কানামাছি

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি
লিখেছেন জুলিয়ান সিদ্দিকী (তারিখ: রবি, ১৯/১০/২০০৮ - ৪:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[img=auto]প্রচ্ছদপ্রচ্ছদ[/img]

মধু যে এত উপাদেয় আর গুণের অধিকারি, নানা ভাবে আমরা এর স্বাদ আস্বাদন করি; কিন্তু মউয়াল যখন তা আহরণ করে, তখন এর সঙ্গে মিশে যায় মউয়ালের হাতের ময়লা, কিংবা সে যখন কাজ করা কালীন তার পুরোনো হুঁলের ক্ষত চুলকায় তখনকার হাতের নখে লেগে থাকা ক্ষতের পুঁজ-রক্ত, কখনো বা নাক ঝাড়ার ফলে হাতে লেগে থাকা সর্দি, মৌমাছির বিষ্ঠা, মোম আর ছাই। আমরা এ নিয়ে তেমন একটা ভাবি না। যেমন ভাবি না একজন বিত্তবানের বৈভব দেখে তার চাকচক্যের পেছনের অন্ধকার। ভাবি না একজন সাধারণ কর্মচারি হয়ে বছর না পেরোতেই বদলে যায় তার পোশাক আশাক, আচার আচরণ। আমরা মধুর সুস্বাদেই অভ্যস্ত, এর মাঝে মিশ্রিত বিষ্ঠা,মউয়ালের ক্ষতের পুঁজ-রক্ত, সর্দি, ছাই আর মোমের স্বাদ কেউ অনুভব করি না।

তেমনি রেবেকা খাতুনও এতদিন অনুভব করতে পারেননি যে, তাঁর সংসারের সুখ-ঐশ্বর্য আর স্বামী এখলাস উদ্দিনের বিত্ত-বৈভব-প্রতিপত্তির সাথেও মউয়ালের ক্ষতের রক্তের মত, মৌমাছির বিষ্ঠা, মোম ও ছাইয়ের মত মিশে আছে সমাজের অন্ধকার জগতের নোংরামি, পাপ, আর অনাচারে পূর্ণ পুঁতি-দুর্গন্ধময় কর্মকান্ড।

এর কিছুই অবশ্য তিনি জানতে পেতেন না, যদি ঘটনাক্রমে তাঁর স্বামী এখলাস উদ্দিনের নারী কেলেঙ্কারি আর চোরাকারবারীর কথা পত্রিকার পাতায় ফাঁস হয়ে না যেত। যদি না পুলিশ, সাংবাদিক আর দূর্নীতিদমন কমিশনের লোকজন এসে তাঁর বিশাল ড্রয়িংরুমে একই সাথে জড় হতেন। এতটা বছর যে তিমিরে তিনি বাস করেছেন, রয়ে যেতেন সেখানেই। স্বামীর ভালমানুষীর মুখোশের আড়ালে লুকোনো কদর্য চেহারাটাও দেখতে পেতেন না কখনো।

এতদিন কেবল এখলাস উদ্দিনের মুখোশটাকেই ভালবেসেছেন। শ্রদ্ধা করেছেন। এ মুখোশের কারণেই গর্বস্ফীত বুকে সমাজে আর আত্মীয়-পরিজনের মাঝে মাথা উঁচু করে চলেছেন। কিন্তু এখন তিনি কী করবেন? তাঁর এতদিনকার অহঙ্কার, বিশ্বাস সব যে ভূলুণ্ঠিত হতে চলেছে। তিনি বলতে গেলে ড্রয়িং রুম থেকে এসে এখানে লুকিয়ে আছেন। এতক্ষণে হয়তো টিভির লোকেরাও ক্যামেরা নিয়ে চলে এসেছে। কোন মুখ নিয়ে তিনি এখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন? কোন অহঙ্কারে নিজকে উপস্থাপিত করবেন মিডিয়ার সামনে? তাঁর যে এখন মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে এগার তলার জানালা গলে নিচের রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়তে। এতকাল কি তাহলে পাপের অর্থে তাঁর এবং সন্তানদের শরীরের রক্ত-মাংস বিকশিত হয়েছে? তাহলে তাদের শরীরের রক্ত-মাংস বোধ-বুদ্ধির কোনোটাই বৈধ নয়? তিনি যে এতকাল ন্যায়-নীতিবোধ আর শূচীতার অহঙ্কার করে এসেছেন, তা কি বিসর্জন দেবেন? তাঁর অহংবোধ কি পর্যবসিত হবে অপার শূন্যতায়? নিজকে কৃমি বা কেঁচো থেকে আলাদা করে ভাবতে পারেন না রেবেকা খাতুন। আর এমন একটি ঘিনঘিনে ব্যাপার মনে আসতেই মুখে বালিশ চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি।

আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর স্বামী এখলাস উদ্দিনের যাবতীয় অপকর্মের দায় কাঁধে নিয়ে ড্রয়িং রুমে হাজির হতে হবে তাঁকে। উপস্থিত লোকজনের প্রশ্নের জবাবে কী বলবেন তিনি? যদিও তিনি কিছুই জানেন না, তবুও কি পারবেন এই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে? কেউ কি বিশ্বাস করবে যে, স্ত্রী জানেন না স্বামীর আয়ের উৎস কি? তিনি কি মুখ বুঁজে এমন আলিশান ফ্লাটে উঠে এসেছেন, অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন বিলাস সামগ্রী আর দামীদামী সব আসবাব ব্যবহারে? স্ত্রী হয়ে একবারও কি তিনি জানতে চেয়েছেন যে, সামান্য ক্লার্ক থেকে দশ বছরের মাথায় কী করে, কোন পথে তিনি এমন বিশাল অর্থ সম্পদের মালিক হয়ে গেলেন?

তিনি যে স্বামীকে কিছুই একবারে জিজ্ঞেস করেন নি তা কিন্তু নয়। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, ‘কী এমন ব্যবসা তোমার যে, কাঁড়িকাঁড়ি টাকা আসে?’
স্ত্রীর প্রশ্নে ঘর ফাঁটিয়ে হেসে উঠেছিলেন এখলাসউদ্দিন এবং স্ত্রীকে সঙ্গে সঙ্গেই বলেছিলেন, ‘তুমি যখন একলাখ টাকা আমার হাতে তুলে দিয়েছিলে, আমি কি জানতে চেয়েছিলাম যে, শ্বশুর সাহেব এত টাকা কোথায় পেলেন?’

রেবেকা খাতুনও চুপ থাকতে পারেননি। বলেছিলেন, ‘তোমাকে আমি আগেই বলেছি যে, সাভারের জায়গাটা বাবা বিক্রি করে দিয়েছেন!’

সান্ধ্যকালীন পার্টিতে যোগ দেওয়ার জন্য নিজকে পরিপাটি করে সাজাতে ব্যস্ত এখলাস উদ্দিন চুলে স্প্রে করে ড্রেসিং টেবলের আয়নায় নিজকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলেছিলেন, ‘তুমি নিজ থেকেই বলেছো। আমি একবারও জানতে চাইনি!’

‘তবুও তোমাকে টাকার উৎস সম্পর্কে বলেছি! কিন্তু তুমি তোমারটা বলোনি! বলোনি কখনো যে, তোমার ব্যবসাটা কি? আমি ভেবে পাই না একজন ক্লার্ক কী করে এত দ্রুত ব্যবসার যাবতীয় গোপন রহস্য জেনে ফেলে?’

‘সেটা কমনসেন্স!’

এখলাস উদ্দিন নিজের মাথায় টোকা মেরে বলেছিলেন।

তারপর ফের বলেছিলেন, ‘একজন ব্যবসায়ীকে জানতেই হবে যে, কোন সিঁড়িতে পা রাখলে দ্রুত উঠা যাবে আর কোনটা দিয়ে সাবধানে উঠতে হবে।’

বলতে বলতে এখলাস উদ্দিন এগিয়ে এসে রেবেকা খাতুনকে আদর করে বুঝিয়েছিলেন, ‘তোমাকে বলেছি না, আমার দারিদ্র্যের কারণে প্রথম বউ দু'সপ্তাহের মাথায় পালিয়ে গিয়েছিলো? তাই বলি, এত জটিল বিষয়ে মাথা ঘামিও না সোনা! একজন ক্লার্কের বউ হয়ে যথেষ্ট কষ্ট করেছ! এখন প্রশ্ন করে নিজের সুখের ঘরে কেন কাঁটা দেবে?’

এখলাস উদ্দিন ঘরময় দামী সেন্টের সুবাস ছড়িয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন রেবেকা খাতুন অনেক ভেবেছেন কিন্তু স্বামীর কথায় কোনো অন্যায় বা অন্যায্য কিছু খুঁজে পাননি। এখন তাঁর মনে হচ্ছে যে, সত্যিই তিনি বোকা। তাহলে সেদিন স্বামীর দুটো নরম কথায় গলে না গিয়ে আরও কিছুটা কঠিন হতে পারতেন। আর সেদিনের কাঠিন্যের সুফল হিসেবে আজ তাঁকে এবং পুরো পরিবারকে এমন বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হতো না।

লোকজন ড্রয়িং রুমে বসে আছে প্রায় আধ ঘন্টা হয়ে গেলো। তারা যে বিরক্ত আর অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে তা তাদের গুঞ্জরণ থেকেই অনুমান করা যায়।

রেবেকা খাতুন এখলাস উদ্দিনের সাথে সেল ফোনে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন বারবার। যতবারই রিং করেছেন প্রতিবারই অ্যাঙ্গেজ টোন পেয়েছেন। লোকটার সাথে কথা বলতে পারলে অবশ্য একটা উপায় বেরিয়ে আসতো। তিনি নিজে একাএকা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। চোখ মুছে তিনি আবার এখালাস উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করতেই সংযোগ পেয়ে গেলেন। আর সংযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই তিনি হড়বড় করে বলতে লাগলেন, ‘বাড়িতে পুলিশ, অ্যান্টিকরাপশনের লোক আর সাংবাদিক গিজগিজ করছে! আমি ওদের কি বলবো বুঝতে পারছি না!’

এখলাস উদ্দিন ফোনে জানালেন, ‘বলে দাও সব মিথ্যা, বানোয়াট! সাজানো ঘটনা! আমি পত্রিকার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করবো! তুমি ভয় পেয়ো না, সব ঠিক হয়ে যাবে!’

‘তাহলে তুমি পালিয়ে আছ কেন?’

‘পালাইনি! হাজি ক্যাম্পে আছি। তুমি লোকজনকে বলো হাজি ক্যাম্পে এসে আমার সঙ্গে কথা বলুক!’

‘লোকজন কি কথাটা বিশ্বাস করবে?’

‘তুমি বল ওদের!’

এ কথা শুনবার সাথে সাথেই যেন তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস আবার স্বাভাবিক হয়ে এলো। তিনি উঠে এলোমেলো চুলগুলোকে টেনে খোঁপা বাঁধলেন। তারপর মাথায় অর্ধেক ঘোমটা টেনে প্রসাধনবর্জিত অবস্থায় ড্রয়িং রুমে এসে উপস্থিত হলেন।

গুলশান থানার ওসি খালেকুজ্জামান খেঁকিয়ে উঠল, ‘রেবেকা ম্যাডাম কোথায়? তাকে এখানে আসতে বলো!’

ওসির প্রশ্নে রেবেকা খাতুন এতটাই হকচকিয়ে গেলেন যে, কী করবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। আধ ঘন্টার ব্যবধানে তাঁর চেহারায় কী এমন পরিবর্তন হয়ে গেল যে, এতবার দেখা হওয়ার পরও ওসি নিজেই চিনতে ভুল করে ফেলল? তবে খুব দ্রুতই নিজকে সামলে নিলেন রেবেকা খাতুন এবং নাটকীয় ভাবে প্রায় ভুলে যাওয়া আঞ্চলিক ভাষায় বলে উঠলেন, ‘হ্যাতাইনের শইল ভালা না! আফনেরারে কইছে সাবের লগে কথা কইতেন!’

খালেকুজ্জামান দুর্নীতিদমন কমিশনার হেদায়েত উল্লার মুখের দিকে তাকালো। চোখে তার পরিষ্কার প্রশ্ন, এ সবের মানে কি?

হেদায়েত উল্লার মুখে হাসি থাকলেও কেমন যেন ছাই মাখানো মনে হয়। যার অর্থ শিকার ফস্কে গেল!

খালেকুজ্জামান বলল, ‘তুমি কি বলছ বুঝতে পারছো তো?’

‘ম্যাডাম অহন সাবের লগে কতা কইছে! বিশ্বাস না অইলে সাবেরে মোবাইল করেন!’

বিভ্রান্ত ওসিকে আরো বিভ্রান্ত করতেই যেন রেবেকা খাতুন বিশ্বাসঘতিনীর মত নিচু কন্ঠে আবার বললেন, ‘সাবে হাজি ক্যাম্পো আছে! মোবাইল নম্বর আইন্যা দিতাম নি?’

‘না না!’

খালেকুজ্জামান তলপেটে লাথি খাওয়ার মত গুঙিয়ে উঠলো। ‘নাম্বার আমাদের কাছে আছে!’

রেবেকা খাতুন একুশে টিভির পানুকে চিনতে পারলেন। চিনতে পারলেন একটি দৈনিকের চিফ রিপোর্টার আনিসকে। কিন্তু সাদামাটা রেবেকা খাতুন সবার কাছে অপরিচিত বলে কারো প্রশ্নের সম্মুখিন হলেন না। আর তখনই তাঁর মাথায় একটা নতুন আইডিয়া আসে। তার আগে লোকজনকে বিদায় করতে তিনি আরো একটি নতুন কৌশল প্রয়োগ করেন। বলেন, ‘আফনেরা বইয়া চা খান আর সাবের লগে কথা কন! আমি চা বানাইয়া আনি!’

‘চা লাগবে না! আমরা এখন বেরোবো!’ বলতে বলতেই খালেকুজ্জামান দাঁড়িয়ে পড়ে। তার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্যরাও।

রেবেকা খাতুনের ঠোঁটে সূক্ষ্ম এক ফালি হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। যা কারো নজরে আসে না। তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবার চলে যাওয়া দেখেন। মনেমনে ভাবেন যে, খালেকুজ্জামানের মত এত বোকা আর স্মরণশক্তিহীন মানুষ কী করে অত বড় পোষ্টে নিয়োগ পায়? অবস্থা এমন হলে তো দেশে ক্রিমিন্যালের সংখ্যা বাড়বেই!

দুই

লোকজন চলে গেছে অনেকক্ষণ।

রেবেকা খাতুন ঘরে এখন একা। কাজের বুয়া ছুটিতে গিয়েছিলো দুদিনের কথা বলে। কিন্তু চারদিন পেরিয়ে গেলেও আজতক সে আসেনি। সারা সকাল তিনি এতটাই বিহ্বল ছিলেন যে, একগ্লাস পানিও মুখে দিতে পারেননি। পারেননি বাসি মুখে পানি বা ব্রাশ লাগাতে। এতক্ষণে যেন তিনি নিজের জন্যে ভাববার সময় পেলেন। বিছানা থেকে নেমে ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়ান তিনি। একি! এ কাকে দেখছেন তিনি? আধ ঘন্টার টেনশন এতটাই প্রভাব ফেলতে পারে যে, তাঁর মুখের বলিরেখাগুলোও এরই মধ্যে হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে? বলিরেখা এমন করে ফুটে উঠবে, এতটা তো বুড়িয়ে যাননি তিনি। তাহলে কি মানসিক বিপর্যয় মানুষের শরীরেও প্রভাব ফেলে?

দাঁতে ব্রাশ চালাতে চালাতে তিনি অনুধাবন করতে পারলেন যে, কেন ওসি খালেকুজ্জামান তাঁকে চিনতে পারেনি! এমন আরো অনেকেই বিভ্রান্ত হতে পারে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে তিনি প্রথমেই ফ্রিজ খুলে দেখেন, খাওয়ার মত কিছু আছে কি না। কিন্তু তিনি খেতে পারেন এমন কিছুই পান না। মিষ্টি জাতীয় খাবার অনেকই আছে। কিন্তু এখন আর ওসব ভালো লাগে না। কী করা যায়? চাল ডাল পেলে তিনি এখনই রান্না করে খেতে পারতেন। কিন্তু কাজের বুয়ার হাতে কিচেনের ভার থাকায় তিনি বলতে পারবেন না যে কোথায় এসব রাখা আছে।

কিচেনে ঢুকে কেবিনেটগুলো এক এক করে খুলে দেখলেন। যতগুলো কৌটা, টিন আর বাক্স ছিলো সবই দেখলেন। কিন্তু চাল-ডালের হদিস পেলেন না। তিনি অবাক হয়ে ভাবলেন, এ বাড়ির লোকজন তাহলে খায় কি? গতকাল কিংবা এরও আগে অর্থাৎ সপ্তাহ খানেকের ভেতর তিনি ডাল আর ভাত খেয়েছেন কিনা বলতে পারবেন না। তাহলে খেয়েছিলেন কি? তিনি আশ্চর্য হলেন এই ভেবে যে, অনেক দিন হয় তিনি ডাল দিয়ে মেখে সাদা ভাত খাননি। গতকাল লিডিয়ার সঙ্গে বেলা দশটার দিকে একটা চিকেন স্যান্ডউইচ আর সাথে ডায়েট কোক খেয়েছিলেন। রাতে ডিনার করেছিলেন ইসাবেলার সাথে। এ মুহূর্তে হঠাৎ করেই তার ডাল-ভাত খেতে খুব ইচ্ছে করছে। ঘন মসুরের ডাল। বেশি করে পেঁয়াজ আর রসুন দিয়ে রান্না করা। মনে পড়ে, অনেক ভাই-বোনের সংসারে মাঝে মাঝে মাছ-মাংস বা নিদেনপক্ষে সব্জি-নিরামিষের অভাব হলে, তাঁর মা বেশি করে পেঁয়াজ আর রসুন দিয়ে ঘন করে মসুরের ডাল পাকাতেন। আর সাধারণ চালের সাদা ভাত। সে খাবারের তুলনায় অন্য খাবারের স্বাদ যেন পানসে। অন্য সময় হাজার বললেও মা তেমন ডাল পাকাতেন না।

খাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতে রেবেকা খাতুনের মাথায় একটা নতুন আইডিয়া আসে। আর সেই সঙ্গে যেন কিছুটা রোমাঞ্চিতও হয়ে উঠলেন। ছোটবেলার কানামাছি খেলার মত কিছুটা ভয়, কিছুটা শঙ্কা তাঁকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও দুশ্চিন্তামুক্ত করে দেয়। তিনি তাঁর বর্তমান সংকটের কথা ভুলে গিয়ে নতুন একটা খেলায় মেতে উঠলেন। তিনি ঠিক করলেন যে, নিজেই ডাল-ভাত রান্না করে খাবেন। পার্স থেকে টাকা নিয়ে দরজা লক করে তিনি নিচে নেমে এলেন। তাঁকে দেখে কেয়ারটেকার হামিদ মিয়া কেমন হাবার মত তাকিয়ে রইলো।

তিনি বললেন, ‘হামিদ মিয়া, তুমি দোকান থেকে আমাকে চাল আর মসুরের ডাল এনে দাও তো!’

