অনুস্মিতা

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: সোম, ২১/০৪/২০০৮ - ৯:৪৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হ্যাঁ, বলুন।
কী বলবো?
যা ইচ্ছে, আপনার যা বলতে ইচ্ছে করবে বলুন। আমিতো আপনার কথা শোনার জন্যই।
হ্যাঁ, জানি, কিন্তু কিছুই মনে আসছে না, কী বলবো বলুনতো? কোত্থেকে শুরু করবো?
আপনার যেখান থেকে ইচ্ছে। অথবা আপনি কথা বলতে না চাইলেও অসুবিধে নেই।
নাহ্ নাহ্ কথা বলতেই তো আসা। আমি নিজেকে বদলাতে চাই, কী করে বদলাবো বলুনতো, আপনার সাহায্য চাই।
নিজেকে বদলাতে চান কেন? তাছাড়া, নিজেকে সম্পূর্ণ পাল্টে ফ্যালা যায় না কি?
কী জানি, যায় হয়তো। আমাকে চেষ্টা করতে হবে। আমি চেষ্টা করতে চাই।
আচ্ছা করুন। কী দিয়ে শুরু করতে চান এই বদলানো?
সেটাইতো জানি না, ঠিক আছে, আগে আমার সম্পর্কে আপনাকে কিছু বলে নিই, তারপর আপনিই না হয় বলুন, কোত্থেকে বদলটা শুরু করবো।
বলুন, আপনার সম্পর্কে শুনি।
আরেক কাজ করলে হয় না, আপনি আপনি আমাকে প্রশ্ন করুন, আর আমি উত্তর দিযে যাই। তারপর একসময় দেখবেন আমি ঠিক নিজেই শুরু করবো বলা, আপনাকে আর প্রশ্ন করতে হবে না।
ঠিক আছে। আপনার নাম দিয়েই শুরু করুন, কি নাম আপনার?
শিহাব উদ্দিন, বাড়িতে সবাই ডাকে, শিহাব বলে।
বাহ্ সুন্দর নাম, শিহাব শব্দের অর্থ কি, জানেন?
নাহ্‌তো, জানি না। দেখেছেন নিজের নামের অর্থটাই জানা হয়নি আজ অবধি, এতো বয়েস হয়ে গেলো, অথচ আমার নামের অর্থ জানিনি, কখনও জানতে চাইনি। আমার কি তবে জানার আগ্রহটাই কম? জানি না।
কতো হলো আপনার বয়েস?
আগামি নভেম্বরে বেয়াল্লিশ হবে। অনেক তাই না?
আপনার পেশা?
চাকুরি করি। একটি বিদেশি সংস্থায়, নাম. .
নাহ্ নাহ্ নাম জানার দরকার নেই। আপনি নিশ্চয়ই জীবন বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে আপনার কর্মস্থলের নামটাও বদলে ফেলতে চান না? নাকি চান?
না, তা নয়। কর্মক্ষেত্রে আমি বেশ ভালোই আছি। কোনও ঝামেলা নেই। নটা-পাঁচটা অফিস, সপ্তাহে ছ’দিন যদিও কিন্তু আমার খারাপ লাগে না। কাজ করতে আমার ভালোই লাগে।
জোর দিয়ে বলছেন?
হ্যাঁ, জোর দিয়েই বলছি।
বিবাহিত?
হ্যাঁ।
কতো বছরের দাম্পত্য জীবন?
এইতো, পাঁচ বছর হবে শিগ্‌গিরই।
তারমানে আপনার বয়স যখন সাঁইত্রিশ, তখন বিয়ে করেছেন। একটু দেরিতে নয় কি?
দেরিতে কি? হতে পারে। নিজেকে গোছানোর জন্য সময় নিচ্ছিলাম।
এর সঙ্গে অন্য কোনও কারণ নেই তো?
নাহ্ তেমন কোনও কারণ নেই।এর আগেও করা যেতো, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে আমাকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি, চাকুরিটা হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি থেকেও চাপ দিচ্ছিলেন মা, কিন্তু করা হয়নি। কেন যেনো. .
স্ত্রী কী করেন?
ওহ্, শায়লা? ও স্কুলে পড়ায়, বাচ্চাদের স্কুল, বেশ নামকরা স্কুলটা। আপনি হয়তো নাম শুনে থাকবেন।
আপনার স্ত্রীর নাম তাহলে শায়লা।
হ্যাঁ, শায়লা শিহাব, দু’টো তালেব্য শ, নিজে নিজেই পাসপোর্ট করার সময় নাম লেখালো, শায়লা শিহাব। আমি কিন্তু ওকে লিখতে বলিনি। যে নামে মানুষ বেড়ে ওঠে, শুধুমাত্র একটি নুতন সম্পর্কের জন্য সেই নামটি বদলাতে হবে, এতে আমি বিশ্বাস করি না।
বাহ্, আপনিতো মশাই বেশ উদার।
না না এতে উদারতার কি আছে? কিন্তু শায়লাকে আমি নিষেধও করিনি।
আপনার ভালো লাগেনি, আপনার স্ত্রী যে তার নামের সঙ্গে আপনার নামটি জুড়ে দিলো?
ভালো লাগা? আমার ভালো লাগার বোধটি মনে হয় কম।
তার মানে মন্দ লাগার বোধটি কি প্রবল?
নিজের সম্পর্কে কি করে বলি? সেটি হয়তো অন্য কেউ বলতে পারবে।
কে ভালো বলতে পারবেন আপনার সম্পর্কে? আপনার স্ত্রী শায়লা? নাকি অন্য কেউ?
সেটা আমি কি করে বলবো? আমার সম্পর্কে কে ভালো বলতে পারবে, সেটা আসলে কখনোই ভেবে দেখিনি।
আপনারা কি আলাদা থাকেন নাকি বাবা-মায়ের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকেন?
বিয়ের কিছুদিন পরেই আমরা আলাদা ফ্ল্যাট নিয়ে উঠে যাই। বাবা আমাদের দু’ভাইয়ের জন্য বেশ কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন ব্যাংকে। সেই টাকা দিয়েই আমরা দু’ভাইয়ের জন্য দু’টো ফ্ল্যাট কিনেছি। ভাইয়ারটা ধানমণ্ডিতে, আমারটা বনানীতে। বাবা মারা গেলেন আমি যখন অনার্স করছি তখন, আর মা গেলেন বছর তিনেক হলো।
কী করতেন বাবা?

