পাখিটি মাটির, খাঁচাটি সোনার (২)

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: মঙ্গল, ২৪/০৬/২০০৮ - ৯:৩৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নয়.
মরুভূমির বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ে সাতটি লম্বা দাগ, আঁকা-বাঁকা যদিও, বোঝা যায়, সাপ গিয়েছে এই পথে, কাকে দংশাবে আজ? নাকি বালি খুড়ে বের করে আনবে তরল সোনা? আজকাল বালির তলার তরলের দাম আকাশের সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে গিয়েছে ঈশ্বরের কাছে; মানুষের মতো কীট কিংবা পতঙ্গ ভূখা, সিয়াটল কিংবা বার্লিনে বসে ভাগ্য নির্ধারণ হয় এইসব কীট ও পতঙ্গের, হয় তারা খাবার পায়, নয় তাদের পাখা দেওয়া হয় কেটে; নইলে ছেড়ে দেওয়া হয় বিষাক্ত সাপ, তারা সাগর মরু মেঠোপথ সব পার হয়ে ঠিক পৌঁছে যায় সেখানে সামান্য গোবরও ফ্যালা যায় না; কে জানে একদিন হয়তো এইসব বর্জই হবে খাবার, গুবরে পোকার ও মানুষের।

দশ.
মানুষ বলে দেবে, এই বিরাণে একদিন কারা ছিল; কোথায় কোন্ পথে তারা নিঃশ্চিহ্ন হয়েছে, কিন্তু তুমি সেখানে যাবার আগে কী করে বুঝবে সেই পথ বিরাণ শূন্যতা আসলে ক্যামন; তুমি আমি সব শূন্যতার প্রেতাত্মা, কালো মেঘ ফুঁড়ে দৈত্যিরা সব তাড়া করে আমাদের, আমরা ধাবিত হই, তাড়া খাওয়া হরিণের পাল যেমন দিকব্দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটে; শত্রুর সামনে ছোটা কোনও সৈনিক, তীব্র ভয়ে কেঁপে ওঠা কোনও রাত-শিশু- সব একাকার, কারণ তার হাতে অস্ত্র ছিল, তাকে বলা হয়েছিল হত্যা করো, তার সব সঙ্গীত কেড়ে নিয়ে তাকে করে দেওয়া হয়েছিল নপুংশক; অথচ সে তার প্রেয়সীর ফুলে ওঠা উদরে হাত রেখে বলেছিল, এইখানে আমার সন্তান, বড় হচ্ছে, হাত বাড়ছে, পা বাড়ছে, বাড়ছে নাভি, শিশ্ন বা যোনি; তাকে হত্যা করা হবে, প্রশিক্ষিত ওরা তাড়া করবে ওকে, এসো শেষ করে দিই এখুনই, সৃষ্টি ও ধ্বংস শুধু ঈশ্বরেরই একার, আমরাইতো শ্রষ্ঠা, ধ্বংসও আমাদের হাতেই হোক – তারপর ছেলেটি ও মেয়েটি মেতে ওঠে ধ্বংসের খেলায়; সেও এক সৃষ্টিই।

এগারো.
একটা পুরোনো গল্পের শুরুটা এমন, কালো এক সোমত্থ শরীরকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে গিয়ে অসীম ভোগ শেষে টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এক বিস্তীর্ণ এলাকায়, তারপর থেকে সেখানকার মাটির রং লাল; কাল শরীরের ধমনীতেও যে লাল স্রোত ছিল সেকথা অজানা ছিল দীর্ঘদিন, তবু মেয়েটা ছড়িয়ে রেখেছিল তার দু’পা; একদিন কর্ষণে উঠে এলো ঊর্বরতা, লাল মাটির ভেতরেই লুকোনো ছিল জীবন।