হামিদ মিয়া রেবেকা খাতুনকে চিনতে পারলো না। বলল, ‘নতুন কামে আইছ নাকি? তোমারে তো আগে দেহি নাই!’

‘তোমাকে কি বললাম?’

‘আমি দোকানে দোকানে দৌঁড় পারলে আমার কাম করবো কে? তুমি নতুন মানুষ দেইখ্যা তোমারে দোকান চিনাইতে লগে যাইতে পারি! কিছু কিন্যা আনতে পারমু না! কামে থাকতে হইলে দোকান তোমারে চিনতেই হইবো!’

রেবেকা খাতুন হামিদ মিয়ার কথা শুনে মনে মনে হাসেন। বলেন, ‘দোকান কি বেশি দূর?’

‘বেশি দূর না। সামনের একটা বিল্ডিং পরেই। চাইল-ডাইল থাইক্যা শুরু কইরা মাছ-গোস্ত, আনাজ-পাতি সবই আছে। তোমারে কই দোকানডা চিন্যা আসো, তোমারই লাভ হইবো!’

‘ঠিক আছে, চলো!’

রেবেকা খাতুন হামিদ মিয়ার পিছন পিছন হাঁটতে হাঁটতে ভাবেন, তিনি কি আজ এতটাই সাধারণের পর্যায়ে নেমে এসেছেন যে, আসতে যেতে প্রতিদিন যে হামিদ মিয়া সালাম দিতো, সেও তাঁকে দেখে চিনতে পারছে না? নাকি সালাম দেয় ঠিকই কিন্তু কারো মুখের দিকে ভালো মত তাকাতে সাহস পায় না? এমন না হলে যত সাধারণ বেশেই তিনি থাকতেন না কেন, চেহারা দেখে না চেনার কথা নয়!

হামিদ মিয়া চলতে চলতে বলে, ‘কয় তালার কামে লাগলা? আইজই জয়েন করছ নাকি?’

রেবেকা খাতুন বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘এত কথা জেনে কাজ কি তোমার?’

‘আমি এই বিল্ডিঙের কেয়ারটেকার, আমার জানতে হইবো না কে কোন তালায় থাকে?’

রেবেকা খাতুন হাসি চেপে বলেন, ‘এগার তলায়!’

‘ও। পুলিশের লোক দেইখ্যা বেগম সাব ভাইগ্যা গেছে! আর ইখলাস সাব তো আগেই ভাগছে! পুলিশ তোমারে কিছুই কইলো না?’

রেবেকা খাতুন অবাক হয়ে হামিদ মিয়ার কথা শোনেন। তাঁদের সম্পর্কে এদের ধারণা এমন? যারা বেশি কথা বলে তাদের কাছে অন্যের হাঁড়ির কথা বেশি থাকে। কিন্তু তারা এ খবর কোত্থেকে পায়? তারপরও নিজেদের সম্পর্কে এ রকম নিচু তলার মানুষদের ধারণা কেমন, সেটা জানতেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘এগারতলার লোকগুলো কি খারাপ?’

‘ভাল হইলে কি পুলিশে দৌঁড়ায়? তয় তুমি ঘরে একলা থাকতে ডরাইয়ো না! আর একলা থাকলে ড্রাইভার আজিজরে ঘরে ঢুকতে দিবা না!’

‘কেন?’

‘হের খাসলত ভাল না। অনেক বুয়াগরে হ্যায় নষ্ট করছে!’

‘তাহলে লোকটাকে চাকরি থেকে তাড়াচ্ছে না কেন?’

‘বার তলার বিবি সাব মাগি ব্যবসা করে! হ্যার ড্রাইভার। আজাগা-কুজাগা সব চিনে দেইখ্যা খেদায় না! হ্যার কুবুদ্ধি হুনবা না! তার লগে কোনোখানে যাইবা না! এই বিল্ডিঙের সুন্দর সুন্দর বুয়াগরে হ্যায় পাচার কইরা দিছে!’

রেবেকা খাতুন জানতে চাচ্ছেন নিজেদের সম্পর্কে। অন্যের ব্যাপারে তাঁর কোনো উৎসাহ নেই। বললেন, ‘এখলাস সাহেব কি কাজ করেন?’

‘ইখলাস সাবের কথা কইয়া লাভ নাই! হুনছি আগে ছোড চাকরি করছে! শ্বশুর বাড়ির ট্যাকা দিয়া ব্যবসা শুরু করছিলো। তার বাদে চোরা কারবারি কইরা অখন ট্যাকার কুমির!’

তাঁর স্বামী যে, শ্বশুরের টাকা নিয়ে ব্যবসায় নেমেছিলেন, এ কথা তো এরা জানবার কথা নয়! তাহলে এরা কী করে জানতে পারে? বিশ বছর ধরে সংসার করেও স্বামীর গতিবিধি সম্পর্কে কিছুই জানলেন না অথচ হামিদ মিয়ার মত লোকেরা, যারা কখনো তার ফ্লাটে ঢোকেনি, তার কাছ থেকেই তিনি নিজের ঘরের কথা জানতে পারছেন? এ কী করে সম্ভব? যেটা তিনি নিজে জানবার কথা, সেটা তিনি জানেন না। অথচ হামিদ মিয়া বলছে ভেতরের কথাও!

দোকানের সামনে এসে হামিদ মিয়া বলল, ‘যা লওনের লও! নতুন মানুষ তুমি, ঘরে তেল মসলাপাতি খুঁইজা পাইবা না! সব কিছুই অল্প অল্প কইরা নিয়া নেও! বেগম সাব আইলে তোমারে পরে সব দেখাইয়া বুঝাইয়া দিতে পারবো!’

বেশি কথা বললেও হামিদ মিয়া খুব একটা খারাপ মানুষ বলে মনে হয় না! কারণ পরামর্শটাও সে খারাপ দেয়নি!

দুপুরে খাওয়ার মত সবকিছু নিয়ে ফেরার পথে রেবেকা খাতুন হামিদ মিয়াকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘এগার তলার ছেলে মেয়ে দুটো কেমন? শুনেছি ঠিক মত ঘরে আসে না!’

‘তুমি ভুল হুন নাই! আর বড়লোকের পোলাপান এমনই হয়। বাপের আগোণা ট্যাকা থাকলে যা হয় আর কি! হুনছি, পোলাডা নাইট ক্লাবে যায়। বন্ধুগ লগে মদ খাইয়া টাল হইয়া থাকে। মাইয়াটা খারাপ না। তয় মাথায় কিছুডা ছিট আছে!’ বলে হামিদ মিয়া হাসে। ‘মাইয়াডা অ্যামনে ভালো! কিন্তু হ্যার পাগলামী হইল টোকাই পোলাপানগো লেখাপড়া হিকাইবো। আরে, যে টোকাই, রা¯তার পোলা, থাকন-খাওনের কোনো ঠিক নাই, হ্যায় দুই-চাইর মাস লেখাপড়া হিক্যা করবোডা কি?’

রেবেকা খাতুন হামিদ মিয়ার কথা শোনেন না। ছেলে আরবানের কথা ভেবে মনে মনে শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। মদের মাত্রা বেড়ে গেলে অসুস্থ হয়ে পড়বে! কিন্তু তাঁর অগোচরে সন্তানরা কার সঙ্গে মেশে, কাদের সঙ্গে ঘোরে, তার কিছুই তিনি জানেন না। তাদের সাথে কখন যে এতটা দূরত্বের সৃষ্টি হলো আর কবেই বা এর সূচনা, তার কিছুই তিনি বলতে পারবেন না।

এক সময় রাতে ঘুমুবার আগে ছেলে-মেয়ে দুজনই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতো। কিন্তু একসময় সেটা কমে গিয়ে দাঁড়ালো সকালের নাস্তার টেবিলে। তারও পরে, আজকাল সন্তানদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় কালেভদ্রে। মাঝে মধ্যে ওরা টাকার জন্যে দেখা করতো। কিন্তু ওদের পার্সোনাল একাউন্ট হওয়াতে সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন বলতে গেলে দেখা হয়ই না। অনেকদিন পর মাদার্স ডে-তে ছেলেটা ফুল নিয়ে এসেছিলো মায়ের জন্যে। মেয়েটা উইশ করেছিলো। তাঁর ইচ্ছে হয়েছিল ছেলে-মেয়ে দুটোকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বলেন, মাকে তোদের মনে পড়ে? তাদের মনে পড়ে না। মায়ের প্রয়োজন তাদের ফুরিয়েছে। ওরা বড় হয়েছে। নিজের ভালমন্দ বুঝবার বয়স হয়েছে। তিনি মনে হয় সত্যিই সন্তানদের কাছে আজ অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছেন। গত এক দেড় মাসের ভেতর ছেলে-মেয়েদের সাথে তাঁর দেখা হওয়া দূরে থাকুক, ফোনেও কথা হয়নি একবার। স্বামী আর সন্তানদের কাজ-কারবারে বুকের ভেতর একটা অভিমানের বাষ্প পাক খেয়ে উঠতে থাকে। এ সংসারে যদি তিনি এতটাই অপ্রয়োজনীয় হয়ে যান, তাহলে এখানে কেন পড়ে থাকবেন অযথা? যেখানে গেলে তাঁর মূল্যায়ন হবে, যাদের কাছে তাঁর গুরুত্ব থাকবে, তিনি তাদের কাছেই যাবেন। একাএকা ঘর পাহারা দেবার কোনো মানে হয় না।

তিনি মনস্থির করেন যে, এখানে আর থাকবেন না। যেদিন স্বামী আর সন্তানদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন, পুনরায় ফিরে আসবেন সংসারে। নতুবা বিদায় চিরতরে।

তিন

হামিদ মিয়ার কথা অনুযায়ী তিনি সব কিছু কিনে না আনলে ফাস্টফুড অথবা রেস্টুরেন্টের খাবার আনিয়ে খেতে হতো। কিন্তু এত কষ্ট করে নিজে গিয়ে চাল ডাল কিনে আনলেন, প্রায় দশ বছর পর ডাল-ভাত রান্না করে খেতে বসেছেন, সেই স্বাদ কি পাচ্ছেন? পাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে ডালে কোনো একটা প্রয়োজনীয় উপাদান বাদ পড়ে গেছে। নাকি তিনি রান্না ভুলে গেছেন?

রেবেকা খাতুন দু’গ্রাস খেয়েই আর খেতে পারলেন না। হঠাৎ করে যেমন খাওয়ার ইচ্ছেটা হয়েছিলো, তেমনি হঠাৎ করেই যেন সেটা উধাও হয়ে গেছে। খাবারগুলো তিনি ফ্রিজের ভেতর রেখে দিয়ে উঠে এলেন। ড্রয়িং রুমে এসে তিনি দরজাটা বন্ধ কিনা চেক করে বাংলা ইংরেজি পত্রিকাগুলো তুলে নিলেন। সকালটা এলোমেলো হয়ে যাওয়াতে আজ পত্রিকায় চোখ বুলাবার সময় পাননি। পত্রিকাগুলো নিয়ে তিনি ফের বেডরুমে ফিরে আসেন।

একটা জিনিস ভেবে তিনি অবাক হলেন যে, হামিদ মিয়ার কথার সঙ্গে পত্রিকার সংবাদেও বেশ মিল রয়েছে। হামিদ মিয়া হয়তো পত্রিকা পড়েও এ কথা বলতে পারে। কিন্তু তাঁর ছেলে-মেয়ের কথা তো পত্রিকাঅলারা লিখেনি? এখলাস উদ্দিন সম্পর্কে পত্রিকাগুলো যদি মিথ্যাই লিখবে, তাহলে কি সবাই জোট বেঁধে একই কথা লিখেছে?

এই যে, চারদিন আগে সফুরা ছুটির কথা বলে বেরিয়েছিলো, আসলে তাকে ফুসলিয়ে নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের গ্রুপটা সীমান্ত অতিক্রমের আগেই ধরা পড়ে যায়। সফুরা পুলিশের কাছে সবই বলে দিয়েছে। মূলত তার কাছ থেকেই বার তলার রশিদা জামানের নাম জানতে পারে পুলিশ। রশিদা জামানের কাছ থেকে আসে এখলাস উদ্দিনের নাম। আর এভাবেই কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে আসে সাপ-বিচ্ছু। এখলাস উদ্দিন সহ আরো অনেকের নাম।

এখলাস উদ্দিন কেবল চোরাকারবারিই নন, সুন্দরী উপজাতীয় মেয়েদের বিদেশী মেয়ে বলে চালিয়ে দিয়েও অনেক ধরনের ব্যবসা করেছেন। বাদ দেননি হেরোইন, সোনা, ডলারও। প্রথম দিকে রেবেকা খাতুন তাঁর বাবার কাছ থেকে একলাখ টাকা এনে স্বামী এখলাস উদ্দিনের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সে টাকায় এখলাস উদ্দিন প্রথমে ডলার ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন। প্রথমে দিলকুশায়। তারপর এয়ারপোর্টে ডলার ফেরি করে রাতারাতি গুলশান সুপার মার্কেটে মানি চেঞ্জিং এজন্সি খুলে বসলেন। আসলে সেটা ছিল তার মূল ব্যবসার বহিরাবরণ। আড়ালে আবডালে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন দেশের বড়বড় রুই-কাতলাদের সাথে।

রেবেকা খাতুন ভাবেন যে, তাঁর স্বামী যাদের সাথে বা যে চক্রের সাথে জড়িয়ে গেছেন, সেখান থেকে কি আদৌ বেরিয়ে আসতে পারবেন? প্রাচুর্যের মোহ আর বিত্ত-বৈভবের যে গোলক ধাঁধাঁয় তিনি অন্ধ হয়ে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন, সেখান থেকে কি মুক্ত হবার পথ পাবেন? ন্যয়-অন্যায়ের উতর চাপানো কানামাছি খেলায় কি তিনি ছুঁতে পারবেন কাঙ্খিত বস্তু? খেলাটা কি কখনো শেষ করতে পারবেন এখলাস উদ্দিন?

হুড়মুড় করে অনেক প্রশ্ন এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর সামনে। বিভ্রান্ত রেবেকা খাতুন আর ভাবতে পারেন না। তাঁর মনে হয়, বিয়ের প্রথম দিকে নিম্ন আয়ের এখলাস উদ্দিনের সাথে কাটানো শাহজাহানপুরের স্টাফ কোয়ার্টারের দিনগুলোই প্রকৃত সুখের দিন ছিলো। যেখানে প্রতিদিন স্বামী-সন্তানদের একান্ত ভাবেই কাছে পেতেন। ছুটির দিনগুলোতে চারজনের এই পরিবারটা উৎসবের আনন্দে মেতে উঠতো। খাওয়া দাওয়া তেমন জম্পেশ না হলেও অবসর সময়টা লুডো নয় ক্যারাম কিংবা শর্ট ব্রিজে পার করে দিতেন নির্বিঘ্নে। কখনো কখনো রমনার সবুজ ঘাঁসের গালিচা হয়ে উঠতো তাদের পারিবারিক আড্ডাখানা। টাকাপয়সার মুখ দেখেছেন সত্যি। এখন অভাব তেমন নেই। নেই শখের অপূর্ণতাও। কিন্তু সুখ নামক সোনার পাখিটা যে কখন পালিয়ে গিয়েছে, তা খেয়াল করবার সুযোগ পাননি একবারও। এখন পুরোনো দিনগুলো শুধুই স্মৃতি। কিংবা মধ্যরাতের হালকা ঘুমের ভেতর অস্পষ্ট কোনো সুখ-স্বপ্ন।

হঠাৎ করে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতেই বাস্তবতায় ফিরে আসেন রেবেকা খাতুন। ডিসপ্লেতে যে নাম্বার দেখতে পাচ্ছেন সেটা তিনি চেনেন না। কিছুটা সন্দিগ্ন মনেই রিসিভ করেন। ‘হ্যালো!’

‘আম্মু! আজকের পত্রিকা দেখেছো? আব্বুকে নিয়ে কী যা-তা লিখেছে!’

‘দেখছি! তুই কোথায় বাবা?’