সরকারী চাকুরি করতেন। সচিব হয়েছিলেন অবসরে যাওয়ার আগে। এর আগে অবশ্য নানা পদ নিয়ে বাংলাদেশের জেলায় জেলায় ঘুরেছেন। সঙ্গে আমরাও। জানেন, আমরা যেখানে যেখানে ছিলাম প্রতিটি জায়গার কথা মনে আছে, এমনকি আমি প্রতিটি দিনের কথা বলে দিতে পারবো।
তার মানে আপনার স্মৃতিশক্তি খুব ভালো, তাইতো?

হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। ছাত্র হিসেবেও বেশ নাম করেছিলাম। খুব বেশি পরিশ্রম করতে হতো না আমাকে, বরাবর ভালো রেজাল্ট করেছি।
আচ্ছা একটু দাঁড়ান, আমরা সেসব কথায় যাবো, তার আগে এখনকার আপনি সম্পর্কে জেনে নিই।
বাচ্চা নেননি আপনারা?
একটি মেয়ে, নাম অনুস্মিতা।
বাহ্, চমৎকার নাম। এতো সুন্দর বাংলা শব্দ কী করে খুজেঁ বের করলেন?
খোঁজ করে বের করতে হয়নি তো, শব্দটা আমার মাথাতেই ছিল। সবসময় ছিল।
নিজের মেয়ে হলে নাম রাখবেন বলে আগে থেকেই এটা বেছে রেখেছিলেন?
না ঠিক তা নয়।
তবে?
তবে. . . .।
আচ্ছা বলতে না চাইলে থাক। পরে যদি বলতে মন চায়, তখন না হয় বলবেন।
আচ্ছা ঠিক আছে।
তার মানে ফ্ল্যাটে আপনি, আপনার স্ত্রী শায়লা, আর কন্যা অনুস্মিতা থাকেন, তাইতো?
না, ওরা থাকে না। এখন আমি আর ময়না থাকি।
সেকি, ওরা কোথায় থাকেন, মানে আপনার স্ত্রী আর কন্যার কথা বলছি।
শায়লা আজ মাস ছয়েক হলো, অনুস্মি-কে নিয়ে বাপের বাড়িতেই আছে। ও মনে হয় আর আসবে না।
আসবে না? কেন? ঝগড়া হয়েছিল বুঝি?

ঝগড়া? সেই অর্থে কোনও দিনই আমাদের মধ্যে ঝগড়া-টগড়া হয়নি। ও খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে। আর আমিও চুপচাপ থাকতেই ভালোবাসি।
তাহলে উনি কি নিয়ে রাগ করেছেন? রাগ করে মেয়েরা বাবার বাড়িতে যেতেই পারে, বাঙালি মেয়েদের আর তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কিন্তু তাই বলে ছ’মাস ধরে থাকাটা তো স্বাস্থ্যকর নয়, কি বলেন।

হ্যাঁ, কিন্তু শায়লা বলেছে, আমি যদি নিজেকে বদলাতে না পারি, তাহলে ও আর আসবে না। ও বলছে, আমি যদি চাই তাহলে ও আমাকে ডিভোর্স দেবে।

সে কি, এতোদূর? এটা তো খুব ভালো কথা হলো না।
সত্যি করে বলুন তো, কী হয়েছে? বাঙালি মেয়েরা তো খুব সহজে ডিভোর্সের কথা বলে না। যতো শিক্ষিতই হোক না কেন, একবার বিয়ে করলে সারা জীবন সংসারকে আগলে রাখাটাই তাদের স্বাভাবিক ধর্ম। আজকাল সময়টা বদলেছে, মানছি। কিন্তু তাই বলে, আধুনিকতার এই চূড়ান্ত অহংটা এখনও বোধহয় বাঙালি জীবনে ঢোকেনি, কি ঠিক বলিনি।

হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। শায়লাও চেষ্টা করেছে। অনেক চেষ্টা করেছে। আমাকে বদলাতে। কিন্তু আমি যে নিজেই বদলাতে পারছি না? আমি কী করবো বলুন? আমাকে আপনি সাহায্য করুন প্লিজ, প্লিজ। আমি না হলে মারা যাবো, কিন্তু মরতে আমার ইচ্ছে করে না। আমার আরও অনেক দিন বাঁচার ইচ্ছে, আরও অনেক দিন। একদম সেই দিন পর্যন্ত যেদিন আমার মুখ আর অনুর নামটি উচ্চারণ করতে পারবে না, এড়িয়ে যাবে, এড়ে-বেড়ে, ত্যাড়া-বাঁকা শব্দে আমি অনুর নামটি উচ্চারণ করতে চাই না। কিন্তু ততোদিন পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকতে চাই।
অনু মানে, অনুস্মিতা, আপনার মেয়ে, তাই তো?
না, মানে. … .. অনু মানে অনু, মানে অনু. . .
আপনি কি কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছেন? আজকে থাকবে? অন্যদিন না হয় কথা বলবেন? উঠবেন আজকে? পরে কোনও দিন না হয় আবার কথা বলবো আমরা, কেমন? একি, আপনার চোখ-মুখ এরকম দ্যাখাচ্ছে কেন? আপনি কি পানি খাবেন? এই নিন, পানিটা খান, ভালো লাগবে। আমি এসিটা বাড়িয়ে দিচ্ছি, বড্ড বিজবিজে গরম পড়েছে আজকাল।ফাল্‌গুন মাস এখনও শেষ হলো না, মনে হচ্ছে ঝপ করে চৈত্র এসে গেলো।

