আবদুল মান্নান সৈয়দ পাঠ

মাসুদ সজীব এর ছবি
লিখেছেন মাসুদ সজীব (তারিখ: সোম, ২০/০৪/২০১৫ - ১২:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পড়ে শেষ করলাম আবদুল মান্নান সৈয়দের শ্রেষ্ঠ গল্প সংকলন। যদিও আবদুল মান্নান সৈয়দ একজন সব্যসাচী লেখক তবু জীবনানন্দ গবেষক এবং সাহিত্য সমালোচক হিসেবে সবচেয়ে বেশি সুপরিচিত। দুই বাংলায় জীবনানন্দ গবেষক হিসেবে তিঁনি বেশ আলোচিত এক নাম। মান্নান সৈয়দের ’জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ র ভুমিকা এক নিশ্বাঃসে পড়েছিলাম অনেক আগে। এটি ছাড়া মান্নান সৈয়দের নিজস্ব মৌলিক লেখার সাথে আমার ব্যাক্তি পাঠের পরিচয় ছিলো না। সেই পরিচয়টা ঘটলো উনার লেখা এই শ্রেষ্ঠ গল্প সংকলন দিয়েই। পাঠ অভিজ্ঞতা বলতে গেলে বলতে হয় ’শেষ কবে কোন লেখকের গল্পের জন্যে এত ব্যাকুল হয়েছিলাম ঠিক মনে নেই। যদিও ইদানিং গল্প কম পড়া হয় তবুও সেই হিসেবে শহীদুল জহিরের পর বোধহয় আবদুল মান্নান সৈয়দের গল্প মুগ্ধ করেছে বেশি। কখন অফিস শেষ করে বাসায় ফিরবো আর কখন আরেকটি নতুন গল্পে ডুবে যাবো এই ভাবনায় কেটেছে গত কয়েকটা দিন। সাধারণত আমি কয়েকটা বই একসাথে পড়ি। এই মাসে শুরু করেছি মুনতাসির মামুনের ’রাজাকারের মন’, সৈয়দ মুজতবা আলীর ’শবনম’, মঈদুল হাসানের ’মূলধারা ৭১’, মাহমুদুল হকের ’মাটির জাহাজ’, শ্যামলী ঘোষের ’আওয়ামী লীগ ১৯৪৯-৭১’। কিন্তু সবার পরে শুরু করা আব্দুল মান্নান সৈয়দের শ্রেষ্ঠগল্প সংকলনই সবার আগে শেষ হয়ে গেলো। এই টুকুতেই বুঝে যাওয়ার কথা কতটা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েছি গল্পগুলো।

মোট ১৫টি গল্প আছে সংকলনটিতে। প্রতিটি গল্পের সাথে তার রচনাকাল উল্লেখ রয়েছে। এই সময়কাল অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে আমার কাছে। সময়ের সাথে শুধু পাঠক নয় লেখক এবং তাঁর লেখাও যে বিবর্তিত হয় তা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে ওঠে প্রথম দিকে লেখা গল্পের সাথে শেষ দিকের লেখাগুলোর তুলনা তে। সেই আলোচনায় পরে আসি। প্রথমে গল্প পাঠানুভূতির কথাই বলি। সংকলনে প্রথম গল্পটির নাম ”মাতৃহননেন নান্দীপাঠ”। দৃশ্যমান জীবনে যেটুকু অদেখা থেকে যায়, অদৃশ্য চেতনার বাইরে ও যে স্রোত বয়ে যায়, সেই অদেখা-অচেনা স্রোতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় গল্পটি। একজন বিচ্ছিন নি:সঙ্গ মানুষের অন্তর্জগতের, অন্তর্লোকের দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে এই গল্পে। নিজেকে ভিন্নধারার মনে করা যুক্তিপ্রবণ এক মানুষের মাতৃহননের জন্যে নিজের ভেতর যে যুক্তি বা কারণ দাঁড় করায় সেই আত্নকথনের গল্প এটি। ভাষা আর যুক্তির শানিত ধার মুগ্ধ যেমন করে তেমনি গল্পের গভীরতা পাঠকের বিশ্বাসের জগতে ধাক্কা দেয় প্রবলভাবে। প্রোথিত বিশ্বাসে আঘাত হানা কয়েকটি চরণ উল্লেখ না করে পারছি না..

