাড়াও!'

সারাদিন পর অবসর হতেই তার মনে পড়ল টুনির কথা। তার টুনি। আদরের টুনি। ঘড়িতে সময় দেখে। ঘন্টার কাঁটা রাত দশটার ঘর পেরিয়ে গেছে। মনে মনে কিছুটা অস্থির হয়ে ওঠে সে। মজিদ রিকশা ডেকে দাঁড় করালে তাতে চড়ে বসে বলে, 'লালবাগ!'

রিকশা চলতে আরম্ভ করলে সে অবাক হয়ে গেল এই ভেবে যে, আজ তার চারপাশের লোকজনকে খুব একটা ভাল মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যে, এ সমস্ত লোকের ভিড়েই লুকিয়ে আছে কোনো ছিনতাইকারী। গুন্ডা-বদমাশ।

সে মনে মনে দোয়া-দুরুদ পড়তে থাকে। একসময় তাদের রিকশা নিরাপদ সীমায় প্রবেশ করে।

মরিয়ম ভিলার দরজার সামনে দঁড়িয়ে কড়া নাড়ে সাগর। কান পেতে রাখে ভেতরের দিক থেকে কোনো পায়ের আওয়াজ ভেসে আসে কি না।

এক সময় মৃদু থপ্-থ্প শব্দ ক্রমশ এগিয়ে আসতেই সে মজিদকে ইঙ্গিত করে এগিয়ে যাবার জন্যে।

মজিদ রিকশাঅলাকে তাড়া দেয়।

লতা এসে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে তার স্বভাবসিদ্ধ প্রশ্ন করার আগেই সাগর বলল, 'আমি খুব ঝামেলায় আছি!'

লতা যেন অন্য এক সাগরকে আবিষ্কার করে বিস্ময়াহত হয়ে তাকিয়ে রইলো। আর সেই অবসরে তাকে পাশ কাটিয়ে সাগর ঢুকে পড়ল বারান্দায়।

তারপর মহাজনের রুমের রজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, 'মাহাজন! হুইয়া পড়ছেন নিকি?'

জমিরুদ্দিন হয়তো অপেক্ষায় ছিলেন। বললেন, 'আয় বাপ, ভিতরে আয়!'

সাগর টাকাগুলো বের করে মহাজনের হাতে তুলে দিয়ে বলে, 'গুইণা দেহেন ঠিক আছে কি না। এহানে ছয় হাজার তিন-শ ট্যাকা আছে!'

জমিরুদ্দিন নিবিষ্ট মনে টাকা গুণে বললেন, 'ঠিকই আছে। এইবার সব হিসাব দে!'

'আপনের কথামত ক্যাশে থাকনের কতা আছিলো চাইর হাজার। আমি গুইণা বাইছা পাইলাম চাইর হাজার আট-শ।’

জমিরুদ্দিন বুদ্ধি করে বললেন, 'ওই পাঁচ-শ ট্যাকার কথা মনে অইছে তুই যাওনের পর! আর খুচরা তিন-শ ট্যাকা আছে ক্যাশের পাহারা। ওই ট্যাকা হিসাবে আনতে নাই!'

'আমি তো মনে করছি আপনের ভুল অইছে। তার লাইগাই তো সব লইয়া আইলাম!'

'আরে পাগলা করছস কি ? তুই ক্যাশের পাহারাও তুইলা আনছস! তাইলে কি ক্যাশ খালি?'

সাগর লজ্জিত ভাবে জানায়, 'দশট্যাকা রাইখা আইছি!'

'তাও চলবো!'

জমিরুদ্দিন আস্বস্ত হয়ে বলেন।

তারপর আবার বললেন, 'শুইনা রাখ ছেড়া! ক্যাশ বাক্স, তবিল আর পকেট, এই তিনডা জাগা কোনো দিন খালি রাখতে নাই!'

সাগর বলল, 'সর্দার সাব আইছিলেন। তানি কইলেন, আমি যদি তার চাক্কিডা বানাইতে পারি, তাইলে আমারে দিবো পাঁচ হাজার ট্যাকা বখশিশ। মাসে আট-দশটা কাম পাঠাইবো!'

জমিরুদ্দিন খুশি হয়ে বলেন, 'আমার লগে তার কথা হইছে। তুই পারলে তোর বেতন ছাড়াও এই কামডার মজুরী পাবি আধা-আধি। কারণ তোর লেইগা আমার কারখানার নাম হইবো। নতুন নতুন কাস্টমার আইবো। বুঝলি ব্যাটা? তুই তো মালিয়াত হইয়া যাবি! তহন তো অর্ধেক রাজ্য আর রাজ-কইন্যা তোরই!'

(চলবে..)


মন্তব্য

মনজুরাউল এর ছবি

উপন্যাসের কিস্তিতে মন্তব্য করা দুষ্কর। দেখা যাবে আমি যা ভেবে মন্তব্য করলাম পরের কিস্তিতে তা এক শ'আশি ডিগ্রী মোড় নিল !

অতএব নো কমেন্টস ! চালিয়ে যান। ধন্যবাদ।

.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

কমেন্ট না করে একটা দেঁতোহাসি মেরে গেলেই চলবে। দেঁতো হাসি

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

- উপরের কমেন্টের প্রতিধ্বনি।

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

রাফি এর ছবি

চলুক...
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

ভাবছি ক্লান্ত না হয়ে পড়ি।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

দেবোত্তম দাশ এর ছবি

ভীষন ভালো লাগছে ।

------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।