মেঘ-জল-অন্তরীক্ষ

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: রবি, ১৩/০৪/২০০৮ - ৭:৩১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জীবনের শুরুটা কোত্থেকে? জন্ম থেকে? যখন কিনা মানুষ জানে না, আসলে সে আসলে মানুষ কিনা? আজকাল অবশ্য বিজ্ঞানীরা মাতৃজঠরের স্মৃতিও ধরতে পারছেন বলে দাবী করছেন, কিন্তু সেই সব স্মৃতিরাশির কী বা দাম, যদি তাতে মনুষ্যগন্ধই না পাওয়া গেলো?
আমি ভাবি, মাঝে মাঝেই ভাবি, কখন থেকে শুরু হয়েছে আমার জীবন?

জন্ম থেকে নাকি যখন থেকে আমি চিনেছি আমার সেই সাদা গিলাফের শিমুল তুলোর বালিশটি, সেদিন থেকে?
আমার ক্ষেত্রে আমি ধরেই নিয়েছি যে, আমার জীবনের শুরুটা সেইদিন থেকেই, যেদিন আমার মা আমাকে বালিশটি বানিয়ে দিয়েছিলেন। সে এক কাহিনী বটে, বালিশ তৈরির কাহিনী। জীবনের শুরুটা একটু ভালোভাবেই বলা যাক, কী বলেন?

আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে আমার ফুপু বাড়ির দূরত্ব বেশ অনেকটাই, বড় হয়ে জেনেছি সেই দূরত্ব নাকি তিন মাইল। গ্রামের তিন মাইল বিভ’তিভ’ষণের উপন্যাসে পড়া আট ক্রোশ দূরের মতোই, মানে ফুরুতে চাইতো না। অথচ ফুপু বাড়ি যাওয়ার নামে আমি নেচে উঠতাম, যখন-তখন। এমনও হয়েছে যে, গভীর রাতে আমি কেঁদেছি, “আমারে ফুপু বাড়ি নিয়ে চলোরে, আমি ফুপুর কাছে যাবো” বলে। গ্রামের গভীর রাত বোধ করি সন্ধ্যে সাতটা কি আটটা হবে। যদি সময়টা বর্ষা হাতো তাহলে আমার মা নিজেও মনে হয় খানিকটা নাচুনে স্বভাবের হয়ে উঠতেন, বাড়ির কাজের লোকটাকে বলতেন, “ইদ্রিসরে নৌকাটা ভাসাও, উঠলো বাই তো ফুপুবাড়ি যাই, চলো গিয়ে সৈ-সন্ধ্যায় ঘুরে আসি গে”। আমার শব্দভাঁড়ারে সঙ্গে সঙ্গেই সৈ-সন্ধ্যায় শব্দটি যোগ হতো, যদিও জানতাম না শব্দটার সত্যিকার অর্থটি আসলে কি। তারপর প্রতিটি বাক্যে না হোক অন্তত প্রতি দশটি বাক্যের একটিতে আমি এই শব্দটি ব্যবহারের চেষ্টা চালাতাম। আমার স্বভাবের এই শব্দযোগটি এখনও অটুট রয়ে গেছে।

তারপর ইদ্রিস আরও কাউকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের ঘাটের খোলা নৌকাটির “মাচৈল”-এর ওপর একটা মাদুর বিছিয়ে দিতো। মা দিতেন আরও একটা বিছানার চাদর, একটা কিংবা দু’টো বালিশ। যদি জ্যোছনা রাত হতো তাহলে আমরা ঘাটে গিয়ে দেখতাম, নৌকোর হালে বসা ইদ্রিস ভাই আর সামনের গলুইতে বসা পাড়ারই বতু দাদা। যদি বাবা বাড়ি থাকতেন তাহলে তিনিও সঙ্গী হতেন আমাদের, আর যদি তিনি না থাকতেন তাহলে হয় বতু দাদার মা কিংবা মায়ের সঙ্গী হওয়ার জন্য আরও যে সব পাড়াতো চাচীরা সব সময় উদগ্রীব হয়ে থাকতেন তাদের কাউকে সঙ্গে নেওয়া হতো।

আমাদের নৌকোটি তেরো হাত লম্বা, একেবারে মাঝ বরাবর আড়ে আড়াই হাত। কমপক্ষে কুড়ি মন নাকি মাল ধরে, এসব আমার শোনা কথা। কার নৌকায় কতো মাল বহন করা যায় তা দিয়েই বর্ষাকালে গৃহস্থির পরিমাণ নির্ধারণ করে গ্রামের মানুষ। প্রায়ই অলস সন্ধ্যার বর্ষাযাপনে এসব নিয়েই কথা হয় আমাদের ঘরের দাওয়ায় বসে, আর আমি সব কথা গিলি এবং মনে রাখি। আমার মনে রাখার ক্ষমতা অসীম, কতো ছোট্ট বয়সের এইসব ঘটনার কথা যে আমি বলছি সেটা কেউ ধারণাই করতে পারবেন না। নৌকোয় আমরা বসা মাত্র নৌকো ছেড়ে দিতো ইদ্রিস ভাই, বিসমিল্লাহ্ বলে জল ছুঁয়ে। বাড়ির ঘাট ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মন বলতো, আহা, আর যদি ফিরে না আসি বেশ হয়, ভেসে যাওয়া, শুধুই ভেসে যাওয়া Ñ আমার ভাসমান জীবনের প্রতি টানধরা নেশাটা আজও আছে, তাইতো স্থিতু হওয়া আর হলো না এ জীবনে, আমার সেই সাদা গিলাফের বালিশটিই আমার এই ভাসমান জীবনের সব সময়ের সঙ্গী, তাই ওর সম্পর্কে বলে নিই সবার আগে।
নৌকো ভরা মায়ের পান-জর্দার গন্ধ, সঙ্গে সামান্য সুগন্ধিও বুঝি, আমার মায়ের সুগন্ধিপ্রেম তীব্র, কেন জানি না ভদ্রমহিলা আজীবন সুন্দরকে ভালোবেসেছেন, কিন্তু আজীবন তাকে অসুন্দর বার বার আক্রমণ করেছে, এখনও অসুন্দরের সঙ্গেই লড়ে যাচ্ছেন প্রায় চলচ্ছক্তিহীন অবস্থায় বিছানায় শুয়ে শুয়েও। অথচ সেই নৌকোয় বসা মাকে আমার আকাশের জ্যোছনার মতো মনে হতো। মা গুন গুন করে গান গাইতেন, বেশিরভাগ সময়ই কোনও রবীন্দ্রসঙ্গীত, তখন আমার রবীন্দ্র-নজরুল জ্ঞান হয়নি, একেবারেই হয়নি কি? আমি তো সেই ছোট্ট বয়সেই শিখেছিলাম, “আমার সকল দুখের প্রদীপ, জ্বেলে দিবস, গেলে করবো নিবেদন, আমার ব্যাথার পূজা হয়নি সমাপন” Ñ যদিও জানতাম না জ-এর নীচে একটা ব-ফলা না দিলে কী হয়, গানটা শুনে শুনে শেখা, মা গাইতেন একা একা থাকলে গুন গুন করে, কখনও গলা ছেড়ে নয়। মানুষের জীবনে কতো বাধ্যবাধকতা, একটা গানও গলা ছেড়ে না গাইতে পারাটা নিশ্চয়ই খুব কষ্টের!