ভুলে যেয়ো না পৃথিবীতে প্রতিটি জিনিসই বেঁচে থাকে পরস্পরের বিনিময়ে, এটাকেই লোকে স্বার্থ বলে। মা, এমনকি মাও স্বার্থবোধের বাইরের বাসিন্দা নন। সেখানেও আছে বিনিময় ব্যবস্থা।

দ্যাখো ছোটবেলা থেকে তুমি নিজেকে অন্য থেকে আলাদা কিংবা অস্বাভাবিক ভেবে আসছো। কিছুতেই তুমি অন্য দশজনের সাথে নিজেকে মেলাতে পারো না। কি করে লোক এত সামান্য কারনে হাসতে পারে, ছোট বিষয় নিয়ে মেতে ওঠে হিংসে প্রতিযোগিতায়..তুমি তা ভেবে পাওনা- এ নিয়ে মনে মনে হেসেছোও যেমন তেমনি দু:খও আছে তোমার : কেন তুমি অন্য দশজনের মতো হলে না, বেলেল্ল হল্লায় মেতে থাকতে পারলে না আজীবন। অথচ ফিলোসফি পড়তে এসে জেনেছো ’স্বাভাবিক’ কথাটি আদর্শ মাত্র। আসলে প্রত্যেক মানুষই অস্বাভাবিক, অন্তত নিজেকে প্রতেক্যে অস্বাভাবিক মনে করে।

বুদ্ধির অনেক উপরে প্রবৃত্তি কাজ করে। বুদ্ধি শুষ্ক নিরুপায় আবেগহীন। শিক্ষা তোমাকে কি দিয়েছে? ‘তুমি কী, তার একটা অস্পষ্ট ধারণামাত্র। প্রবৃত্তির মোড় ফেরাবার ঘন্টা বাজানোর সামান্যতম শক্তিও নেই তার। আসল কথা, মানুষের মৌল কয়েকটি রাস্তা আছে, একই কারণ একই রাস্তা দিয়ে তোমাকে বয়ে নিয়ে যাবে, যেখান থেকে মুক্তি নেই কারো।

আবদুল মান্নান সৈয়দের গল্পে মুগ্ধ হওয়ার অন্যতম কারণ খুব সম্ভব গল্পের ভাষা আর উপমা-উৎপেক্ষা চিত্রকল্পের বহুবিদ ব্যবহার এবং বিষয় বৈচিত্র্যতা। হুমায়ুন আজাদের মতোই সুখকর মোহনীয় গদ্যে ভরে উঠেছে প্রতিটি গল্প। প্রথম তিন-চারটি গল্প মূলত একজন বিচ্ছিন্ন মানুষের দ্বন্দ্বের গল্প, যে দ্বন্দ্ব তার মনোজগতের সাথে বহির্জগতের একটা সুক্ষ দূরত্ব তৈরি করে দেয়। যেই দূরত্বের জন্যে একটা মানুষ নিজেকে গুটিয়ে নেয় সমাজ থেকে, পরিবার থেকে, হয়ে যায় নি:সঙ্গ গ্রহের বাসিন্দা। কিন্তু জীবন একমুখী নয়, বহুমুখী জীবনের পথ চলাতে একদিন বেরিয়ে আসতে হয় সেই অন্তর্জগতের খোলস থেকে। তখন নিজের বৃত্তের বাহিরে যে আরো অনেক বৃত্ত আছে, পথ আছে সেগুলো বড় অচেনা ঠেকে। সেই চেনা-অচেনার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে ’চাবি’ গল্পে। প্রতিকী গল্প ’চাবি’ মুগ্ধ করেছে তার ভিন্ন ধারার নির্মাণ শৈলীতে। নিজ গৃহের চাবি হারিয়ে গল্পের নায়ক তার বাসার প্রতিটি প্রতিবেশীর গৃহে যান চাবি খোঁজ করতে। আপতত দৃষ্টিতে বিষয়টি অযৌক্তিক হলেও গল্পটি প্রতিকী বলে এই নির্মাণ কৌশল অতুলনীয়। চাবি খুঁজতে গিয়ে প্রতিটি প্রতিবেশীর আচরণ আমাদের নাগরিক জীবনের যাপিত জীবনধারা কে সুক্ষাতিসুক্ষ ভাবে তুলে ধরে। যেখানে আমরা আত্নকেন্দ্রিকতায় ডুবে থাকি বলে চেনা হয়না-জানা হয় না দু-হাত দূরে থাকা প্রতিবেশী কে, অবিশ্বাস করতে শিখি সবাই কে, নিজের মাঝে ব্যস্ত থাকি নিজস্ব পৃথিবীতে। এই নগর জীবনে আমরা প্রত্যেকে এখন আলাদা দ্বীপবাসী মানুষ, একি ছাদের তলায় থেকেও আমরা কেউ কাউকে চিনি না, জানি না, এ কী কম বিস্ময়কর! সেই বিস্ময়কর যাপিত জীবনকে চোখের সামনে তুলে এনেছেন লেখক। আর যেই বিস্ময়কর গন্ডিতে তালাবদ্ধ থাকি সেই গন্ডি থেকে মুক্তি পেতে ’চাবি’ খুুঁজতে থাকি আমরা, কিন্তু গল্পের নায়কের মতো আমরাও সেটি পাই না কোনকালে।

