একুশ শতকের এক কিশোরীর জন্য বৈশাখী মায়াকান্না

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: মঙ্গল, ১৫/০৪/২০০৮ - ১২:২৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজকাল আমাকে স্মৃতি-ভাইরাসে পেয়ে বসে আকছার।মাঝে মাঝে মনে হয়, নিযুত মাইল দীর্ঘ এক পথ ফেলে এসেছি পেছনে।যে পথের প্রতিটি ধূলিকণা এখন স্মৃতি-ভাইরাস হয়ে আমায় ক্রমাগত আক্রমণ করে চলেছে। আমি যেনো এই ভাইরাসের দ্বারা সৃষ্ট স্মৃতি-জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ক্রমাগত ভুল বকে চলেছি, ভুল ভেবে চলেছি। নইলে, আজকাল যাকে মানুষ আধুনিকতা হিসেবে গেলানোর চেষ্টা করছে, আমি কেন তা গিলতে পারছি না? কেন আমার বুকের কাছে এইসব তথাকথিত আধুনিকতা কঠিন শিলাখণ্ডের মতো আঁটকে আছে? তবে কি এই যুগ, এই যান্ত্রিকতার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণই বেমানান?
সত্তরের দশকের প্রথম ভাগে আমার জন্ম, স্বাধীন দেশের বয়স সবে মাত্র দু’বছর। হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগুচ্ছে দেশ। জন্মের প্রথম পাঁচ বছরের কথা বাদ দিচ্ছি, কেউ হয়তো বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমার এই সময়ের স্মৃতিও মনে আছে। সেই বিতর্কে না যাই, মানুষের স্বাভাবিক মনে থাকার বয়স থেকেই শুরু করি।
আক্ষরিক অর্থেই একটি গণ্ড গ্রাম। শহুরে জীবনের প্রধানতম উপকরণ বৈদ্যুতিক বাতি যে গ্রাম থেকে গ্রীস্মে পাঁচ মাইল পায়ে হাঁটা পথ, আর বর্ষায় ঘন্টা তিনেকের নৌকো যাত্রা-পথ দূরত্বে।উত্তর দক্ষিণে দীঘল এই গ্রামের পাশ দিয়ে ছোট্ট খাল, কেউ বলে ব্রিটিশ আমলের, কেউ বা বলে তারও আগে। তবে আমার মনে হয়, এককালে কুমার নদের শাখা ছিল এটি, কারণ এই খাল-পথেই বর্ষায় ইঁট-বালু-সুঁরকি এনে আলগী গ্রামের জমিদার-বাড়ি, বাড়ুজ্যে-বাড়ি, দত্ত-বাড়ি, সমাদ্দার-বাড়ি, পাঠক-বাড়ি, নাট-মন্দির, বানার মাঠের পাশে স্থায়ী পূজো মণ্ডপ নির্মিত হয়েছিল।তখন হয়তো গ্রীস্মেও এই কুমার নদের শাখা নদীতে নৌকো চলতো, বাবুরা তখন নিশ্চয়ই পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতেন না। আমি মাঝে মাঝেই চোখ মুদে সেইসব দিনে চলে যাই; সে অবশ্য আমার মন ময়ূরীরের পাখা-ঝাপ্‌টানো ওড়াউড়ি, সে কথা অন্যদিন। আজকে আপনাদের বৈশাখের কথা বলি।
আমার জন্মের পর যে চৈত্র মাসের কথা আমার খুব ভয়ঙ্করভাবে মনে