আরবানের গলার স্বর শুনতে পেয়ে রেবেকা খাতুনের মনটা কেমন আর্দ্র হয়ে উঠলো। ছেলেটাকে একবার দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো। তিনি আবার বললেন, ‘ঘরে চলে আয় বাবা!’

‘এখন যাওয়া যাবে না! তোমাদের ওখানে নাকি পুলিশ গিজগিজ করছে!’

‘ওরা চলে গেছে!’

রেবেকা খাতুন টের পান যে, ছেলে কেমন জড়ানো কন্ঠে কথা বলছে। ‘বাবা, তোর শরীর কি ভাল না?’

‘ভালই আছে!’

‘তাহলে তোর কথা এমন শোনাচ্ছে কেন?’

‘মদ খেয়েছি আম্মু! বনানির সাকুরাতে আছি। অনেক মদ খেয়েও আমি কিছু ভুলতে পারছি না! আম্মু, তুমি কি সত্যি করে বলবে, আমি বাস্টার্ড কিনা?’

রেবেকা খাতুনের বুকের ভেতর হঠাৎ করেই যেন ভাঙচুর শুরু হয়। ‘এমন আজেবাজে কথা কে বললো?’

‘চিনি না! ফোন করে শুধু বলল, স্মাগলার আর ঘুষখোরদের ছেলে-মেয়েরা সবগুলো বাস্টার্ড! বাবা স্মাগলার হওয়ার আগেই তো আমি জন্মেছি। তবুও কেন বাস্টার্ড হবো?’

রেবেকা খাতুন মনেমনে ডুকরে উঠলেন। তাহলে কি স্মাগলারের স্ত্রী হিসেবে আমিও ওদের দলে? বিচিত্র কি? অবৈধ উপার্জনের টাকায় আমার শরীরের রক্ত-মাংস বেড়েছে! তাহলে?

রেবেকা খাতুন ছেলের কথা শুনতে পান না। মনেমনে ভাবেন যে, ক্রিমিন্যালের স্ত্রী হয়ে সমাজে তিনি মুখ দেখাবেন কী করে? এ পোড়া মুখ নিয়ে তিনি কোথায় যাবেন? পরিচিত কারো কাছে গেলে তো সেই একই অবস্থা! এখলাস উদ্দিনের স্ত্রী হিসেবেই তাকে চিনবে সবাই। কিন্তু তিনি তো পরিচিত হতে চান আত্মপরিচয়ে। বাঁচতে চান রেবেকা খাতুন হয়ে। কোনো ক্রিমিন্যালের স্ত্রী হয়ে নয়।

চার

অনেকদিন আগে রোটারি ক্লাবের একটি কনফারেন্সে এনজিও কর্মকর্তা রাহেলা আক্তার নামের এক ভদ্র মহিলার সঙ্গে আলাপ হয়েছিলো রেবেকা খাতুনের। যিনি সুন্দরবন এলাকায় বিধবা আর স্বামী পরিত্যাক্তাদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছিলেন। কথায় কথায় তিনি রেবেকা খাতুনের নারীদের পৈতৃক সম্পদে সমান অধিকার, শ্রমের ক্ষেত্রে পুরুষের সমান মজুরী এবং প্রশাসনে নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণার কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘আপনাকে আমার সঙ্গে পেলে দুঃস্থ নারীরা অনেক উপকৃত হতো! আর আমিও আরো অ্যাকটিফ হয়ে কাজ করতে পারতাম!’
রেবেকা খাতুন বলেছিলেন, ‘সংসার-সন্তান ফেলে অতদূর গিয়ে থাকবো কিভাবে?’

কথা শুনে রাহেলা আক্তার হেসে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, ‘প্রথম প্রথম এমনই মনে হয়। কিন্তু স্বামী কিংবা সন্তান যাই বলেন না কেন আপা, ওদের যদ্দিন প্রয়োজন আছে তদ্দিনই ওরা আপনাকে খুঁজবে! আপনি সার্ভিস দিতে পারছেন কিনা বা কতটুকু দিচ্ছেন তা কেউ খতিয়ে দেখবে না! যখন ওদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে, তখন একই ছাদের নিচে থাকলেও কারো দেখা পাবেন না। ওরা সবাই স্বার্থপর! এ জগতে একা নিঃস্বার্থ হবার মত বোকামি আর হতে পারে না!’

রাহেলা আক্তারের সঙ্গে অনেক বিষয়েই আলাপ হয়েছে রেবেকা খাতুনের। শেষে যাবার সময় রাহেলা আক্তার একটি কার্ড আর একটি স্যুভেনির ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘সংসারের একঘেয়েমী থেকে যখন মুক্তি খুঁজবেন, তখন চলে আসবেন আমার কাছে। কোনো সংকোচ করবেন না। কাজ আরম্ভ করলেই দেখতে পাবেন “আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী প’রে” কথাটা কতটুকু সত্যি! এও বুঝতে পারবেন যে, আসলে স্বামী-সন্তান নয়, বাইরের দুখি আর দরিদ্র মানুষগুলোই আপনার প্রকৃত আপনজন হয়ে উঠবে!’

সময়ের স্রোত আর ঘটনার পলিতে সেই স্মৃতির অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছিলো। কিছুটা চাপা পড়ে গিয়েছিলো দৈনন্দিন কর্মব্যস্তার আড়ালে। এতদিন পর হঠাৎ সেই ঘটনা, সেদিনকার আলাপচারিতা বিস্মরণের ধূলো-মাটি সরিয়ে মানস পটে জীবন্ত হয়ে উঠতেই তিনি তৎপর হয়ে উঠলেন। কিন্তু এতদিন পর কি তিনি সেই কার্ডটার সন্ধান পাবেন? তবুও তিনি সবগুলো কার্ডহোল্ডার উল্টে-পাল্টে দেখলেন। কিন্তু পেলেন না। স্যুভেনিরটার কথা মনে পড়তেই তার স্বরণে আসে যে, কার্ডটা ওটার ভেতরই রেখেছিলেন।

তারপর তিনি স্যুভেনিরের খোঁজে বইয়ের র‌্যাক তন্নতন্ন করে খুঁজলেন। সবচেয়ে নিচের তাকে ধূলো-মলিন অবস্থায় পুরোনো ম্যাগাজিনের সাথে পড়ে আছে। সেটা ঝেড়ে মুছে নিয়ে পাতা উল্টে দেখতে দেখতে কার্ডটা পেয়ে গেলেন। সময় গড়ানোর সাথে সাথে এতদিনে ওটার উজ্জ্বলতাও অনেকটা ম্লান হয়ে এসেছে। কিন্তু ওতে যে ফোন নাম্বার দেওয়া আছে, এখন সেই দিন আর নেই। এনালগের দিন শেষ হয়ে গিয়ে সবই ডিজিটালে রূপান্তরিত হয়েছে। তবুও বাংলাদেশের সরকারি কাজ-কর্ম শম্ভূক গতিতে চলে বলে এখনও কিছুটা আশা আছে।

রেবেকা খাতুন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কার্ডটা দেখলেন। সেখানে শুধু অফিসের ফোন নাম্বারই নয়, পুরো ঠিকানাই রয়েছে। তবে কিভাবে তিনি সেখানে গিয়ে পৌঁছুবেন, সেটাই এখন তাঁর প্রধান চিন্তা। অনেক বছর হয়ে গেল, দূরপাল্লার বাসে চড়েন না। পুরোনো পত্রিকা ঘেঁটে ঘেঁটে বিভিন্ন রুটের বাস বিশেষ করে খুলনা বাগের হাঁটের দিকে যে সমস্ত বাস যায়, সেগুলোর নাম, ভাড়া, কোত্থেকে ছাড়ে ইত্যাদি তথ্য একটা ছোট্ট নোটবুকে টুকে রাখলেন। ঘর থেকে বেরোবার আগে তাকে সেই চিরাচরিত রেবেকা ম্যাডাম হতে হবে। না হলে গেটের সিকিউরিটি গার্ড তাঁকে সুটকেস নিয়ে বাইরে যেতে দেবে না।

মাঝারি ধরনের একটা সুটকেসে প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড়, ওষুধ, স্প্রে, টুথব্রাশ থেকে আরম্ভ করে নেইল কাটার, টুথপিক, মোটের ওপর তাঁর প্রয়োজনে যা যা আসতে পারে কিছুই বাদ রাখলেন না। শুধু পারলেন না তার প্রিয় ক’টি বই আর নিদ্রাছুট মধ্যরাতের আশ্রয় রকিং চেয়ারটি সঙ্গে নিতে।

গোছগাছ শেষে, কিছুটা সময় নিয়ে রেবেকা খাতুন গরম আর ঠান্ডা মিলিয়ে ঈষদুষ্ণ পানিতে শাওয়ার নিলেন। শাওয়ার নিতে নিতে তিনি তাঁর যাবতীয় মেয়েলিপনাও ধূয়ে ফেললেন যেন। এখন থেকে তিনি আর পিছু ফিরে তাকাবেন না। কেনই বা তাকাবেন? স্বামী-সন্তান সবাই যদি নিজকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তিনি মিছেমিছি কেন ওদের জন্যে পুড়বেন? যদিও অসম্ভব! তবু তিনি একবার মনের ওপর ইরেজার ঘষবেন। যেমন করে মুছে ফেলেছিলেন শাহজাহানপুর স্টাফ-কোয়ার্টারের পরিচয়। সম্পর্ক রাখেননি কারো সাথেই। যদিও মাঝে মধ্যে ওদের কারো কারো সাথে পথে বা এখানে সেখানে দেখা হয়ে গেছে, তখন অবলীলায় তাদের এড়িয়ে গেছেন। আর এভাবেই তিনি মুছে ফেলতে চেষ্টা করবেন গুলশান গ্রিন টাওয়ারের ইতিহাস। মিসেস এখলাস উদ্দিন নয়, রেবেকা খাতুন হয়েই তিনি বেঁচে উঠবেন নতুন করে।

শাওয়ার সেরে তিনি পছন্দের একটি টাঙ্গাইল সূতি শাড়ি পরলেন। সঙ্গে ম্যাচ করে বাকি সব। গয়নাগাটি পরলেন না। এমন কি মুখে পাউডারও না। তবে ঠোঁটে লিপস্টিক না ঘষলে কেমন যেন মনে হয়। তাই হালকা করে লিপস্টিক ঘষে নিলেন। টাকা-পয়সা তেমন বেশি নিলেন না। তবে পার্সোনাল অ্যাকাউন্টের চেকবইটা নিয়ে নিলেন। জরুরী প্রয়োজনে যাতে টাকার অভাবে বিপদে পড়তে না হয়। একবার ভেবেছিলেন যে, চেকবইটা নেবেন না। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে যত টাকাই থাকুক, তা কেবল তাঁরই। আপন অধিকারকে কখনো ছোট করে দেখেননি বলেই জীবনের প্রতিটা পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে আসতে পেরেছেন অনায়াসে। আশা করেন বাকি জীবন অসাবধান না হলে হোঁচট খেয়ে পড়বেন না।

ইন্টারকমে তিনি হামিদ মিয়াকে চাইলেন। কিন্তু সিকিউরিটি জানালো, হামিদ মিয়ার ডিউটি আবার রাতের দিকে।

রেবেকা খাতুন ধমক দিয়ে বললেন, ‘এখন যে ডিউটিতে আছে তাকে বল একটা ইয়েলো ক্যাব ডাকতে!’

‘কে যাবেন ম্যাডাম?’

বলার সময় সিকিউরিটির গলা কেঁপে যায়।

‘বল যে, এগার তলার ম্যাডাম!’

আধঘন্টা পেরিয়ে গেলেও নিচ থেকে কোন খবর আসে না।

রেবেকা খাতুন অস্থির হয়ে আবার সিকিউরিটির সঙ্গে কথা বলেন। মিনিট দশেক পরেই খবর আসে যে, ট্যাক্সি পাওয়া গেছে।

শেষবারের মত তিনি তাঁর বেডরুমের চারদিকে দৃষ্টি বুলালেন, কোন স্মৃতিকাতর কিছু রয়ে গেলো কি না। দেওয়ালে ঝুলছে রেবেকা খাতুন আর এখলাস উদ্দিনের সাদাকালো যুগল ছবি। পাশে পুরো পরিবারের আরও একটি রঙিন ছবি। আরবান আর সুসির জন্য প্রাণ কেঁদে উঠলেও তিনি আবেগকে প্রশমিত করলেন। তারপর ঘুরে পেছন থেকে টেনে দরজাটা লক করে দিলেন।

তারপর মেন দরজা ভেতর বাইর দুদিক থেকেই লক করে লিফট দিয়ে নামতে নামতে ভাবেন যে, স্বামী সন্তানদের কেউ ঘরে ঢুকতে চাইলেও অসুবিধা নেই, প্রত্যেকের কাছেই ডুপ্লিকেট চাবি আছে। এখন সময় মত পৌঁছুতে পারলে তিনি বনানির কাকলি স্ট্যান্ড থেকেই একটা বাস পেয়ে যাবেন।

পাঁচ

অনেক বছর আগে, সেই ছোটবেলায় ট্রেনে চড়ে বাবা-মার সাথে গফরগাঁও থেকে ময়মনসিংহ নানার বাড়ি যেতেন রেবেকা খাতুন। বিয়ের পর ট্রেনে চড়েই ঢাকায় শাহজাহানপুর কোয়ার্টারে এসে উঠেছিলেন। তা ছাড়া ঢাকা শহরের কোথাও গেলেও বাসে উঠবার প্রয়োজন পড়েনি কখনো। তাই হঠাৎ করে বাসে চড়বার পর পেটের ভেতর কেমন ঘুলিয়ে আসতে লাগলো রেবেকা খাতুনের। মনে হচ্ছিলো পেটের নাড়িভূড়ি সব ঠেলে গলা দিয়ে উঠে আসবে। এ পর্যন্ত বমি করেছেন দু'বার। খুবই দুর্বল লাগছে শরীর। তা ছাড়া পাশের পুরুষ যাত্রীটিই বা কী মনে করছেন, তা ভেবে লজ্জায় তিনি আরো আড়ষ্ট হয়ে পড়ছিলেন। বমি হওয়া ঠেকিয়ে রাখতে চেষ্টা করছিলেন প্রাণপণে।

ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। মুখে রুমাল চেপে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছেন। গাড়িতে কেউ বমি করতে থাকলে পাশের জনের স্বাভাবিক ভাবেই খারাপ লাগার কথা। কিন্তু রেবেকা খাতুন বমি বন্ধ করতে তো চেষ্টা করছেনই, কিন্তু বমি বন্ধ না হলে তাঁরই বা কী করবার আছে? এরই মাঝে আবার বমির বেগ হচ্ছে। সামলে রাখতে না পেরে জানালা দিয়ে মাথা বের করতেই ভদ্রলোক হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, ‘সাবধান!’

কিন্তু সে মুহূর্তে রেবেকা খাতুন কেমন হতচকিত হয়ে মাথাটা ভেতরে নিয়ে এসে ধপ করে সিটে বসে পড়লেন। তবে বমির বেগটাও যেন হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি আঁচল দিয়ে নাকমুখ ঢেকে রাখলেও চেহারা পুরোটা ঢাকেনি। তিনি ভদ্রলোকের উদ্বিগ্ন মুখ দেখতে পেলেন। হয়ত দাঁড়াবার সময়ই মুখ থেকে রুমাল সরিয়ে ফেলেছেন। চোখে চোখ পড়তেই ভদ্রলোক বললেন, ‘সিটে হেলান দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে রাখেন! ভাল্লাগবে!’

কিন্তু রেবেকা খাতুনের চোখ বন্ধ করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। রাস্তার পাশের ঢালু থেকে আরম্ভ করে দূরের গ্রামগুলো পর্যন্ত কেমন সব্জে দেখায়। ছোটবেলা এ রকম সবুজের সাথে তাঁর পরিচয় ছিলো আরো নিবিড়। কিন্তু জীবনের নানা চড়াই উৎরাই পেরোতে পেরোতে সে পরিচয় আজ অচেনার পর্যায়ে চলে গেছে। তাই পুরোনো আর চির নতুন এ গ্রামবাংলার রূপদর্শন থেকে নিজকে বঞ্চিত করতে চান না। বলা তো যায় না, এমন দৃশ্য আর চোখে পড়বে কি না!

ভদ্রলোক বসতে বসতে বললেন, ‘মনে হচ্ছে বাসে চড়ে আপনার তেমন অভ্যেস নেই!’

কিছুটা কুন্ঠিত ভাবেই রেবেকা খাতুন স্বীকার করেন, ‘ঠিক তাই! এটাই জীবনের প্রথম!’

‘আর কিছু বাড়তি টাকা খরচ করলে প্লেনেই আসতে পারতেন!’

‘ভেবেছিলাম যে, রাস্তার পাশের সুন্দর দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে চলে যাবো!’

‘ভাবনাটা ঠিকই ছিলো, কিন্তু অনভ্যাসের শরীর সেটা সমর্থন করছে না!’ ভদ্রলোক হাসলেন। সাদা ঝকঝকে দাঁতের পরিচ্ছন্ন আর পরিমিত হাসি।

রেবেকা খাতুন বুঝতে পারলেন, কথা বলা শুরু করার পর থেকে আর তেমন বমির বেগ হয়নি। পেটের ভেতরকার সেই উদ্বেগটাও যেন আর নেই।

ভদ্রলোকের প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞ হয়ে উঠলেন তিনি। আগ বাড়িয়ে নিজ থেকে কখনোই আলাপটা শুরু করতে পারতেন না তিনি।

কথায় কথায় জানা যায়, ভদ্রলোক সুন্দরবনের ফরেস্ট বিভাগে চাকরি করেন। সেই সুবাদে রাহেলা আক্তারের ঠিকানাটার কথা বললেন তিনি। সেখানে যেতে হলে সময় এবং কষ্ট বাঁচিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে কি না। কিন্তু রেবেকা খাতুনকে নিরাশ করে ভদ্রলোক জানালেন যে, খুলনা শহর থেকে ব্যবস্থা আলাদা। নৌকা-লঞ্চে সবচেয়ে ভাল। তবে কিছুটা পথ রিক্সা-ভ্যান করে যেতে হবে। কারণ, সে পথে প্রাইভেট আর মাঝে মধ্যে দুএকটা সরকারি গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি চলাচল করে না।

এরপর ভদ্রলোক নিজের বুকে হাতের বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে বললেন, ‘আমি এনায়েত মল্লিক! কখনো সুন্দরবন দেখবার ইচ্ছে হলে প্রথম গেটেই আমার নাম বলবেন। আপনার ঘুরাঘুরির সব ব্যবস্থা আমি করে দেবো!’

রেবেকা খাতুন মুখ থেকে আঁচল সরিয়ে বললেন, ‘সে সুযোগ কি আর পাবো?’

‘সুযোগ তো পাওয়া যায়না না! করে নিতে হয়!’

তারপরই এনায়েত মল্লিক বললেন, ‘আচ্ছা, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বাগেরহাঁট পৌঁছে যাবো! সেখানে আমার কিছু কাজ আছে!’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে! আপনি ছিলেন বলে কথায় কথায় সময়টা কাটলো!’

‘আমি উঠি, কেমন!’ বলে এনায়েত মল্লিক সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। আর কিছুক্ষণের মধ্যে সত্যি সত্যিই বাসটা খাঁন জাহান আলি সাহেবের মাজারের পাশ দিয়ে বাগেরহাঁটের মাঝামাঝি এসে থামলো।

এনায়েত মল্লিক বাস থেকে নেমে গিয়ে জানালার পাশে এগিয়ে এলেন। হাত তুলে বললেন, ‘সুন্দরবন দেখতে আসবেন কিন্তু!’

রেবেকা খাতুন হাসলেন কেবল। কারণ এনায়েত মল্লিকের আহ্বানের মধ্যে এমন একটা আন্তরিকতা ছিলো যে, তার আহ্বান বেশ কিছুক্ষণ রেবেকা খাতুনের শ্রুতি বাতায়নে অনুরণিত হতে থাকে। সেই সঙ্গে মনে হয় কিছুটা ভালো লাগাও।

ছয়

খুলনা শহর থেকে এ পর্যন্ত পথটুকু যতটা কষ্ট করে এসেছেন, আগে থেকে জানা থাকলে এমন একটা বোকামি করতেন না কিছুতেই। বিকল্প কিছু একটা সহজ পথ অবশ্যই খুঁজে বের করতেন।

কাঁচা সড়ক পথে একটা খালি রিক্সা-ভ্যান আসতে দেখে রেবেকা খাতুন হাত তুলে সেটাকে থামতে ইশারা করেন। চালকের বয়স মাত্র কৈশোর পেরিয়েছে মনে হয়। তাকে বললেন, ‘মোহনপুর এখান থেকে কত দূর হবে?’

‘এই ধরেন গে, দশ কিলো হবি!’

‘তুমি মোহনপুর চেনো?’

‘মোহনপুর কোহানে যাবেন?’

‘বিজয় সরকারের বাড়ি!’

‘আপনি এনজুতে যাবেন?’

রেবেকা খাতুন এনজু শব্দটা প্রথমে বুঝতে না পারলেও ধরে নিলেন যে, ওটা এনজিও হবে। এনজিও অফিস তো ওখানেই। তিনি বললেন,‘হ্যাঁ!’

‘তালি ওঠেন!’

‘ভাড়া কত দিতে হবে?’

‘এই ধরেন গে, কিলোতে দুই টাহা দিলি আমার বিশ টাহা হয়া যাবেনে!’

রেবেকা খাতুন তাঁর সুটকেসটা টেনে ভ্যানে তুলবার সময় ছেলেটা এসে হাত লাগায়। কিন্তু ভ্যানে চড়তে যেয়ে তাঁকে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো। তা ছাড়া খুবই কসরৎ করে ভ্যানে চড়তে হয়েছে। এ সময় তাঁর হাসি পাচ্ছিল ভীষন। কারণ এমন একটি অদ্ভূত যাত্রার কথা তিনি স্বপ্নেও কখনো ভাবেননি। তিনি এই ভেবে আরো আশ্চর্য হলেন যে, মানুষের জীবন কত বিচিত্র! তার চেয়ে আরো বিচিত্র তার অভিজ্ঞতা। আর মানব জীবনে এমন বৈচিত্র্যময় ঘটনার সমারোহ আছে বলেই সে তার জীবনের একঘেয়েমীর গন্ডি পেরিয়ে খুব সহজেই নিজকে স্থানান্তর করতে পারে ভিন্ন গন্ডিতে।

রেবেকা খাতুন ভ্যানে বসে লক্ষ্য করছিলেন যে, রাস্তার দু'পাশে খেলায় ব্যস্ত শিশুর দল আর কর্মব্যস্ত নারীরা ভ্যানের আরোহিনী এক অচেনা মহিলাকে দেখে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকছে। তবে খুবই স্বল্প সময়ের জন্য। তারপরই আবার যে যার মত ব্যস্ত হয়ে পড়ছে আপন ভুবনে। ব্যস্ত সবাই। তাঁর দিকে মনোযোগ দেবার সময় কারো হয় না। সময় হয় না পাশে দু'দন্ড বসে একটু কথা বলার। তিনি কেমন আছেন, সময় কী ভাবে কাটছে, মানসিক অবস্থা ভালো কি মন্দ, এর বিন্দুমাত্র খোঁজ নেবার অবসর কি কারোরই নেই? তিনি কি কেবল অন্যের প্রয়োজনে নিজকে নিয়োজিত রাখবেন সারাক্ষণ? তাঁর জন্যে কারোর ব্যস্ততার প্রয়োজন নেই?

না নেই। আর নেই বলেই তাঁর এই নিরুদ্দেশ যাত্রা। রাহেলা আক্তারকে যদি না পান, তাহলে তো এ নিরুদ্দেশ যাত্রারই নামান্তর! যেখানে তিনি চলেছেন বিপুল অবসরের বিশাল এক ভান্ডার নিয়ে। নিজকে যদি কোনো ব্যস্ততার সঙ্গে কিংবা কোনো কর্মযজ্ঞের সঙ্গে জড়িয়ে নিতে পারেন, তাহলে চেষ্টা করবেন আজ অবধি যে স্মৃতির মিনার গড়ে তুলেছেন, ধীরে ধীরে হলেও তা জমিনের সাথে মিশিয়ে দিতে।

কিন্তু মানুষ তার যাবতীয় স্মৃতিকে ভুলে যাওয়া যতই সহজ মনে করুক না কেন, আদৌ কি সব ভুলে যাওয়া যায়? সত্যিই কি তা সম্ভব? এই যে, স্বামী সন্তানের উপর অভিমান করে ঘর থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছেন, এতে কার কী এমন ক্ষতি হবে? স্বামী-সন্তান কি কখনো অনুধাবন করতে পারবে তাঁর অভিমানের হেতু? কেন তাঁর এই অজ্ঞাতবাস? হয়তো তারা দুএকদিন মনে মনে কষ্ট পাবে। পত্রিকায় ঘটা করে নিখোঁজ সংবাদ ছেপে সপ্তাহ খানেক অপেক্ষা করবে। তারপরই আবার যার যেমন ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এক একটি দিন গত হবার সাথে সাথে টান পড়বে সম্পর্কের সূতোয়। তারপর দীর্ঘদিনের টানের ফলে একদিন সেটাও ছিঁড়ে যাবে। তিনি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন একটি সংসার থেকে। একটি সমাজ থেকে। কিন্তু গোপনে গোপনে ঠিকই অনুভব করবেন সন্তানদের জন্যে আপন নাড়ীর টান, স্বামীর জন্যে অগাধ ভালবাসা!

সাত

রেবেকা খাতুনকে প্রথমটায় চিনতে পারলেন না রাহেলা আক্তার। একজন মহিলা হাতে সুটকেস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন এটা দেখতেও খারাপ লাগে। তাই নিদেন পক্ষে সৌজন্যের খাতিরে হলেও তাকে বসতে বলতে হয়। তা ছাড়া এই ভদ্র মহিলা এসেছেন তারই কাছে। কাজেই রাহেলা আক্তার রেবেকা খাতুনকে চিনতে না পারলেও বসতে বললেন।

তারপর রেবেকা খাতুনের মুখোমুখি বসে বললেন, ‘আপনার জন্য কি করতে পারি বলেন!’

রেবেকা খাতুন পরিচয় থেকে এখানে আসার আহ্বান পর্যন্ত সংক্ষেপে বিবৃত করেন।

চিনতে পেরে রাহেলা আক্তার জড়িয়ে ধরেন রেবেকা খাতুনকে। বললেন, ‘এতদিনে আপনার সময় হলো?’

‘সময় কি আর হয়, উপায় না দেখে চলে এসেছি!’
‘খুব ভালো করেছেন!’

রাহেলা আক্তার একটা মেয়েকে বললেন, ‘খুকি, সুটকেসটা গাড়িতে দিয়ে আয় তো!’

তারপর বললেন, ‘আসতে আপনার অনেক কষ্ট হয়েছে বুঝতে পারছি! রোদে চেহারা কেমন লালচে হয়ে উঠেছে! আগে বাসায় চলেন, ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম নেন। তারপর রাতে ফিরে কথা হবে!’

খুকি নামের মেয়েটা সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে যায় এবং প্রায় সাথে সাথেই ফিরে এসে জানায় ‘রেখে এয়েছি!’

রাহেলা আক্তার রেবেকা খাতুনের হাত ধরে বললেন, ‘চলেন, আপনাকে বাসায় দিয়ে আসি!’

‘বাসা কি বেশি দূর?’

‘তেমন একটা দূর নয়, কাছেই!’

‘এ অঞ্চলে পায়ে হেঁটে কোথাও যেতে পারি না। মেয়েরা এমন ভাবে ঘিরে ধরে যে, মুক্তি পেতে কম করে হলেও একঘন্টার ধাক্কা!’

‘তাহলে এখানে বেশ পরিচিতি পেয়ে গেছেন বলতে হবে!’

‘অনেকদিন ধরেই তো মেয়েদের নিয়ে কাজ করছি, যে কারণে মোটামুটি সবাই চেনে!’

রাহেলা আক্তারের কণ্ঠে কেমন একটা আত্মপ্রসাদের সুর খেলা করে যেন।

গাড়িতে যেতে যেতে রাহেলা আক্তার এখানকার মেয়েদের সম্পর্র্কে মোটামুটি একটি ধারণা দিতে চেষ্টা করেন। তাঁর কাজের উদ্দেশ্য, ধরন, প্রজেক্টের ধরন, এ নিয়ে মানুষদের ধারণা কি? এসব এক এক করে বলেন। আরও বলেন নতুন আরেকটি প্রজেক্টের প্রোপোজাল নিয়েও আলোচনা চলছে। মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর পাশাপাশি হাতের কাজ শিখিয়ে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার প্ল্যানও আছে। তা ছাড়া এ এলাকায় সুন্দরবন ছাড়াও খাল-বিলের পাশে প্রচুর হোগলা হয়। তা থেকে পাটি, ঝুড়ি, বিশালাকৃতির প্যাকেট বুনে বিভিন্ন জেলায় বিক্রির ব্যাপারেও বিভিন্ন পার্টির সাথে আলোচনা চলছে। কিন্তু তিনি একা বলে একই সঙ্গে দুটো কাজে হাত দিতে সাহস পাচ্ছেন না। এখন রেবেকা খাতুন যদি এগিয়ে আসেন, তাহলে হোগলা প্রজেক্টের জন্য ফান্ড চেয়ে আবেদন করবেন। এ ছাড়াও তার কাজের যথেষ্ট হেল্পও হবে।

রেবেকা খাতুন বললেন, ‘এসেছি যখন হেল্প তো কিছুটা পাবেনই!’

একটা ছোটোখাটো সেমি পাকা বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে রাহেলা আক্তার বললেন, ‘আপাতত এটাই আমার ডেরা!’

গাড়ি থেকে নেমে রবেকা খাতুন বললেন, ‘এ বাড়িতে আপনি একা থাকেন?’

‘একদম একা না!’ বলে হাসলেন রাহেলা আক্তার।
তারপর পেছন থেকে সুটকেসটা নামিয়ে বাড়ির গেটে প্রবেশ করে বললেন, ‘দুটো মেয়ে আছে! যাদের সব থেকেও নেই!’

‘ওদের বিয়ে হয়নি?’

রাহেলা আক্তার অবাক হয়ে বলেন, ‘বিয়ে, কেন? বিয়ে ছাড়া মেয়েরা থাকতে পারে না?

রেবেকা খাতুন কিছুটা অবাক না হয়ে পারেন না। এমন ধরনের কথা এই প্রথম তিনি কোনো নারীর মুখে শুনলেন। তিনি কিছু বলার আগেই রাহেলা আক্তার আবার কথা বলে উঠলেন, ‘তা ছাড়া ওদের বিয়ের ইচ্ছে আছে বলে মনে হয় না! অনেকদিন ধরেই তো আছে, এমন ইচ্ছে থাকলে আমাকে বলতো অবশ্যই!’

বাড়ির ভেতরের দিকে এসে অবাক না হয়ে পারেন না রেবেকা খাতুন। বিশাল উঠোনের তিন পাশে চমৎকার ফুলের বাগান। একটি খাঁচায় শালিকের মত দেখতে কিছুটা বড় আকৃতির পাখি দেখে তিনি ভাবেন ওটা ময়না বুঝি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তার ভুল ভাঙে। ওটা কাগজে ছাপা একটা ছবি। বাড়ির এ অংশটা খুব ভাল লেগে যায় তাঁর।

এরই মাঝে রাহেলা আক্তার ‘জরিনা, রহিমা তোরা কোথায়?’ বলে জোরে হাঁক দেন।

প্রায় সমবয়সী দুজন তরুণী ছুটে আসে।

একজনের হাতে হলুদ লেগে আছে। হয়ত হলুদ পিষছিলো বা কিছুতে মাখাচ্ছিলো। ডাক শুনেই কাজ ফেলে ছুটে এসেছে। অন্যজন আঁচলে হাত মুছতে মুছতে আসে। দুজনেরই ভরভরন্ত সুগঠিত শরীর। সুন্দর সুখী সুখী মুখ। বয়স বিশ-বাইশের মধ্যেই হবে। মেয়ে দুটোকেও ভালো লাগে রেবেকা খাতুনের।

রাহেলা আক্তার সুটকেসটা রহিমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা তোদের রেবেকা ম্যাডাম! এখন থেকে আমাদের সাথেই থাকবে। ওর জন্য একটা ঘর পরিষ্কার করে ঝেড়েমুছে দে! আর পানি গরম করে বাথরুমে দিয়ে দিস, গোসল-টোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিতে পারবে!’

জরিনা রহিমা একই সঙ্গে মাথা কাত করে।
তারপর রাহেলা আক্তার ফিরে যেতে যেতে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘আমি ফিরতে দেরি হবে। তোরা ওকে খাবার দিয়ে নিজেরাও খেয়ে নিস! কেমন?’

তারপর রেবেকা খাতুনকে বললেন, ‘আপনি খেয়েদেয়ে আগে একটা ঘুম দেবেন! আমি ফিরে এসে কথা বলবো!’

রেবেকা খাতুন সুটকেসটা নিয়ে বললেন, ‘কোন ঘরে থাকবো সেটা একজন দেখিয়ে দাও!’

দেখতে শ্যামলা মত মেয়েটা ছুটে যায়। কিছুক্ষণ পর ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে আসে। বলে, ‘ম্যাডাম, আপনের কোঠায় চইলে আসেন!’

রেবেকা খাতুন বললেন, ‘তোমার নামটা কি?’

‘জরিনা!’

সুটকেস টেনে রেবেকা খাতুন জরিনার পিছু পিছু একটা রুমে আসেন। আর তখনই রহিমা বললো, ‘আমি চুলোয় পানি বসাই গে!’

রেবেকা খাতুন সুটকেস খুলে একটি সূতির ম্যাক্সি, তোয়ালে-সাবান, টুথব্রাশ-পেস্ট বের করে বললেন, ‘তোমাদের এখানে পুকুর নেই?’

জরিনা ঠোঁট উল্টিয়ে বলল, ‘পুকুর ভালো লয়! তাও আবার অনেক দূর!’

‘তাহলে?’

রেবেকা খাতুন দৃষ্টিতে প্রশ্ন মেখে তাকিয়ে থাকেন।

‘আমরা সব কিছুই চাপকলের পানিতে করি!’

তারপর সে সুটকেস নিয়ে পাশের একটা রুমে গিয়ে ঢোকে।

রুমটা দেখে মোটামুটি পছন্দ হয় রেবেকা খাতুনের। বিছানা, বালিশের কভার, জানালার পর্দা সবই ঝকঝকে নতুন।

জরিনা আলমারি খুলে দিয়ে বললো, ‘আপনার সব কাপড় এর মদ্যি রাখবেন। আর পেরতেক দিন গোসলের পর কাপড় ছেড়ে আসবেন। ধুয়ে দেবানি!’

‘আচ্ছা, তুমি এখন যাও। আমি কাপড় চেঞ্জ করে তোমাকে পরে ডাকবো!’