মাছ’ গল্পটি আসলে নাগরিক জীবনের সুগভীর বিচ্ছিন্নতা, অনিবার্য বিপন্নতা, সীমাবদ্ধতা, গন্ডিবদ্ধ জীবনযাপন, হাজারো কোলাহোলের মধ্যে নি:সঙ্গতার কথন। প্রত্যেক মানুষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো তারা জন্যে সঠিক পথটি খুঁজে বের করা, অথচ নিজের জন্যে সঠিক পথটি খুঁজে পেতে তার জীবনের বেশিরভাগ সময়টা চলে যায়। নিজেকে খুঁজে পেলেই নিজের দায়িত্ব, সঠিক কর্ম সম্পাদন করা সহজ হয় মানুষের জন্যে। সেই নিজেকে চিনতে পারার, জানতে পারার আর নিজের পথ খুঁজে পাওয়ার গল্প এসেছে ’মাছ’ গল্পে। ’রাস্তা’ গল্পটি অনেকটাই ’চাবি’ গল্পের মতোই আত্ন অনুসন্ধানের, আত্নমুক্তির পথ খোঁজার আহ্বানে রচিত।

গল্প ১৯৬৪’ আর ’জলপরী’ দুটো আগের গল্পগুলোর চেয়ে পুরোপুরি বিপরীত মুখী ভিন্নধারার অসাধারণ গল্প। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়কার পটভূমিতে রচিত ‘গল্প ১৯৬৪’ তে দেখানো হয়েছে মানুষের লড়াই যতটা না বহির্লোকের/শাক্তি সাথে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি লড়াই নিজের সাথে। নিজের সাথে অসম অসীম লড়াইয়ে মানুষ হেরে যায় হয়তো বারে বারে, কাম বাসনা আর ক্ষনিকের উত্তেজনা যে মানুষের আদর্শ আর নীতিকেও টলিয়ে দিতে পারে সেই সত্যই বলেছেন গল্পে। তবু মানুষ হলেই মনুষত্ব্য থাকে, সেই মনুষত্ব্যের জন্যে কৃর্তকর্মের জন্যে তার অনুশোচনা জাগে। অপরাধ বোধ জাগ্রত বিবেকের নাম মনুষ্যত্ব, মনুষ্যত্ব যার আছে সেই মাত্র মানুষ।

জলপরি” রুপময় রূপক নিরেট প্রেমের গল্প। আবদুল মান্নান সৈয়দের ভাষার জাদুময়তার অন্যতম প্রকাশ ঘটেছে এ গল্পে। সহজ ধারার প্রেমের গল্পও কেমন করে ভাষার গাঁথুনি আর নির্মাণ শৈলীর নিপুণ দক্ষতার জন্যে সুখকর পাঠ হয়ে ওঠতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এটি। শুরুটা এমন মুগ্ধকর

