ইউটোপিয়া অথবা অক্সিজেন

মাসকাওয়াথ আহসান এর ছবি
লিখেছেন মাসকাওয়াথ আহসান (তারিখ: শনি, ২২/০৫/২০১০ - ১:৪৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দুর্নীতিতে বাংলাদেশ কয়েকবার শীর্ষ পর্যায়ের তকমা লাগিয়ে পনেরকোটি মানুষের আত্মপরিচয়কে একধরনের ধূসরতার মাঝে রেখেছে।অথচ বাংলাদেশের ঠিক কতজন মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত তা হিসাব করতে পরিসংখ্যান বিভাগের সাহায্য লাগেনা। নানারকম অনানুষ্ঠানিক দৈবচয়নে শতকরা দুজনের বেশী দুর্নীতিবাজ বেরিয়ে আসবে না নানা পেশা থেকে (অনুকল্প)।
সরকারের কিছু বিভাগ দুর্নীতিতে এগিয়ে আছে ঐতিহাসিক ভাবেই। ব্রিটিশেরা এই দুর্নীতির চারা লাগিয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তারা তাতে নিয়মিত পানি, সার,পাহারা দিয়েছে আর আমাদের দেশী সামরিক শাসকেরা দুর্নীতির বটগাছগুলোর নীচে মাজার বসিয়েছে।ব্রিটিশরাজ পুলিশের কন্সটেবল বা দারোগা পদে যেসব নেটিভদের চাকুরী দিয়েছিল তাদের বেতন ছিল নেটিভ স্কেলে। কিন্তু যেকোন বেচারা প্রজাকে সন্দেহজনক গতিবিধির জন্য গ্রেফতারের এখতিয়ার তাদের দুর্নীতির পথে ঠেলে দেয়।তার ডমিনো এফেক্ট তো আমাদের সবারি জানা।আবার হিন্দু এলাকায় মুসলমান আর মুসলমান এলাকায় হিন্দু নেটিভ প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের আয়োজন করে, ভারত বিভাজন ছিল যার গন্তব্য।স্কচের টেবিলে ভারতীয় ঠিকাদারদের তৈল মর্দন তাদের সাফল্যের শিখরে নিয়ে যায়। সারাভারত ভরে যায় রায়বাহাদুর আর খানবাহাদুরে।এই নব্য লোকাল এলিটেরা প্রত্যাশা করে গরীব মানুষেরা তাদের দেখে অদৃশ্য সাবানে হাত কচলাবে।সেই থেকে শুরু হল তৈলমর্দনের সংস্কৃতি।যে কারণে আজ দুর্নীতিবাজের সংখ্যা দুই শতাংশের বেশী বলে মনে হয়।বড় একটা গাড়ী নিয়ে কোন একটা মহল্লায় ঢুকলে লোকজন এগিয়ে আসবে, কেউ কেউ কেবল সরলতাপ্রসূত কেউ দুর্নীতির ভক্ত হিসেবে। ভক্তটি এই গাড়ীপীরের সাফল্যে তার মুরীদ হতে চায়।আমাদের আজকের সমাজে দুর্নীতির প্রতি নীরব আকর্ষণ বেড়েছে সম্ভবত সাদাকাল ছবিতে সৎ মানুষের (আনোয়ার হোসেন)চোখের পানি আর দুর্নীতিবাজ খলনায়কের দাপট দেখে।ছবির ভিলেনকে নায়ক যখন পেটায় আমজনতা তখন শিস দেয়, আর বাস্তবে আমজনতা নায়ককে না পেয়ে খলনায়কের মুরীদ হয়ে যায়।
দুর্নীতির জনদেবতাদের মাজারগুলোতে তাই ভক্তের জোয়ার।বাংলায় ইসলাম প্রচার পীর সংস্কৃতির ছায়ায় ঘটেছিল বলেই কীনা, সবপেশাতেই দুর্নীতিবাজরা একটা মাজার প্রথা চালু রেখেছে।আমরা ধানমণ্ডি, গুলশান,বারিধারা বা ডিওএইচএসএ দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি ও সামরিক আমলা-ব্যবসায়ী-রাজনীতিক চক্রের প্রাসাদ গুলোর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হই, প্রাডো দেখে ভাবি বাহ বেশ। সমাজ এভাবে পিঠ চাপড়ালে দুর্নীতির ডিজুস ক্যাম্পেইনটি কফি ওয়ার্ল্ডে হা হা করে হাসে, এখন সে গ্রেড কিনে নিতে পারে পাড়ার ইউনিভারসিটি থেকে।আমার অনুজপ্রতিম মধ্যবিত্ত সাংবাদিক ছেলেটিকে সাংবাদিকতার চারুপাঠ দিতে গিয়ে দেখি সে লস্কর বাড়ির ছেলেদের কাঠি লজেন্স কিংবা চৌধুরী বাড়ির মেয়েদের রাসফেস্টিভ্যাল দেখছে।ও তখন সংকল্প করছে দেখেনিস একদিন আমরাও।বিতর্কের আসরে নবাগত বিচারক বিয়ের আগেই গাড়ি কেনার সংকল্প করছে।নবীন গবেষক প্রভাষক এপার্টমেন্ট কিনতে মরিয়া। এই যেখানে সংকল্পের গন্তব্য সেখানে কোন পরিবর্তনের কথা আমরা ভাবছি!