এখন কেমন বোধ করছেন? একটু ভালো? আপনিতো মশাই বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন আমাকে। আচ্ছা আপনার কি মনে হয়, এই বাংলা ভাষায় মশাই শব্দটি কি ফরাসি মঁসিয়্যে শব্দ থেকে এসেছে নাকি?
দুঃখিত, এ বিষয়ে আমার লেখাপড়া নেই, বলতে পারবো না।
আচ্ছা ঠিক আছে বলতে হবে না, আমি নিজেও জানি না, জানার চেষ্টা করতে হবে। তারপর বলুন, আপনার স্ত্রী আপনাকে বলেছেন, আপনি চাইলে তিনি আপনাকে ডিভোর্স দিতে প্রস্তুত আছেন, তাইতো?
হ্যাঁ।
তা আপনি কি চাইছেন? ডিভোর্স?
জানি না।
আরে বাবা, জানি না বললে তো চলবে না। এতো বড় একটি ব্যাপার, আপনাকে তো জানতে হবে, তাই না?
আমি সত্যিই জানি না, জানি না আমি কি চাই।

এটা তো কোনও মানুষই জানে না, সে আসলেই কি চায়। কিন্তু তাই বলে কিছু কিছু ব্যাপারে তো চাওয়া বা না চাওয়ার মাঝখানে সীমারেখাটি একেবারেই পাতলা, তাই না? যেমন ধরুন, আপনি বিয়ে করেছেন, আপনার একটি সন্তান আছে, আপনার স্ত্রী শান্ত, শিক্ষিত, কর্মজীবী ভদ্রমহিলা। আপনার তো মশাই সুখের সংসার হওয়ার কথা ছিল, অন্য যে কোনও বাঙালি ছেলে এটুকু পেলে বর্তে যেতো, আর আপনি বলছেন, কি চান জানেন না। একটি প্রশ্নের উত্তর দিনতো, আপনার স্ত্রী দেখতে কেমন?

শায়লা গড় পড়তা বাঙালি মেয়ের তুলনায় অনেক লম্বা, হালকা-পাতলা গড়ন, গায়ের রং শ্যামলা, মাথায় অনেক চুল, কোমর ছাড়িয়ে গেছে সেগুলো দৈর্ঘে, খুব ধীরে ধীরে কথা বলে, ভালো গান করে, আর . . .
দাঁড়ান, দাঁড়ান, দাঁড়ান মশাই, আপনি দেখছি, মহা সৌভাগ্যবান। যে বর্ণনা আপনি দিলেন সেরকম মেয়ের জন্য অনেকেই হা পিত্যেশ করে মরে, আর আপনি কি না. . ., নাহ্ মশাই, আপনি মানুষটি খুব বেশি সুবিধের মনে হচ্ছে না। দুঃখিত, আপনি কিছু মনে করলেন না তো, আমি ঠাট্টা করছিলাম। আপনি ভালো কিংবা মন্দ তা বলবার আমি কেউ নই, আমি শুধু আপনার কথাগুলো শুনতে চাইছি। আপনি বলেছেন, নিজেকে বদলাতে চান, কেন বদলাতে চান, কি বদলাতে চান, সেটাই জানতে চাই শুধু। যাকগে, বলুন, শেষবার যখন শায়লা আপনার কন্যাকে নিয়ে বাবার বাড়িতে গেলেন, কী হয়েছিল সেদিন?

আমি মারধোর করেছিলাম। প্রচণ্ড মারধোর করেছিলাম শায়লাকে। ওর চোখ ফুলে গিয়েছিল। কপালের ওপর কালশিটে পড়ে গিয়েছিল। ও কথা বলতে পারছিলো না, গলা টিপে ধরেছিলাম তো। ওর লম্বা চুলগুলো কেমন যেনো রুক্ষ হয়ে গিয়েছিল, আমি ওর চুল টেনে ধরে ওকে এলো পাতাড়ি থাপ্পড় মেরেছিলাম তার আগের রাতে।

তার মানে? আপনিতো মহা বিরক্তিকর মানুষ হে, কারো গায়ে হাত তোলার মতো নীচু কাজ আর কি হতে পারে? আপনি কারো সঙ্গে একমত হতে না পারেন, তার চাল-চলন কিংবা কথাবার্তা আপনার ভালো না লাগতে পারে, কিন্তু তাই বলে তাকে শারীরিক ভাবে আঘাত করাতো মধ্যযুগীয় বর্বরতা। মধ্যযুগে এরকম স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের পেটাতো। পৃথিবী তো মধ্যযুগ পার করে আধুনিক হয়ে এখন উত্তর-আধুনিকতার দিকে এগুচ্ছে, আর আপনি কি না এখনো স্ত্রীকে পিটিয়ে আধমড়া করে বাপের বাড়িতে পাঠাচ্ছেন? হাহ্ ঈশ্বর, আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমার রুচিতে বাঁধছে। আমি উঠি, এরকম মানুষের সঙ্গে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আপনি আপনার মতো থাকুন, আমি আমার পথ দেখি। ভালো থাকবেন, না না ভুল বলা হলো, আপনার জন্য ভালো থাকার কামনা আমি করবো না, আমি এতোটা উদার নই। আচ্ছা আসি, নমস্কার।

না না যাবেন না, প্লিজ যাবেন না। একটু বসুন, আর একটু আমার কথাগুলো শুনুন। আমাকে বদলাতে হবে, আমি বদলাতে চাই। পারছি না। আমাকে একটু সাহায্য করুন। প্লিজ শুনুন আমার কথাগুলো।