না: শম্পাকে আমি পাইনি। চাওয়া-পাওয়ার: এ-সব আমার কাছে অসহ্য শব্দ। কিন্তু আজ ঐ সব শব্দই নিজেকে প্রকাশ করতে হচ্ছে। সত্য হয়তো এরকমই, যা সবাইকে তার মিনার থেকে নামিয়ে আনে সমতলে, একে এক করে দ্যায় সবাইকে-কিছুতেই আলাদা হতে দ্যায় না।

অস্তিত্ব অন্যত্র’ জীবনের দু-বিপরীতমুখী স্রোতের সাংঘর্ষিক গল্প। যদি ও প্রিয় মানুষের মৃত্যু আমাদের কে নিয়ে যায় গভীর শোকের দ্বীপে তবুও সেই শোক থামিয়ে দিতে পারে না আমাদের জীবন ভাবনা কে, স্বপ্ন কে। জীবন বহতা নদীর মতো চির-বহমান, নিজ মৃত্যু আসার আগে কোন বাঁধাই তাকে আটকাতে পারে না তার কক্ষপথ থেকে। গল্পে মন্টুর দাদার মৃত্যুর শোকে কাতর, দাদার লাশের পাশে বসে দাদার সাথে অসংখ্য প্রিয় স্মৃতি যেমন জেগে ওঠে তেমনি চলমান জীবন নিয়ে তার স্বপ্নগুলো ও ডানা মেলতে থাকে ভাবনার আকাশে। দুটো বিপরীত মুখী চেতনার ভেতর দিয়ে যেতে হয় মন্টুকে। শুধু মন্টু নয়, অামাদের সবাইকে এক জীবনে অসংখ্য বার বিপরীত মুখী চেতনার স্রোত দিয়ে বেয়ে যেতে হয় জীবন নৌকা।

অমরতার জন্যে মৃত্যু’, ’আম্রকাননে’ এবং ’রাজা’ তিনটি গল্পের পটভূমি রূপকথার গল্পের মতোই। রাজা-প্রজার নাম শুনলেই ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়, যে গল্পগুলো শুনে আমরা বড় হয়েছি কিংবা যে গল্পগুলো ছোটবেলার গল্প বলে বেশি পাঠিত হতো সে ধারার বর্ণনায় রচিত গল্পগুলো। পৌরাণিক রূপকথার মতো মান্নান সৈয়দের গল্পে রাজা-প্রজা থাকলেও এর সাথে বর্তমানের অসঙ্গতি-অনিয়ম, মিথ্যাচার, ব্যাভিচার, বংশীয় রাজনীতির যে সম্পর্ক রয়েছে সেটি ফুটে উঠেছে, ফলে গল্পগুলো হয়ে ওঠেছে ভীষন সমসাময়িক। প্রথম গল্পটিতে একজন সাধারণ মানুষকে সমাজ-রাষ্ট্র যেভাবে অবহেলা করে, তার ত্যাগ কিংবা অর্জন সব কিছুকে বাতিল করে দিয়ে শুধু ক্ষমতাভোগী শাক্তিমান-রা যে নিজেদের কথা ইতিহাসে অমর করে রাখে সেই অসঙ্গতির কথাই বলা হয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রে যেমন সাধারণ মানুষগুলো প্রতিটি রাষ্ট্রীয় সংগ্রামে জীবন দিয়েও ইতিহাসে স্থান পায় না অথচ ইতিহাসে অমর হয়ে যায় ক্ষমতাভোগী ষড়যন্ত্রকারীরা! সেই ইতিহাস সেচ্ছাচারিতাকেই রূপক আকারে গল্পে রূপ দিয়েছেন লেখক। এমন গল্প বোধের গভীর মর্মে আঘাত হানে, যদিও যাদের বোধে আঘাত হানার কথা তাদের বোধ ঘুমিয়ে গেছে বহুকাল আগে। ঘুমন্ত বোধকে জাগ্রত করার প্রয়াসে এমন লেখা জারি থাকুক আজীবন, প্রতিষ্ঠিত হোক সাম্য আর ন্যায়ের ইতিহাস, এটাই চাওয়ার। ’রাজা’ গল্পটি আমাদের দেশের সমকালীন রাজনীতির সাথে অনেকটাই একত্রীভূত হয়ে যায়। গল্পের মতো এখানেও রাজনীতিতে মিথ্যাচার-ষড়যন্ত্র আর স্বৈরাতন্ত্র এক হয়ে পথ চলে আর একই নাটক বার বার মঞ্চায়িত হতে থাকে।

