নাড়ীর বাঁধন

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি
লিখেছেন এস এম মাহবুব মুর্শেদ (তারিখ: শনি, ১৪/০৭/২০০৭ - ৬:৫৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto

দেশে যাবার আগে ভাবছিলাম মার কোলে শুয়ে থাকব, মায়ের হাতে ভাত খাব, জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদব, আরও কত কি। শেষে দেশে যাবার ঠিক আগমুর্হুতে সেমিষ্টার শেষের পরীক্ষা, রিসার্চের ধুন্দুমার চাপ এসব কাটিয়ে প্লেনে ওঠার আগ পর্যন্ত আমার দুদিনের ঘুম বকেয়া হয়ে গেল। জার্নির পুরোটা সময় ঘুমাতে ঘুমাতে গেলাম। দেশে গিয়ে মার সাথে কি করব ভুলেই গেলাম।

চৌত্রিশ দিন দেশে ছিলাম অথচ একদিনও মায়ের হাতে ভাত খাইনি। একদিনও জড়িয়ে ধরে মা বলে কাঁদিনি। কেবল হরতালের কল্যানে তিনদিন সারাদিন বাসায় ছিলাম মায়ের সাথে। আমি বসে বসে ল্যাপটপে কাজ করি, মা এসে পাশে বসে থাকে। বসে থাকে কিন্তু কিছু বলে না। আমি স্বভাব বসত ইগনোর করে যাই। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল হল আরে, মা বাবাকে তো সময়ই দেয়া হয়নি। শেষে মায়ের কোলে শুয়ে আমি, মা আর বাবা টিভি দেখলাম কিছুক্ষন। আমার সোনালী মুর্হুত্ব বালির মত হাতের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়...

এবারে শ্বাশুড়ী আম্মাকেও মিস করেছি অনেক। বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর হরতাল, অবরোধে তাকেও সময় দেইনি একদমই।

প্রথম বার আসবার মত কষ্ট লাগেনি এবার। আসবার আগেরদিন দুপুরে খেতে বসেছি। মা ভাত বেড়ে দিচ্ছে। হঠাৎ মনে হল মায়ের সাথে এটাই আমার শেষ দুপুর। বুক ভেঙ্গে কান্না চলে আসল।

আসবার দিন সকালে খুব কষ্ট শুরু হল যখন আমার ভাই তার ঘুমন্ত মেয়েটাকে এনে আমার কোলে দেয়। মা কাঁদছে। আমার স্ত্রী কাঁদছে। কাঁদছে ভাইয়ের স্ত্রী, ভাই, বোন, খালারা। দূরে দাঁড়িয়ে কান্না চাপছে আমার বাবা। গলার কাছে দলাটাকে চেপে জোড় করে ভিতরে ঠেলে দিয়ে বকা দিলাম, এতো কান্নার কি আছে?

এয়ার পোর্টে গিয়ে দেখলাম নতুন নিয়ম করেছে। মালপত্রের সাথে আর ঢুকতে দেয়া হয়না আত্মীয় স্বজনকে। আমার ছোটকাকা বিমানে কর্মরত বিধায় ঢুকতে পারলেন। মালপত্র চেক ইন করতে গিয়ে দেখি চেকইন ব্যাগেজ আন্ডার ওয়েট কিন্তু ক্যারিঅন ওভার ওয়েট। সব ঠিকঠাক করতে করতে দেরী হয়ে গেল। ফিরে গিয়ে আর শেষ দেখা হল না সবার সাথে। এয়ারপোর্টের ভেতর থেকে ফোনেই বিদায় নিলাম।

সব ঝামেলা সেরে যখন বোর্ডিং করেছি প্লেনে তখন হঠাৎ মনটা খারাপ হতে শুরু করল। আমার শৈশব, আমার বেড়ে ওঠা, আমার নাড়ীর বাঁধন সব কিছু ফেলে সীট বেলটের সাথে নিজেকে বেঁধে পাঠিয়ে দিচ্ছি দূরদেশে। প্লেন দৌড়াচ্ছে, গতি বাড়ছে। ছোট ছোট জলাশয় গুলো পেছনে ফেলে ছুটে যাচ্ছে প্লেন। আস্তে আস্তে ছোট হতে শুরু করল মানুষ, বাড়ীঘর, মানচিত্র। সবকিছু ঝাপসা হতে শুরু করল। আহ, চোখে কিছু পড়ল? নাকি বাইরে বড্ড বেশী কুয়াশা...?

জানুয়ারী ২৭, ২০০৭


মন্তব্য

শামীম এর ছবি

গত প্রায় চার বছরে ১২ বার দেশে যেতে হয়েছে, ঈর্ষা করার কোন কারণ নেই, নিজের বাবা-মায়ের কাছে টানা ২ দিন থাকতে পারিনি কখনো - শুধু আসা যাওয়ার পথে রাত্রিযাপনের সময়টুকু। মন খারাপ

দলা পাকানো একটা অনুভুতি যা সযত্নে লুকিয়ে রাখতে চাই, সেটা এসে গেল আপনার লেখা পড়ে; সব ঝাপসা, টিস্যূপেপার খরচ। ওঁয়া ওঁয়া

এজন্যই ইদানিং পড়ার পরিমান কমিয়ে দিয়েছি - প্রফেসরকে সন্তুষ্ট করতে হবে, মন অন্যদিকে সরানো যাবে না - তা না হলে ৪টা বছরের ত্যাগটুকু মাটি হবে। ইয়ে, মানে...
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

বিপ্রতীপ এর ছবি

মাহবুব ভাই,
চোখ ঝাপসা হয়ে এলো...

সৌরভ এর ছবি

সব গল্পই একরকম।

------ooo0------
বিবর্ণ আকাশ এবং আমি ...


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

রেজওয়ান এর ছবি

হ্যা নাড়ীর বাঁধন ছেঁড়া কষ্টকর।

--------------------------------------

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

আপনার নাম লিখুন এর ছবি

bhalo laglo suman.

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

কিডা ভাই আপনি?
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

নজমুল আলবাব এর ছবি

এইসব পড়ে কান্না আসে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।