হ্যাঁ, শুনতে পারি, তবে আমি আর আপনাকে কোনও প্রশ্ন করবো না, আপনার ইচ্ছে হলে বলবেন, আর যা বলতে ইচ্ছে না করে তা বলবেন না, আমার সেগুলো শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।হ্যাঁ, বলে যান।

না ভাই, আপনাকে প্রশ্ন করতে হবে। প্রশ্ন না করলে, আমি নিজে থেকে কিছুই বলতে পারবো না। আমি জানি, এসব বলতে না পারলে, আমি নিজেকে পাল্টাতেও পারবো না। আমাকে বলতেই হবে, আমাকে বলতেই হবে। আপনি জিজ্ঞেস করুন, প্রশ্ন করুন, যা ইচ্ছে, আমি সব প্রশ্নের উত্তর দেবো।

ঠিক আছে, আমি প্রশ্ন করবো, কিন্তু আমার প্রশ্নগুলো কিন্তু খুব রূঢ় হবে, আপনি ঠিকভাবে নিতে পারবেন তো? দেখুন আগে থেকেই বলছি, আমি আর কোনও ভদ্রতার ভেতর দিয়ে যেতে চাইছি না, আপনি ভদ্রতার যোগ্য নন। সুতরাং, আমার প্রশ্নে আপনি আঘাত পেলে আমার কিছুই করার নেই। আপনি তৈরি?
জি, আমি তৈরি।
আপনি কি অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে জড়িত? মানে অন্য কাউকে ভালোবাসেন?
কিছু মনে করবেন না প্লিজ, আপনার এই প্রশ্নটির উত্তর আমি দেবো, তবে সবশেষ প্রশ্ন হিসেবে একে রেখে দিন প্লিজ, কেমন? আমার এই আরেকটি উপকার আপনি করুন, আপনার কাছে হাতজোড় করছি।
ঠিক আছে, আর কোনও অনুরোধ কিন্তু করতে পারবেন না। যা জিজ্ঞেস করবো, সরাসরি উত্তর দেবেন, ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
মেয়েটি কি আপনাদের অফিসের?
না।
কতোদিন ধরে চেনেন তাকে?
ত্রিশ বছর।
ত্রিশ বছর? কোথায় পরিচয় হয়েছিল?
ফরিদপুরে।
আরে ত্রিশ বছর আগে আপনার বয়স কতো ছিল?
এখন বেয়াল্লিশ হলে, তখন ছিল বার বছর।
বার বছরেই প্রেম শুরু করে দিয়েছিলেন? আপনিতো দেখছি ইঁচড়ে পাকা ছিলেন। কোন্ ক্লাশে পড়তেন তখন?
ক্লাশ নাইনে।

বার বছর বয়সে কেউ নাইনে পড়ে নাকি? গুল মারছেন আপনি। দেখুন মিথ্যে কথা বললে কিন্তু আমি আর কথা বলতে পারবো না আপনার সঙ্গে, এমনিতেই আমার অনেক সময় নষ্ট হয়েছে, এখন বানানো গল্প শুনে আরও সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না।

আমি বানিয়ে বলছি না। আসলে আমি প্রতিবার ডাবল প্রমোশন পেয়েছিলাম। যেমন ভর্তি হয়েছিলাম দ্বিতীয় শ্রেনীতে। বার্ষিক পরীক্ষার পর সরাসরি আমাকে নেওয়া হলো, চতুর্থ শ্রেনীতে, তার পরের বার ষষ্ঠ শ্রেনীতে, তার পরের বার অষ্টম, কিন্তু যেহেতু মেট্রিক পরীক্ষা দিতে হবে সেহেতু আমাকে ক্লাশ নাইনেই ওঠানো হলো, সরাসরি পরীক্ষায় বসতে অনুমতি দেওয়া হয়নি, আমি কিন্তু পারতাম, তখনও যদি আমাকে সরাসরি পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হতো তাহলে আমি পরে যে রেজাল্ট করেছিলাম, তাই করতাম। কারণ ক্লাশ নাইনের পর, মেট্রিক পরীক্ষা পর্যন্ত আমি আর কিছুই পড়িনি, মানে পড়তে পারিনি।

কেন প্রেমে পড়েছিলেন বলে?
ঠিক প্রেম নয়, তাকে কি প্রেম বলে কি না আমি বলতে পারবো না। আপনাকে তো বলেইছি, অল্প পড়েই আমি ভালো রেজাল্ট করতাম, বরাবর তাই হয়েছে, আমি ক্লাশ নাইনে ওঠার আগেই মেট্রিকের সবকিছু পড়ে ফেলেছিলাম, তাই পরীক্ষায় কোনও অসুবিধে হয়নি।

বাদ দিন, আপনার লেখাপড়ার গল্প আর শুনতে চাইছি না। আপনি যা বলছিলেন তাই বলুন। মেয়েটির কথা বলুন। কী মেয়েটি আপনাকে পাত্তা দেয়নি, তাইতো? আপনি একাই ভালো বেসেছিলেন, বলার সাহসও হয়নি, ঠিক ধরেছি না? আর তাকেই আজ অবধি বুকের ভেতর বয়ে বেড়াচ্ছেন, তাই না?