আমার জন্মের পর সেই চৈত্রের কথা আমার ভয়ঙ্করভাবে মনে পড়ে, যে চৈত্রে আমার প্রিয় খেলার সাথী শামেলা কলেরায় মারা গিয়েছিল। ফাল্‌গুনের শেষেই শুরু হতো ভয়টা, চৈত্রে তখন মানুষ পুড়ছে, মাঠ পুড়ছে, গাছ-গাছালি পুড়ে যাচ্ছে অভাগার মতো। যদিও চৈতালী উঠে যাওয়ায় মাঠ তখন ফাঁকা।চষা মাটির লাঙল-চেরা বুকের ভেতর দিয়ে সেঁধিয়ে যাচ্ছে সূর্য, যেনো শেষাবধি পুড়িয়ে ছাড়বে। আর তখন গ্রামের পুকুরগুলির তলায়ও সূর্য পৌঁছে যাওয়ায় তলা থেকে সাদাপানা থোকা থোকা বুদ্বুদ বুক সমান পানির ওপরে ভাসতে শুরু করতো। স্নানের পানি তো দূরের কথা খাবার পানিও পাওয়া দুষ্কর। পাঠক-দীঘিতে ঠাসা কচুরি দাম, পানির ওপরে যতোদূর ডাল-পাতা, পানির নীচে তার চেয়েও দীর্ঘ কালো দাঁড়ি। সেই দীঘিই আলগি-বড়দিয়া জমজ গ্রামের একমাত্র জলোৎস। যদিও পাঠক পরবর্তীতে যাদের দখলে সেই বাড়িটি গিয়েছিল, তারা সেই জল নিতে গেলে কুকুর লেলিয়ে দিতো, অথচ শুনেছি, এই পাঠক-দীঘি কাটানোই হয়েছিল চৈত্রের জলকষ্ট থেকে দুই গ্রামের মানুষকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। আসলে মানুষের মুক্তি সহজে আসে না!
সেই চৈত্রেও কলেরা লাগলো চারদিকে। খা খা রোদ্দুরে মনে হয় ওলা ওঠার দেবী ন্যাংটো হয়ে চারদিকে নেচে ফিরছেন। সাঁঝ লাগলেই শুদ্র-পাড়ায় ঢোল-কাঁসর বেজে উঠতো, এয়তিরা উলুধ্বনি দিয়ে দেবীর পূজো দিতেন। আর কায়স্থ বাড়িতে পাঁচালি পাঠ করতেন এলাকার তখনও একমাত্র পূজারি বামুন, সোনা ঠাকুর। আর মুসলমান পাড়ায়, মনে আছে তারা মৌলভী ঠিক সন্ধ্যের পরেই, এশার নামাজের পর পরই, গ্রামের জওয়ান ও স্বাস্থ্যবান কয়েকজন পুরুষকে সঙ্গে নিয়ে পথে নামতেন, নির্দেশ থাকতো সন্ধ্যের পর কোনও ঘরের দরোজা খোলা থাকবে না, এমনকি কোনও জানালাও খোলা যাবে না, কারণ তারা মৌলভী কলেরার “বালা” তাড়ানো শুরু করবেন গ্রামের একমাথা থেকে, তিনি প্রতিটি বাড়ির ওপর দিয়ে যাবেন, তারপর একেবারে গ্রামের শেষপ্রান্তে যে পুরোনো শ্মশ্মান ভিটে সেইখানে প্রতি রাতে পৌঁছে দিয়ে আসবেন কলেরারা “বালা”-কে। প্রতি দুই বাড়ি অন্তর তিনি আজান দেবেন, যতোদূর সেই আজানের শব্দ পৌঁছুবে ততোদূর পর্যন্ত সরে যাবে “বালা”, কিন্তু যদি এই সময় কারো ঘরের দরোজা-জানালা খোলা থাকে তাহলে “বালা” ঢুকে পড়বে তার ঘরে, এবং সেই ঘরে কলেরা হবেই হবে। কলেরার বালা খেদানোর বিশেষ এই প্রক্রিয়ার নাম “রোন ফেরা”।
