মেটামরফসিস অ্যাট বাঙলা কলেজ

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি
লিখেছেন এস এম মাহবুব মুর্শেদ (তারিখ: সোম, ১১/০৬/২০০৭ - ৫:৪৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:
১। ভূমিকা সরকারী বাঙলা কলেজে আমার সবচেয়ে বেশী পরিবর্তন হয়েছে। স্কুলে আমি ছিলাম নার্ডি পড়ুয়া টাইপের বোকাসোকা একটা ছেলে। কলেজে উঠে সেই খোলশটা ছাড়ানোর সুযোগ পেলাম। মেটমরফসিস বোঝাতে আগের কিছু কথা বলা দরকার। ব্যাপারটা নিজের ঢোল নিজে পেটানোর মত শোনাবে। অসহনশীল মানুষকে ঠিক এ জায়গা থেকে বিদায় নিতে অনুরোধ জানাচ্ছি। তবু ঘটনার প্রয়োজনে বলি। আমার নার্ডি রূপটা আসলে দশম শ্রেণীতে প্রেমের পড়ার আগ পর্যন্ত বহাল ছিল। চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলে ঢুকি নবম শ্রেনীতে। তো আমার পরিচিত জনের কাছে আমি ছিলাম এক আইডল ধরনের। আশেপাশের পোলাপাইন আমার কাছে আসত পরামর্শ টর্শ চাইতে। স্বভাবতই এট্টু ভাবে থাকতাম। তখন প্রচুর প্রচুর বই পড়তাম। আমার পড়ার গতি ছিল ভয়াবহ। তাই গোগ্রাসে গিলতাম সব কিছু। আমার বন্ধু বান্ধব ছিল সেই ধরনের, নার্ডি টাইপের। দশম (কিংবা নবম) শ্রেনীতে প্রেমে পড়ার পর টের পেলাম আই এম নো গুড এস এ ড্যাশিং লাভার। সেই থেকে পড়া লেখা ছেড়ে ড্যাশিং হিরো হবার চেষ্টা। এইটাকে আমার পরিবর্তন না বলে একটা চেষ্টা বলা যেতে পারে। বলা বাহুল্য কৈশোরের সে প্রেম কখনই সফল হয়নাই। টেস্ট পরীক্ষার আগে আগে সর্তক হয়ে গেলাম। টেস্টে আমাদের সেকশনে প্রথম হলাম এবং অন্যান্য সেকশনের মধ্যেও ভাল স্থানেই ছিলাম। তার আগের ব্যাচেই আঠারো জন স্ট্যান্ড করেছিল বলে আমাদের উপর অগাধ আশা ছিল তাদের। কলেজিয়েট স্কুলে বরাবরই ছাত্রদের বেসিকের উপর জোর দেয়। আমার বাবা ছিলেন আরেক কাঠি উপর। তাই আমার বেসিক স্ট্রং করার প্রচুর চেষ্টা করা হলেও আমার কখনই ৫০০ প্রশ্ন ব্যাঙ্ক মুখস্ত থাকত না। নিজেকে জ্ঞানী ভেবে কখনও চেষ্টাও করি নাই। ফলাফল যা হবার তাই হল- প্রতিটা অবজেকটিভে আমার ৩০-৩৫ এর বেশী নম্বর ছিল না। প্রশ্ন ব্যাঙ্কের সেই শেষ স্বর্ণালী বছরে আমি নম্বর খরায় আক্রান্ত হয়ে মেট্রিক পাস করলাম - স্ট্যান্ড তো দুরের ব্যাপার। এছাড়া অবশ্য অন্যান্য ছোটখাট কারনও ছিল - কিন্তু সেগুলো উল্লেখ করে গল্পের মূল পয়েন্টটা নষ্ট করতে চাই না। যেটা ঘটল সেটার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। কলেজ ভর্তি গুলো হল সব নাম্বারের ভিত্তিতে। তাই আমার পছন্দ লিমিটেড হয়ে পড়ল। আমার বাবা কার সাথে যেন কথা বলে দেখলেন এক সরকারী কলেজে পড়লে ট্রান্সফার করা সম্ভব হয় আরেক সরকারী কলেজে। সে লোক কি কি সব আশ্বাসও দিল আব্বাকে। তাই আমি ভর্তি হলাম বাঙলা কলেজে। বলা বাহুল্য সেই লোক কখনও তার আশ্বাস রাখেননি। ২। দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন রেজাল্ট হবার কিছুদিন পরের ঘটনা। আমি তখন ঢাকায়। আব্বা, আম্মা আর ছোট ভাই তখনও চিটাগাংয়ে। মেট্রিক পরীক্ষার মার্কশীট এসেছে। স্কুল থেকে আব্বার সেটা তুলে নিয়ে আসবার কথা। সেদিন দুপুরে আব্বা ফোন করে জানালেন মার্কশীট আনতে গেলে তাকে স্কুলের যে লোক দায়িত্বে ছিলেন তিনি কথা শুনিয়েছেন। কি বলেছেন সেটা আর নাই টানি, কিন্তু আব্বা আমাকে দায়ী করে বললেন, ‘তোমার জন্য আজকে কথা শুনতে হল!’ বাঙলা কলেজে ভর্তি হবার পর সবার ভাব ভঙ্গী পাল্টে গেল আমার সাথে। যে যেমন পারে উপদেশ দিতো। আমার আম্মা এমনিতে খুব ঠান্ডা মানুষ। সেই আম্মাও একদিন আমাকে শুনিয়ে দিলেন যে আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। আজ যখন এত বছর পর সেগুলো নিয়ে ভাবছি তখন কতগুলো ব্যাপার আবিষ্কার করছি। তখন এই বাস্তবতার উপলব্ধি আমাকে ভাবতে বাধ্য করেছিল যে পৃথিবীতে আসলে সব কিছু অর্জন করে নিতে হয়। মেধা জিনিসটা চর্চার একটা জিনিস। আপনা আপনি খুব কমই সেটা আয়ত্বে আসে – তাকে আয়ত্বে আনতে হয়। আরেকটা উপকার হয়েছিল আমার। ভাল স্কুল আর ভাল কলেজে বেশীর ভাগ ছেলে পড়াশুনা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। স্কুলে একটাও ছেলে দেখিনি যে পড়াশোনার বাইরে কিছু করত। ওয়েল করত: যেমন স্কাউটিং বা বইপড়া এসব। কিন্তু একেবারে আউট-অফ-দ্যা-বক্স কিছু কেউ করত না। বাংলা কলেজে ঢুকে দেখলাম পড়ালেখায় সেখানে সবাই সাধারন মানের। কিন্তু তাদের অনেকেরই অনেক বিষয়ে পারদর্শীতা আছে। আমি এদের সাথে মিশে মিশে বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠলাম। প্রথম বন্ধু পাই প্রলয়কে। একটা বির্তক প্রতিযোগীতার বাছাই পর্বে দেখা প্রলয়ের সাথে। আমার বির্তক খুবই বাজে হয়েছিল। কিন্তু প্রলয়েরটা অসাধারন, অসাধারন ছিল। ছেলেটা গলা কাপিয়ে টুকরো কবিতা আবৃত্তি করে এমন একটা বির্তক দিল যে আমরা মুগ্ধ। তারপরের দিন দেখি ব্যাটা মাঠের ধারে বসে আছে। আমি গিয়ে কথা বললাম। সে থেকেই বন্ধুত্ব শুরু। পরে আমরা দুজন আবৃত্তি নিয়ে বহুদুর গিয়েছি। সেটা আরেকটু পরে আসবে। প্রথম বর্ষের শুরুর দিকে ইন্টারমিডিয়েটের জন্য রেজিষ্ট্রেশন করতে হয়। রেজিষ্ট্রেশন করছি, দেখি আমার পাশের ছেলেটা আমার জন্মতারিখ দেখে দেখে বসাচ্ছে। মেজাজ গেল খারাপ হয়ে। বললাম, কি আশ্চর্য আমার জন্ম তারিখ তুমি লিখছ কেন? সেও মহা বিরক্ত হয়ে আমাকে বলে, তোমারটা আমি লিখব কেন? পরক্ষনে দুজনের জন্মদিন যে একই দিনে সেটা বুঝতে হো হো করে হেসে উঠলাম। পরিচয় হল জয়ের সাথে। পরিচয়ের পরই টের পেলাম অতিরিক্ত কথা বলা এবং নিজেকে বিরাট বড় করে দেখা একটা চরিত্র হচ্ছে জয়। অনেকে তার দুটো স্বভাবের জন্য তেমন পছন্দ করে না। তবে যখন জানলাম এই ছেলে কিশোর পত্রিকায় লেখে তখন ভাবলাম নাহ এই ছেলের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে যদি লাইন ঘাট করে কিছু পাবলিশ করা যায়। তখন অবশ্য আমি আর প্রলয় দুজনেই কবিতা লেখতাম। আর আমাদের কবিতার একমাত্র পাঠক ছিল জয়। জয় খুব আশ্বাস দিত খুব ভালো হচ্ছে। পরে জয়ের পরামর্শে একটা লিডিং নিউজ পেপারে (এখন নাম মনে পড়ছে না, সম্ভবত আজকের কাগজ হবে) যাই লেখা জমা দিতে। এ ব্যাপারে পরে আরো আসবে। একদিন ঠিক করে লেখা জমা দিতে তিনজন মিলে চলে গেলাম মতিঝিল সেই পত্রিকা অফিসে। বাসে ঝুলে হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে আনন্দ করে গেলাম আমরা। তখন প্রলয় হাল্কা এমেচারিস সিগারেট ফুঁকত। আর আমি এক দুইটা খেয়েছি – কিন্তু এমেচারিস ও হয়ে উঠতে পারিনি। তো আমি পাকনামী করে সিগারেট কিনে ধরালাম। সঙ্গে সঙ্গে জয় আর প্রলয়ও। এখন সেসব কথা ভাবলেই খুব অনুপ্রানিত বোধ করি। সদ্য কৈশোর পেরোনো তারুন্যের অনুভুতিটা জেগে ওঠে। এভাবেই শুরু হয় আমার মেটামরফসিস। ৩। কবিতা ও সৌকারু শুনলাম পঞ্চাশ টাকার মত দিলে ক্লাশ না করার দোষ মউকুফ হয়ে যায়। তার উপর আড্ডা মারার নেশা, কবিতা নিয়ে দিকদারী, সিগারেট। এসবের পাল্লায় পড়ে আস্তে আস্তে আমরা ক্লাশ করা ছেড়ে দিলাম। গল্প উপন্যাস পড়তাম আগেই। অল্প বিস্তর কবিতাও পড়তাম। এর মধ্যে জানা গেল প্রলয় আবৃত্তি করে। প্রলয়ের দারুন ভরাট কণ্ঠে আবৃতি শুনতাম আমরা বিভিন্ন কবিতার। তার উপর আমরা দুজনেই কবিতা লিখি। তাই প্রচুর কবিতা পড়া হতে লাগল। আস্তে আস্তে আমরা আধুনিক, উত্তর আধুনিক ছাড়িয়ে নাগরিক কবিতার দিকে আগাতে থাকি। সঙ্গে তখন শান্তিনিকেতনীয় কবি কবি ভাবের সাইড ব্যাগ নিয়ে ঘুরতাম। প্রলয়ের কবিতা গুলো শক্ত হোত। তাই তার পাঠক পাওয়া যেত না। আমি আবার আগ্রহ করে সেগুলো পড়তাম। পড়ে বিজ্ঞের মতো মন্তব্য করতাম। তাই প্রলয়ের সদ্যপ্রসুত কবিতাগুলোর ধাইমা হলাম আমি। প্রসব করতে না করতে আমাকে পড়াত। এর মাঝে কিভাবে যেন মাথায় ভুত চাপল একটা সংগঠন করা যাক। দুষ্টু বুদ্ধিটা আমার মাথা থেকেই এসেছিল। জয় আর প্রলয়ও রাজি হয়ে গেল। আরেকটা ব্যাপার উল্লেখ করা হয়নি জয়ের বাবা ছিল বাঙলা কলেজের প্রফেসর। তাই আমাদের ধারনা ছিল যে সাংগঠিনক ব্যাপারে কলেজের সার্পোট পাওয়া যাবে। এভাবে পাগলামী করে শুরু হল আমাদের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সৌকারু’। ‘সুন্দর কাজ করতে চায় যারা’ এরকম একটা মানে দাঁড় করিয়ে অভিধানের বাইরে থেকে শব্দ নিয়ে শুরু হল আমাদের সংগঠন। সংগঠনের প্রেসিডেন্ট করা হল আমাকে, অবশ্যও আমারো আপত্তি ছিল না। :) সৌকারু নিয়ে আমাদের উন্মত্ততা কম ছিল না। শুরু হল সদস্য সংগ্রহ। যতদুর মনে পড়ে সস্তায় ফরম ছাড়ার কারনেই হোক আর সংগঠনের আর্কষনেই হোক প্রায় শ-খানেক ফরম বিক্রী হল। মোটামুটি কার্যক্রম শুরু হল আমাদের। প্রথমে অধ্যক্ষা হাজেরা নজরুল (নাম যতদূর মনে পড়ে এটাই ছিল) ম্যাডামের সাথে আলাপ করে ঠিক করা হল আমাদের সাথে বানিজ্য বিভাগের একজন ম্যাডাম ইন্টারভিউ নিতে সাহায্য করবে। যাদের ফরম বিক্রী করা হয়েছিল তাদে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকা হল। সিম্পল কে কি জানে এটা ইভালুয়েট করাই ছিল উদ্দেশ্য। সেখানে বেশ কিছু ভালো পারফর্মার পেলাম আমরা। তারপর শুরু হল বিপুল উৎসাহে কাজকর্ম। শেষতক আমরা সৌকারু থেকে দেয়াল পত্রিকা, বেশ কয়েকটি আবৃত্তি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলাম। একবছরের টাইম স্প্যানে এটাকে ভাল সাকসেসই বলতে হবে। সৌকারু থেকে পরে বেরিয়ে এসেছিল বেশ কিছু ভাল ভাল পারফর্মার, যারা আবৃত্তি, নাটক এসবে জড়িত হয়েছিল পরবর্তীতে।   ৪। পরিসমাপ্তি বাঙলা কলেজে আমাদের পরপর নাটকের একটা দল বেরিয়ে এসেছিল। তারা কেন যেন আমাদেরকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখত! তাই আমার ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও নাটকে যেতে পারিনি তখন। ওদের একটা প্রযোজনা এসেছিল শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তারপর কি হয়েছে সেসব আর জানা নেই। কলেজে শেষের দিকে এসে হাসানের সাথে পরিচয়। বাঙলা কলেজে সবচেয়ে একটিভ এবং সাকসেসফুল ব্যান্ড গ্রুপ ছিল ওর। ওর সাথে আমি মিশে গীটার শেখার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। এব্যপারে আগেই একটা লেখা লিখেছিলাম। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগে টের পেলাম আমার কিছুই পড়াশোনা হয়নি। তাই সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে তিনমাস দমবন্ধ পড়াশুনা করে জীবনটা বাঁচিয়ে ছিলাম বলে রক্ষা। এভাবে বাঙলা কলেজ আমার মধ্যে কিছু খারাপ গুন (সিগারেটের নেশা) এবং কিছু ভালো গুন (যে কারো সাথে মিশতে পারা, লেখালেখি, আবৃতি, লীডারশীপ, গীটার) অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয়। আমার মেটামরফসিস শেষে আমি হয়ে উঠি সম্পূর্ণ মানুষ। এখন সময়ের এই প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমি ভাবি আসলেই বাঙলা কলেজ ছাড়া আমি হয়ত ‘আমি’ হয়ে উঠতে পারতাম না। ধন্যবাদ বাঙলা কলেজ - ধন্য আমি তোমার ছোঁয়ায়।

মন্তব্য

সৌরভ এর ছবি
পড়লাম । মিলে যায় এরকম অনেক গল্প খুঁজে পেলাম । ------ooo0------ বিবর্ণ আকাশ এবং আমি ..

আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ সৌরভ।
নজমুল আলবাব এর ছবি
আপনার ব্যাচ কোনটা? আমার কয়েকটা কাজিন ছিল। সমসাময়িক হতে পারে আপনার। লেখাটা দারুন লাগল। সৌরভের সাথে গলা মিলিয়ে বলি, মিলে গেল অনেক কিছু। !!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!! ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি
আমার ১৯৯৭ ইন্টারমিডিয়েট, ১৯৯৫ ম্যাট্রিক। পড়ার জন্য ধন্যবাদ নজমুল ভাই।
নজমুল আলবাব এর ছবি
তাইলে মনে হয় একটা ছিল আপনার লগে। !!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!! ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি
জিগাইয়েন সৌকারুর কথা। ক্ষীণ একটা সম্ভাবনা আছে চেনার।
নজমুল আলবাব এর ছবি
হ, জিগামুনে। ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
সিরাত এর ছবি

অসাধারণ লেগেছে মাহবুব ভাই। পাঁচ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।