ঠিক তা নয়, তবে হ্যাঁ, সে আছে, সব সময়ই আছে। আমার কাছে, খুব কাছে। এই যে আপনার সঙ্গে বসে কথা বলছি, সে আমাকে নিষেধ করছে বলতে। সে চায় না, তার কথা আমি কাউকে বলি, কাউকে এতোদিন বলিনিতো।সে বলতে দেয়নি।

দেখুন ভায়া, আপনি এখন ঘটনাটিকে আধি-ভৌতিক মোড় দিচ্ছেন, আমি এসবে বিশ্বাস করি না, তাই বিশ্বাস করাতে পারবেন না। যাকগে, তাড়াতাড়ি শেষ করুন। আপনার স্ত্রীকে পেটানোর কৈফিয়ত হিসেবে এসব আধি-ভৌতিক কাহিনী আর যাকে বলেই পার পেয়ে যান না কেন, আমাকে মজাতে পারবেন না।আপনি যদি মূল ঘটনা বলতে চান তো বলে ফেলুন, ফেনিয়ে কোনও লাভ হবে না।

যেহেতু বারো বছর বয়সেই আমি ক্লাশ নাইনে উঠেছিলাম, সেহেতু ক্লাশের সবাই আমার চেয়ে বয়সে বড় ছিল। জেলা শহরের স্কুল, সরকারী বয়েজ স্কুলে আমি ভর্তি হতে পারিনি। বাবা চাননি, আমি সেখানে ভর্তি হই। সরকারী কর্মকর্তার সন্তান হিসেবে আমাকে এমনিতেই ভর্তি করিয়ে নেওয়ার কথা, কিন্তু বাবা এই সুবিধে কখনোই নেননি, তাই আমি কখনোই কোনও জেলা স্কুলে পড়িনি। পড়েছি, সাধারণ স্কুলে। ফরিদপুরেও আমি ভর্তি হয়েছিলাম ঈশান স্কুলে। খুব ভালো হিসেবে নাম ছিল না স্কুলটির, লেখাপড়ার মতো ছাত্রছাত্রীরাও মাঝারি। শিক্ষকরাও ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার যত্ন-আত্তি তেমন নিতেন বলে মনে হয়নি। আমার অবশ্য কোনও অসুবিধে হয়নি তাতে, কারণ আমি আমার নিজের পড়া নিজেই পড়ে নিতাম। যাহোক, ক্লাশ নাইনে আমি ক্লাশ করতে শুরু করলাম, কিন্তু কেউই আমার সঙ্গে তেমন কথা বলে না। আমিও বলতাম না, কথা বলতে আমার ভালো লাগে না।শিশুকাল থেকেই আমি একা একা খেলতে, একা একা থাকতে ভালোবাসি। সে জন্য স্কুলে আমার সঙ্গে কেউ কথা বলুক, না বলুক, আমার তাতে কিছুই এসে যেতো না।

তখন সাধারণ বিজ্ঞান নামে ইয়া মোটা একটা বই আমাদের পড়ানো হতো। তাতে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান – সবই ছিল। কিন্তু একেক অধ্যায়ের জন্য শিক্ষক ভাগ করা ছিল। কেমিস্ট্রি যিনি পড়াতেন, তিনি ছিলেন ভয়ংকর রাগি। কথায় কথায় ছেলেমেয়েদের মারতেন খুব। যদিও কোনওদিন ক্লাশে তিনি আমাদের কিছুই বুঝিয়ে দেননি। যেনো ছাত্রদেরকে বোঝানো তার দায়িত্ব নয়। তিনি শুধু ক্লাশে এসে পড়া ধরবেন, যদি কেউ না পারে তাকে বেদম পেটাবেন আর তারপর ক্লাশ থেকে বেরুনোর আগে বলে যাবেন, আগামি ক্লাশে অমুক পাতা থেকে অমুক পাতা পর্যন্ত পড়ে আসবে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ছিল কি জানেন?

কি?
উনি কেমিস্ট্রির পড়া ধরতেন কি ভাবে জানেন? ধরা যাক উনি ১২২ পাতা থেকে ১৩২ পাতা পর্যন্ত, দশ পাতা পড়ে আসতে বলেছেন। এই দশ পাতার ভেতর যে কোনও একটি পাতা থেকে, যেমন ধরুন গিয়ে ছাব্বিশ নম্বর পাতা, যাকে ধরা হতো তাকে একটানা মুখস্ত বলে যেতে হবে। কেমিস্ট্রি মুখস্ত করার মতো বিষয় নয়। তারপরও তার ভয়ে সবাই পাতার পর পাতা মুখস্ত করে আসতো। আমিও যেতাম, আমাকে অবশ্য খুব কষ্ট করতে হতো না, মুখস্ত করার জন্য। আমি কয়েকবার পড়ে শুধু পাতা নম্বরগুলো মনে রাখতাম, তারপর যখন তিনি পড়া ধরতেন তখন চোখ বন্ধ করে সেই পাতাটি চোখের সামনে ভাসিয়ে আমি দিব্যি বলতে পারতাম। আমি এখনও পারি, কয়েকবার একটি পাতা পড়লে, সেই পাতাটি আমার চোখের সামনে ছবির মতো ভাসিয়ে আমি বলে দিতে পারবো, আপনি চাইলে, এই পরীক্ষাটি আমার নিতে পারেন।