দুই শতাংশ দুর্নীতিবাজ কখনো মডেল কখনো পীর কখনো দার্শনিক হয়ে ঘুরছে চারপাশে।ফলে দুর্নীতির চেয়ে দুর্নীতির দর্শন বেশী প্রভাবক হয়ে দেখা দিয়েছে।সমাজের সাফল্যের মানদণ্ড নির্ধারণ করছে আজকের নব্য এলিট দুর্নীতি দার্শনিকেরা।টিভি স্কিটে গাড়িওলা হিংসুটে বাচ্চা গাড়িহীন বাচ্চা টাকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ী থেকে ফেলে দিলে, দুখী বাচ্চার বাবা ব্যাংক লোন নিয়ে গাড়ি কিনছে।মিডিয়া যে জীবনের ছবি দেখায় সেটা একটা ইলিউশন তৈরীর চেষ্টা। খবরের কাগজে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের পাশে যে সামাজিক সন্ত্রাসের ছবি দেখা যায়,সেটা ঐ মিডিয়া ইলিউশনের সাথে বাস্তবের মিল দেখতে চাইবার সংঘর্ষ।আমাদের সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার যখন বলতেন এই দুর্নীতি বাজারের ব্যবসায়ী-রাজনীতিক-মিডিয়া দুষ্ট চক্রের কথা, অনেকেই ভাবতো এসব অচল উপদেশ।রিকশা করে আসা সরদার ফজলুল করিমের চেয়ে ব্যাংক খেলাপী স্পন্সর বা ডানকিনে মিডিয়া শোবিজ মুঘলদের কদর বাড়তে থাকল, সততা যখন বোকাদের আশ্রয় তখন আমরা কেউ আর বোকা হয়ে চালাকদের ধমক শুনতে চাইনি।শুরু হয়ে গেল চালাকির রেস। দুর্নীতি দর্শনের পাওয়ার পয়েন্ট প্রেসেন্টশন নিয়ে হাজির হল বানিজ্যদেবী, এসো সাইকেলে চড়ি এনজিওর দাদা দিদিরা এসো পাজেরো চড়ির ওয়ার্কশপ শুরু করলেন।মিডিয়া তার নানারকমের দুর্নীতিবাজ স্পন্সরদের সুশীল সমাজের পৈতে লাগিয়ে সফলতার শোকেসিং শুরু করল।আমরা বসবাস করতে শুরু করলাম মিডিয়া বাস্তবতায়।
সম্প্রতি অমিতাভ বচ্চন অভিনীত রণ—ছবিটি দেখে আবার ভাবতে শুরু করলাম দুর্নীতির দুষ্ট চক্র নিয়ে, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, মিডিয়া এই ত্রিভুজ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের নিয়তি।তবে রণ বা লড়াই ছবিটি একটা সম্ভাবনার কথাও বলেছে।মিডিয়ার অচলায়তনে বিষণ্ন একজন সাংবাদিক কিভাবে প্রকাশ করে দেয় ত্রিভুজ ষড়যন্ত্রের খবর, আর তাতে তছনছ হয়ে যায় ত্রিভুজ রসায়ন। এটা নিছক কোন বলিউডি কল্পনা নয়। বাস্তব হয়ত আরো এগিয়ে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর ব্লগিং এর এতো কেবল শুরু।অনুকল্পের দুই শতাংশের দুর্নীতির জগদ্দল পাথরের বিপরীতে আটানব্বুই শতাংশ মানুষের দুর্দশার আর প্রতিরোধের ব্যারিকেড হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই আন্তর্জালিক তথ্যমাধ্যম।
দুষ্টু ত্রিভুজ হয়ত এখনো ঠাহর করতে পারেনি ঠিক কতজন ব্লগারের সপ্তম ইন্দ্রিয়ের ক্যামেরা তাক করা আছে ত্রিভুজ ষড়যন্ত্রের দিকে,দুর্নীতির ময়ূরপ্রাসাদটি ক্রমশ আয়নামহল হয়ে যাচ্ছে,বোকা মানুষেরা চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলছে চালাকের আস্তানাগুলো।চারপাশের নিভে যাওয়া বাতিগুলো একে এ্কে জ্বলে উঠছে আবার সবকিছু নষ্টদের অধিকার থেকে ফিরে আসবে এরকম একটা প্রত্যাশা হয়ত কোন ইউটোপিয়া নয়, খুব সম্ভবত অক্সিজেন। চলবে’