আমি বসতাম নৌকোর সামনের গলুইয়ের কাছে। একেবারে সামনে বতুদাদা, বৈঠা হাতে, যদিও নৌকো গাঙে না পড়া অবধি বৈঠার কোনও কাজ নেই। তাই বতু দাদাও বসে থাকতেন চুপচাপ। মা কথা বলতেন, গল্প। নানা বিষয়ের, স্বাদের। আমি কান পেতে থাকতাম নৌকোর গায়ে, পাটা তুলে দিতাম মায়ের কোলে। কত্ কত্ শব্দ হতো জলের, নৌকোর গায়ে লেগে জল ধাক্কা খেয়ে সরে সরে যেতো। আমরা পেরুতাম, কাঁচিকাটা খাল, মোনাবদির বাগ, মোল্লাবাড়ির কাচা, মুন্সির ভ’ঁই, ডাক্তারের ভিটা Ñ এসবই আমার জানা হয়ে যেতো, প্রতিটি জায়গার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ইদ্রিস ভাইজান কিংবা বতু দাদা, মা কিংবা বতু দাদার মা এইসব জায়গার নাম নিয়ে কোনও না কোনও ঘটনা বলতেন, আমি শুনতাম। মাঝে মাঝে মা আমাকে প্রশ্ন করতেন, “বলো দিকি আকাশে কতো তারা?”
আমি বলতাম, “জানি না।”
“পৃথিবীর কোনও উত্তরই অজানা নয়, অজানা থাকে না। কোনও কোনও দিন সব উত্তর জানা যায়, মানুষ জেনে যায়, বুঝলে?” Ñ মা বলতেন।

মা আমার সঙ্গে কথা বলার সময় কখনও গ্রাম্য ঢং-এ কথা বলতেন না। অথচ অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মা দিব্যি গ্রামের আর সবার মতো করেই কথা বলতেন। যদিও তার নিজের গ্রামের ভাষা আর আমাদের গ্রামের ভাষার সুর একরকম নয়। অনেক পরে জেনেছি, মানুষ খুব সহজেই ভাষার এই সুরটি আয়ত্ব করতে পারে, যদিও পুরোপুরি নয়, খানিকটা অসম্পূর্ণতা থেকেই যায়, সেটাতো মানুষের জীবনেও থাকে, অসম্পূর্ণতা নিয়েই মানুষ একটা গোটা জীবন কাটিয়ে যায়।
মা বলতেন, “আচ্ছা গুণতে শুরু করোতো!”
আমি বলতাম, “কোত্থেকে করবো?”
ঃ ওই যে ওখান থেকে।
ঃ কুখান থেকে?
ঃ এই মেয়ে, কুখান থেকে কী? Ñ মা হেসে দিতেন।
তারপর হাসি থামিয়ে বলতেন, “আচ্ছা আমি বলি, আকাশে তারার সংখ্যা অগণিত”।
“অগণিত মানে কি?”
ঃ অগণিত মানে, যে সংখ্যা গণিতে নেই, মানে অঙ্কে নেই।
ঃ অঙ্কে কতো সংখ্যা আছে?
এইবার মা বিপদে পড়েন, কারণ মায়ের অঙ্ক জ্ঞান মেট্রিক অবধি। পরে অবশ্য অনেক কষ্টে-সিস্টে মা বিএ ডিগ্রী নিয়েছিলেন। আমি যখন ইন্টারমিডিয়েট দেই তখন মায়ের বিএ পরীক্ষা ছিল, আমরা একসঙ্গে পড়তাম, মায়ের জন্য আমি ঘুমুতে পারতাম না, সারাক্ষণ নিজেও জেগে থাকতেন আমাকেও জাগিয়ে রাখতেন। সেটা অবশ্য অনেকই পরের কথা, এর মাঝে কতো নদী মরে গেলো, কতো জল শুকিয়ে মরু হলো পৃথিবী দেহ।
মা কথা ঘুরিয়ে দিতেন, কৌশলে। আমিও সেই কৌশলটি ছোট্ট বয়সেই ধরতে পেরেছিলাম, যদিও নৌকোয় সেই সব রাতের ভ্রমণে নয়, পরে, আরও পরে। হঠাৎই মা বলতেন, “ওই যে দ্যাখো, তারা খসে পড়ছে”।
ঃ তারা কি ফুল যে খসে পড়বে?
ঃ তারাতো ফুলই, পৃথিবী গাছের ফুল, পুরো আকাশটা হলো গিয়ে পৃথিবী গাছের ডালাপালা। মেঘগুলো পাতা, আর তারারা ফুল, রাতে ফোটা ফুল, দ্যাখো না, হাস্নুহানা কিংবা সন্ধ্যামালতিরা সূর্য মরে যেতে যেতে ফোটে, তেমনই তারা ফুলরাও সূর্য চলে গেলেই ফোটে।
ঃ তারা-ফুলের বোঁটা কই?
ঃ বোঁটা তুমি দেখতে পাও না, এতো ছোট ছোট ফুলের বোঁটা দেখা যায় নাকি? পিঁপড়ার কি পা দেখা যায়? পিঁপড়ার পা যেমন মাটির দিকে থাকে বলে দেখা যায় না, তারা-ফুলের বোঁটাও তেমনি ওপরের দিকে থাকে বলে দেখা যায় না, বুঝলে।