না, কোনও পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। আপনি বলে যান।

সেদিন ছিল সোমবার। মহিবুর স্যার ক্লাশে ঢুকতেই কেমন করে যেনো বোঝা যাচ্ছিলো স্যারের মেজাজ খুব খারাপ। সেদিন আমাদের পড়ার কথা ছিল সাধারণ বিজ্ঞান বইয়ের একশ চল্লিশ পাতা থেকে একশ পঞ্চাশ পাতা পর্যন্ত। আর মজার কথা হলো, এই দশ পাতা ভর্তি ছিল শুধু নানা সমীকরণ। পানি, নানা রকম এসিড, খার, খারক, ইত্যাদির বিক্রিয়া সহ পাতা ভর্তি সমীকরণ। কারোরই মুখস্ত থাকার কথা নয়। আমারও মনে সন্দেহ ছিল আমি পারবো কি না। এমনিতে আমি বসতাম একদম সামনের বেঞ্চিতে। কিন্তু সেদিন আমি গিয়ে বসেছিলাম একেবারে শেষের বঞ্চে। আমাদের ক্লাশটিতে মোট তিনটে সারি, দুই বেঞ্চের সারিতে ছেলেরা বসতাম, আর একটি সারিতে মেয়েরা। আমি সেদিন বসেছিলাম একেবারে শেষের বেঞ্চে, এবং মেয়েদের সারির দিকে একেবারে কোণের সিটটিতে।স্যারের পিটুনিকে আমার বড় ভয়, আমি পিটুনি খেতে চাইনি। তাই ভেবেছিলাম, সবাইকে পড়া ধরা শেষ করে আমার কাছে আসতে আসতে হয়তো ঘন্টা পড়ে যেতো। বলতে ভুলে গেছি, স্যার, একেবারে প্রথম বেঞ্চ থেকে শুরু করতেন, একের পর একজনকে পড়া ধরতেন, কখনও সামনের সারির কাউকে বাকি রেখে পেছনের সারিতে যেতেন না। তাই ভেবেছিলাম, অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও পেছনের বেঞ্চে পৌঁছার আগেই হয়তো ঘন্টা পড়ে যাবে। আমি অপেক্ষা করছিলাম, আর মনে মনে পড়ে আসা পাতাগুলো ছবির মতো ভাসিয়ে দিয়ে নুতন করে পড়ার চেষ্টা করছিলাম। দেখলাম, প্রতিটি পাতাই আমার মনে পড়ছে স্পষ্ট।

স্যার শুরু করলেন। প্রথম ছেলেটিকে বললেন, একচল্লিশ নাম্বার পাতা মুখস্ত বলতে। ছেলেটি শুরু করলো, কিন্তু একটুক্ষণ পরেই তোতলাতে শুরু করলো। তারপর আর বলতে পারে না। স্যার চেয়ার থেকে উঠলেন না, বসে বসেই তার পরের ছেলেটিকে বললেন, বেয়াল্লিশ নাম্বার পাতা থেকে পড়তে। ছেলেটিও একটুক্ষণ বলে তারপর থেমে গেলো। এবার স্যার বললেন, আজকে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠবো না, আজকে তোরা নিজেরা নিজেদের শাস্তি দিবি। দু’জন দু’জনের গালে যতো জোরে সম্ভব চড় দিবি। কেউ যদি শয়তানি করে আস্তে থাপ্পড় মারিস তাহলে তার পিঠে আমি এই বেত ভাঙবো, এবং আমার কথার নড়চড় হবে না।

স্যারকে সবাই চিনতো, তাই প্রথম দু’টি ছেলে একজন আরেকজনের গালে ভয়ঙ্কর জোরে থাপ্পড় মারল। এরপর দেখা গেলো গোটা ক্লাশে কেউই সেদিন পড়া পারছে না। সবাই একজন আরেকজনের গালে থাপ্পড় মারছে। ক্লাশের প্রায় শেষদিকে এলো আমার পালা। আমার বেঞ্চে আর কোনও ছেলে নেই। আমি একাই বসেছিলাম। কিন্তু আমার পাশ থেকেই মেয়েদের বেঞ্চ শুরু। সেখানে বসেছিল, অনুরাধা। বড় বড় চোখ, অনেক লম্বা চুল, হালকা শরীর, ওকে দেখলে আমার যেনো কেন লেজঝোলা পাখির কথা মনে হতো। আমি কোনও দিন দেখিনি, লেজ ঝোলা পাখি কেমন, কিন্তু ওকেই আমি লেজঝোলা পাখি হিসেবে চিনেছিলাম।

যথারীতি আমাকে স্যার বললেন, পয়তাল্লিশ নাম্বার পাতা মুখস্ত বলতে। আমিও চোখ বন্ধ করে গড় গড় করে বললাম, অনুরাধা মিলিয়ে দেখলো পয়তাল্লিশ নাম্বার পাতা। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কিরে অনুরাধা ঠিক আছে? ও মাথা নাড়লো, আর খুব নরোম গলায় বললো, জি স্যার।

এবার তুই মুখস্ত বল, পঞ্চাশ নাম্বার পাতা।এই শিহাব তুই মিলিয়ে দ্যাখ।
আমি বই হাতে নিয়ে দাড়িয়ে থাকলাম অনুরাধার মুখের দিকে তাকিয়ে। ও পড়তে শুরু করলো। দু’তিন লাইন পড়েছিল, তারপর থেমে গেলো। আর মুখ নামিয়ে রইলো নিচের দিকে। ওর মুখ নামিয়ে রাখা দেখেই বুঝেছিলাম ও আর পারবে না। এরপর স্যার যা করলেন তা আমি জীবনে আর কোনও দিন ভুলতে পারিনি।

স্যার আস্তে আস্তে চেয়ার থেকে উঠে এলেন, দাঁড়ালেন আমাদের মাঝখানে। তারপর অনুরাধার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই ছেমড়ি মুখ তোল্। শিহাবের দিকে ঘোর।

অনুরাধা যন্ত্রের মতো আমার দিকে ঘুরলো, মুখটা সামান্য তুললো। ওর চোখ দেখতে পেলাম আমি, আরও বড় মনে হলো আমার কাছে ওর চোখ, জোড়া ভুরুর নীচে চোখ দু’টিকে তখন আমার মনে হচ্ছিলো, যেনো চোখ নয়, অন্য কী যেনো।

স্যার এবার আমার দিকে তাকালেন, বললেন, নে এবার একটা কষে চড় মার দেখি। যদি আস্তে মারিস, তাহলে আজকে এই বেত তোর পিঠে ভাংবো, আমারে তো চিনিস।

আমি স্যারের কথা শুনলাম, তারপর অনুরাধার বাঁ গালে প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে একটি থাপ্পড় মারলাম। আমার মনে হলো, আমার হাত কোনও নরোম ঘাসের ভেতর ডুবে গিয়েছিল, আমি অনেক কষ্টে সেই ডুবে যাওয়া হাত তুলে আনলাম আমার কাছে ফেরত।