বারো.
হ্যাঁ, ভালোবাসি; শপথ তারার, রাস্তার কোণায় টিমটিমে আলোটিরও, তার তলার কম্পমান ছায়া যার খানিকটা অভিশপ্ত, খানিকটা আশীর্বাদের, আমি দেখেছি তাদের যেতে ও ফিরতে, তাদেরও বাদ দিই কি করে।
ভালোবাসিইতো; শপথ ওই উঁচু ভবনটির, তার ওপরে টাঙানো ভাঙাচোরা এ্যান্টেনার, যা দূর ও দূরত্বকে টেনে আনে কাছে।
সত্যিই ভালোবাসি; শপথ এই সমকামী যুবকেরও, যার শরীরের সঙ্গে লেগে থাকা লাল প্যান্ট, ফুলে থাকা লিঙ্গ যা স্বাভাবিকের চেয়েও বড় মনে হয় অনেকের, তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা কোকের ক্যান, যাকে শুষতে সার সার পিঁপড়েরা এসেছে তৃতীয় বিশ্ব থেকে।
বিশ্বাস করো, ভালোবাসি; ফেপে থাকা রাত ষোড়ষীর স্তন দলাই মলাই করে যাওয়া ট্রাক, রাস্তার পাশে দাঁড়ানো দেহজীবী, যারা নিজেকে না বিছিয়েও খরিদ্দারকে তৃপ্তি দেওয়ার অদ্ভূত কৌশলপটু – এদের সবার শপথ।

এবং ভালোবাসি; শপথ বিছানায় কেঁতরে থাকা বহু ব্যবহারে ক্লান্ত শিশ্নের পাশেই হিস্ হিস্ উত্তপ্ত নারীটির অভিশাপের; এবং সেই সন্তানটির যার জন্ম ভালোবাসাহীন সঙ্গমে, পৃথিবীতে আসার দায়-দায়িত্ব তার নিজের নয় অথচ তাকে তা বহন করতে হয় মৃত্যু পর্যন্ত, আর সে পারে না দিতে কিছুই কাউকে, শুধু কষ্ট ছাড়া।

তেরো.
সাবানের গন্ধের মতো সময়, স্নানের পর ধীরে ধীরে সরে যায় শরীর থেকে ধীরে ধীরে জড়ো হয় ঘামক্লান্তি – এক্ষণে আমার জন্য একটি গান গাও, পূবের হাওয়ার মতো হাওর থেকে উঠে আসা, যার ভেতর সাবানের সঙ্গে থাকবে কাঁকড়ার ঢিঁপির কিচকিচ বালি, কচুরির নীল ফুলের সামান্য হলুদ চোখের মতো অংশটুকু, নয়নজুলি থাকলে ক্ষতি নেই, শুধু ভুল করো না দিতে শ্যাওলার একটুখানি সবুজ, স্বচ্ছ স্রোতজলে যেখানে কুমারী মাছেরা শুয়ে থাকে সূর্যের দিকে তাকিয়ে।

চৌদ্দ.
চওড়া জল শুয়ে আছে, আমার পাখা নেই যে পার হবো; একটা নৌকো হলে বেশ হতো, দু’জনকে বহনযোগ্য নৌকো, যাতে আমি এবং ভালোবাসা ঠাঁই পাবো; একটা গাছকে বিশ্বাস করেছিলাম, পিঠ ঠেকিয়ে বসেওছিলাম কিন্তু তারপর সে বাঁকা হলো এবং ভেঙে গ্যালো, সেই সঙ্গে ভালোবাসাও টুকরো টুকরো হলো; নৌকো প্রস্তুত হলো, সাজলো, যতোক্ষণ না তার গলা পর্যন্ত ডুবে যায়, অথচ সে আমার মতো নিজেকে পূর্ণ করতে পারলো না ভালোবাসা দিয়ে, আমি জানি না আমি ভাসবো কিংবা ডুবে যাবো; এখন ভালোবাসা বৃদ্ধ, ভোরবেলাকার শিশিরের মতো সূর্য ওঠার জন্যই তার অপেক্ষা।

পনেরো.
একদিন আত্মাকে ডেকে বললাম, বসো, গল্প করা যাক। আত্মা এলো, দীর্ঘ অনাহারির মতো, শীর্ণ, তার পায়ে শেকল, তার বুক ফুটো, চোখ বাঁধা কালো কাপড়ে, পথ চিনে আসতে কষ্ট হলো খুব? হলোতো। কার কাছে বন্ধক দিয়েছো আমায়? জানতে চাইলো সে। বললাম, জানি না। আত্মা মৌন হলো। তারপর দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে খাড়া হলো, কষ্ট হলো খুব, তারপর ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে চলে গ্যালো।দেখলাম তার পেছনে একদল জলপাই সবুজ কুকুর লেগেছে; বুঝলাম তারা আমার আত্মার পাহারাদার।