খুব সুন্দর ব্যাখ্যা, আমি কিন্তু ঠিকই পরে পিঁপড়ার পা দেখেছি। সেটা অনেক পরে। তারা-ফুলের বন পেরিয়ে নৌকোয় করে ফুপু বাড়িতে যাওয়ার দিনগুলি তখন অনেক দূরে ফেলে এসেছি। নোনা খালে ঢোকার মিনিট খানেক আগে থেমেই মা ইদ্রিস ভাইজানকে বলতেন, “ইদ্রিসরে সাবধান, নোনা খাল কিন্তু বালো না, কিনারে কিনারে নাও ধইরো”।
“আম্মা আপনি বই পাইয়েন না, নতুনতো না।” Ñ ইদ্রিস ভাইজান মাকে অভয় দিতেন। প্রতিবার ফুপু বাড়ি যাওয়ার পথে মায়ের এই সাবধানবাণী আর ইদ্রিস ভাইজানের এই অভয়বাণী শুনতাম। নোনা খালে পড়তেই ইদ্রিস ভাইজান আর বতু দাদা বৈঠা ধরতেন। তখনে আর বাঁশের লম্বা চৈড় ঠাঁই পেতো না, বৈঠা ধরতে হতো। নোনা খাল বিশাল পূব চককে ঠেলে নিয়ে গেছে কুমার নদীতে, বর্ষার শুরুতে নদী থেকে জল এনে ঢালে পূব চকে, আর বর্ষার শেষে পূব চক থেকে চল নিয়ে ঢালে নদীতে। ছোট্ট নোনা খাল তাই গোটা বর্ষাকালটাই খুব ব্যস্ত। একেবারে নদীতে পড়ার মুখেই একটা দহ। খুব বড় নয়, একটা বড় পুকুরের সময়, জলের পাকেই এই দহ হয়েছে। একেবারে ভরা গ্রীষ্মেও শুকোয় না। অনেকে একে খুব রহস্যময় দহ বলে, কিন্তু পরে দিকে তাও শুকিয়ে যেতো, তখন আর রহস্য বলে কিছু ছিল না। মায়ের সেই কথার মতো, সব প্রশ্নেরই উত্তর আছে, পৃথিবীর কোনও প্রশ্নেরই উত্তর অজানা নয়, অজানা থাকে না।

নোনা খালের সেই দহে অসম্ভব পাক, জলের। তাই নৌকোকে দহ-লাগা কাজি বাড়ির একেবারে কিনার ঘেঁষে নিতে হতো। ওদের বাড়ির হিজল গাছের ডালপালা আমাদের মাথা ছুঁয়ে যেতো, আমরা নীচু হয়ে নৌকোর সঙ্গে লেগে থামতাম, আমিতো আগে থেকেই শুয়ে থাকতাম মায়ের কোলে পা রেখে, মা-রাই মাথাটা নীচু করতেন। তারপর নদীর স্রোতশব্দ শোনা যেতো। কলকল শব্দে যে নদীর স্রোত বয় না সেটা সেই বয়সেই জেনে গিয়েছিলাম, আরও পরে যখন অনেক নদী দেখেছি তখন বুঝেছি, একেক নদীতে স্রোতের শব্দ একেক রকম। তবে কোনও নদীই কল কল শব্দে বয় না, ওটা আমাদের বানানো। একেকজন মানুষ একেক রকম ভাবে ওই শব্দ শোনে। যার কাছে যেরকম লাগে তিনি সেরকম ভাবেই লিখে গেছেন। কলকল ছলছল নদী করে টলমল, ঢেউ ভাঙে ঝড় তুফানেতে, নাও বাইওনা মাঝি বিশম দৈরাতে Ñ পল্লীগীতির এই শব্দগুলির সঙ্গে নদীর মিলটি আসলে একেবারেই নেই, এরকম নদীকে বড় জোর প্রেমনদী বলা যেতে পারে।
কুমার নদী তখন ভরভরন্ত, জলে-জলে ঠাসা, উপছে পড়ার অবস্থা, নোনা খালের মতো অসংখ্য খাল দিয়ে তখন সেই উপছানো জল চলে যাচ্ছে চকে, বিলে অথবা গ্রামের পা ধুইয়ে দেওয়ার জন্য পুকুরগুলোকেও ভরে দিতে। নৌকো চকে থাকতে কত্কত্ যে শব্দটি ছিল নদীতে পড়ার পর সেই শব্দটি আর নেই। আমি কান পেতে শব্দ শোনার চেষ্টা করি, কিন্তু শব্দ নেই, তাই শোনা যায় না। স্রোতের সঙ্গে নৌকো তখন ছুটছে। নদীতে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাই নদী থেকে ফুপু বাড়িতে ঢোকার ছোট্ট খালে, যে খালের নাম গাবতলার খাল। শুকনোর দিনে নদীর পারে সেই বিশাল গাবগাছ আমার কাছে আজীবন ভয়ের, বিস্ময়ের। এতো বড় গাবগাছ হয়তো আমার জীবনে আমি দেখিনি আর কিন্তু আমার মতো অনেকেই সেই গাব গাছের বিশালত্ব দেখে অবাক হবেন নিশ্চিত। হতে পারে সেই ছোট্ট বয়সের বিস্ময় আর সবকিছু আকারে বড় দেখার একটা ভ্রম থাকতে পারে কিন্তু এখনও সেই ভ্রমটাই আমার ভেতরে রয়ে গেছে, ভ্রম সংশোধনের কোনও চেষ্টা আমিও করিনি আর হয়ওনি। এরকম বহু ভ্রমই আমি আজীবন ধরে পুষছি, চিরদিন পুষলাম এক অচীন পাখি-র মতো; সবাই পোষে, আমার মতো।
সেই গাবতলার খাল এলেই আমার চোখ বন্ধ, কারণ সেই গাবগাছে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভ’ত। যে ভ’তের ভয় আমার কোনওকালেই যায়নি, নিজেকে আধুনিক বলে দাবি করি বটে, কিন্তু কতোটা কে জানে? চোখবন্ধ অবস্থাতেই ফুপুদের ঘাটে নৌকো ভেড়ে, মা তার কোল থেকে পা নামিয়ে দিলেই বুঝি ঘাট এসে গেছে। পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে নেমে পড়ি ফুপুদের ঘাটে। তারপর শোরগোল পড়ে, সবার আগে ফুপু বেরিয়ে আসেন, অন্ধকারে চোখে ভালো দেখতে পান না, দিনের আলোতেই দেখেন না, তার আবার অন্ধকার। তারপরও অভ্যেসের বসে ঠিকই ঘাটের পথ চিনে এগুতে থাকেন। “ওরে আমার দরদীরা আইছেরে, আমার দরদীরা আইছে। ও জবেদা চুলায় এট্টু পানি উডাইয়া দে, চা বানা” Ñ বলতে বলতে ফুপু এগিয়ে আসেন। আমিও সবার আগে দৌঁড়ে যাই ফুপুর কাছে। ঝাপটে ধরি ফুপুকে, ফুপুর শরীরে চুলপেড়ে তাঁতের কাপড়, নরোম, ফুপুর শরীরের মতোই। সেই শাড়িতে আশ্চর্য এক গন্ধ, তুলতুলে, কেমন যেনো। আমি নাক ডুবিয়ে থাকি, ফুপু চোখেমুখেচুলে হাত বুলিয়ে দেন। খসখসা হাত, মাঝে মাঝে বোধ হয় কিছুতে কেটে টেটে গিয়ে থাকবে, শুকনো চামড়ায় আমার মুখে খোঁচা লাগে, কিন্তু আমার ভালো লাগে ফুপুর হাত বুলোনো। মনে হয়, সময়টা থেমে যাক, আরও কিছুক্ষণ হাত বুলোন ফুপু আমার শরীরে।