অনুরাধা তখনও মুখ নামিয়ে নেয়নি। ঠিক তখনই ঘন্টা বাজলো, তবে আমাদের ক্লাশে কারো মুখে কোনও শব্দ নেই। সবাই তাকিয়ে আছে অনুরাধার মুখের দিকে। আর অনুরাধা কাঁদতে ভুলে গেছে, মুখটা লাল হয়ে গেছে, আমার মনে হচ্ছে, অনুরাধা কাঁপছে থর থর করে, ও কি পড়ে যাবে নাকি? পড়ে গেলে আমি কি ধরবো ওকে? কী ভাবে ধরবো? কোথায় ধরবো? আমি ভাবছিলাম, ভাবছিলাম কী করবো।

ততোক্ষণে স্যার বেরিয়ে যাচ্ছেন, যাওয়ার আগে পরের দিনের পড়া দিয়ে গেলেন, পঞ্চাশ থেকে ষাট পাতা।স্যার বেরিয়ে যাওয়ার পরেও ক্লাশে কেউ কোনও কথা বলছে না। অন্যদিন স্যারকে নিয়ে কিংবা কারো মার খাওয়া নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে। কিন্তু সেদিন সেসব কিছুই হলো না। পরবর্তী দু’টি ক্লাশ আমি তাকাইনি অনুরাধার দিকে। ছুটি হলে, আমরা যে যার মতো চলে এসেছি, কিন্তু তারপর থেকে অনুরাধাকে আর দেখিনি ক্লাশে কোনও দিন। যেহেতু ক্লাশের কারো সঙ্গেই আমার তেমন কথাবার্তা হতো না, তাই কাউকে যে অনুরাধার কথা জিজ্ঞেস করবো তাও পারিনি।

আমি প্রতিদিন ভেবেছি, কী ভাবে খোঁজ নেওয়া যায়, অনুরাধাদের বাড়ি কোথায়? একদিন বাড়িতে গিয়ে জেনে আসবো কিনা তাও ভেবেছি। কিন্তু তার আগেই ক্লাশে একদিন ফিসফিসানি, সবাই আমার দিকে যেনো কেমন করে তাকায়। আমাকে দেখলেই, কোনও কোনও ছেলে গালি ছুড়ে দেয়, মেয়েরাও কানাকানি করে। আমি বুঝতে পারছিলাম, কিছু একটা হয়েছে, কী হয়েছে সেটা বুঝিনি। বুঝেছি অনেক পরে।

বাবা বদলি হয়ে ঢাকায় চলে আসবেন, আমাকেও ঈশান স্কুল থেকে বিদায় নিতে হবে। ক্লাশ নাইনের মাঝামাঝি তখন, স্কুলের শিক্ষকদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ক্লাশের সবাইকে বলবো বলবো করেও বলতে পারছি না, ওদের সঙ্গে আমার তো তেমন কোনও কথাই কোনওদিন হয়নি। তারপরও সাহস করে বললাম, যাচ্ছি, আর কখনও হয়তো দেখা হবে না। আপনারা ভালো থাকবেন। যেহেতু আমি বয়সে ওদের চেয়ে ছোট তাই সবাইবে আপনিই সম্বোধন করলাম। তারপর খুব সাহস করে বললাম, অনুরাধা ক্লাসে আসে না কেন? ওর কী হয়েছে?

অনেকক্ষণ কেউ কোনও উত্তর দেয়নি আমাকে। তারপর একটি মেয়ে খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, কী আর হবে, পাগল হয়ে গেছে।ও শুধু নিজের গালে থাপ্পড় মারে, চুল ছেঁড়ে, হাতে-পায়ে-শরীরে আঁচড় কাটে। ওকে কোলকাতা নিয়ে গেছে ওর বাবা। ও আর ফিরবে না।ওরা সবাই নাকি কোলকাতা চলে যাবে।

মেয়েটির কথায় কী যেনো ছিল, আমার মনে হচ্ছিল, আমি হেঁটে বাড়ি ফিরতে পারবো না। কিন্তু ফিরেছিলাম, তারপরতো ঢাকায় এলাম। স্কুল শেষ হলো, কলেজ শেষ হলো, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ হলো, চাকুরি পেলাম। আমি চাইনি জানেন?

কী চাননি?
বিয়ে করতে চাইনি।
তাহলে করলেন কেন?
মা জোর করতে লাগলেন? বড় ভাবি একদিন গোপনে ডেকে নিয়ে জানতে চাইলেন, আমার কোনও অসুখ-টসুখ আছে কি না, বিয়ে করতে চাই না কেন? কোনও মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, বললেন, যন্ত্র-পাতি ঠিক আছে তো?

আমি কি বলবো, এরপর, বলুন? তারপর মা-ই খুঁজে পেলেন শায়লাকে। আমি দেখিনি। দেখতে চাইনি। বলেছি, তোমার পছন্দই আমার পছন্দ। বাসর রাতে শায়লাকে খুব ছুয়েঁ দেখতে ইচ্ছে করলেও দেখিনি। সে রাতেই আমার মনে হলো, আমার পাশে শায়লা নয় অনুরাধা শুয়ে আছে। আমার ভেতরে প্রচণ্ড আনন্দ হচ্ছিলো জানেন, প্রচণ্ড আনন্দ। পরদিন ভোরবেলা দেখলাম, ও অনুরাধা নয়, শায়লা। আমি বেরিয়ে গেলাম বাড়ি থেকে। ফিরে এলাম গভীর রাতে। আবার মনে হলো, আমার পাশে অনুরাধা শুয়ে আছে। আমি কাছে টেনে নিলাম, ওর চোখের ওপর ঠোঁট রাখলাম, পাগলের মতো বলতে লাগলাম, আমার অনুরাধা, অনুরাধা, অনু অনু অনু অনু, এতোদিন কোথায় ছিলে তুমি? কোথায়?