রেবেকা খাতুন বাইরের কাপড় ছেড়ে সূতির ম্যাক্সিটা পরে নেন। কিন্তু হঠাৎ বিচিত্র একটি শব্দ শুনে দরজার দিকে তাকাতেই দেখতে পান জরিনা আর রহিমা কেমন জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে তাঁর সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো।

আট

রেবেকা খাতুন মনে মনে অস্বস্তিতে ভোগেন। এখানে তিনজন নারী থাকলেও তিনি কেমন যেন সহজ স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। মনে হয় কোনো আড়াল থেকে দুটো লোভী চোখ তাঁকে লক্ষ্য করছে। রাহেলা আক্তারও কেমন যেন। বিনা কারণে গায়ে হাত বুলিয়ে বলে,‘এই বয়সেও আপনার শরীর এত সুন্দর থাকে কি করে? আপনার হাজবেন্ড কি সবটা পায়নি?’

রাহেলা আক্তারের এ ধরনের আচরণ ও কথাবার্তা মোটেও ভাল লাগে না। ওদের দেখলে তিনি ভেতরে ভেতরে খুব লজ্জা পান। গায়ে ভালমত ওড়না জড়িয়ে রাখার পরও অস্বস্তি দূর হয় না। ঘুমালে কিংবা শুয়ে থাকলেও এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা তাঁকে শঙ্কার ভেতর ফেলে রাখে। যে কারণে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে রাখেন। এটা নিয়ে অবশ্য রহিমা একবার অনুযোগ করে বলেছিল, ‘ম্যাডাম কি আমাগের ভয় পান?’

রাহেলা আক্তার শুনে বলেছিলেন, ‘এ কেমন কথা! এক মেয়ে আরেক মেয়েকে ভয় পাবে কেন?’

রেবেকা খাতুন বলেছিলেন, ‘দৃষ্টি খারাপ হলে, সেটা যারই হোক একটা মেয়ে স্বাভাবিক ভাবেই অস্বস্তি বোধ করবে!’

রাহেলা আক্তার যেন আজগুবী কিছু শুনছেন এমন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। তবে এর পর থেকে জরিনা কিংবা রহিমাকে দেখা যায়নি আড়াল থেকে লক্ষ্য করতে।

তার পরও কথা থাকে। ওদের গায়ে পড়া ভাবটা কখনো যাবে বলে মনে হয় না। ইদানিং নতুন একটা কষ্ট যোগ হয়েছে তাঁর জীবনে। দিনের বেলা এখানে ওখানে মিটিঙের কাজে ছুটোছুটির ফলে দিনের শেষে খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। যদিও গাড়ি নিয়েই এখানে ওখানে যান, তবুও রাতের বেলা হাত-পা আর শরীরের ব্যথায় ঘুমাতে পারেন না। কথায় কথায় একদিন রাহেলা আক্তারকে এ কথা বলতেই তিনি জানালেন, ‘ওষুধে এ ব্যথা যাবে না!’

‘তাহলে কি করতে হবে?’

‘জরিনা অথবা রহিমাকে বললে, ওরা খুশি হয়েই পা থেকে মাথা পর্যন্ত ম্যাসেজ করে দেবে!’

তারপর রাহেলা আক্তার আবার বললেন, ‘একদিন ম্যাসেজ না করালে তো আমার ঘুমই আসে না!’ সঙ্গে সঙ্গে কেমন ভাবে যেন হেসে উঠলেন তিনি।

রাহেলা আক্তারের হাসিটা ভালো লাগে না রেবেকা খাতুনের। তবুও শরীর ম্যাসেজের ব্যাপারটা তাঁর কাছে তেমন খারাপ বলে মনে হয় না। কিন্তু ওদের চাহনির ভাব ভালো নয়। তাদের দৃষ্টির সামনে নিজকে কেমন নগ্ন নগ্ন মনে হয়। তা ছাড়া ওদের মধ্যে একটি উদ্ভট মানসিকতাও বিরাজ করছে। যেটা তাঁর জন্যে শুভ নাও হতে পারে। সাবেক এক ডিসির স্ত্রী বলেছিলেন যে, এ ধরনের শরিরী সমস্যায় গরম পানিতে গোসল করলে বেশ কাজ দেয়!

পরদিন দূরের একটি গ্রামে মিটিঙে যাবেন বলে আগে আগেই শুয়ে পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু শরীর এতটাই খারাপ লাগছিলো যে, তিনি বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে পারলেন না। ভাবলেন, গরম পানিতে গোসল করলে কষ্টটা কমতেও পারে। ঢাকা থাকতে অবশ্য এমন ধরনের সমস্যায় তাঁকে পড়তে হয়নি কখনো। কারণ, বেশির ভাগ সন্ধ্যার সময়ই তিনি ঈষদূষ্ণ পানিতে গোসল করতেন।

তিনি বিছানা থেকে নেমে জরিনা অথবা রহিমাকে পানি গরম করতে বলার জন্য তাদের রুমের দিকে যাবার আগে রাহেলা আক্তারের রুমে উঁকি দিয়ে দেখলেন যে, তিনি এখনো ফেরেন নি।

তারপর জরিনা রহিমার রুমে গিয়ে উঁকি মারতেই কেমন ভূত দেখার মত চমকে ওঠেন। ঘৃণায় তাঁর সারা শরীর রিরি করে উঠলেও কেন জানি ওদের দু'জনের প্রতি করুণায় আর্দ্র হয়ে উঠলেন। তাদের বিরক্ত না করে তিনি একাই রান্না ঘরে গিয়ে চুলোয় পানি চড়িয়ে দেন। চুলোয় আগুন দিতে দিতে ভাবেন যে, প্রথম দিন কেন ওদের দৃষ্টিতে পুরুষের ছায়া দেখেছিলেন। তবে তিনিই বা তাদের দোষ দেবেন কিভাবে? সময় মত মেয়েদেরে বিয়ে না হলে বা দীর্ঘদিন স্বামী সঙ্গ থেকে বঞ্চিত থাকলে যা হয় আর কি!

চুলোয় ডাল-পাতা পোড়ার একটা ধোঁয়াটে গন্ধ পুরো রান্নাঘর জুড়ে পাক খায়। আর তখনই জরিনা রহিমা অবিন্যস্ত বেশে ছুটে আসে রান্নাঘরের দরজায়।

রেবেকা খাতুন বললেন, ‘তোমরা আবার উঠে এলে কেন?’

জরিনা বলল, ‘ভাবলাম আগুন লেইগেছে বুঝি!’

রেবেকা খাতুন কেমন ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বললেন, ‘পানি গরমে দিয়েছি!’

রহিমা বলল,‘আমাগেরে বললি কইরে দেতাম না?’
রেবেকা খাতুন হাসলেন। কিন্তু কিছু বললেন না।
রহিমা আঁচল কোমরে পেঁচিয়ে বলল, ‘আপনি যান দিনি! আমি নিয়ে আসতিছি!’

রেবেকা খাতুন দুটো মুখের দিকেই তাকালেন। দুটো চেহারাই কেমন সুখীসুখী আর প্রশান্ত। তবু তিনি মনেমনে বললেন, ‘বেচারি!’

নয়

অনেকদিন পর খুব ভালো ঘুম হলো রেবেকা খাতুনের। গরম পানিতে যে কাজ হয়েছে তা মনে মনে স্বীকার না করে পারেন না। মিটিঙে যাবার জন্য তৈরী হয়ে তিনি রাহেলা আক্তারের ঘরে উঁকি দিলেন। কিন্তু বিছানা খালি দেখে জরিনাকে বললেন, ‘রাহেলা আপা রাতে আসেননি?’

‘এয়েছেন তো!’

‘তাহলে দেখছি না যে?’

‘গাড়ি মেরামত করতিছেন!’

রেবেকা খাতুন অবাক বিস্ময়ে ছুটলেন গ্যারেজের দিকে। সত্যি সত্যিই গায়ে ওভারঅল চাপিয়ে হাতে রেঞ্জ নিয়ে গাড়ির তলায় ঢুকে আছেন রাহেলা। হাঁটুর নিচ থেকে পায়ের অংশ বাইরে দেখা যাচ্ছে।

রাহেলা আক্তারের এ গুণের কথা জানতেন না রেবেকা খাতুন। তিনি গাড়ির নিচে উঁকি দিয়ে বললেন, ‘আপা, তুমি মেকানিক হলে কবে থেকে?’ রাহেলা আক্তার ইঞ্জিনের একটা নাট টাইট দিতে দিতে বললেন,‘তুমি ড্রাইভার হওয়ার অনেক আগে থেকেই!’

তারপর গাড়ির নিচ থেকে শরীরটাকে ছেঁচড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন রাহেলা আক্তার। উঠে বললেন,‘মাঝপথে গাড়ি খারাপ হলে, হাঁটা ছাড়া উপায় থাকবে না! কাজেই মেকানিক না হলে রাস্তায় পড়ে কাঁদতে হবে!’

রেবেকা খাতুন বললেন, ‘গোবিন্দপুরের প্রোগ্রামটা ঠিক আছে তো?’

‘তবে তোমার সঙ্গে আমাকেও যেতে হবে। বলা যায় না, গাড়িটা কখন বিগড়ে যায়!’

রাহেলা আক্তারের চেহারার ঔজ্জ্বল্য হঠাৎ করেই কেমন ম্লান হয়ে যায়। বললেন,‘গাড়িটা পাল্টাবার কোন সুযোগই পাচ্ছি না!’

‘তুমি না বললে,‘পেপার রেডি হয়ে আছে!’

‘এখনো তো সাইন হয়নি!’

আনমনে রাহেলা আক্তার কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর আবার বললেন,‘তোমার হোগলা প্রজেক্ট তো খুবই প্রশংসা পাচ্ছে! একটা গাড়ি তুমিও পেয়ে যাবে!’

‘তুমি বলছো?’

‘আমি বলছি না! কাল তোমার ব্যাপারে খুলনা গিয়েছিলাম। প্রথম কিস্তির টাকা আশা করছি সামনের সপ্তাহেই পেয়ে যাবো! টাকাগুলো ঠিক মত বিলিবন্টন হয়ে গেলে আগামী মাসের প্রথম দিকে হোগলার চালানটা খুলনা পৌঁছাতে পারবে না?’

‘আমিও সেটাই ভাবছি!’

‘মিটিঙে বললাম, তুমি আমার গাড়ি নিয়ে টানাটানি কর বলে, আমার কাজের হ্যাম্পার হয়!’

রেবেকা খাতুনের আগ্রহ শানিয়ে ওঠে আরো। বললেন,‘ ওরা কী বললো?’

রাহেলা আক্তার বললেন,‘ কী আর বলবে!’

তারপর পন্ডসের বিজ্ঞাপনের কায়দায় রেবেকা খাতুনের দু'গাল টিপে দিয়ে বললেন,‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ড্রাইভিং লাইসেন্সটা করিয়ে দিতে!’

‘আমার গাড়ি এলে তোমারটা রাখবে কোথায়?’

‘কেন? যেখানে থাকে সেখানেই!’

রাহেলা আক্তার বনেট নামিয়ে দিয়ে টেনেটুনে পরীক্ষা করলেন।

‘তোমার গাড়ি তো পুরোনো আর রদ্দিমার্কা হয়ে গেছে! ওটা বাইরে থাকবে!’

‘তোমাকে নতুন গাড়ি দেবে, না আমারটার চেয়েও রদ্দিমার্কা দেবে, সেটা কিন্তু বলেনি!’

তারপরই রেবেকা খাতুন কিছু বলে উঠবার আগেই তিনি আবার বলে উঠলেন, ‘নাস্তা করেছো?’

‘তোমাকেই তো আগে খুঁজতে বেরোলাম!’

‘চলো, চলো! আগে নাস্তা, তারপর সব!’ বলে তিনি রেবেকা খাতুনকে ঘরের দিকে বাহু ধরে ঘুরিয়ে দিলেন।

দশ

হোগলা প্রজেক্টের মেয়েরা টাকা পেয়ে খুবই খুশি। নাজমা বলে একজন স্বামী পরিত্যাক্তা মেয়ে কেঁদে ফেললো। তার কান্না দেখে রাহেলা আক্তার বললেন, ‘টাকা পেয়ে কাঁদছো কেন?’

‘অনেক দিন ধইরে বাপ-ভাইয়ের কান্দে বোঁঝা হইয়েছিলাম! এখন নিজে কিছু একটা করতি পারবো!’

রাহেলা আক্তার বললেন, ‘টাকা পেয়ে কিন্তু ইচ্ছে মত খরচ করে ফেলো না! এ টাকা দিয়ে তোমরা হোগলা কিনবে। আর সে হোগলার পাটি জনপ্রতি একশটা করে দেবে। তোমাদের সাথে আমাদের এ চুক্তিই আছে! পরে নয় তো টাকা ফেরত দিয়ে দিতে হবে!’

তেমন কাউকে অখুশি দেখা যায় না। বেশির ভাগ গ্রহীতাই জানালো যে, একমাস লাগবে না! বিশ-পঁচিশ দিনের মাথায়ই তারা কাজ বুঝিয়ে দিতে পারবে!

নতুন ধরনের এ কাজের প্রতি প্রায় সব মেয়েরাই আগ্রহী হয়ে উঠলো। তাদের কারো কারো অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা যারা চিংড়ি পোনা ধরবার কাজে চুক্তিতে নিয়োজিত হতো, তাদের অনেকেই এ পেশার সাথে কোনো না কোনো ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে গেল। কিন্তু যারা এ সমস্ত ছেলে-মেয়েদের দিয়ে কাজ করাতো কিংবা যারা এদের বিভিন্ন মহাজনের কাছে নিয়োগ দিয়ে কমিশন পেতো, তারা খুশি হতে পারলো না। সপ্তাহ না ঘুরতেই অনেক মেয়ে তাদের টাকা ফেরত দিয়ে দিতে চাইলো।

রেবেকা খাতুন বললেন,‘তোমাদের সমস্যাটা কি?’

রবিয়া নামের এক বিধবা বললো,‘এনজুর ট্যাকা না জায়েজ! এ দিয়ে কিছু করাও জায়েজ হবে না!’

অদ্ভূত কথা শুনে রেবেকা খাতুনের বিস্ময় কাটে না। তিনি নির্বাক হয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ পর বললেন,‘এ টাকা না জায়েজ হবে কেন?’

‘বিদেশী খিরিস্টানরা এনজু চালানোর ট্যাকা দেয়। আপনেরা সেই ট্যাকা আমাগের দেছেন!’

‘আমরা তো তোমাদের এমনি এমনি টাকা দেইনি! তোমরা আমাদের হোগলার পাটি বানিয়ে দেবে, সে জন্যে কিছু আগাম দিয়েছি!’

‘এই কইরে আমাগের লাভ হবে! তাতে আপনেগের কী লাভ?

‘আমরা আরো বেশি দামে বিক্রি করবো! তা ছাড়া তোমাদের ঘরে অভাব থাকবে না! ভালো মত খেতে পরতে পারবে! তোমাদের ছেলেমেয়েরা বাইরে গিয়ে কাজ না করে লেখাপড়া করতে পারবে! বড় হয়ে মানুষ হবে! ভালো চাকরি করতে পারবে!’

‘আপনেরা আমাগের লোভ দিয়ে দিয়ে পরে খিরিস্টান কইরে ফেলার চক্রান্ত কইরেছেন!’

রাহেলা আক্তার ক্ষেপে গেলেন। ‘তোমাদের এসব আজে বাজে কথা কে বলেছে?’

রবিয়া দমে না গিয়ে আবার বলে, ‘ঢাকা শহরের কাছে সাভারে একজন মোসলমান লোক খিরিস্টান হইয়েছে। সেডাও এনজুর কাজ! আপনেরা খিরিস্টানগের দালাল!’

রেবেকা খাতুন জানেন না, আদৌ কোনো মুসলমান খৃস্টান হয়েছে কিনা। এমন কথাও কোনোদিন শুনেননি।

রবিয়া একবার পেছনের দিকে মাথা ঘুরিয়ে কি যেন দেখলো। কিন্তু কিছু বলল না।

যুগপৎ রাহেলা আক্তারও সেদিকে তাকালেন। মেয়েদের সারিগুলোর পরের সারিতে অনেক পুরুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। এমনটা সব সময়ই থাকে। যে মেয়েরা এসব মিটিঙে আসে, তাদের কারো স্বামী, চাচা, কিংবা বাপ-ভাইও সঙ্গে আসে। তবে রবিয়াকে এ সমস্ত কথা যে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে সে ওই ভিড়ের মধ্যেই কোথাও আছে।

রেবেকা খাতুন বুঝতে পারলেন যে, এমন জটিল অবস্থায় মাথা গরম করা চলবে না। সত্যিকার ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে হবে। বিশেষ করে ধর্মীয় ছাঁয়া থেকে আঘাত করে তাদের কাজ-কর্মকে থামিয়ে দিতে কোনো একটি চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদেরও চটানো যাবে না। কারণ শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়ে থাকা প্রকৃত জ্ঞান-বুদ্ধি চর্চায় এমন অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি এলাকায় মেয়েদের যতই বোঝানো হোক, যত অকাট সত্যিই বলা হোক না কেন, তারা নিজেরা কখনোই মতামত দিতে যাবে না। পারবে না এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে। এখানে সাক্ষী সাবুদ ছাড়াই পুরুষের মুখের তিন-কথা শুনে মেয়েরা কাঁদতে কাঁদতে বাপের বাড়ি ফিরে আসে। তা ছাড়া সেই মেয়েদের বাপ-ভাইও ফিরে গিয়ে মেয়ের স্বামী-শ্বশুরকে কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করে না। কাজেই এমন পরিবেশে দিনরাত যারা বাস করছে, তাদের কাছে কোনো একটি ব্যাপার গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হলে সেটা করতে হবে মেধা দিয়ে। আন্তরিকতা দিয়ে। তিনি রাহেলা আক্তারকে বললেন,‘আপা, মাথা গরম করলে আমাদের প্রজেক্ট ফেল করবে!’