তারপর মা চলে আসেন, মা এসে ফুপুকে জড়িয়ে ধরেন। “কেমন আছেন বুজি?”
ঃ বালো আছি মাইজ্যা বউ, বালো আছি। তোমরা কেমুন আছো? বাড়ির হ¹ুলি কেমুন আছে?
এরপর বেশ কিছুক্ষণ কুশল বিনিময় হয়, হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির ভেতর অবদি পৌঁছেও চলে সেসব কথা। আমি ধরে থাকি ফুপুর হাত, কখনও আঁচল। ফুপুর ব্লাউজবিহীন শাড়ী, কুঁচকানো ঝুলে থাকা চামড়া সব ধরি, মাঝখানে কিছুদিন ধরা হয়নি বলে এগুলোকে ধরতে অনভ্যস্ত লাগে কিন্তু বেশ লাগে। তারপর বারান্দায় বসে চলে গপ্প। কতো ধরনের গপ্প, তার শেষ নেই। খবর নেওয়া, খবর দেওয়া, আশেপাশের গ্রাম কিংবা পাশের থানারও গল্প শোনা হয়। গল্পের মধ্যে চা আসে, অনেক দুধের অনেক গুড়ের মিষ্টি চা। আমার মা চা খান কম লিকার, কম মিষ্টি, কম দুধে কিন্তু এ বাড়িতে এলে ওই চা-ই সুন্দর করে চুমুক দেন। চায়ের সঙ্গে বেশিরভাগ সময়ই মুড়ি থাকে, মায়ের নিষেধ চায়ের মধ্যে মুড়ি ভিজিয়ে খাওয়া যাবে না। কিন্তু ফুপু বাড়ি বলে কথা, আমি সেসব নিষেধের কিছুই মনে রাখি না। দেই চায়ের মধ্যে মুড়ি ঢেলে, বিজবিজ শব্দ হয় মুড়ি ভেজার, তারপর শব্দ বন্ধ হলে আমি চামচ দিয়ে মুড়ি তুলে তুলে খাই মিষ্টি আর একেবারে ভাতের মতো নরোম, মুখে দিলেই গলে যায়।

চা শেষ হওয়ার আগেই ফুপু আমার হাতে হয় গাছের পাকা বিচিকলা কিংবা পেয়ারা তুলে দেন। আমি সেগুলো হাতে নিয়েই বসে থাকি, ওগুলো খাওয়ার চেয়ে সবার গল্প শুনতেই আমার বেশি ভালো লাগে। আমি জেনে যাই, ফুপুর মেজ মেয়ে জোবেদা বুজির ছাড়াছাড়ির মামলা শেষ হয়ে গেছে। জোবেদা বুজি তার ছেলে ইলিয়াসকে নিয়ে এই বাড়িতে পাকাপাকি চলে আসবে, যদিও বিয়ের পর মাত্র মাস কয়েক জোবেদা বুজি তার শ্বশুর বাড়ি ছিলেন, ইলিয়াস পেটে আসার পরেই তিনি সেই যে এই বাড়িতে এলেন আর যাননি। এখন তো ছাড়ানই হয়ে গেলো, ছাড়ান মানে যে তালাক হয়ে যাওয়া সেটাও তখনই আমি জানতাম। ফিসফিস করে ফুপু মায়ের কানের কাছে মুখ এনে বলেন, “আরে বিডার দোষ আছিলো, এক মাগিতে ওইতো না”।
হারিকেনের সামান্য আলোয় মা আমার দিকে তাকাতেন, দেখতেন আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে গল্প শুনছি। কিন্তু মা কখনওই বলতেন না যে, বড়দের কথা শুনতে নেই। আমি শুনতাম, যা বুঝতাম তা নিজেই, যা বুঝতাম না তাও নিজেই। এর কোনও দায়-দায়িত্ব আর কেউ বিশেষ করে মাতো কখনওই নিতেন না।