মন্তব্য

সাইফ তাহসিন এর ছবি

খাইছে আমারে!
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

মাসকাওয়াথ আহসান এর ছবি

কোনো বাংলা ছবির নাম॥

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখনি,নইলে কোন দিন নয়।

শামীম এর ছবি

বস্ লেখাটা ভালো লাগলো। কিন্তু ঐ ২% বিষয়টার বিবেচনা শুধু উচ্চমাত্রার দূর্নীতিতে সীমাবদ্ধ থাকলো।

দোকানদার যখন চাপা দিয়ে খারাপ মাল গছায় (পঁচা মাছ; মাংসের বদলে হাড্ডি; পোকায় খাওয়া বেগুন; পঁচা আম), কিংবা অতিরিক্ত দামে বিক্রয় করে -- সেটাও দূর্নীতি। একজন সি.এন.জি. থ্রিহুইলার চালক যখন ৬০ টাকার ভাড়া ১৫০ টাকা চায় সেটাও এক প্রকার দূর্নীতি। আবার, জেনে বুঝেও যখন ডিজিটাল বাংলাদেশে বেশিরভাগ লোক পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার করে সেটাও আরেকটা দূর্নীতি। জমি দখলের জন্য যখন মসজিদ বানিয়ে দেয় - সেটাও দূর্নীতি। কোথাকার কোন মাদ্রাসার নামে চাঁদা চাইতে আসে সেটাও দূর্নীতি (কোথায়? -- এইতো পাশেই; পাশেই কোন জায়গায় -- এইতো ঢাকার পাশেই; ঢাকার পাশে কোনজায়গায় -- ... ... দূরত্ব ১০০ কি.মি হয়ে যায় ..)।

এই বিষয়গুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছে, তাই হয়তো আলাদা ভাবে চোখে পড়ে না। কিন্তু দেশের বাইরের অভিজ্ঞতা, এই বিষয়গুলোকে আরো প্রকটভাবে চোখে পড়তে সাহায্য করে। কাজেই ২% এর হিসাবটা ৫২% হলেও আমি অবাক হতাম না।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

গৌতম এর ছবি

কোনো একদিন রাগের বশে একজনকে বলে ফেলেছিলাম- আমাদের সংস্কৃতিটাই দুর্নীতির সংস্কৃতি। উদাহরণ? ওই তো উপরে শামীম ভাই দিলেন। সন্তান কাস্টমসে চাকরি পেলে, পুলিশে জয়েন করলে আনন্দমুখর আত্মীয়স্বজনের মুখগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। হয়তো মনে হবে, অভাবের তাড়নায় বাঁচার যাবতীয় প্রচেষ্টাই দুর্নীতি নয়; কিন্তু অভাব যেখানে প্রান্তিক, দুর্নীতিও কিন্তু সেখানে প্রবল! সে হিসেবে হিসাবটা ৫২%-এর বেশি হলেও অবাক হব না। তবে বুঝতে হবে, কোনটাকে আমরা দুর্নীতি বলব!

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

মাসকাওয়াথ আহসান এর ছবি

গৌতম তো উত্তর টা দিয়েই দিলেন। এই পঞ্চাশজন দুর্নীতি পীরের মুরিদ। দুই শতাংশের সাফল্যের চমকে পুলকিত। পুলিশ অবশ্য এদের নজরানা নেয় দুর্নীতি মাজারের খাদেম বা কলোনিয়াল শ্যালক হিসেবে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখনি,নইলে কোন দিন নয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।