নষ্ট সময়-৯

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি
লিখেছেন জুলিয়ান সিদ্দিকী (তারিখ: শুক্র, ০৮/০৮/২০০৮ - ২:১৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সাগর হাঁটতে হাঁটতে মতিঝিল সেনাকল্যাণ ভবনের সামনে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনা সামনি চলে আসে। কিন্তু তেমন কোনো লোকজন দেখতে পায় না। মাত্র তিন-চারটা রিকশা আছে। ওগুলোর চালকরা বসে আছে শকুনের মত দৃষ্টি নিয়ে। কোনো বিপদগ্রস্থ যাত্রী পেলে ইচ্ছে মত ভাড়া হাঁকতে পারবে।

সাগর একটা অটোরিকশার আশা করছিল। কিন্তু কোনো অটোরিকশা বা মিশুক কিছুই দেখতে পেল না। রাত বিরাতে চলতে গেলে পদে পদে বিপদ ওত পেতে থাকে। তাই সে রিকশায় না গিয়ে অটোরিকশার অপেক্ষা করতে থাকে। এমন সময় একটা ট্যাক্সি ক্যাব এসে থামে তার সামনে। সে একটু ঝুঁকে পড়ে চালককে বলল, 'কদ্দুর যাইবেন ভাই?'

'আপনে যাইবেন কই?'

চালক পাল্টা জিজ্ঞাসা ছুঁড়ে দেয়।

'আমি তো যামু নিমতলীর দিকে।

'চলেন যাই!'

'ভাড়া কি মিটারে দিতে অইবো?'

'আপনের ইচ্ছা!'

'ভাড়া কত আইতে পারে?'

'বেশি আইবো না! খুব বেশি হইলে তিরিশ-চল্লিশ ট্যাকা!'

'চলেন!' বলে, ক্যাবে চড়ে বসে সাগর।

রাতের শহর ঝিমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই। রাস্তায় যান-বাহনের তেমন উপস্থিতি নেই। বেশ ভাল লাগছিল সাগরের। তাজা বাতাসের ছোঁয়া তাকে ভিন্নতর একটা আনন্দের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে। ক্যাবের ভেতর বসে থেকে নিজকে এ মূহুর্তে ওপর-তলার মানুষগুলোর মতই মনে হয়।

বেশিক্ষণ লাগল না। ঘড়ি ধরে দশ মিনিটের মাথায় ট্যাক্সি চলে আসে নিমতলীর মোড়ে। হাতের ডানে ফজলুল হক হল রেখে, সাগর বলল, 'থামেন, থামেন!'

ট্যাক্সি থামলে নেমে আসে সাগর। গাড়ির জানালায় উঁকি দিয়ে মিটার দেখে। লাল সবুজ অনেকগুলো সংখ্যা। সে বুঝতে পারে না কোনটা টাকার অংক। চালককে জিজ্ঞেস করল, 'কত আইলো ভাই?'

'পাইতিরিশ ট্যাকা!' বলে, চালক মিটারের সবুজ সংখ্যার ওপর হাতের আঙুল রাখে।

সাগর টাকা বের করবার অবসরে ঘড়িতে সময় দেখে। রাত তিনটা।

তারপর পকেট থেকে টাকা বের করে চালকের হাতে দু'টো বিশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, 'বাকিডা তোমার!'

চালক খুশি হয়ে টাকাটা কপালে ছোঁয়ায়।

তারপর গাড়িতে স্টার্ট দেয়।

সাগর পাশে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সিটার চলে যাওয়া দেখে। কিছুক্ষণ এমনি এমনিই দাঁড়িয়ে থাকে। যেন আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসার পর মাটিকে চিনতে কিছুটা সময় নেয়া।

তারপর গলি ধরে আস্তে-ধীরে হাঁটে। টুনির ঘরের জানালা খোলা ছিল। ভেতরে অন্ধকার। জানালার সামনে যেতেই ভেতর থেকে টুনি বলল, 'এত দেরি?'

সাগর বলে, 'গাড়ি পাইতে দেরি অইয়া গ্যাল! আর আইতে যাইতে সময় তো কম লাগে না! আর গেছিলামও দেরি কইরা!'

টুনি দরজা খুলে দিয়ে অন্ধকারেই সাগরকে ভেতরে ঢুকতে বলে।

সাগর ঘরে ঢুকতেই টুনি বলল, 'দরজা আবজাইয়া দেও!'

দু'হাত পেছনের দিকে নিয়ে দরজাটা ঠেলে বন্ধ করে দেয় সাগর।

টুনি জানালা বন্ধ করে দিয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেয়।

ঘরের মেঝেতে একটা মাদুর বিছানো শুধু। আর কিছু নেই। এক কোণে নতুন হাড়ি-পাতিল বাসন গ্লাস, একটা কেরসিনের স্টোভ দেখা যাচ্ছে। বসতে হলে সাগরকে মাদুরেই বসতে হবে। তাই এক রকম বাধ্য হয়েই জুতো খুলে মাদুরের ওপর বসে সাগর।

'হাত-মুখ ধুইবা না?'