জোবেদা বুজি ততোক্ষণে রান্না ঘরে গিয়ে হয় নতুন করে কিছু রান্না করতে বসেছেন, বেশিরভাগ সময়ই সেই রাতে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুতে যাওয়া কোনও মুরগিকে ঘুম থেকে টেনে তুলে এনে জবাই করা হতো। মায়ের শত নিষেধ অমান্য করেও তাড়াহুড়ো করে রান্না হতো ঘন্টাখানেকের মধ্যেই। তারপর সেই মোটা মোট ইরি-ভাত আর মুরগির ঝোল খেতে বসতাম আমরা কুপি জ্বালিয়ে। তখনও মুরগির রাণটি ছিঁড়তে আমার জান বেরুতো। বাড়িতে আমরা সব সময় লাল রঙের লক্ষ্মীদীঘা ধানের ভাত খাই, তাই সাদা আর মোটা ইরি ভাত দেখতে ও খেতে একটু ভিন্নরকম লাগতো। দাঁতের নীচে ভাতগুলিকে বিশাল মনে হতো, আর সেই সঙ্গে ঝাল, যা আমার জন্য সম্পূর্ণ নতুন কারণ আমাদের বাড়িতে রান্নায় মা কাঁচা মরিচ সামান্য ফেঁড়ে ঝোলের মধ্যে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই আবার তুলে ফেলতেন। এতে নাকি তরকারীতে কাঁচা মরিচের সুন্দর গন্ধ হয় কিন্তু ঝাল হয় না। কিন্তু ফুপু বাড়ির ঝাল দিব্যি মা খেতেন, শুধু আমাকেই মাংসটা ধুয়ে দিতে হতো, পরে অবশ্য আমিও ফুপু বাড়ির ঝাল খেতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম, যখন শুকনোর দিনে একা একা ফুপু বাড়িতে আসা শিখে গিয়েছিলাম তখন তো দিনের পর দিন থাকতাম এই বাড়িতে, তখন এই বাড়ির ইরিভাত আর ঝালও আমার কাছে আর নতুন কিছু ছিল না। অনভ্যস্ততায় অভ্যস্ত হওয়ার পাঠ সেই থেকেই মনে হয়।

যদিও আমার কাছে সেই মুরগির মাংসের চেয়ে ফুপু বাড়ির দুপুরের রান্না ভাজি, শুকনো ডাল কিংবা গুড়ো মাছের চর্চরিই মজা লাগতো বেশি কিন্তু তা মুখে দিলে আমার এমনিতেই কান্না পেয়ে যেতো, এতো ঝাল। তাও খেতাম, মুখচোখ বন্ধ করে গিলে ফেলতাম। না পারলে ওদের বেড়ালকে দিয়ে দিতাম, জানতাম বেড়াল শুধু ভাজি কিংবা ডাল দিয়ে মাখা ভাত খায় না, মাছ কিংবা মাংসের গন্ধ থাকতে হয়। গুড়ো মাছ কিংবা মাংসের টুকরো থেকে ছিঁড়ে বেড়ালকে ভাত মেখে দিতাম। ওদের বেড়ালকে খেতে দেওয়ার জন্য সুন্দর আর ছোট্ট একটা টেবিল ছিল, ঠিক বেড়াল বসলে যে উচ্চতায় মুখ থাকে সেই উচ্চতার টেবিলটি। আমাদের বাড়িতেও ছিল, কিন্তু ওদের টেবিলটা বেশি সুন্দর, আমার ফুপার হাতের কাজ। ফুপা বেঁচে থাকতে নিজের হাতে এরকম অনেক কাজ করে গিয়েছেন, যা সারা বাড়ি ছড়িয়ে আছে। আমার মনে হতো, ফুপাও বোধ হয় কোথাও আছেন, বেড়ালকে খেতে দেওয়া ওই টেবিলটির মতো, কোথাও। আমার সামান্য ভয় লাগতো, কারণ গেল কার্তিকেই ফুপা মারা গিয়েছেন। গাবতলার খালের পাশেই ফুপুদের যে ভিটা সেখানেই ফুপার কবর, পাশে ফুপুর জন্যও জায়গা রাখা হয়েছে। ওই ভিটার পাশ দিয়ে আসার সময় এসব কারণেও আমার চোখ বন্ধ থাকে।
আমার ফুপার মৃত্যুদিনটি আমার স্পষ্ট মনে আছে। কার্তিক মাস, আমন ধান তখনও পাকেনি। পানিতে টান ধরেছে, চক থেকে খাল দিয়ে পানি নদীতে নেমে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও পানি টেনে গিয়ে জমি জেগে উঠছে কিন্তু পুরোপুরি নয়, স্বচ্ছ জলের তলায় জমির বুক দেখা যায়। এরকমই একদিন আমাদের বাড়ির ঘাটে নৌকো ভিড়লো, আমার ফুপা দো-মাল্লাই নৌকো পাঠিয়েছেন, আমার মাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এরকম প্রতি বর্ষাতেই ফুপা নৌকো পাঠান মাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই বর্ষাতেও এসেছিল, আবার কার্তিক মাসে নৌকো আসাতে মা মনে হয় মনে মনে একটু বিরক্তই হয়েছিলেন। কারণ আর কিছুদিন পরেই ধান উঠবে, কতো কাজ বাকি। সারা বর্ষায় গোটা বাড়ি ছেয়ে গেছে আগাছায়, সব পরিষ্কার করতে হবে। পালা দেওয়া পাটখড়ি শুকিয়ে নতুন করে পালা দিতে হবে। দু’দু’টো উঠোন পরিষ্কার করে একেবারে নিপাট করে লেপে রাখতে হবে যাতে ধান ছিটে দুর্বাবনে না যায়। দুর্বাবনে ধান গেলে সেখান থেকে কোনও শলা দিয়েই তা বের করা সম্ভব না। কতো কাজ চারদিকে, আর এমন সময় কিনা দুলাভাই নৌকো পাঠালেন? মা নিজের মনে নিজেই কথা বলেন। আমি শুনে ফেলি, কোনও ভাবে হয়তো।