আব্দুল হাফিজ: জীবন ও সাহিত্য’ গল্পটি সমকালীন লেখকদের গল্প। একজন লেখককে এই সময়ে লেখালেখির জন্যে কতটা বঞ্চনার স্বীকার হতে হয়, হতে হয় হেয় প্রতিপন্ন তার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন গল্পে। বেঁচে থাকার তাঁড়নায় প্রতিটি দিনে আপোস করতে হয়, আর প্রতিটি আপোস লেখককে একেকবার নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে মৃত্যুর স্বাদ দেয়। প্রতিনিয়ত লেখকের লেখক সত্ত্বার মৃত্যুর গল্প এটি। ’হোসেন মিয়ার সঙ্গে’গল্পে পদ্মা নদীর মাঝির চরিত্রগুলোকে পুনরুজ্জীবন দিয়েছেন লেখক। সময়ের সাথে কত কি বদলে গেছে, বদলে যায়, শুধু সমাজ থেকে বদলায় না হোসেন মিয়া-রা।

সংকলনের পরের দুটি গল্প জীবনানন্দ কে নিয়ে। যদিও এ দুটো গল্প পাঠে কিছুটা সংশয় তৈরি হতে পারে পাঠকের মনে। প্রথম যে গল্পটি সংশয় তৈরি করে তার নাম ’জীবনানন্দের একটি অপ্রকাশিত গল্প’। এই গল্পের শুরুতে গল্পটির পটভূমি নিয়ে ছোট্ট একটি ভূমিকা থাকে। ফলে শুরুতে বুঝা দায় গল্পটি কার লেখা! এটা কী জীবনানন্দের লেখা না আব্দুল মান্নান সৈয়দের? তবে গভীর মনোযোগ দিয়ে পাঠের শেষে এসে মনে হয় এটি মান্নান সৈয়দের লেখা। বিশেষ করে গল্পের ভাষায় যখন জীবনানন্দকে অতি মাত্রায় আরোপিত করা হয়েছে তখন সচেতন পাঠকের পক্ষে এটি অনুধাবন করা সম্ভব। কবিতায় যেমন জীবনানন্দ কিছু শব্দ অতি ব্যবহার করতেন, গল্পটি কেও জীবনানন্দময় করে তুলতে সেই শব্দগুলো অতি ব্যবহৃত হয়েছে। যা লেখাটি কে অনেকটা দুর্বল করে দিয়েছে।

তবে পরের গল্পটি সেই দুর্বলতাকে কাটিয়ে উঠেছে সম্পূর্ণরূপে। কবির মৃত্যুর আগেরে দিনের বর্ণনার গল্প এটি। এই গল্পে পাঠক, কবি জীবনানন্দকে জানতে পারবে স্ত্রী লাবণ্য আর বোন সুচরিতার নিবিড় পর্যবেক্ষনরত বর্ণনাতে। শুধু মাত্র একটি ঘটনায় কবি জীবনানন্দের দৃষ্টিভঙ্গির প্রখরতা পাঠক কে মুগ্ধ করে দিবে গল্পে।