তারপর তিনি রবিয়াকে সামনে রেখে উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বললেন,‘আপনারা শান্ত হয়ে আমাদের কথা শোনেন! আমাদের এনজিও আপনাদের কাছ থেকে হোগলার পাটি কিনে নিয়ে বিভিন্ন শহরে বিক্রি করবে। এতে আমাদের যেমন লাভ হবে, তেমন আপনাদেরও দুটো পয়সা ঘরে আসবে। অভাবের কারণে আপনাদের অনেকের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে চিংড়ি পোনা ধরতে সাগরে যেতো! যেখানে বিষাক্ত সাপ আর জীবজন্তুর কারণে অনেকে মারাও গেছে! কেউ কেউ ঝড়ের সময় হারিয়েও গেছে! আবার কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে সময় মত চিকিৎসা না পেয়ে অকালে মারা গেছে! আপনাদের বাচ্চারা যদি বাড়িতে বসেই কাজ করতো বা নিজেদের গ্রামেই থাকতে পারতো, তাহলে তারা হয়তো অকালে মারা যেতো না কিংবা হারিয়ে যেতো না! আরেক দিকে যাদের স্বামী বা বাপ-ভাই সুন্দরবনে গিয়ে কাজ করতো, কেউ বাঘের পেটে গেছে। কেউ বা বাঘের থাবায় পঙ্গু হয়ে ফিরে এসেছে। ঘরে বসে হোগলার পাটি বুনলে তাদের আর এমন বিপদের কাজ করতে হতো না। তাদের এমন ভাবে বনে জঙ্গলে মরে পড়ে থাকতে হতো না!’

উপস্থিত নারী-পুরুষদের মাঝে কেমন একটা গুঞ্জরণ উঠলো।

রেবেকা খাতুন আবার বলতে লাগলেন,‘আপনাদের ঘরে অভাবের কারণে অনেকের স্বামী তার বউকে বাপের বাড়ি ফেলে রাখে মাসের পর মাস। অভাবে সংসারের শান্তি নষ্ট হয়। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া হয়। কোনো কোনো মেয়ে স্বামীর বাড়িতে ঠিক মত খেতে না পেয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে আসে। আপনারা যদি অভাবে না থাকেন, তাহলে স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেবে না। স্ত্রী তার স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে যাবে না। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কেউ গলায় দড়ি দিয়ে মরতে যাবে না। আর আপনাদের যদি অভাব না থাকে, তাহলে আপনাদের এলাকায় অশান্তি থাকবে না। আমাদের সরকারকেও বিদেশ থেকে খাবার আর টাকা পয়সা ভিক্ষে করতে হবে না!’

গুঞ্জরণটা বেড়েই চললো।

পেছনের সারি থেকে কেউ বললো,‘রবিয়া চইলে আয়!’

রবিয়া টাকাগুলো সঙ্গে নিয়েই ফিরে যাবে, নাকি টাকা ফেরত দিয়ে যাবে, সেই দ্বন্দ্বে ভুগলো কিছুক্ষণ।

রেবেকা খাতুন বললেন,‘তুমি টাকাগুলো নিয়ে যাও! বাড়িতে পরামর্শ করে তারপর ঠিক কর কি করবে!’

রবিয়া ফিরে গেলে সবার মধ্যেই কেমন একটা অস্থিরতা ফুটে উঠলো। কিন্তু নতুন করে কোনো প্রশ্নের বাণ ছুটে আসে না। আস্তে আস্তে ভিড়টা পাতলা হতে থাকে। কেউ কেউ তাদের বাড়ির দিকে ফিরে যাচ্ছে।

রাহেলা আক্তার গলার স্বর নামিয়ে বললেন,‘দারুণ একটা কাজ করেছো তুমি! আমার তো মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিলো!’

‘এ ধরনের জটিল ব্যাপারে মাথা খারাপ করতে নেই। মানুষ তার ধর্মের ব্যাপারে খুবই ইমোশনাল! কোনোভাবে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়লে সেখানে যুক্তি-বিবেচনা, শিক্ষা বা বিশ্বাস কোনোটাই কাজে আসবে না!’

ভিড় আরো কমতেই এক যুবক এগিয়ে আসে।

রেবেকা খাতুন তাকে চিনতে পারেন। তার সঙ্গে যখন প্রথম আলাপ হয়, তখন অন্যান্যরা খাতুনের জামাই বলে তার পরিচয় দিয়েছিলো। খাতুনের জামাই বেশ খানিকটা এগিয়ে এসে বললো,‘আমরা দু’জনে মিলে পঞ্চাশটা পাটি বুনে ফেলেছি। এহোন ঘরে শোবার জাগা নেই! আমাগের কষ্ট হতিছে!’

রাহেলা আক্তার স্থানীয় ইউ.পি সদস্য মর্জিনাকে বললেন,‘যার যার কাজ বুঝে নিয়ে তুমি তোমার বাড়িতেই সব রাখবার ব্যবস্থা কর। যে ঘরে রাখবে গোডাউন হিসেবে ওটার ভাড়া পাবে!’

মর্জিনা বললো,‘এ জন্যি তো একটা ঘর খালি করাতি হবে!’

‘করে নাও! যার যার মাল বুঝে পাবে, হিসাব করে কাগজে টুকে রাখবে!’

শেষ পর্যন্ত সবাই চলে গেলে রাহেলা আক্তার গাড়িতে উঠতে উঠতে বললেন, ‘দুষ্টু লোকেরা কোথায় নেই বলতে পারো?’

রেবেকা খাতুন বললেন, ‘শয়তান যেখানে নেই!’

এগার

মন খারাপের কারণে রেবেকা খাতুন আজ কোথাও বের হননি। ভোরবেলা একটা স্বপ্ন দেখে অকস্মাৎ তাঁর ঘুম ভেঙে যাবার পর ঘুমুতেও পারেননি আর। আরবান তখন খুবই ছোট। চার-পাঁচমাস বয়স। শাহজাহান পুরের স্টাফ কোয়ার্টারে থাকতেন। এক রাতে কি করে যেন সে পাশ দিয়ে খাট থেকে পড়ে গেলো। মশারী টানানো থাকায় তার ঘেরাটোপে ঝুলে সে আটকে ছিলো। সেই দৃশ্যটাই একটু ভিন্নভাবে দেখলেন। আরবান সে অবস্থায় মা মা করে ডাকছে আর কাঁদছে। কিন্তু জানলা দিয়ে ঘটনাটা দেখছেন তিনি। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকায় ঘরে ঢুকতে পারছেন না! খুবই অদ্ভূত একটি স্বপ্ন!

আরবান এখন কেমন আছে? সঙ্গদোষে আরো খারাপ হয়ে গেল কিনা! নাকি ঘরে মা নেই বলে সে খারাপ পথ থেকে ফিরে এসেছে? তার বিন্দুবিসর্গও তিনি জানেন না। ঘুম ভেঙে যাবার পর তার শরীরটাকে বিছানা থেকে নাড়াতে পারছিলেন না। তিনি অনেক শক্ত মনের মানুষ হলেও আজ কেন জানি সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে পড়তে চাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর থেকে থেকে ভেতর থেকে একটা অব্যক্ত কষ্টের বাষ্প উপরের দিকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছিলো। কিন্তু কোনো পথ না পেয়ে শেষে অশ্শ্রুকণা হয়ে দুচোখ বেয়ে বেরিয়ে এলো।

রেবেকা খাতুন আঁচল দিয়ে চোখ চেপে ধরেন। কিন্তু চোখের পানি কোনো বাঁধ মানে না। এভাবে নিজের দুর্বলতা কারো কাছে প্রকাশ হয়ে যাক সেটাও তিনি চান না। কোনোরকমে কষ্ট করে তিনি বাথরুমে গিয়ে দরজা আটকে দিয়ে অনেক্ষণ কাঁদলেন। কেঁদে কেঁদে তিনি চাচ্ছিলেন চোখ দুটো যেন পানি শূন্য হয়ে যায়। কিন্তু তার কান্না ফুরায় না। তাঁর জানা ছিলো না যে, এ ছয় মাসে তাঁর দু’চোখ কতটুকু কষ্টের পানি ধারণ করেছে!

দরজায় অকস্মাৎ জোরে ধাক্কা পড়লে সাথে সাথে রহিমার গলার স্বর শোনা যায়। ‘ম্যাডাম, আপনি এতক্ষণ কী করতিছেন? ও ম্যাডাম! কতা কচ্ছেন না ক্যান?’

রেবেকা খাতুন কান্না সামলে বললেন,‘দরজা ধাক্কাচ্ছিস কেন?’

‘আপনে এতক্ষণ করেন কি? আমার ভয় করতিছে!’

রেবেকা খাতুন চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দরজা সামান্য ফাঁক করে বললেন,‘তুই ভয় পাচ্ছিস কেন?’

‘অনেক্ষণ হইয়ে গেছে তো, তাই ভাবলাম খারাপ কিছু হল কিনা!’

‘আমি তো ঠিক আছি! তুই যা, নাস্তা রেডি কর!’

রহিমা চলে যায় না। বলে, ‘আগে দরজা খোলেন!’

রেবেকা খাতুন দরজা খুললে রহিমা ভেতরে অনুসন্ধানী দৃষ্টি চালায়। তারপর সন্তুষ্ট চিত্তে বলে, ‘আমার সঙ্গে আসেন!’

রেবেকা খাতুন পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছেন। বুকের ভেতরটাও যেন অনেক হালকা লাগছে। বললেন, ‘তুই কেন ভয় পাচ্ছিস?’

‘এর আগে এমন সময় এক ম্যাডাম গলায় দড়ি দিয়ে মইরেছিলো!’

‘আমিও গলায় দড়ি দেবো ভেবেছিলি?’

রহিমা কথা বলে না।

রেবেকা খাতুন রহিমার সতর্কতা দেখে অবাক হন। মেয়েটা সত্যিই তাঁকে ভালোবাসে! তিনি বললেন,‘আগের ম্যাডাম কি তোকে খুব ভালবাসতো?’

‘আমারে বুকে না নিলি তেনার ঘুমই হতো না!’

রহিমার কন্ঠ কেমন গদগদ হয়ে ওঠে।

রেবেকা খাতুন মনে মনে বলেন, ‘ওরে মূর্খ মেয়ে! সেই ম্যাডাম আগে নিজে নষ্ট হয়েছে, তারপর তোকে নষ্ট করেছে! আর তুই নষ্ট করেছিস জরিনাকে!’

তারপর তিনি রাহেলা আক্তারের কথা ভাবেন। রাহেলা আক্তার নষ্ট হলো কিভাবে? নিজে নিজেই? অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা বলে একা একাই বিকল্প পথ বের করে নিয়েছে? তবে এটা একদম ঠিক নয়। এটা এক ধরনের মানসিক বিকৃতি। আর মানসিক বিকৃতি সুযোগ পেলে দিনদিন বাড়ে বৈ কমে না!

রেবেকা খাতুন নাস্তার টেবিলে বসে মনে মনে ঠিক করেন যে, এদের এই বিকৃতির পথ থেকে সরিয়ে আনতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে। তবে তার আগে তাদের মন থেকে দূর করা প্রয়োজন পুরুষ বিদ্বেষ। কোনো কারণে এরা জীবনের কানামাছি খেলায় চোখ বেঁধে নামবার পর চোখ থেকে সে আড়াল সরেনি বা সরাবার সুযোগ পায়নি। সে অবস্থায়ই এখনো হাতড়ে মরছে! ছুঁতে পারেনি সত্যিকার কোন পুরুষ হৃদয়! আর তাই এখনো তাদের ভোঁ ভোঁ দশা চলছে। কিন্তু তিনি এখনো জানেন না কেন তাদের এই পুরুষ বিদ্বেষ? আর পুরুষ বিদ্বেষী হওয়ার অর্থ তো সমকামী হওয়া নয়!

নাস্তা এগিয়ে দিয়ে রহিমা রেবেকা খাতুনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হয়তো বা অপেক্ষা করছে আর কোন আদেশ হয় কিনা। কিন্তু রেবেকা খাতুন হঠাৎ করেই বলেন, ‘আচ্ছা রহিমা, আজ ছয় মাস হতে চললো, তোদের কোনো আত্মীয়-স্বজন বা বাপ-ভাই কাউকে আসতে দেখলাম না! তারা কি অনেক দূরে থাকে?’

রহিমা হেসে বলে, ‘না ম্যডাম, আমার বাপ ভাই সব এখানেই থাকে। আমার বাপের বাড়ি তো এই গিরামেই!’

‘তাহলে?

‘এহানে পলাইয়ে রয়েছি!’

রেবেকা খাতুন বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন রহিমার মুখের দিকে।

রহিমা বলে, ‘হয়, ম্যাডাম, সত্যি কতিছি! বাবা আমারে কেরামত হাজির কাছে বে দিতি চাচ্ছিলো জোর কইরে। তাই পলায়েছি!’

‘কেরামত হাজি কেমন ছিলো?’

‘খুনখুইনে বুড়ো। ব্যাটা বদের বদ! আগে দাদা কতাম। কিন্তু কোনো কাজে তার বাড়ি গেলে বুড়ো আমারে আসতি দিতো না। আকথা-কুকথা কতো। পেরতেক বারই খারাপ কাজ করতি কতো! কিন্তু ম্যাডাম সত্যি কতিছি, ওসব আমার ঘেন্না লাগে!’ কথা শেষ করে মুখ বিকৃত করে ফেলে রহিমা।

‘কেরামত হাজি এখনো আছে?’

‘নাহ, কবে মইরে ভূত হইয়ে গেছে!’

‘তাহলে ভয় কি?’

‘যদি আবার কোথাও বে দিতি চায়? বে মানিই তো খারাপ কাজ! তাই না ম্যাডাম?’

‘বিয়ে মানে খারাপ কাজ, তোকে কে বললো?’

‘কেরামত হাজি তো তাই কতো! বিয়ের পরে এই করবে, সেই করবে। আরো কত কি! তাইতে আমার বের উপর ঘেন্না ধইরে গেল!’

‘তাহলে তোরা দুজনে যে...’

‘রহিমা হাসে। বলে, ‘মেয়েতে মেয়েতে কি খারাপ কাজ হয়?’

রেবেকা খাতুন মনে মনে কপাল চাপড়ান।

তারপর তিনি মনেমনে ষড়যন্ত্রের মত খুব দ্রুতপরিকল্পনা করে ফেলেন। সেই সাথে কথায় কথায় রহিমার বাবা-ভাই, ঘর-বাড়ি আদিঅন্ত জেনে নেন। তিনি ভাবেন যে, রহিমার মন থেকে পুরুষ বিদ্বেষ চলে গেলে জরিনা এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। আর রহিমা-জরিনা না থাকলে কোণঠাসা হয়ে পড়বে রাহেলা আক্তারও।

তিনি নাস্তা খেতে খেতে মনে মনে অনুসন্ধান চালান যে, রাস্তার বাঁক যেখানে শুরু হয়েছে তার প্রায় সাথেই দুটো ছোটো ছোটো গোলপাতার ঘর। আর রহিমার কথা ঠিক থাকলে ওটাই আক্কাস মন্ডলের বাড়ি।

রেবেকা খাতুনের আজ কোথাও যাবার প্রোগ্রাম নেই বলে রাহেলা আক্তার পুরোনো গাড়ি রেখে নতুন গাড়িটা নিয়ে বেরিয়েছেন। রেবেকা খাতুন নাস্তা সেরে কিছুক্ষণ পর রাহেলা আক্তারের লক্কর-ঝক্কর মার্কা গাড়ি নিয়ে ঠিক আক্কাস মন্ডলের বাড়ির সামনের বাঁকটাতে এসে স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে ফের কয়েকবার স্টার্ট দিয়ে বন্ধ করে দিলেন। শব্দ শুনে বুড়ো মত একজন লোক এসে বললো,‘এনজু ম্যাডামের ভাঙ্গা গাড়ি নে বের অইছেন ক্যান? এডারে তো সারাদিনই ঠিক করা লাগে!’

রেবেকা খাতুন গাড়ি থেকে নেমে সামনের বনেটটা তুলে ইঞ্জিনের ত্র“টি পরীক্ষা করার নামে সময় পার করেন। এটা ওটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে বললেন, ‘এটাই তো সমস্যা!’

তারপরই হঠাৎ আক্কাস মন্ডলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না!’

‘আমি আক্কাস!’

পরে হাত দিয়ে সে তার বাড়ি দেখিয়ে বলে, ‘এডা আমারই বাড়ি!’

‘তাহলে তো ভালই হলো!’

তারপর রেবেকা খাতুন মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘আচ্ছা, আপনিই হয়তো ভাল বলতে পারবেন, এখানে এমন কাউকে পাওয়া যাবে, যে তিনবেলা খেতে পাবে আর আমাদের দুটো গাড়ি ধূয়ে-মুছে পরিষ্কার রাখবে? তা ছাড়া সময় সুযোগ মত ওকে আমরা গাড়ি মেরামত করা আর আস্তে-ধীরে ড্রাইভিংটাও শিখিয়ে দেবো!’

তারপর তিনি আবার বললেন, ‘কাজ শিখে নিলে তখন অবশ্য বেতন ঠিক করে নেবো! এমন কাউকে পাওয়া যাবে না?’

‘অনেক পাবেন! আমার নিজের ভাইয়ের ব্যাটাই তো কাজ পাচ্ছে না!’

‘কেন? বড়রা তো সুন্দরবনে নয় তো মাছের ট্রলারে কাজ করে!’