কিন্তু নৌকো নিয়ে যে এসেছে তার মুখে শোনা গেলো, ফুপার শরীর খুব খারাপ, মরার আগে মাইজ্যা বউকে দেখতে চান তিনি। আমার মা তাড়াতাড়ি গোছগাছ করেন। আমাদের ঘরে সারা বছর ঘি করা হয়, একটা বড় কাঁচের বয়ামে ভরা থাকে, সেখান থেকে আরেক বয়ামে ঘি নেন; নিজেদের ছাড়াও পাড়ার কয়েকজনের গাইয়ের দুধ এনে একটা পেতলের কলস ভরা হয়; ঘরে চালকুমড়োর মোরব্বা ছিল তাও একটা বাটিতে নেওয়া হয়; দু’টো পাকা শশা ঝুলছিল উঠোনের একপাশে মাচায়, চুন দিয়ে রঙ করা, কিন্তু শশার শরীরের যেখান থেকে চুন উঠে গেছে সেখানে হলুদ রঙ ধরেছে বোঝা যায়, একটা শশা কেটে এনে নৌকায় তোলা হয়। তার আগে অবশ্য মা আমার আর সব চাচীদেরও বলেন যাওয়ার জন্য। তাদের কেউই তেমন গা করেন না, একমাত্র আমার সেজ চাচার বড় বউ ছাড়া, তার কোনও কাজ নেই, সারাদিন তিনি এবাড়ি ওবাড়ি ঘোরেন, ছোট দুই বউ বাড়ির সব কাজ করেন। তাই তিনি তার পরনের কাপড়টা বদলে একটা “উঠানো” শাড়ি নামিয়ে সেটা পরে মায়ের সঙ্গে নৌকোয় ওঠেন।
আমরা যখন পৌঁছাই তখন সন্ধ্যা হবো হবো করছে, কার্ত্তিক মাসের বেলা নেমে যায় যায় অবস্থা। ঘাট থেকে নেমেই আমরা ফুপাকে দেখতে গেলাম দৌঁড়ে, কিসের কি, ফুপা দিব্যি সুস্থ, কথা বলছেন, হুক্কা টানছেন, চাল বরাবার ধোয়া যাচ্ছে। আমার থুঁতনি নেড়ে বললেন, “কি গো শাশুড়ি আম্মা কেমন আছেন?”

আমার ফুপা কেন যেনো আমায় শাশুড়ি বলে ডাকতেন, আমি লজ্জা পেতাম, সেদিনও লজ্জায় লাল হয়ে সরে গেলাম। যতোটুকু আকাঙ্খা নিয়ে নৌকো থেকে নেমে দৌঁড়ে ফুপার কাছে এসেছিলাম ঠিক ততোটুকুই লজ্জা নিয়ে সরে গেলাম। ঠিক সেই সময় নৌকোর মাঝি এসে সামনে দাঁড়ালেন। বললেন, “এখন তো যাইতি হয় ডিলার সাব”। ফুপা কোনও এক সময় পাকিস্তান সরকারের রেশনের ডিলার ছিলেন। আমার সে কথা বা ইতিহাস জানা নেই।
ফুপা বললেন, “আরে মিয়া যাবা কুহানে, রাইতটা থাকো, খাওয়া-দাওয়া করো, মাইজ্যা বউর হাতের রান্নাতো খাও নাই, খাইয়া দেহো, কোনও দিন ভুলবার পারবা না। খাইয়া-দাইয়া নৌকায় ঘুমাইয়া থাহো, কাইল সন্ধ্যা নাগাদ আবার এগোরে ফিরাইয়া দিয়া তোমার দায়িত্ব শেষ। তয় তার আগে তোমার পাওনাডা মিডাইয়া দিয়া যাই, কাইলতো আর আমার সুময় অবে নানে। সব কাম আইজই শেষ করতে অবে, বুঝলা। এ ইডা, তবিলডা আইনা দে দি”।
কে যেনো ফুপাকে তহবিল এনে দিলো, ফুপা সেখান থেকে টাকা বের করে দিলেন মাঝিকে। তারপর জোবেদা বুজিকে হাঁক দিলেন, “এ রান্নার জুগাড় কর। মাইজ্যা বউ রানবে। ও মাইজ্যা বউ, তোমার যা ইচ্ছা রান্ধ, আমারে যা যা খাওয়াবার চাও আইজ খাওয়াও, কাইল আর আমি থাকবো না। আমার ডাক আইছে, এই জীবনে আর সুযোগ পাবা না আমারে খাওয়াবার”Ñ ফুপা খুব স্বাভাবিক স্বরেই কথাগুলো বলেন। কিন্তু সারা বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যায়। ফুপু কাঁদেন, জোবেদা বুজি কাঁদেন, জোবেদা বুজির বড় বোন হাজেরা বুজি কাঁদেন Ñ সবাই কাঁদে।
মা বলেন, “এই সব কি কথা দুলাভাই? ফাইজলামির একটা শেষ আছে না?”
ঃ আরে মাইজ্যা বউ তোমার সাথে নয় ফাইজলামি করবার পারি কিন্তু ওগো সাথে কি আর ফাইজলামি করা যায়? আমি সত্যি কথা কই, আমার আর সময় নাই। আমার শরীরে বিষ-ব্যাথা কিছুই নাই, বুঝলা? Ñ ফুপার বলার মধ্যে কি ছিল কে জানে, মা উঠে রান্না ঘরের দিকে যান। তারপর শুরু করেন রান্না। অনেকগুলো পদ করেন সেদিন। সবশেষে পাকা শঁষা দিয়ে পায়েস রান্না করেন, সঙ্গে নিয়ে আসা দুধ দিয়ে। পুলাও করেন, নিজের হাতের ঘি দিয়ে। রঙহীন জর্দা করেন, ফুপা জর্দা পছন্দ করেন বলে। সঙ্গে দু’টো হাঁস রান্না করেন, নারকেল বাঁটা দিয়ে, ফুপার সবচেয়ে পছন্দের খাবার।
তারপর ফুপাকে খাওয়াতে বসেন, কিন্তু সেদিন ফুপার কি হয় কে জানে, একা খাবেন না বলে বায়না ধরেন। সবাইকে বসতে হবে তার সঙ্গে। আমরা সবাই বসি, আমি শুধু শঁশার পায়েস খাই আর জর্দা খাই, আর কিছু খাই না। মিষ্টি হলে আমার আর কোনও কিছুই মুখে রোচে না। ঝাল তখন ছুঁতেও ইচ্ছে করে না। অবশ্য এখন অভ্যেসটা বদলে গেছে। কতো কিছুই যে বদলে গেছে তার কি শেষ আছে? বদলে যাওয়াই বোধ হয় বলে, আমি বেঁচে আছি।

