সবুজ দ্বীপের মতো

মাসকাওয়াথ আহসান এর ছবি
লিখেছেন মাসকাওয়াথ আহসান (তারিখ: মঙ্গল, ০৩/০৭/২০০৭ - ৪:৩৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মুকুল কেশ একরত্তি ছেলে। তাকে নিয়ে তার বাবার এক বুক স্বপ্ন। দাদা কেশারাম উঠোনে টুলের ওপর বসে মৃতসঞ্জীবনী সুরা খায় আর মুকুল কেশের বাবাকে গালমন্দ করে- নাকিরার। কেশারাম কাশতে কাশতে চিৎকার জুড়ে দেয়। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে টিনের চালে দুটো ঢিল ছোড়ে। ময়লা ধুতির খোঁটাটা কোমরে গুঁজে তেড়ে যায় জানালার কাছে।

মুকুল কেশ সুর করে পড়ে। হাট টিমা টিম টিম, তাদের খাড়া দুটো শিং। কেশারাম ভাবে মুকুল তাকে নিয়ে রসিকতা করছে। তেড়ে মারতে যায়। মুকুলের মা দূর্গারানী তাকে হাত দিয়ে আগলায়। ছোটবেলা থেকেই সুইপার কলোনির ছেলেমেয়েরা বাপ-মার সঙ্গে কাজ শেখে। ধাঙড়ের বাচ্চা ধাঙড় হবে এটাই নিয়ম। দূর্গারানী এই নিয়মের অন্যথা করে। না খেয়ে পয়সা জমায়, বই পুস্তক কেনে। লাল টুকটুকে একটা জামা বানিয়ে দেয়। তারপর মুকুলকে সঙ্গে করে গণকটুলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাজির হয়। এর আগে সে ভাগলপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সেখানকার হেডমাস্টার সাফ সাফ বলে দিয়েছে ধাঙড়ের ছেলেকে ভর্তি নিবে না। গণকটুলি স্কুলের সিঁড়ির গোড়ায় দূর্গারানী মাথা ঠেকিয়ে ঠায় বসে থাকে। রোদে পুড়তে থাকে ছোট্ট এক রত্তি মুকুল কেশ। হেডমাস্টারের মায়া হয়, "ঠিক আছে ভর্তি করে নিলাম। তবে আসন ব্যবস্থা নিজস্ব। ছোট জাতের ছেলের পাশে কেউ বসবে না"

বাসা থেকে আম কাঠের একটা ছোট্ট টুল এনে বসে মুকুল কেশ ক্লাস করে। ক্লাস শেষে সেটা হাতে করে নিয়ে যায়। মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করে। সব প্রশ্নের উত্তর সে পারে। কিন্তু বলতে সঙ্কোচ হয় সে ছোট জাতের ছেলে। স্কুলের গ্লাসে পানি খেতে পারে না। স্কুলের ফুটবলে লাথি দিতে পারে না। সমবয়সী অন্য ছেলেমেয়েরা ধাঙড়ের বাচ্চা বলে তাকে ঘৃণা করে। মুকুলের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলে। মুকুলের শিশুমন তার অন্ত:জ জীবন-অস্পৃশ্য সামাজিক অবস্থান পুরোপুরি টের পায়। তার মন ভেঙে যায়। ঘরে এসে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। কান্না লুকাতে হাপর-ফাঁপর লাগে। মা ঠিকই বুঝতে পারে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। "হামরা ছোট জাত আছি বলে কি মানুষ লই"!