ষোলো.
বলা প্রয়োজন, আমি এটি উপহার হিসেবে পেয়েছি।
ব্যবহারের সময় আমি অবশ্য বুঝতে পারিনি এটি আসলে কি। ভেবেছিলাম আরও ভালো লাগেবে কিন্তু একে ছুঁলে কোমল মনে হয় ঠিকই, তবে তেমন আরামদায়ক নয়। আর্থিক ভাবে এটি খুব সাশ্রয়ী নয়, যদিও আমি এর অর্ধেক খরচ করে ফেলেছি, বলা মুস্কিল অর্ধেক নাকি তার চেয়েও কম বা বেশি। ব্যবহারবিধি সম্পর্কে অনেক কিছুই লেখা, খুব ছোট অক্ষরের ঠাস বুনুনি লেখা, কমলকুমার মজুমদারের গদ্যের মতো, জানি না আমি কোন্‌টি অনুসরণ করবো, কোন্‌টি এড়িয়ে যাবো।
তবে আমার মনে হয় কোনও শিশুর হাতে এরকম কিছু আমি কখনওই জেনে-বুঝে দিতে পারবো না। কারণ, আমি তো জানিই না, এর উপযোগীতা আসলেই কি।
একজন বন্ধু জানালেন, এটা নাকি এজন্যই বানানো হয়, যাতে এর প্রস্তুতকারক নিজেকে কর্মক্ষম রাখতে পারেন, যদিও এর মূল্য অনেক, অনেকই বেশি। মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবী একে ছাড়াই অযুত নিযুত বছর পার করেছে, তাহলে এখন কেন এর প্রয়োজন হলো, বলুনতো?
নানা রঙের লেভেল সাঁটা এতে, যদিও দেখতে বাঁকা-ত্যাড়া; লেখা ওয়াটার-প্রুফ কিন্তু তাপ-সহ্য নয়; নিজে নিজের ভার বইতে পারে না কিন্তু যে বয় সেও জানে না কতোদিন এই ভার বওয়া; তবে হ্যাঁ, এটা কিন্তু সত্য যে, দ্রব্যটি বেশ জনপ্রিয়, কারণ সবার কাছেই আছে এটি। এর আবার বিশেষজ্ঞও আছে, কিন্তু তাতে কি, আমিতো ভোক্তা মাত্র।
জানতে চান, উপহার না পেলে আমি একে কিনতাম কি না? বলা শক্ত, এর বিকল্প এবং ভালো কিছু না পেলে হয়তো কিনতাম সের খানেক।

পুনশ্চঃ প্যাকেটটির শরীরে বড় অক্ষরে লেখা ছিল “জীবন”; পড়তে কারোই অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। আমারও হয়নি।


মন্তব্য

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

বিমূর্ততা আর মূর্ততার মাঝামাঝি থেকে কোনো একদিকে আরেকটু হেলে গেলে হতো কবিতা বা গল্প। তাহলে কি এখন একে গল্পিতা বলব?


এক্ষণে আমার জন্য একটি গান গাও, পূবের হাওয়ার মতো হাওর থেকে উঠে আসা, যার ভেতর সাবানের সঙ্গে থাকবে কাঁকড়ার ঢিঁপির কিচকিচ বালি, কচুরির নীল ফুলের সামান্য হলুদ চোখের মতো অংশটুকু, নয়নজুলি থাকলে ক্ষতি নেই, শুধু ভুল করো না দিতে শ্যাওলার একটুখানি সবুজ, স্বচ্ছ স্রোতজলে যেখানে কুমারী মাছেরা শুয়ে থাকে সূর্যের দিকে তাকিয়ে।

আহা 'কোথায় যেন মায়া রহিয়া গেল!'

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আমি ফারুকের সাথে একমত... একেবারেই।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

না আমি ফারুকের সাথে একমত নই নজুর মত
এই ব্লগটি কবিতা বা গল্পে নিয়ে গেলে কি লাভ
ব্লগব্লগর হিসেবেই বেশ আছে থাক না

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।