হঠাৎ আমার ঠোটেঁর নীচ থেকে ছিট্‌কে সরে গেলো অনুরাধার মুখ। তারপর কাটা কাটা গলায় কে যেনো বললো, আমি অনুরাধা নই, আমি শায়লা।

আমার সবকিছু ভেঙে-চুরে গিয়েছিল। ইচ্ছে হলো, সামনের মেয়েটিকেও ভেঙে-চুরে ফেলি, শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে শায়লার মুখে চড় মারলাম। সেই চোখ, সেই মুখ থেকে সমস্ত অভিব্যক্তি নিঃশেষ হওয়া চেহারা, ঘরের ভেতর আবছা আলো, আমি স্পষ্ট দেখলাম, মুহূর্তের মধ্যে শায়লার মুখও লাল হয়ে গেলো, অবিকল তেমনটি যেমনটি একদিন এসেছিল, অনুরাধার মুখেও।

তারপর থেকে যখনই শায়লাকে আমি অনুরাধা ভেবে ডেকে উঠেছি, বিশেষ করে রাতে, যখন আমার পাশে ও এসে শুতো, তখন, ঠিক তখন ওকে অনুরাধা বলে ডাকলেই, ও ছিটকে সরে যেতো, আমিও মাথা ঠিক রাখতে পারতাম না, থাপ্পড় মারতাম এলোপাতাড়ি, চুল টেনে, গলা টিপে, যখন যেভাবে ইচ্ছে করতো মারধোর করতাম, একদিন এভাবেই প্রথম ওর সঙ্গে আমার শরীরের সম্পর্ক হলো। আর তার পরেই মেয়েটি এলো আমাদের ঘরে, আমিই জোর করে নাম রাখলাম, অনুস্মিতা, অনেক ভেবে নামটি বের করেছিলাম। অনুরাধার অনুটুকু রেখে, স্মিতা জুড়ে দিলাম, আসলে অনুরাধার অনু-অংশই আমার কাছে ছিল, এছাড়া আমিতো নিঃস, কী বলেন?

কী বলবো বলুন? কী বলতে বলেন আমাকে?
আপনাকে কিছুই বলতে হবে না। আপনি কি আর বলবেন? মানুষ নিজেকে নিজে যদি কিছু বলতেই পারতো, তাহলে তো কতো আগেই বদলে ফেলতে পারতো নিজেকে, তাই না? আপনি যান, কোথায় যাচ্ছিলেন যান। আপনার দেরি করিয়ে দিলাম।

কোথায় আর যাবো? তারচেয়ে চলুন একসাথে হাটি খানিকটা, যাবেন?
ঠিক আছে, চলুন।

আচ্ছা চলুন তাহলে।
আচ্ছা।


মন্তব্য

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ভালো লাগলো।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অনিন্দিতা এর ছবি

ভীষণ টান টান্।
অনেক শুভেচ্ছা।

রাকিব হাসনাত সুমন এর ছবি

বদলাতে চাই । কিন্তু এ যে সত্যি ভীষন কঠিন...............

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

মাসুদা, গল্পটি খুবই চমৎকার। দারুণ। আসলেই দারুণ। ভদ্রতার প্রশংসা নয়। এটি ভালো লাগত ছাপার অক্ষরে, পত্রিকায়। ব্লগে এত বড় লেখা আসলে পড়া বেশ কঠিন। অনেকেই সম্ভবত ধৈর্য্য বজায় রেখে পড়তে পারেন নি, নইলে আপনি আরো অনেক ভালো কমেন্ট পেতেন। আমি কিন্তু আপনাকে ভোট দিয়েছি!

----------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

সুধীর এর ছবি

গল্পটা একটু বড় হলেও সুখপাঠ্য। কয়েক সপ্তাহ আগে (বোধ হয় ভ্যালেন্টাইন ডে -তে) সামহোয়্যার ইনে "শিশু"-এর লেখা "দাগ" নামে একটা গল্প পড়েছিলাম, সেখানেও শৈশবের এক স্মৃতির অমোচনীয় স্বাক্ষরের কথা ছিল, যদিও ভায়োলেন্স ছিল না।

আমাদের স্কুলে এক শিক্ষক আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়কে কেন জানি দুচোখে দেখতে পারতেন না; তার অনেক মেধা সত্ত্বেও স্মৃতি শক্তি ছিল ভীষণ দুর্বল। একবার পাঠ্য বইএর এক কবিতা মুখস্থ বলতে গিয়ে আঁটকে যাওয়াতে স্যার আমাকে বললেন তার কান টেনে দিতে। আমি অস্বীকার করেছিলাম। সেছেলেটি পরে সব পাব্লিক পরীক্ষাতে প্রথম হয়েছিল।

ক্যামেলিয়া আলম এর ছবি

আমি বিমোহিত হয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম কোনরকম বোর হওয়া ছাড়া--- সত্যিই অসম্ভব ভাল লেখেন আপনি ------
.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........

.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি

আহা, গল্পটা বড় বলে এতো অবহেলা সইতে হলো!!

এই কারণেই কি বাংলাদেশের উপন্যাসের আকার দিন দিন ৮০ পাতারও নীচে নেমে আসছে??

হাসান মোরশেদ এর ছবি

অবশ্যই অবহেলা নয় এই গল্পের জন্য ।
বাংলা ব্লগে মুলধারার সাহিত্য চর্চা বিকশিত হোক । ব্লগ পাঠক মননে বনসাই হয়ে গেলে তো বিপদ
----x----
...অথবা সময় ছিলো;আমারই অস্তিত্ব ছিলোনা

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।