অন্ধকার মাঠের প্রান্তে বিরাট একটা গাছ। ছড়ানো ডালপালা। পাতায় পাতায় ছাওয়া। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে কিছু কিছু আকাশের তারাও চোখে পড়ে। গাছের নিচে গিয়ে জবিনানন্দ কী যেন খুঁজতে লাগলেন।
’কী খুঁজছেন?’ নীহারকান্তি বলে।
’ডাল। গাছের ডাল।’ জীবনানন্দ নিচু হয়ে ডাল খুঁজতে লাগলেন।
’ঢিল পেয়েছি একটা। ঢিল হলে চলবে?’ জিগেস করেন নীহারকান্তি।
’ঢিল? জীবনানন্দ যেন রেগেই গেলেন। ‘গাছে তুমি ঢিল ছুড়বে? তুমি না কবি?
লজ্জা পেয়ে চুপ করে ডাল খুঁজতে লাগল নীহারকান্তি।পাওয়া গেল ছোটো ছোটো কয়েকটি ডাল।
জীবনানন্দ ডালগুলো গাছের গায়ে ছুড়ে ছুড়ে মারতে লাগলেন। কয়েকটি পাখি গাছ থেকে কলরব করে উড়তে লাগল গাছের উপরে।
নীহারকান্তি প্রশ্ন করেন ঢিল না-ছুড়ে ডাল ছুড়লেন কেন?
’বোঝেনি, কেন?’ -ঢিল ছুড়লে পাখিরা ভয় পায়। ঘুমের মধ্যে আতঁকে উঠে ওরা। ডাল ছুড়লে ভয় পায় না ওরা। রাতে যখন প্রেমিক-প্রেমিকা পাশাপাশি শুয়ে থাকে-ঘুমের মধ্যে হঠাৎ যদি প্রিয়তমের হাত প্রিয়তমার শরীরে এসে লাগে, তখন কী নারী চেঁচিয়ে ওঠে? ভয় পায়? না, ভয় পায় না। ভয়ে চ্যাঁচায় না। কেননা ঐ স্পর্শ তো পরস্পরের কাছে চেনা। নিবিড়। অন্তরঙ্গ। সেই ঘুমন্ত নারীকেই যদি কোনো অপরিচিত পুরুষ ছোঁয়, অম্নি মেয়েটি চেঁচিয়ে উঠবে। কারণ ঐ স্পর্শ তো মেয়েটির অচেনা। এও তেম্নি। গাছের সঙ্গে তো পাখির আজন্ম পরিচয়। ডাল, পাতা সব। ডাল ছুড়লে তাই ভয় পায় না।

এমন বিস্ময়কর অনুধাবন নৈসর্গিক কবি জীবনানন্দ ছাড়া আর কার পক্ষে সম্ভব? সেই নৈসর্গিক কবির মৃত্যু নিয়ে যে রহস্য কিংবা বনলতাকে নিয়ে যে রহস্য, গল্পে সেই রহস্য ভেদ করার কোন চেষ্টা করেননি লেখক বরং এর চেয়ে কবির মনোজগত, নির্মোহ যাপিত জীবনকে ছোট ঘটনার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। সর্বশেষ গল্প ’বিদ্যা সুন্দর কাহিনী’ মনোজাগতিক অসম প্রেমের। এই লেখায় বেশ তাড়াহুড়ো আর লেখকরে সহজাত মুগ্ধকর গদ্যের অনুপস্থিতি ঘটেছে। অন্য গল্পগুলো তে লেখকের ভাষার মোহনীয়তা, গল্পের রূপক নির্মাণ আর উপমা কৌশল হৃদয়ে হিমেল বাতায়নের মতো যে ভালোলাগা তৈরি করে এই গল্পতে সেই ভালোলাগা তৈরি করতে পারেনি।