গোটা চৈত্র জুড়েই একদিকে রোন ফেরা, অন্যদিকে উলু-পাঁচালি, সোনা ঠাকুরের ওলা ওঠা দেবীকে তুষ্টু রাখার পূজো-আর্চা। যদিও প্রতিটি চৈত্রেই গ্রামের কেউ না কেউ তার প্রিয়জনকে হারাতো। হু হু সন্ধ্যে কিংবা গভীর রাতগুলো বদ্ধ ঘরের গুমোট বিছানায় ছট্‌ফট্ করে কাটতো। সেদিক দিয়ে বৈশাখ ছিল সকলের কাঙ্খিত মাস, সেটা যতোটা না বছরের প্রথম মাস হিসেবে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল চৈত্রের বিভীষিকা থেকে মুক্তি লাভের আশায়।কারণ বৈশাখের প্রথম বৃষ্টির পরই কৃষক লাঙল কাঁধে মাঠে নামবে, পেছনের একপাল ছেলেমেয়ে; আমন ধানের বীজ থাকবে “পইকায়” আর সঙ্গে কাঁসার জামবাটিতে আগের রাতে ভেজানো আলো চাল, খেজুরের গুড়, সামান্য আদাকুঁচি, আর যার বাড়িতে লেবুগাছ আছে তার বাটিতে বাড়তি কিছু লেবুপাতা, জমিতে লাঙল ছোঁয়ানোর আগে এই আলো চাল গুড় আদা ভালো করে মিশিয়ে ছেলেমেয়েদের হাতে দিয়ে তারপর লাঙল ছোঁয়ানো, শস্যদায়িনীকে শস্যেরই নৈবেদ্য।
কোনও এক বিচিত্র কারণে চৈত্রের শেষ দিন আকাশের ঈশাণ-কোণ মিসমিসে কালো রং দুপুর থেকেই গভীর থেকে গভীরতায় গিয়ে ঠেকতো। ঠিক বিকেল বেলাটায় হু হু হাওয়া উঠতো, আর তখনই দাদি-ঠাকুমা’রা বলতে শুরু করতেন, এইবার তিনি মুখ তুললেন, এই বৃষ্টিতেই ধুয়ে যাবে সব রোগ-বালাই, এইবার মুক্তি। সত্যি সত্যিই এই বৃষ্টির পরে আর কেউ কলেরায় মারা যেতো না, যতো শোক চৈত্র-সংক্রান্তির সাথেই শেষ হতো, বৈশাখ যেনো বেঁচে থাকার নতুন কোনও বার্তা নিয়ে সংক্রান্তির সেই সন্ধ্যাপ্রদীপের সঙ্গে জ্বল জ্বল করতো গৃহস্থের উঠোনে। আমি জানি না, লোকায়ত বাংলায় এই কারণেই বৈশাখকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল কি না? যদিও এখন নানা বিশেষজ্ঞ নানা প্রমাণে বৈশাখের মাহাত্ম তুলে ধরছেন, কেউ কেউ তো বৈশাখকে মুসলমানি তক্‌মা দেওয়ার জন্য বাদশাহ্ আকবরের আমলকেই এর সূচনাকাল হিসেবে চিহ্নিত করছেন, যেনো এর আগে এই জনপদে মানুষ ছিল না, তাদের লোকায়ত সংস্কৃতি বলতে কিছুই ছিল না, অথবা তাদের নতুন বছর বলেও কিছু ছিল-টিল না।
এখন ভাবলে খুব আশ্চর্য লাগে যে, এই যে ভয়াবহ চৈত্র কেটে গেলো, তারপর পহেলা বৈশাখেই যে মেলাটি আমাদের এলাকায় হতো সেখানে কী করে এতো রঙের ছড়াছড়ি সম্ভব হতো? একথা ঠিক যে, প্রতি চৈত্রেই হয়তো কলেরার মতো ভয়ঙ্কর মরণব্যাধি চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো না, কিন্তু তারপরও চৈত্র যে কতো নিদারুণ একটি মাস সেকথা গ্রামবাসী মাত্রেই জানেন। এই কষ্টের মধ্যে থেকেও পহেলা বৈশাখের জন্য রং-বেরঙের জোর প্রস্তুতি না থাকলে পহেলা বৈশাখকে এই বিচিত্রতায় সাজানো সম্ভবপর হতো না। মানুষ-চরিত্রের এই বৈপরীত্য আমাকে ভাবায় এবং একই সঙ্গে দারুণ আনন্দ দেয়। ধ্বংস এবং নির্মাণের এই পাশাপাশি অবস্থান যে জীবনের জন্য কতোটা জরুরী সেকথা জীবনকে ভালোবেসেই বুঝতে পারি। সে যাক, পহেলা বৈশাখের কথা কিছু বলে ইতি টানি।