সাগর বলল, 'রাইত তো আর বেশি নাই! ধুইয়া কি অইবো?'

'বারে!' টুনি আশ্চর্য হয়ে বলে, 'চাইরডা ভাত খাইবা না?'

মুখ কাচুমাচু করে সাগর নিজের পেটের ওপর হাত রেখে বলল, 'আইজ অনেক খাইছি!'

টুনি হতাশ কন্ঠে বলে, 'হায় আল্লা! আমি এত কষ্ট কইরা রাইন্দা থুইলাম কার লাইগ্যা?'

সাগর নির্বিকার ভাবে বলে, 'অহন যতই কও, এক চিমটাও খাওন যাইবো না!'

সাগরের কথা শুনে টুনির মুখটা ম্লান হয়ে যায়।

নিজের পেছন দিকে দু'হাত নিয়ে শরীরের ভর রেখে সাগর বলল, 'তুমি বও! কতা আছে! আমি অহন আজগরের ওহান থেইক্যা আইলাম!'

টুনি খুব আগ্রহ নিয়ে সাগরের পাশে বসেই তার হাঁটু ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল, 'ঘটনা কি সত্য?'

'তোমারে বেইচ্যা দেওনের ঘটনা কতটুক হাচা-মিছা ওইডা জানি না! তয় আজগর ভাইরে দেখলাম আরামেই আছে! তার নতুন বউ কমলারে দেখলাম। তোমার চাইয়া অনেক সোন্দর! কইল, তুমি আজগর ভাইরে তালাক দিয়া দ্যাও। ক্ষতি পূরণ হিসাবে পাইবা পাঁচ হাজার ট্যাকা।'

টুনি বলল, 'আমার ক্ষতিপূরণের কাম নাই। কোনো ঝয়-ঝামেলা না থাকলেই অইলো!'

সাগর বলল, 'কমলা কইছে তোমার উপরে কোনো বিপদ য্যান না আহে, তা দেখবো!'

'কিন্তুক!' বলে, টুনি থামল। কিছু ভেবে নিয়ে ফের বলল, 'তালাক কেমনে দিমু? আমাগো তো কাবিন অয় নাই! মুন্সি আইয়া বিয়া পড়াইয়া দিয়া গেছে। আমি তো কবুলও কই নাই!'

'তাইলে বিয়াডা অইলো ক্যামনে?'

সে কিছুক্ষণ টুনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তারপর বলে, 'আইজ সবই আমার লাইগ্যা ভালা খবর আইতাছে। আজগর ভাই যেই পাঁচ হাজার ট্যাকা তোমার দাম ধরছিল, ওইডা কমলা নিজেই পেট-কাটা বাদলরে দিয়া দিবো কইছে। তুমি মনে কয় বাঁইচা গেলা!'

টুনি হুট করে সাগরের উরুর ওপর মাথা রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। সেই সাথে দু'হাতে সাগরের এক হাত জড়িয়ে ধরে বলে, 'আর কি খুশ-খবর আছে কও! আইজ আমি ঘুমামু না! তোমার লগে কতা কইয়াই রাইত পার কইরা দিমু!'

তারপর সাগরের হাতটা গালের ওপর চেপে ধরে বলে, 'কত্ত আশা আছিলো এই বুকটার ভিতরে। কিছুই মিটলো না! তুমি কতা কও, আমি পরাণ ভইরা হুনি!'

টুনির উচ্ছ্বাস দেখে হাসল সাগর।

তারপর বলল, 'আইজগা তাহের সাব বইলা নতুন পাট্টি একটা কাম আনছে। ওইডা যদি কইরা দিবার পারি তাইলে পাঁচ হাজার ট্যাকা বকশিশ পামু! মাহাজন কইছে তার লাভের অর্ধেকও আমারে দিবো!'

'ওহ্ ,আল্লায় বুজি তোমার দিন ফিরাইলো!' বলে, কাত হয়ে সাগরের কোমর জড়িয়ে ধরে টুনি।

সাগর নিজের অজান্তেই টুনির পিঠে হাত বুলাতে থাকে।
(চলবে..)


মন্তব্য

দেবোত্তম দাশ এর ছবি

হুমম্ দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গড়ায় । ভালোই চলছে । প্রত্যাশা নিয়ে পড়ছি

------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

তানবীরা এর ছবি

পরের পর্বের আশায় রইলাম।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

আনিসুর রহমান ফারুক এর ছবি

জমে উঠছে। সামনে বুঝি আরো রোমান্স?

চালিয়ে যান।

সেই শুভবাদী রোদ

সেই শুভবাদী রোদ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।