আক্কাস মন্ডল হেসে বললো, ‘বাঘের ভয়েতে সুন্দরবন যায় না। ট্রলারে ওঠে না ঝড়ের ভয়েতে। ছোডো বেলায় ঝড়ে পইড়ে পানিতে ভেসে গিয়েছিলো। সাত আট মাস হয় ফিরে এয়েছে!’

‘আপনার ভাইয়ের ব্যাটার বয়স কেমন হবে?’

‘এই ধরেন চব্বিশ-পঁচিশ!’

‘বিয়ে করেছে তো, না?’

আক্কাস মন্ডল আবার হাসে। ‘যে নিজেই খাতি পায় না, ওরে মেয়ে দিবি কেডা!’

রেবেকা খাতুন মনে মনে খুশি হয়ে উঠলেন। রহিমা ছেলেটাকে দেখলেও চিনতে পারবে না। কোন ছোট বেলা দেখেছে, সে স্মৃতিও হয়তো আজ ফিকে হয়ে গেছে। তা ছাড়া রহিমাকে দেখেও ছেলেটা চিনতে পারবে না।

‘ও কি বাড়িতে আছে?’

‘আছে!’ বলেই আক্কাস মন্ডল জোরে চেঁচিয়ে ডাকলেন, ‘বারেক! ওয় বারেক!’

এক যুবক ছুটে এসে বললো, ‘আমারে ডাকিছেন চাচা?’
‘তুই না কাজ খুঁজতিছিলি?’

‘হয়!’

মাথা চুলকায় বারেক।

‘এই এনজু ম্যাডাম কচ্ছিলো যে, তাগের গাড়ি দুডো ধোয়া মোছা করে পয়-পরিষ্কার করে রাহা লাগবেনে! এ জন্যি কেবল তিন বেলা খাতি পাবি! রাজি আছিস?’
‘আমি তো রাজি! তয়...’

বারেক ফের মাথা চুলকায়।

‘তয় কি? থামলি ক্যান?’

‘কেবল খাওয়া হলিই চলবে? আমার লুঙ্গি-গামছা, জামা-স্যান্ডেল লাগবে না! আমি কি এমবাই থাকবো?’

রেবেকা খাতুন বললেন, ‘সময় মত সবই হবে! কাজ শিখতে পারলে ভালো বেতন ও হবে! তবে একটা কথা, আমাদের ঘরে দুটো কাজের মেয়ে আছে। তিন বেলা খাবারের সময় ছাড়া তাদের সঙ্গে দেখা করতে পারবে না! আড্ডা দেওয়া, গল্প-গুজব এসব চলবে না! রাজি?’

‘আমি রাজি!’

‘মেয়েদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না! তাদের বিরক্ত করবে না! তারা যদি মিথ্যে করেও বলে যে, তুমি লোক ভালো না, তাহলে তোমাকে বাদ দিয়ে আমরা অন্য লোক খুঁজবো!’

বারেক হাসে। ‘এমন আরামের কাজ পালি খারাপ হতি যাবে কেডা?’

‘তাহলে কাল সকাল বেলা এসো! তোমার কি কি করতে হবে বুঝিয়ে দেবো!’

বারেক খুশি হয়ে বলে, ‘আচ্ছা!’

আরো কিছুক্ষণ ইঞ্জিনের এটা সেটা দেখে নিয়ে, রেবেকা খাতুন গাড়িতে উঠে স্টার্ট দেন। গাড়ি ছাড়ার আগে বারেককে বললেন, ‘সময় মত চলে এসো!’

বার

গাড়ির শব্দ পেয়ে রহিমা হন্তন্ত হয়ে ছুটে আসে।

‘ম্যাডাম ফিরে আলেন যে?’

‘দূরে কোথাও যাবো, তাতো বলে যাইনি!’

তারপর ইচ্ছে করেই বললেন, ‘একজন কাজের লোক খুঁজতে গিয়েছিলাম!’

‘কাজের লোক?’

ওরা দু'জনেই কেমন অবাক হয়ে যায়।

‘হ্যাঁ! তিন বেলা আমাদের এখানে খাবে আর গাড়ি দুটো ধূয়ে মুছে পরিষ্কার রাখবে!’

জরিনা বললো, ‘ও কাজ কি আমরা পারিনে?’

রেবেকা খাতুন ভাবলেন যে, মোক্ষম একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। এটা হাত ছাড়া করা যাবে না। বললেন, ‘তোরা যেভাবে গলাগলি হয়ে শুয়ে থাকিস, গাড়ি মোছার সময় কোথায় তোদের?’

‘কোনো কাজ নেই বলেই না! তা ছাড়া বাগানের কাজ আমরা করিনে?’

‘বাগানের কাজ আর গাড়ির কাজ এক হলো নাকি? আর ছেলেদের দিয়ে যে কাজটা করাতে পারবো তোদের দিয়ে সেটা করালে গ্রামের লোকেরা দেখলে তো ভালো বলবে না! তা ছাড়া তোরা ও কাজ করলে ঘরের কাজে সমস্যা হবে না!’

রহিমা আর জরিনা দু'জনেই বলে উঠলো, ‘দিয়েই দ্যাখতেন!

রেবেকা খাতুন হাসলেন, তারপর ওদের দু'জনের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘আসলে আমাদের বিভিন্ন কাজের জন্য একজন ছেলে মানুষ লাগবে! যে সময়ে অসময়ে হাটে বাজারে ছুটে যেতে পারবে। একটা বাড়িতে কেবল চারটে মেয়ে মানুষ, দুটো গাড়ি। পাহারার জন্যও তো আলাদা একটা মানুষ লাগে! নাকি? রাত দুটোর সময় যে তোর পেট ব্যথা শুরু হলো, আমরা কি সঙ্গে সঙ্গে তোকে ওষুধ এনে দিতে পেরেছিলাম? একটা ছেলে থাকলে সে তখনি ওষুধের জন্য ছুটে যেতে পারতো! আমরা মেয়ে বলেই না অত রাতে বের হতে সাহস পাইনি!’

জরিনা মাথা নেড়ে বললো, ‘তা ঠিক!’

রহিমা বলে, ‘ওরে বাড়ির ভেতর থাকতি দেবেন না কলাম! ছেলেরা অনেক বদমাইশ হয়!’

‘বারেকের তো এ গ্রামেই বাড়ি! ইচ্ছে করলে কাজ সেরে ও নিজের ঘরে গিয়েও ঘুমাতে পারবে। নয় তো গ্যারেজেও থাকতে পারবে!’

‘তালি তো আর ভয় নেই!’ বলে, কেমন বোকার মত হেসে উঠলো জরিনা।

রেবেকা খাতুন বললেন, ‘এখন আমার কথাগুলো খুব ভালো করে শুনে রাখ। বারেককে তার বাবা মা ভাইবোন কারো কথা কখনো জিজ্ঞেস করবি না! খাওয়ার সময় ডেকে খাবার দিয়ে দিবি, নয় তো দিয়ে আসবি। বসে বসে ওর সাথে আড্ডা দিলেই কিন্তু সাহস পেয়ে যাবে!’

রহিমা ঠোঁট উল্টে বললো, ‘আমাগের কত না ঠেকা পড়িছে বাড়ির কামলার সঙ্গে ভাব জমাতি!’

রেবেকা খাতুন নিজের মিশন নিয়ে মনে মনে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। ভাবেন, ওষুধ এখনো দেওয়া হয়নি, কেবল গন্ধেই রোগির চেতনা ফিরতে আরম্ভ করেছে!

সন্ধ্যার দিকে রাহেলা আক্তার ফিরে আসতেই রেবেকা খাতুন বারেকের ব্যাপারটা জানালেন। তিনি খুশি হয়ে বললেন, ‘তাহলে তো ভালোই হয়!’

তারপর কেমন ক্লান্ত স্বরে বললেন, ‘গাড়ির স্টিয়ারিং ধরতে আর ভাল্লাগে না! অনেক দিন ধরেই এমন একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছিলাম। বেতন দিয়ে কাউকে রাখলে তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে খরচ আর সময় দু'টোরই সাশ্রয় হতো!’

‘তাহলে বলো, আমার প্ল্যানটা কাজে লেগেছে!’

রাহেলা আক্তার খুশি হয়ে বললেন, ‘তোমার ব্রেনটা আসলেই খুব ভালো! সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসাতে দিনদিন শার্প হচ্ছে!’

রেবেকা খাতুন মনে মনে খুশি হয়ে ভাবলেন যে, মাঠটা জমে উঠবে আরো কিছুদিন পর!

তের

রেবেকা খাতুন আজকাল যত ধরনের পরিশ্রমের কাজই করেন না কেন, যত কঠিন জটিল কাজেই ব্যস্ত থাকেন না কেন, সে অনুপাতে তিনি কাজের ভেতর ডুবে যেতে পারেন না। বেশি বেশি কাজ করলে শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে রাতে ভালোমত ঘুমাতে পারবেন ভাবলেও কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই মাঝরাতে তাঁর ঘুমটা হঠাৎ করে ভেঙে যায়। পরে চেষ্টা করেও আর ঘুমাতে পারেন না। ঘুম হয় না। এখন নতুন করে আরেকটা কষ্ট যোগ হয়েছে। আর তা হলো, মাঝে মাঝে হঠাৎ করেই যেন কানে ভেসে আসে আরবানের ভয়ার্ত চিৎকার!

ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় সুসি একবার সাইকেল থেকে পড়ে হাত ভেঙে ফেলেছিলো। অনেক দিন তাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে হতো। সে সময়ের কথা ভেবে কষ্ট পান রেবেকা খাতুন। সে ঘটনার পর থেকে মেয়েটার জন্যে মনে মনে একটা বাড়তি টান অনুভব করেন সব সময়। কিন্তু কী পেলেন ছেলে মেয়েদের কাছ থেকে! ওরা বড় হয়ে যাবার পর তাদের মাকে এভাবেই ভুলে যেতে পারলো? ছোটবেলা তিনি যেভাবে তাদের বুকের সাথে জড়িয়ে নিতে পারতেন এখন সেটা তো আর সম্ভব নয়। আর সম্ভব নয় বলেই তো তাদের সঙ্গ, ছোঁয়া, সেই ছোট্ট সময়টির মত একই অনুভূতির কথা মনে করিয়ে দেয়। তাহলে ছেলে-মেয়েরা বড় না হয়ে সারাজীবন ছোট থাকলেই বুঝি ভালো হতো? তাহলে কখনোই আর মায়ের বুক থেকে দূরে সরে যেতে পারতো না! তাই বলে কি তিনি চান না যে তাঁর সন্তানরা মানুষ হোক? ভবিষ্যৎ জীবনের সিঁড়ির ধাপগুলো নিজেরাই একা একা পার হয়ে যাক? এত স্বার্থপরের মত চিন্তা করাটাও বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। তিনি তাঁর বেপথু সন্তানদের ঘরমুখো করবার চেষ্টা না করে বরং তাদের কাছ থেকে সরে এসেই অন্যায় করেছেন। এখন ওরা আরো বেশি করে ধ্বংসের পথে এগিয়ে গেলেও তিনি ওদের জন্য কিছুই করতে পারবেন না!

এই যে, তিনি দুঃস্থ নারী-শিশুদের কল্যাণে এত পরিশ্রম করছেন, পরের সন্তানদের মানুষ করবার জন্য এমন একটি অন্ধকারে নিমজ্জিত পল্লীগ্রামে এসে পড়ে আছেন, তার সুফল কি? তিনি কি আদৌ কিছু করতে পারছেন ওদের জন্যে? কেউ যদি প্রশ্ন করে যে, ‘আমাগের সন্তানরা কতটুকু মানুষ হয়েছে?’ তিনি কি জবাব দিতে পারবেন? তিনি জানেন না তাঁর সন্তানরা আদৌ ঘরমুখো হয়েছে কিনা। তাঁর অভিমান, গৃহত্যাগ, স্বামী সন্তানকে কতটুকু শিক্ষা দিতে পেরেছে? তিনি যদি ছেলে-মেয়ে দুটোকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারতেন তাহলে সেটা বোধ হয় তাঁর জীবনের সবচেয়ে ভালো কাজটা হতো।

বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। টিনের চালে ঝমঝম শব্দে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পড়ছে। তিনি জানালা খুলে বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। মাঝে মধ্যে বিদ্যূচ্চমকের ভেতর দিয়ে ভারি বর্ষণ দেখতে পাচ্ছেন। কিংবা সবই ধোঁয়াটে দেখছেন। বৃষ্টির ছাঁট এসে তাঁর চোখ-মুখ গলা থেকে বুকের খোলা অংশটুকু ভিজিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তিনি সেখান থেকে সরে আসেন না বা জানালার পাল্লা দুটো বন্ধ করে দেন না। বৃষ্টির পানিতে যদি তাঁর তাপিত বুকে কিছুটা হলেও প্রশান্তি ফিরে আসে তো মন্দ কি! বাইরে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে পারলে হয়তো আরো ভালো হতো। ভিজে ভিজে বুকটা শীতল হতো। এ পোড়া বুকে এত অভিমান নিয়ে তিনি কেন জন্মালেন? আরো কিছুটা কম অভিমান, আরো কিছুটা কম নৈতিকতা বোধ নিয়ে জন্মালে কী এমন ক্ষতি বৃদ্ধি হতো? কখনো কখনো জীবনের পিচ্ছিল আর অন্ধকার বাঁকে এসে প্রয়োজনে আপস কিংবা সন্ধি করে নিতে পারতেন। কিন্তু এখন যে তিনি একা একা নিজকে পোড়ানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারবেন না!
তাঁর স্বামী এখলাস উদ্দিন আদৌ হজে গিয়েছেন কিনা! নাকি এখনও সেই অন্ধকারেই আরো বর্ণিল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন? তিনি যে একা একা সিদ্ধান্ত নিয়ে এখানে চলে এলেন, এখন কোন মুখেই বা ফিরে যাবেন? সে মুখ তো তাঁর নেই! ফিরে গেলে ওরা যদি বলে, তাদের বিপদের দিনে তিনি স্বার্থপরের মত নিজের মান বাঁচাতে আর জেদ বজায় রাখতে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু একবারও ভেবে দেখলেন না, যে নারীর স্বামী-সন্তান বেপথু আর গহীন অন্ধকারের বাসিন্দা, সে নারী একা একা কী করে নিজের সম্মান রক্ষা করতে পারেন? না সে সম্মান রক্ষা হয়? মানুষ চোখে আঙুল দিয়ে বলবে না যে, অমুকের স্বামী স্মাগলার! ছেলে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকে। মেয়ে যাও একটা আছে, তারও দিনরাত বোধ নেই!

এ কথা সবাই বলবে! যে বলবার সাহস রাখে না সেও! অর্থাৎ হামিদ মিয়ার মত লোকেরাও বলে যাবে শতমুখে।

খুবই ব্যথাক্লান্ত মন নিয়ে রেবেকা খাতুন ফিরে গেলেন বিছানায়। কারণ তাঁকে আবার সকাল সকাল ছুটতে হবে খুলনা শহরে। এই প্রথম বিভিন্ন এনজিওর পরিচালক, ম্যানেজার সবাই একত্রিত হচ্ছেন মিটিঙের জন্য। তাঁর হোগলা প্রজেক্টের সাফল্যের পেছনে কী এমন কৌশল আছে তার বিস্তারিত জানতে চান সবাই।

চৌদ্দ

রেবেকা খাতুন যতটা না মন মরা হয়ে বসেছিলেন, পাশে দ্বিগুণ ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে বসেছিলেন রাহেলা আক্তার। তাঁর মনটা আজ অন্যান্য দিনগুলোর চাইতে অনেক খুশি আর প্রাণবন্ত। কিন্তু ব্যাপারটার কারণ অনুধাবন করতে পারেন না রেবেকা খাতুন।
সবাই একে একে এলেও কোনো কারণে মিটিং শুরু হতে দেরি হচ্ছিলো। অযথা কাল ক্ষেপন ভাল লাগছিলো না রেবেকা খাতুনের। তিনি বিরক্ত হলেও রাহেলা আক্তার গুনগুন করে খুব পরিচিত একটা গানের সুর ভাঁজছিলেন। অন্যদিকে কিছুক্ষণ পর পরই কান্না পাচ্ছিলো রেবেকা খাতুনের। এই যে, তিনি এত স্বল্প সময়ে দূরূহ অথচ অর্থবহ একটা প্রজেক্ট দাঁড় করিয়ে ফেললেন, সেটার সাফল্যের আনন্দ কাউকে নিয়ে উপভোগ করতে পারছেন না। তাঁর প্রিয়জনরা কোথায় কি অবস্থায় আছে তার কিছুই তিনি জানেন না। এরই মাঝে হঠাৎ ঘোষক মাইকে ঘোষনা করলো, ‘উপস্থিত সূধি, অনুষ্ঠানের শুরুতেই এ অঞ্চলের হোগলা প্রজেক্টের পরিচালক রেবেকা খাতুন আমাদের বলবেন যে, এত সামান্য পুঁজির একটা প্রজেক্টকে কী ভাবে তিনি প্রথম সারিতে নিয়ে এলেন? এখন আসছেন রেবেকা খাতুন!’

ঘোষকের প্রথম দিকের কথাগুলো শুনতে পাননি রেবেকা খাতুন। শেষের দিকে কেবল নিজের নামটা শুনতে পেলেন তিনি। আর তখনই রাহেলা আক্তার পিঠে হাত দিয়ে বললেন, ‘যাও, তোমার পাঁচালী শুনিয়ে এসো!’