আমাদের গাঁয়ের সবচেয়ে কাছের বৈশাখী মেলাটি হতো আশফরদি নামে একটি গ্রামের পাল-বাড়ির সামনে একটি চটান জায়গা, যার নাম নোনা-হ্রদ। কেন এই নাম জানি না, তবে গ্রামের আর কোথাও বালি না দেখলেও সেইখানে দেখতাম, পা দিয়ে একটু খুঁড়লেই দুর্বার নীচে চকচকে বালি। কে জানে হয়তো এককালে সেখানে কোনও হ্রদ থেকে থাকবে, এলাকার হিন্দুদের মতো সেই হ্রদও এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, শুধু রয়ে গেছে পাল-পাঠক-বাড়ুজ্যে-সমাদ্দার বাড়ির মতো শুধুমাত্র নামটি, নোনা হ্রদ।
পহেলা বৈশাখের সেই বিকেলে, তখনও সেই অর্থে বিকেল হয়নি, টাটকা রোদ, আকাশের ঈশাণ কোনে তখনও মেঘ জমতে শুরু করেনি, তখনই বাঁশের বাঁশিতে কে যেনো চড়া টান দিতো। আমার কাছে আজীবন বিস্ময়ের সেই সুর, আমার মন এখনও সেই অজানা বাঁশিওলার সেই চড়া টানে মজে আছে, আজ কেউ যদি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, আমি সেই বাঁশিওয়ালা, তাহলে তাকে সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারি অনায়াসে। পৃথিবীর বিখ্যাত সব সিম্ফনির সঙ্গে আমার পরবর্তীতে পরিচয় হয়েছে কিন্তু সেই বেনামি বাঁশিওয়ালাকে আমি আজও ভুলতে পারিনি। এটা আমার ব্যর্থতা না সেই বাঁশিওয়ালার স্বার্থকতা, কে বলবে?
পান্তা-ইলিশের শহুরে আধুনিকতা, আমি অবশ্যই একে অগ্রাহ্য করছিনে, কিন্তু এটা নিতান্তই নাগরিক বৈশাখী এবং বাঙালি সংস্কৃতিতে নতুনতর সংযোজন, গ্রাম্য বৈশাখীতে এই প্রচলণ ছিল না, কারণ বৈশাখে ইলিশ মাছ শহুরে অর্থের কাছে সহজলভ্য হতে পারে, গ্রামের বৈশাখী আয়োজনে তা দুষ্প্রাপ্য বৈকি। সাতান্ন-শাক দিয়ে লাব্‌ড়া, যার মধ্যে দুর্বা ঘাসও পড়তো, কিংবা নিদেন পঞ্চ-ব্যাঞ্জনই আসলে আমার দেখা গ্রামের বৈশাখে প্রধান খাবার-উপাচার, সঙ্গে গেল শীতে জমানো খেজুর গুড়ের গরম গরম পায়েস, অবশ্যই কলা পাতায় ঢেলে জুড়িয়ে তারপর চেটে-পুটে খাওয়া এবং দুপুরের রোদ মরার আগেই মেলায় পৌঁছে যাওয়া; মেলা থেকে তালপাতার বাঁশি না কিনলেও তালপাতার সেপাইয়ের সঙ্গে ফুলসুঁতির পালদের হাতে গড়া গরু-ঘোড়া কিংবা আজকালকের যীশু-মাতা মেরির আদলে পুতুল-বউ না কিনে দিলে সেই বৈশাখ আবার বৈশাখ নাকি? আহ্ ভুলেই গিয়েছিলাম, মনসার ঘটের কথা, কারা কিনে নিতো জানি না, তবে কোনও মুসলমানকে আমি কখনও কিনতে দেখিনি, কিন্তু মেলার একেবারে কোণের বটতলায় পালা করে রাখা হতো নানা মাপের মনসার ঘট, সন্ধ্যে নাগাদ যখন ঝড় উঠবে উঠবে তখন দেখতাম সেই ঘটের স্তুপ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ফেরার পথে ছোট্ট মেয়েটির হাতে চাছা বাঁশের কুলো, খালুই, মুড়ি