প্রথমেই উল্লেখ করেছি প্রতিটি গল্পের পেছনে সময় উল্লেখ ছিলো। সেই সময়টি একজন পাঠককে লেখক আর তার লেখার ক্রমপরিবর্তন হওয়া সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দেয়। প্রথম আটটি গল্প মনোজগতের, অব্যক্ত, বহুমুখী সম্ভবনাময় প্রতিকী গল্প। প্রথম দিকে লেখক বিচ্ছিন্ন নি:সঙ্গ মানুষের আত্নকথন, মনোজগতের দ্বন্দ্ব, সীমাবদ্ধতা, সংকীর্ণতা, জীবনকে গভীর থেকে দেখার বাসনা, অতৃপ্তি, মানবিক সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা আর আস্থা হীনতার চিত্র ফুটে তুলেছেন। যে সম্পর্ক শুধু জন্ম, মৃত্যু আর আনন্দ উৎসবে একত্রিত করে মানুষ কে, সে সম্পর্ক কতটা আত্নার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে সে প্রশ্ন ঘুরে ফিরে এসেছে প্রথম দিকের গল্পগুলো তে। অন্যদিকে তার বিপরীত চিত্র থাকে মধ্য বয়স থেকে জীবনের শেষ দিকে লেখা গল্পগুলোতে। এখানে লেখক অন্তর্লোকের জগত থেকে বহির্জগতে এসেছেন, নির্মাণ করেছেন সমাজ বাস্তবতা, নানান রূপকে ফুটিয়ে তুলেছেন সমাজ-রাষ্ট্রের নানান অসঙ্গতি। জীবনানন্দ চর্চা ও গবেষনা শুরু করেছেন কোন সময় থেকে আর তার কতটুকু ছাপ ফেলেছে গল্পকারের লেখনীতে তা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে ওঠে শেষ দিকের লেখা রচণা তে।

সাহিত্য পাঠে একজন পাঠককে চিন্তা করার ক্ষমতা এবং স্বাধীনতা দুটোই দেওয়া উচিত লেখকের। নিজ চিন্তাশক্তি আর বোধ দিয়ে কল্পনার চরিত্রগুলো দাঁড় করানোর মাধ্যমেই পাঠক কখনো নিজে গল্পের একজন সদস্য হয়ে ওঠে, কখনো খুব কাছে থেকে দৃশ্য-ঘটনাগুলো অবলোকন করে। পাঠক কে পাঠক হয়ে উঠার সেই সুযোগ গল্পকার দিলেও সংকলনটির শুরুতে গল্পগুলো নিয়ে বিশ্লেষনমূলক আলোচনা করা হয়েছে, সংকলনের শুরুতে এমন আলোচনা গল্প পাঠের আগেই পাঠকের নিজস্ব কল্প ক্ষমতাকে আটকে দিতে পারে। এছাড়া সেই আলোচনাতে আবার এমন কয়েকটি গল্পের কথা বলা হয়েছে যে গল্পগুলো এই সংকলনে নেই! এই ভুলটুকু আশা করি পরবর্তী সংস্করণে শুধরে নিবে প্রকাশনাটি। এই অসঙ্গতিটুকু বাদ দিয়ে বলতে পারি বিষয় বৈচিত্র্যতা আর গল্পের নির্মাণ-শৈলীতে আবদুল মান্নান সৈয়দের গল্প সুখপাঠ্য হবে সাহিত্যের প্রত্যেক বিদগ্ধ পাঠকের কাছে। সুখকর হোক আবদুল মান্নান সৈয়দ পাঠ।

শ্রেষ্ঠ গল্প


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আর যা যা পড়ছেন, তার আলোচনাও আশা করি পাচ্ছি আমরা।

আলোচনা ভালো লেগেছে। মান্নান সৈয়দের গল্প ওভাবে পড়া হয়নি। পড়তে হবে দেখা যাচ্ছে।

স্বয়ম

মাসুদ সজীব এর ছবি

মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ, এনশাল্লাহ আগামী ঈদের পরে সবগুলো নিয়ে একখান লেখা লিখে ফেলবো চোখ টিপি (এই মন্তব্য কোথাও কারো সাথে মিলে গেলে লেখক দায়ী নয়)

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

রানা মেহের এর ছবি

আব্দুল মান্নান সৈয়দের গল্প পড়া হয়নি।
কত ভাল ভাল জিনিস বাকি রয়ে গেল জীবনে মন খারাপ

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

মাসুদ সজীব এর ছবি

মান্নান সৈয়দ কে পড়তে হবে, অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হবেন। শুভেচ্ছা হাসি

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

কর্ণজয় এর ছবি

অনেকটা সময় ভাল রাখবে আমাকে, আপনার এই লেখা।।।

মাসুদ সজীব এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ হাসি

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।