স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একজন মানুষ এলেন। সাদা ধবধবে শাড়ি। কালো ফ্রেমের চশমা। চশমার আড়ালে দুটো মায়াময় চোখ। আপাদমস্তক একজন মা। নরম করে কথা বলেন। স্নেহের স্পর্শ লেগে থাকে তার কণ্ঠস্বরে। সে স্বর স্পর্শ করে মুকুল কেশকে। তার শিশুমনে জীবনে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন জাগিয়ে তোলেন তিনি। এরপর যে ঘটনাটা ঘটে সেটা মুকুল কেশের জীবন বদলে দেয়। স্কুলের বাচ্চাদের কারো হাত ধরে, কারো মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করার এক ফাঁকে বেঞ্চের আড়ালে ছোট টুলে বসে থাকা ধাঙড়ের সন্তানটিকে তিনি কোলে তুলে নেন। মায়ের স্পর্শের মতোই অবিকল সেই তাপ, সেই নরম ছোঁয়া। আনন্দের বিস্ময়ে মুকুল কেশ ভেঁউ ভেঁউ করে কেঁদে ফেলে। সে যে ভাবতেই পারে না পৃথিবীতে এমনও মানুষ আছে যার কাছে জাতের বাছ-বিচার নেই। মানুষ মানুষই।

তিনি ফিরে যাওয়ার পর থেকে মুকুল কেশের জীবনটা অনেক সহজ হয়ে যায়। সে অন্যদের সঙ্গে এক বেঞ্চিতে বসতে পায়। স্কুলের ফুটবলে লাথি দিতে পারে। দু'চারটে বন্ধু হয়। মনের মধ্যে আঁকা হয়ে থাকে সেই সফেদ শাড়ি পরা মাতৃরূপ। সুফিয়া কামাল।

স্কুল জীবন পার করে মুকুল কলেজে যায়। পড়াশোনার পাশাপাশি রাজনীতিতে যোগ দেয়। দেশে তখন স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা। মিছিলে, মিটিঙে, অবরোধে, প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘটে মুকুল কেশ। তার সুইপার কলোনিতে সে মিটিং করে। সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখায়। জীবন বদলে ফেলার শপথ করায়। মুকুল কেশ বন্ধুদের সঙ্গে মধুর ক্যান্টিনে যায়। পার্টি অফিসে বড় নেতাদের হাবভাব বুঝতে চেষ্টা করে। স্বৈরাচার উৎখাতের জন্য এইটুকু একজন মানুষ মুকুল কেশ, কোথায় কিভাবে কাজ করবে সে বুঝতে পারে না। তবে একটা জিনিষ বুঝতে পারে। ভিতরে ভিতরে আপোষ হচ্ছে, সুবিধাবাদীরা ঘট পাকাচ্ছে। মুকুল কেশের দিশাহারা লাগে। ছাত্রনেতাদের ধরপাকড় চলছে। বড় নেতারা জেলে চলে গেলে আন্দোলন চালাবে কারা! ছোট ছোট স্বার্থের দ্বন্দ্বে, ছোট খাটো মতবিরোধে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসছে। মুকুলের বুক শুকিয়ে যায়। কোথায় যাবে সে, কে তাকে দিক নির্দেশনা দেবে!

সফেদ শাড়ি পরা কালো ফ্রেমের চশমায় নরম মাতৃরূপ। মুকুল কেশের মনে পড়ে যায় তার দ্বিতীয় জন্মের স্মৃতি। কথাটা সে একে ওকে বলে। ছোট মুখে একটা কথা সাহস করে বলে- "চলো মায়ের কাছে যাই"

সুফিয়া কামাল একটা বেতের মোড়ায় বসে ছাত্রনেতাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মিষ্টিমুখ করালেন। ছোটবেলায় মায়েরা যেমন বাচ্চাদের ঝগড়া মিটিয়ে দেয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, পতাকা খামচে ধরেছে শকুন- মানচিত্রে দৈত্যের ছায়া। জলপাই রং ট্যাঙ্ক। দেশটাকে বাঁচাতে হবে। গণতন্ত্র বাঁচাতে হবে। নইলে মুক্তিযুদ্ধ যে অর্থহীন হয়ে পড়বে।

সুবোধ বালকের মতো সবাই মাথা নেড়ে সায় দেয়। মায়ের উঠোন থেকে ধীর পায়ে তারা রাজপথে নেমে আসে। পিছনে বারান্দায় খুঁটি ধরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে মা। অজানা আশঙ্কায় তাঁর চোখ ভিজে ওঠে। চোখের জলের বাষ্প ঝাপসা করে তোলে চশমার কাঁচ।

৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর মুকুল কেশ মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতো। ছাত্রজীবন পেরিয়ে কর্মজীবনে এসে নানান ব্যস্ততায় যাওয়া হয়ে উঠেনা। তবু এর ওর কাছে খোঁজ নিতো, মা কেমন আছে, তাঁর শরীর কেমন! পত্রিকায় কোনো অনুষ্ঠানে তাঁর ছবি দেখলে মুকুল কেশের বুক ভরে যেতো। তার মানে তিনি একটু অসুস্থ। চলাফেরা করতে পারছেন না।

সংবাদটা হঠাৎ কোত্থেকে উড়ে আসে। দু:সংবাদ বাতাসের আগে ছোটে। লণ্ড-ভণ্ড, ওলট-পালট করে দেয় মুকুল কেশের জীবন। সুফিয়া কামাল নেই! অবিশ্বাস্য এই সংবাদটা মুকুল কেশের বুক ভেঙে দেয়। টেনশনে রিকশা নিতে ভুলে যায়। পাগলের মতো দৌঁড়াতে থাকে। মানুষের ঢল নেমেছে সাঁঝের মায়ায়। সুফিয়া কামাল নেই, এই সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পায় মুকুল কেশ। গেটের কাছেই থমকে যায়।

মুকুল কেশ ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে আসে। কোথায় কার কাছে যাবে। বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। চোখ বুজলেই দেখে সুফিয়া কামালের কোলে একরত্তি মুকুল কেশ। মুকুলের ইচ্ছা করে তার হাত-পাগুলো ছোট হয়ে যাক। শৈশব ফিরে আসুক। সে একটা টুলে বসে থাকবে। সফেদ শাড়ি পরা, কালো ফ্রেমের চশমার সুফিয়া কামাল তাকে কোলে তুলে নেবেন। উদ্দেশ্যহীন দিক হারিয়ে হাঁটতে থাকে মুকুল কেশ। জনারণ্য জনপদ তার কাছে ঝাপসা হয়ে আসে। পাগলের মতো খুঁজতে থাকে। মুকুল কেশ কোথায় গেলে পাবে সবুজ দ্বীপের মতো সুফিয়া কামাল!


মন্তব্য

ঝরাপাতা এর ছবি

অসাধারণ, অপূর্ব, অনন্য আর বেশি কিছু মনে পড়ছে না বলার। তারচেয়ে বরং আরেকবার পড়ি।
_______________________________________
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

সুফিয়া কামালের স্মৃতিতে শ্রদ্ধা ।
মুকুল কেশ কি বাস্তবের কোন চরিত্র?

-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

বার বার পড়ার মত একটি লেখা।
শুভেচ্ছা।

-----------------------------------------------
গাধারে সাবান দিয়া গোসল দেয়ানোটা গাধাপ্রীতির উজ্জ্বল নমুনা হতে পারে; তবে ফলাফল পূর্বেই অনুমান করা সম্ভব, গাধার চামড়ার ক্ষতি আর সাবানের অপচয়।

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- গল্পটা পড়ার সময় চোখের সামনে আক্ষরিক অর্থেই "এক রত্তি মুকুল কেশ" ভেসে উঠেছে। ছুঁয়ে যায় প্রতিবারই "বিষণ্ণতার শহর"
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

রাজিব মোস্তাফিজ এর ছবি

ঐ তো লক্ষ ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনী দামাল
সবুজ দ্বীপের মত মাঝখানে সুফিয়া কামাল।
সুফিয়া কামালকে নিয়ে মুহম্মদ জাফর ইকবালের 'হিমঘরে ঘুম'-এর মতই একটা ভালো লেখা। কবে যে আপনাদের মত লিখতে পারব?
ইদানীং সুলতানা কামালকেও আমার অনেক ভালো লাগছে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।