খাওয়ার সাজি, গৃহস্থ বউয়ের ভাতের চাল মাপার জন্য বেতে তৈরি সের, মোয়া রাখার ডালা, বড়ি দেওয়ার চাটাই, মাছ ধরার ঘুনি; খোকার হাতে মাটির চাকা লাগানো রথ, টানলেই তাতে দু’দিক থেকে ঢোলে বাড়ি পড়ার মতো বাড়ি পড়ে আর ঢম ঢম বেজে ওঠে, আর অবশ্যই কলাপাতায় মোড়ানো গুড়ের সিরায় ডোবানো জিলাপি কিংবা দানাদার কিংবা কাঁচা ছানার সন্দেশ – আহ্ আমি আর লিখতে পারবো না, এখন এসব ভাবলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি, প্রচণ্ড অসুস্থ!
স্মৃতি মানুষের সবচেয়ে বড় অ-সুখ, বিবেচনা শক্তিটি জন্মানোর পর থেকে আমৃত্যু মানুষ এই অ-সুখে ভোগে।স্মৃতি এমনই এক রোগ যে, এই রোগকে সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব নয়, খুব শক্তিশালী “পেইন কিলার” দিয়েও এর কষ্টকে সামান্য লাঘব করা যায় না। একদিন হয়তো দুরারোগ্য ক্যান্সার সম্পূর্ণ নিরাময়ের ব্যবস্থা বের হবে, মানুষ দীর্ঘায়ু পাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের শনৈ শনৈ উন্নতির ফলে কিন্তু স্মৃতি-বিমারি মানুষের দীর্ঘ জীবনের সঙ্গে সবচেয়ে কষ্টদায়ক ভাইরাস হয়েই থাকবে, এর থেকে মানুষের মুক্তি নেই। জীবনের এপার থেকে ওপার পর্যন্ত, এই ভাইরাসের দুর্দমন বিচরণ।
কেন অসুস্থ হই সেকথাটি একটু বলে শেষ করি।সত্তরের দশক থেকে দু’হাজার আট সাল, তিন দশকের ব্যবধান, অথচ কতো কিছু ঘটে গেছে বাংলাদেশে। রমনার বটমূলে ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের অংশ হিসেবে যা পঞ্চাশের দশক থেকেই পালিত হয়ে আসছিলো পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, সেখানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছে, লাশ পড়েছে অনেক। পহেলা বৈশাখের শহুরেয়ানাকে রোখার চেষ্টা হয়েছে বোমার আঘাতে কিন্তু গ্রামে সেরকম কিছুই করতে হয়নি। কিছু মোল্লার বৈশাখী মেলাকে হিন্দুয়ানি বলে ফতোয়া জারি আর গ্রাম্য মাতবরদের হাত করেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে আশফরদি গ্রামের নোনা হ্রদে সেই পহেলা বৈশাখের মেলাকে। আহা এই একুশ শতকে যে মেয়েটি আমারই মতো আলগী কিংবা বড়দিয়ায় বেড়ে উঠছে সে জানতেও পারছে না যে, একদিন এই পহেলা বৈশাখে তারই মতো একটি মেয়ে এই গায়ের পথেই সাঁঝের কালে কুলো-ঢেঁকি-সাজি-মোয়া-জিলাপি-মাটির পুতুল তার আঁচল ভরে নিয়ে ধুলো উড়িয়ে বাড়ি ফিরতো, তার আলতা পরা পায়ের চিহ্ন এখন শুধুই ওই জনপদের অতীত, লোকায়ত সংস্কৃতির ফসিল। একুশ শতকের এই বাঙালি মেয়েটি সত্যিই দুর্ভাগা, নাকি আমিই হতভাগী, সংস্কৃতি-খাগী কে জানে?