খাওয়ার পরে ফুপা কাউকে ঘুমাতে দেন না, গল্প করেন, করতেই থাকেন। অনেক রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায় শব্দে, ফুপা কেমন যেন করছেন, কী সব বলছেন। ভাদ্র মাসে পাট রোদ দেওয়ার জন্য সারা বাড়িভর্তি বাঁশের আড়া টাঙানো, এখনও খোলা হয়নি। ফুপা বলেন কারা নাকি ওই টাঙানো বাঁশের ওপর বসে আছেন, তারা এসেছেন ফুপাকে নিয়ে যেতে। ফুপাও তৈরি যাওয়ার জন্য কিন্তু ভয় লাগছে, কবে কখন কাকে একটু ঠকিয়েছিলেন সেসব নাকি মনে পড়ছে। ফুপাদের পাশের বাড়ির মাওলানা সাহেবকে বললেন তওবা পড়ানোর জন্য। ফুপাকে তওবা পড়ানো হলো, সবাই কাঁদছে, কিন্তু ফুপা কীসব বলেই যাচ্ছেন। আমি জেগে যাচ্ছি, আবার ঘুমিয়ে পড়ছি, বারান্দাতেই মাদুর পাতা, সেখানেই বসে বসে গল্প শুনছিলাম, সেখানেই ঘুমিয়ে গেছি। আবার জেগেছি, তারপর আর ঘুমাইনি। কারণ শেষবার জেগে শুনেছিলাম ফুপা মারা গেছেন।

সারারাত কেউই ঘুমায়নি, ফজরের নামাজ পড়েই সবাই লেগে গেছেন ফুপার কবর খুঁড়তে, কার্ত্তিক মাস, তখনও গাবতলার খালের পানি শুকোয়নি। এমনকি সেবার প্রায় ফুপুদের ভিটার ওপরেই পানি উঠে গিয়েছিল। তাও সবাই হাঁটু পানি ঠেলেই ভিটেয় গিয়ে কবর খুড়লো, একটুখানি খুড়তেই পানি এসে যাচ্ছে কবরের ভেতর। সেই পানি আবার সেঁচে ফেলা হচ্ছে, তারপর কবর খোঁড়া শেষ হলো।

ফুপুদের ভিটের যে কাঁঠাল গাছটায় মাটির নীচে শেকড়ে কাঁঠাল ধরে আর শেয়ালে শুঁকে শুঁকে গর্ত করে পাকা কাঁঠাল বের করার ব্যর্থ চেষ্টা করে আর আমার ফুপু সেই গর্ত দেখেই বুঝতে পারেন মাটির নীচে কাঁঠাল পেকেছে, যদিও সেই পাকা কাঁঠালে কোয়া হয় মাত্র পাঁচ থেকে দশটি, কিন্তু কী যে তার স্বাদ, কী যে তার সুগন্ধ Ñ সেই কাঁঠাল গাছটি থেমে মাত্র কয়েক হাত দূরেই ফুপার কবর খোঁড়া হলো। হাঁটু পানি ঠেঙিয়ে আমি সেই ভিটেয় যাইনি, কিন্তু ফুপুদের বাড়ির পশ্চিম পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি কবর খোঁড়া, লোকেদের কথাবার্তাও শুনেছি। কবর খোঁড়া শেষ হলেই জানাজা হলো ফুপুদের উঠোনেই কারণ চারদিকে পানি, মসজিদের ভিটের ওপর হাঁটু পানি, সেখানে জানাজা সম্ভব নয় তাই উঠোনেই হলো। তারপর ফুপাকে নিয়ে যাওয়া হলো ভিটেয়, সেখান থেকে ফুপা আর এলেন না। আমার চোখে লেগে রইলো ফুপাকে কবরে নামানোর দৃশ্য। সাদা কাফনে মোড়া একজন মানুষ, তার পাশেই সদ্য খোঁড়া মাটির ওপর আগর বাতি থেকে ধূয়া বেরুচ্ছেÑ এটুকুই শুধু আমি মনে করতে পারি।
নাহ্ আরও মনে আছে, আমরা সেই নৌকোতেই ফিরে এসেছিলাম, যদিও আমাদের বাড়ি থেকে পরের দিন সকালে অনেকেই এসেছিলেন। আমার চাচারা, চাচীরা, পাড়া-প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়-স্বজনরা। আসার সময় নৌকোয় শুধু আমি মা আর সেজ চাচি ছিলাম কিন্তু ফিরে যাওয়ার সময় আমাদের নৌকো ভরা ছিল মানুষ। কে কে ছিল বলতে পারবো না, শুধু নড়তে-চড়তে অসুবিধে হচ্ছিলো। কিন্তু কিছুদূর আসার পরই ভ’ঁইমালীর বিলের স্বল্প পানিতে নৌকো ঠেকে যাচ্ছিলো বলে অনেককেই নামতে হলো। কেউ কেউ নৌকো থেকে নেমেই আবিষ্কার করলো যে, ভুঁইমালীর বিল ভর্তি বড় বড় শালুক, পায়ে ইঁটের শুরকির মতো বিঁধছে। কেউ কেউ দু’একটা তুলেও ফেললো, তারপর অনেকেই নেমে গেলো নৌকো থেকে, শালুক তুলতে। নৌকোর ভারও কমে গেলো, নৌকো চলতে শুরু করলো, কিন্তু খুব ধীরে, কারণ যাত্রীরা শালুক তুলছে নৌকোর পাশে পাশে হেঁটে হেঁটে। আমার মা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, দেখছিলেন আমি নামতে চাই কি না, মায়ের চোখ লাল, ফোলা ফোলা মুখ কেমন যেন গম্ভীর, আমার ইচ্ছে থাকলেও আমি নামিনি, অবশ্য বড়দের হাঁটু পানি মানে আমার সেখানে বুক-জল। জলে আমার বড্ড ভয়, আমি এমনিতেও নামতাম না। কিন্তু আমার আশ্চর্য লেগেছিল খুব, মনে হচ্ছিলো, একজন মানুষকে এই সকালেই কবর দিয়ে আসা হয়েছে, তিনি চলে গেছেন, সেটা যেমন সত্য তেমনই এই এদের, আমাদের সঙ্গের যাত্রীদের এই ভ’ঁইমালীর বিলে শালুক তোলাটাও একই সঙ্গে সত্য Ñ কিন্তু দু’টো সত্য দুই রকমের।