রেবেকা খাতুনের যদিও মন খারাপ ছিলো, দুরুদুরু বুকে মঞ্চে গিয়ে উঠলেন। আস্তে ধীরে তাঁর এত দিনকার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে এক সময় ভুলে গেলেন পারিপার্শ্বিকতার কথা। প্রজেক্টের ইতিবৃত্ত বলতে গিয়ে জরিনা রহিমার কথাও বাদ দিলেন না। বাদ দিলেন না কেরামত হাজির কথাও। তিনি যখন তাঁর বক্তব্য শেষ করে নেমে আসবেন তখনই এনজিও ফোরামের চেয়ারম্যান হোগলা প্রজেক্টের স্বর্ণপদক প্রাপ্তির সংবাদ জানিয়ে টেবিলে রাখা বিশাল ফুলের তোড়াটা রেবেকা খাতুনের হাতে তুলে দিলেন। আর তখনই চারপাশ থেকে ক্যামেরা ক্লিক করবার সাথে সাথে সেগুলোর ফ্লাশ লাইটগুলোও জ্বলে উঠলো। সেই সঙ্গে মুহুর্মুহু করতালি।

আচমকা ফ্লাশ লাইটের আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় রেবেকা খাতুনের। চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলতেই আবার ক্লিক। আবার ফ্লাশ। তারপর কোনো রকমে মঞ্চ থেকে নেমে রাহেলা আক্তারের পাশে এসে বসে পড়লেন। পরবর্তী বক্তারা সবাই মোটামুটি হোগলা প্রজেক্টের সাফল্য নিয়েই কথা বললেন। কিন্তু রেবেকা খাতুনের কানে সে সবের কিছুই প্রবেশ করছে না। তার কানে বেজে চলেছে ছোট্ট আরবানের চিৎকার। যে মশারীর ঘেরাটোপে ঝুলে আছে, কেউ আসছে না উদ্ধার করতে!

মিটিং শেষ হয়ে গেলে সবার সামনে অনেক কষ্টে হাসিমুখ বজায় রাখলেন রেবেকা খাতুন।

রাহেলা আক্তার জানালেন, ‘সামনের মাসে কোনো একদিন শেরাটনে প্রোগ্রাম করে তোমার মেডেল দিয়ে দেবে। সেই সাথে ব্যক্তিগত ভাবে পাবে একলাখ টাকার একটা চেক!

রেবেকা খাতুন রাহেলা আক্তারের প্রগলভতায় খুশি হতে পারছিলেন না। বললেন, ‘তখন আমি হাতি হবো না ঘোড়া হয়ে যাবো?’

রাহেলা আক্তার সে কথা শুনে কি মনে করলেন কে জানে। একবার হেসে শুধু বললেন, ‘পাগলী!’

পঁনের

শহর থেকে ফিরতে তাঁদের প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেলো।

বাসার কিছুটা দূরে থাকতেই হঠাৎ রাহেলা আক্তার গাড়ি থামালে পেছনে বাধ্য হয়েই রেবেকা খাতুনকে গাড়ি থামাতে হয়।

রাহেলা আক্তার পেছন ঘুরে মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘তোমার নতুন প্রজেক্টও গোল্ড মেডেল পেয়ে যাবে!’

রেবেকা খাতুন রাহেলা আক্তারের হেয়ালী ধরতে না পেরে বললেন, ‘কী বলছো?’

‘গ্যারেজের দিকে তাকাও!’

রেবেকা খাতুন দেখলেন, বারেক রহিমার একটি হাত ধরে মাটিতে বসা থেকে টেনে তুলতে চাচ্ছে। আর পাশে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলছে জরিনা। এরই মধ্যে অসাবধানে হঠাৎ রেবেকা খাতুনের এক হাত স্টিয়ারিঙের উপর হর্ন বাটনের উপর পড়তেই আচমকা হর্ন বেজে উঠলো। ওরা দুজনেই দেখতে পেলেন যে, রহিমা আর জরিনা ঘরের ভেতর ছুটে পালালো।

বারেকের মনে কোনো ভাবান্তর ছিল না। গ্যারেজের ভেতর দুটো গাড়ি পাশাপাশি থামতেই সে চাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘হায় আল্লা! দুডো গাড়িই দেহি কেদা মাটিতে মাখামাখি! আইজ আমারে দুগুণা ভাত দিতি হবেনে!’

রাহেলা আক্তার ধমক দিয়ে বললেন, ‘তোকে কম ভাত দিলে বলতে পারিস না?’

‘পেট পুরে খাওয়ার যে কী শান্তি, যারা কোনোদিন উপোস দেয়নি, তারা বুঝবে না!’

রেবেকা খাতুন গাড়ি থেকে নেমে বললেন, ‘তুই গাড়ি ধোয়ার চিন্তা করছিস নাকি?’

‘হয় ম্যাডাম!’

‘এখন তো সন্ধে হয়ে গেছে! কাল সকালে করিস!’

‘অ্যাহন কষ্টডা কম হবেনে! শুকোয় গেলি তো কাইল দুগুণা খাটতি হবে!’

রাহেলা আক্তার বললেন, ‘আচ্ছা, তোর মন চাইলে কর!’

তারপর তিনি গাড়ি থেকে নামবার জন্য কাত হলেন। কিন্তু হঠাৎ করে পায়ে শাড়ির নিচের ঝুলন্ত অংশটায় প্যাঁচ লেগে ধাপাস করে পড়লেন নিচে। এবং প্রায় সাথে সাথেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

ব্যাপারটা এতই দ্রুত ঘটলো যে, রেবেকা খাতুন কিংবা বারেকের তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছু করবার ছিলো না।

রাহেলা আক্তার সলজ্জ ভাবে একবার হাসলেন শুধু।
রেবেকা খাতুন বললেন, ‘লাগেনি তো?’

‘না মনে হয়!’

বারেক বললো, ‘বড় মানুষের ব্যথা পরে লাগে!’

কিন্তু রাহেলা আক্তার স্বাভাবিক ভাবেই গ্যারেজ থেকে ঘরের কাছে এলেন। কিন্তু ঘরে উঠবার সময় কোমরের কাছে মেরুদন্ডের হাঁড়ে কেমন যেন একটা চিরিক দেওয়ার মত হালকা ব্যথা অনুভব করলেন। তিনি অবাক হয়ে ভাবলেন যে, যেভাবে তিনি পড়েছেন, তাতে হাঁটুতে অথবা নিতম্বে আঘাত পাওয়ার কথা। কোমরের এখানে ব্যথা হবে কেন?

রেবেকা খাতুন রাহেলা আক্তারের হাঁটার পরিবর্তনটা খেয়াল করলেন না। আনমনে নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন। বাইরে থেকে এসে প্রথমেই এভাবে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকা তাঁর নতুন করে অভ্যাস হয়েছে। কিছুক্ষণ এভাবে শুয়ে থাকার পর উঠে হাত-মুখ ধোয়া নয় তো গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নেওয়া।

রাতের খাওয়ার জন্য রহিমা ডাকতে এলে, রেবেকা খাতুন বললেন, ‘রাহেলা আপা এসেছে?’

‘উনি কলেন খাবেন না!’

‘কেন খাবেন না?’

‘তাতো জিজ্ঞেস করিনি!’

‘কেন করিসনি? কেউ রাতে না খেয়ে থাকতে চাইলে তাকে জিজ্ঞেস করবি না কেন খাবে না?’

‘এহন থেকে বলবোনে!’

‘তুই খাবার দে! আমি দেখছি!’

তারপর তিনি রাহেলা আক্তারের রুমে গিয়ে দেখলেন রাহেলা আক্তার কপালে হাতের উল্টোপিট রেখে শুয়ে আছেন। তাঁর পাশে বসে বললেন, ‘শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?’

কোমরে হাত দিয়ে কঁকিয়ে উঠলেন রাহেলা আক্তার। ‘খুবই কষ্ট!’ বলার সময় মুখ বিকৃত হয়ে যায় তাঁর। ‘একটু নড়াচড়া করলেই কেমন চিরিক দিয়ে উঠছে!’

রেবেকা খাতুন চিন্তিত ভাবে বললেন, ‘এত তাড়াতাড়ি এমন ব্যথা হয়ে গেলো?’

‘বুঝতে পারছি না!’

‘বাম মালিশ করে দেবো? ভালো লাগবে! তারপর গরম সেঁক দিলে কিছুটা আরাম পাবে!’

‘আমি যে ঘুরবো, ঘুরে কাত হবো, তাও তো পারছি না!’

মোটাসোটা আর ভারী শরীরের রাহেলা আক্তার যেভাবে পড়েছিলেন, তাতে কোমরের হাঁড়ে ব্যথা লাগবার সম্ভাবনাই অনুমান করেন রেবেকা খাতুন। কিন্তু সেটা রাহেলা আক্তারকে বললেন না। কাল অর্থোপেডিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেই হবে। তার আগে কিছু না খেলে কেমন দেখায়! তাই তিনি বললেন, ‘বয়স্ক মানুষ ব্যথা পেয়েছো, একটু তো খারাপ লাগবেই! তার উপর যদি এভাবে শুয়ে থাকো তাহলে জায়গাটা ফুলে যেতে পারে বা বাত জমতে পারে। কিছু নড়াচড়া না করলে ব্যথা কমবে না। হয়তো দেখা যাবে পরে বিছানা থেকে উঠতেই পারছো না!’

রাহেলা আক্তার কোনো রকমে ছেঁচড়ে বিছানার বাইরে পা দুটো নামালেন। তারপর হাতে ভর দিয়ে উঠবার সময় পিঠে হাত দিয়ে রেবেকা খাতুন তাঁকে উঠতে সাহায্য করেন।

কোমরে হাত দিয়ে রাহেলা আক্তার ডাইনিং টেবিলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘একটু বাম মালিশ করে সেঁক দিলে আরাম পেতাম মনে হয়!’

‘আগে কিছুটা খাও, তারপর আমি দেখছি!’

‘আমার খেতে ভালো লাগবে না!’

‘যেটুকু পারো! একবারে না খাওয়ার চাইতে এক গ্রাস খাওয়াও অনেক ভালো!’

বাচ্চা মেয়েদের মত মুখ ভার করে রাহেলা আক্তার খাওয়ার টেবিলে যোগ দিলেন।

ষোল

ঘরে যখন কেউ একজন অসুস্থ হয়, তার সাথে সাথে অন্যরাও কম বেশি যন্ত্রণা ভোগ না করে পারে না। এই যেমন রাহেলা আক্তারের চিল-চিৎকারে সারা রাত কেউ ঘুমাতে পারলো না। সবাই তাঁকে ঘিরে রাত পার করে দিলো। রেবেকা খাতুন রাহেলা আক্তারকে যতই বোঝান ততই তিনি না করেন। এই করে করে সকালগিয়ে বেলা গড়ালো দুটোর দিকে। কারো নাওয়া-খাওয়া হলো না।

‘তুমি কেন বুঝতে পারছো না? সময় যত গড়াবে তোমার ব্যথাও তত বাড়বে!

‘গাড়ির ঝাঁকুনি আমার সহ্য হবে না!

‘যদি বোনে আঘাত লেগে থাকে, ফ্র্যাকচার দেখা দেয়, এক্স-রে না করলে কিছুই বোঝা যাবে না! আর এ ধরনের ব্যথা সারতেও সময় লাগে!’

‘আমার কথাটা বুঝতে চেষ্টা কর, প্লিজ!’

ওদের বাদানুবাদের এক পর্যায়ে জরিনা এসে বললো, ‘ক’জন মানুষ এয়েছে! বাড়ির ভেতরে আসতি চাচ্ছে!’

রেবেকা খাতুন বললেন, ‘কারা? কোত্থেকে এসেছে জিজ্ঞেস করিসনি?’

‘না! একজন বুড়ো লোক আর সঙ্গে দুডো ছেলে-মেয়ে।’

খুবই বিরক্ত হয়ে রেবেকা খাতুন দরজা খুলে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। সামনে দাঁড়িয়ে আরবান আর সুসি।

তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘তোরা?’

আরবান আর সুসি দু’দিক থেকে রেবেকা খাতুনকে জড়িয়ে ধরে। পেছনে দাঁড়ানো মুখ ভর্তি দাঁড়ি-গোঁফের জঙ্গলে আত্মগোপনকারী লোকটা যে এখলাস উদ্দিন তা বুঝতে আর বাকি থাকে না রেবেকা খাতুনের। তবে তিনি ভেবে পান না যে, এমন জায়গার সন্ধান ওরা পেলো কিভাবে?

সুসি বললো, ‘কেমন আছো আম্মু? আমরা তোমাকে কত মিস করেছি! কত জায়গায় খুঁজেছি! এমন কি ঢাকার সবগুলো পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলাম!’

আরবান বলল, ‘আম্মু, এক্ষুনি চলো! এখন থেকে আমি তোমার সব কথা শুনবো!’

এখলাস উদ্দিন বললেন, ‘আমি আর কতক্ষণ বাইরে থাকবো? এক বছর তো হলো!’

খুশিতে রেবেকা খাতুনের চোখ ভিজে আসছিলো। এখন তাঁর মনে হচ্ছে ঘর ছেড়ে খুব একটা ভুল করেননি তিনি। আর এতদিনকার ত্যাগ, তিতিক্ষা, সবার অলক্ষ্যে আত্মপীড়ন সব যেন একই সঙ্গে ফুল হয়ে ফুটে উঠেছে। যে ফুলের ঘ্রাণে চারদিক এখন ম ম করছে। তিনি এক বছরের সাধনায় পরিশুদ্ধ মানুষটির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কেমন অভিমানী কন্ঠে বললেন, ‘তোমাকে বাইরে থাকতে বলেছে কে?’

‘ঘরে যেতেও তো কেউ বলছে না!’ অস্থির ভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে কাঁচাপাকা দাড়ি চুলকান এখলাস উদ্দিন।

রেবেকা খাতুন যেন নতুন করে জীবন্ত হয়ে উঠলেন এবং বিয়ের পর সেই প্রথমবারের মত মিষ্টি করে বললেন, ‘এসো!’

তারপর দু’পাশে দু’সন্তান নিয়ে তিনি রাহেলা আক্তারের রুমের দিকে যেতে যেতে বললেন, ‘তোরা এখানকার খবর পেলি কিভাবে?’

সুসি বললো, ‘আজ পত্রিকায় তোমার ছবি আর নিউজ এসেছে! আমরা প্রথমে খুলনা এসেছি। সেখান থেকেই তোমার অ্যাড্রেস পেয়ে গেলাম!’

রাহেলা আক্তারের রুমে ঢুকে রেবেকা খাতুন বললেন, ‘আপা দেখ কাদের নিয়ে এসেছি!’

রাহেলা আক্তার রেবেকা খাতুনের দু’পাশে দু’জন ছেলেমেয়ে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন।

‘আমার ছেলে-মেয়ে!’

বলার সময় রেবেকা খাতুনের মুখে যেন হাজারো বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ খেলা করে।

‘খবর পেলো কিভাবে?’

‘পত্রিকায় আমাদের মিটিঙের ছবি আর খবর দেখে!’

‘হাউ ইন্টারেস্টিং!’ বলেই কোমরের ব্যথা ভুলে রাহেলা আক্তার বিছানায় উঠে বসতে চাইলেও ফের ‘আউ আউ’ করে শুয়ে পড়লেন।

আরবান বললো, ‘পেশেন্টকে এভাবে ফেলে রেখেছো কেন আম্মু?’

‘এ কথাই সকাল থেকে বোঝাচ্ছি, কিন্তু রাজি তো হচ্ছে না!’

‘কে রাজি হচ্ছে না?’ বলতে বলতে এখলাস উদ্দিন রুমে ঢুকেই রাহেলা আক্তারকে দেখে চমকে উঠে বললেন, ‘এ কে, বুড়ি না?’

রাহেলা আক্তার যেন দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠলেন।

বললেন, ‘এ নাম কে বললো?’

রেবেকা খাতুন বললেন, ‘আমার হাজবেন্ড!’

রাহেলা আক্তার কেমন বিমূঢ়ের মত তাকিয়ে থাকেন।
রেবেকা খাতুন তাড়া দেন রাহেলা আক্তারকে, ‘আর দেরি করো না!’

‘গাড়িতে গেলে আমি মরে যাবো!’

‘তাহলে প্রাইভেট হেলিকপ্টারে নেবো!’

এখলাস উদ্দিনের কন্ঠস্বর কেমন ভারী শোনায়।

রেবেকা খাতুন চমকে উঠে ফিরে তাকান স্বামীর দিকে। ‘তুমি?’

‘হ্যাঁ!’ এখলাস উদ্দিনের কন্ঠ গমগম করে। ‘বুড়ি হচ্ছে সেই মেয়ে, যে আমার সংসারের দারিদ্রের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে না পেরে দুসপ্তাহের মাথায় পালিয়ে গিয়েছিলো!’

রেবেকা খাতুন রাহেলা আক্তারের পাশে বসে মাথায় হাত রাখেন। ‘তাহলে তুমি আমার আপনজনই ছিলে?’

রাহেলা আক্তার তার এতদিনকার সুখ-দুখের সঙ্গিনী রেবেকা খাতুনের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেন না। দু’হাতে মুখ ঢেকে রাখেন। কিন্তু তাঁর হাতের ফাঁক গলে চোখের কোল বেয়ে দু’পাশে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

রেবেকা খাতুন তা দেখে খুব নরম ভাবে বললেন, ‘কেঁদো না আপা! আমরা এখন চারজন আছি। তোমার একটুও কষ্ট হবে না!’

***


মন্তব্য

পুতুল এর ছবি

এই জীবনে পড়েছি, কানামাছি এখনো পড়া হয়নি। সময়ের টানাটানিতে মন্তব্য সম্ভব হল না। পরে মন্তব্য করব।
ভাল থাকবেন।

কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

করসেন কি? দেইখ্যা ফালাইলেন? আমি তো এইটা পোস্ট করি নাই। আমার বাক্সে লুকায় রাখসি! দেঁতো হাসি
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।