(লেখাটি কলকাতার দৈনিক স্টেটসম্যান-এর জন্য লেখা)


মন্তব্য

রাহা এর ছবি

আহা এই একুশ শতকে যে মেয়েটি আমারই মতো আলগী কিংবা বড়দিয়ায় বেড়ে উঠছে সে জানতেও পারছে না যে, একদিন এই পহেলা বৈশাখে তারই মতো একটি মেয়ে এই গায়ের পথেই সাঁঝের কালে কুলো-ঢেঁকি-সাজি-মোয়া-জিলাপি-মাটির পুতুল তার আঁচল ভরে নিয়ে ধুলো উড়িয়ে বাড়ি ফিরতো, তার আলতা পরা পায়ের চিহ্ন এখন শুধুই ওই জনপদের অতীত, লোকায়ত সংস্কৃতির ফসিল
................
আপনি আসলেই ভাগ্যবান । আমরা যারা আরো পরে জন্মেছি তারা না ঘরকা না ঘাটকা । না গ্রামের হওয়া না শুহুরে ১০০ ভাগ বাবুয়ানা । মাঝে মাঝেই নিজেকে খুব অভাগা মনে হয় ।

..হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দার জলে...

হাসান মোরশেদ এর ছবি

ঠিক এরকম একটা বোধে আমি আক্রান্ত হয়েছিলাম এবারের একুশে ফেব্রুয়ারীতে । দেশে ছিলাম । টিভিতে রাজধানীর উপচে পড়া ভীড় আর বইমেলার সংস্কৃতি সংস্কৃতি প্রদর্শনী চলছিল ।
প্রশ্ন জেগেছিল দেশ্র বাকীটুকুতে,বিশেষ করে গ্রামগুলোতে একুশ পালনের কি অবস্থা?
শৈশবে একেবারে প্রান্তিক গ্রামে ও শহীদ মিনার দেখেছি । একটু বড় হবার পর অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি ,সেই ১৯৫২'র ফেব্রুয়ারীর একুশ তারিখের প্রভাবটা আসলে কতো বিশাল ছিলো । ঢাকার রাজপথে গুলী হলো, সুনামগঞ্জের কোন এক দুরবর্তী গ্রামে শহীদ মিনার গড়ে উঠলো । চেতনার প্লাবনটা কতো তীব্র হলে অধিকতর ধর্মান্ধ সেই সময়ে ও মানুষ শহীদ মিনার তৈরী করেছে, নির্মিত মিনারে ফুল দিয়েছে ।

রাজধানী বসে যারা দেশের সাংস্কৃতিক অভিভাবকত্ব করেন,তারা কি খবর রাখেন ৫৫ বছর পর সেই শহীদ মিনার আর আছে কিনা কিংবা থাকলে শহীদ মিনারে ফুল দেবার মতো সাংস্কৃতিক বোধটুকু গ্রামের মানুষের অবশিষ্ট আছে কিনা?

xxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxx
...অথবা সময় ছিলো;আমারই অস্তিত্ব ছিলোনা

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

পুতুল এর ছবি

বাশীঁ কৈ আগের মত বাজে না!
পান্তা ইলিশ সত্যিই একটু বেমানান।
অনেক কথা মনে পড়ল আপনার লেখা পড়ে। এমন করে বেদন দেবার জন্য ধন্যবাদ।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

অন্দ্রিলা এর ছবি

শুরুতে লেখাটা পড়ে আপনাকে ভয়ংকর, ভয়ংকর ঈর্ষা হচ্ছিল। কিন্তু শেষটায় এসে চোখে জল চলে আসলো। অসংখ্য ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।