এরপর ফুপু বাড়ি এলেই ফুপার গল্প হয়, সদ্য মৃতের গল্প মানুষ করে খুব, ধীরে ধীরে মৃৃতের বয়স বাড়ে, মৃত্যুদিবস পেছাতে থাকে আর গল্পও কমে যায়। সেই রাতেও খাওয়া হয়ে গেলে শুরু হলো চা-পান খাওয়া-পর্ব। মা পান খান, সঙ্গেই থাকে। মায়ের জর্দা সবার পানের সঙ্গে মিশতো। তারপর গল্প হলো ফুপার, সঙ্গে আবার চা। চা শেষ হলে আমরা বিদায় নেই। এবার আমাদের সঙ্গে ফুপু। এমন কোনও দিনই হয়নি যে, আমরা ফুপু বাড়ি গিয়েছি আর ফেরার সময় ফুপুকে ছাড়া ফিরে এসেছি। এমনও হয়েছে যে, ফুপু মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে আমাদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ফিরেছেন, এক সপ্তাহ পরেই আমি হয়তো গিয়েছি ফুপু বাড়ি, একদিন কি দু’দিন থেকে ফুপুকে আবার সঙ্গে নিয়ে ফিরেছি। ফুপা মারা যাওয়ার পর ফুপুর বোধ হয় ওই বাড়িতে ভালো লাগতো কিংবা এরকমও হতে পারে বাপের বাড়িতে বার বার যেতে বোধ হয় সব মেয়েরই খুব ভালো লাগে, তা দশ বছরের কিশোরী-বউই হোক আর আমার ফুপুর মতো সত্তর বছরের বৃদ্ধাই হোন Ñ বাপের বাড়ির গন্ধই মনে হয় ভিন্ন।

ফেরার সময় আকাশ আরও স্বচ্ছ, আরও তারা। চারদিকে চকচক করছে জ্যোছনা, অনেক দূরের সবকিছুও স্পষ্ট দেখা যায়। এবার আমরা নদী নয়, চক দিয়ে ফিরে আসি, কারণ গভীর রাতে নদী দিয়ে ডাকাতের নৌকো যায়, যদি সেরকম কোনও নৌকোর সামনে পড়ি? নদীর পারে যাদের বাড়ি তারা তাই সারা বর্ষা বাড়ি পাহাড়া দেওয়ার জন্য দূরের আত্মীয়কেও নাইওর এনে রাখেন। শুধু নদীর পারে যাদের বাড়ি তাদের কথা বলছি কেন, আমাদের বাড়ি তো নদী থেকে বেশ দূরে কিন্তু আমাদেরও ভরা বর্ষায় সারারাত বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য মানুষজন জোগাড় করে রাখতে হয়। আমার মতো সারা বর্ষা লোকজন খাওয়াতে খাওয়াতেই কাটিয়ে দেন, বেতন দিয়ে তো আর এতো মানুষ রাখা সম্ভব না, তাই খাইয়ে-দাইয়ে, লুডু কিংবা কেরামবোর্ড কিনে দিয়ে সবাইকে জাগিয়ে রেখে মা নিজেও ঘুমান না সারা বর্ষা।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমি ঘুমে কাঁদা, একেবারে বাড়ির ঘাটে এলে আমাকে তোলা হয়। চোখ চেয়ে দেখেছিলাম হয়তো মাণিকদীর খাল, কিন্তু চোখ খুলে বাড়ির ঘাট দেখে অবাক হয়ে যাই, কী করে চোখের পলকে এতোটা পথ ইদ্রিস ভাইজান আর বতু দাদা পাড়ি দিয়ে এলেন সেটা ভেবে বিস্ময় লাগে কিন্তু বিস্ময়ের সুযোগ থাকে না, ঘাট থেকে ঘর ও বিছানা পর্যন্ত আসতে আসতে সেসব বিস্ময় উবে যায়, আমি আবার ঘুমে তলিয়ে যাই। পরের দিন আর সেসব কিছুই মনে থাকে না।

একটা বালিশ তৈরির কাহিনী বলতে গিয়ে এক বর্ষার গল্প বলে ফেললাম।


মন্তব্য

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍বর্ষা ও বালিশের গল্প নাম দিয়ে একখানা উপন্যাস নামিয়ে ফেলুন হাসি

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
নিজেকে জয় করার অর্থ বিজয় না পরাজয়? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

নন্দিনী এর ছবি

লেখাটার সারা শরীরে অদ্ভুত এক হাহাকার ছড়িয়ে আছে ! মন ছূঁয়ে
যায় ...

নন্দিনী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।