আলুর দাম বাড়লে জীবনের দাম কমে

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: শুক্র, ২৮/১১/২০০৮ - ৩:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আলুর দাম দু’পেন্স বেড়েছে, খেয়াল করেছো?
অবশ্যই, তাইতো এ সপ্তাহে এখনও আলু কিনিনি, শনিবারে কিনেছিলাম দেড় কেজি। এখনও দু’টো আছে। মটরের দামও বাড়লো, এইতো গেল সপ্তাহেও ছিল নব্বই পেন্স, কালকে দেখি নিরানব্বই পেন্স। এক ধাক্কায় নয় পেনি। আমি ভাবতে পারছি না কি হবে? তোমার অফিসেতো এখনও ছাঁটাই শুরু হয়নি, যদি সেরকম কিছু হয় তাহলে আমাদের কী হবে জগন?
কি আর হবে পাদ্মা? আমাদের চাকরি যাবে না, আরে আমরাতো আর বুদ্ধি বিক্রি করি না, আমরা টেকনিক্যাল কাজ করি, আমাদের প্রয়োজন থাকবেই। এখানে না হলে, অন্যকোথাও, আর শেষ পর্যন্ত ভারততো আছেই। তুমি ভেবো না পাদ্মা। আমাদের ভাতি বড় হচ্ছে, ওর কথা ভাবো। সবচেয়ে ভালো হতো তুমিও যদি একটা কাজ শুরু করতে পারতে। কিন্তু ছেলেটাকে দ্যাখাশোনা করে তুমিতো সময়ই পাচ্ছো না। আচ্ছা ভাতির জন্য এ সপ্তাহে কিছু আপেল কিনো তো, ওকে একটু ফল খাওয়ানো দরকার।
আরে তুমি কি পাগল হলে? আপলের দামওতো বেড়েছে। তাছাড়া এই দেশে সব ফলই ফ্রিজে রাখে, এই ফ্রিজে রাখা ফল খেলে ভাতির ঠান্ডা লাগে, তুমি জানো না?
হ্যাঁ, তাও ঠিক। আচ্ছা আমার পে-স্লিপটা কি এসেছে এ মাসের? গেল মাসে মেলালাম, মনে হচ্ছে কুড়ি পাউন্ডের হিসেব মিলছে না। বছরে আমার বেতন হওয়ার কথা বেয়াল্লিশ হাজার তিনশ বত্রিশ পাউন্ড।বিফোর ট্যাক্স এই অংকটা মিলতে হবে। কিন্তু আমি ছ’মাসের হিসেব দেখলাম, তাতে কুড়ি পাউন্ডের মতো মিলছে না। দেখতে হবে এ মাসে সেটা এ্যাডজাস্ট হলো কি না।
নাহ্তো এখনও আসেনি। আসবে হয়তো দু’একদিনের মধ্যে। সাধারণতঃ শনিবারের পোস্টেই তোমার পে-স্লিপ আসে।
হুঁ, শোনো চেন্নাইয়ের বুকিংটাও দিয়ে দিতে হবে। এবার পুঙ্গল-এ আন্নাকে কথা দিয়েছি আমরা থাকবো। এখনই বুকিং না দিলে পরে টিকিট পেতে সমস্যা হবে, বুঝলে।
ঠিক আছে, আমি দিয়ে দেবো। তুমি যাও এখন, তোমার দেরি হয়ে যাবে। এই যে এই বক্সে তোমার জন্য দু’টো ইডলি আর খানিকটা সাম্বার দিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে নিও সময় করে। তুমি চলে গেলে আবার ছেলেটাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তাকে তৈরি করে স্কুলে নিয়ে যেতে হবে। ভাগ্যিস এখানে স্কুলে কোনও খরচ দিতে হয় না। দিতে হলে সমস্যা হতো কি বলো?
শুধু কি স্কুলে? এখানে তো ডাক্তার দেখাতেও খরচ লাগে না।অবশ্য আমাদের কোম্পানী মেডিকেল ইন্সুরেন্স করেই আমাদেরকে এখানে পাঠায়। আসি পাদ্মা।
বাই।
বাই।

দুই.
হাই জাগস্।
হ্যালো মার্টিন।
আজ দিনটি কি সুন্দর দেখেছো?
ওহ্ হ্যাঁ।
তোমার মন খারাপ নাকি? মুখটা অমন ভার করে রেখেছো কেন?
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস্-এর খবরটা দেখেছো?
দেখবো না কেন? ওহ্ ঈশ্বর, এর জন্য মন খারাপ? চিয়ার আপ ম্যান, চিয়ার আপ। কি আর হবে? ছাঁটাই হবে? তাতে কি? কিছুদিন হলিডে করে কাটানো যাবে। আরে বাবা আমাদের প্রয়োজন ফুরুবে না। মানুষ যতো যন্ত্রনির্ভর হবে, ততো যন্ত্রচালকদের দাম বাড়বে। তুমি খামোখা ভাবছো। চলো কফি নিয়ে আসি।
না না, আমি তো চা-কফি কিছু খাই না।
ওহ্, ভুলে গিয়েছিলাম।
হাই ক্রিস্টিনা।
হাই মার্টি।
তুমি কি যাচ্ছো নাকি এবার মিউনিখ-এ? বিয়ার ফেস্টিভ্যালে?
অবশ্যই। যদিও ক্রেডিট ক্র্যাঞ্চ।কিন্তু আমার তাতে কি? যা জমেছে তাতে চলে যাবে বেশ কিছু দিন। পরেরটা পরে দেখা যাবে। তুমি কি করছো? যাবে নাকি আমার সঙ্গে?
হ্যাঁ, তাতো যাওয়াই যায়। এলিজাবেথ এখনও ফেরেনি অস্ট্রেলিয়া থেকে। তার আগে তোমার সঙ্গে মিউনিখ ঘুরেই আসা যায়। তোমার সঙ্গটাও খুব লোভনীয়।
তাহলে ওই কথাই রইলো, আমরা যাচ্ছি। তুমি টিকিট বুকিং দিয়ে দাও। রাইন এয়ারেই করো। সস্তায় পাওয়া যাবে।
ওকে মাদমোয়াজেল।
হে গাইস? হোয়াটস্ আপ?
নাথিং সিরিয়াস, জাস্ট ক্রেডিট ক্রাঞ্চ।
হা হা হা হা।
আমিতো চলে যাচ্ছি, জানো তো।
কোথায় ভিকাস? কবে?
এইতো হেগ-এ, আসছে মাসে।
তুমিতো দেখি একটা ভাগ্যবান কুত্তা। এই আক্রার বাজারেও একটা চাকরি বাগিয়ে ফেললে।তাও আবার মেইনল্যান্ড ইউরোপে। যারা নিজেদের অর্থনীতির ভেতরটা সম্পর্কে কাউকে কিছু জানাতেই নারাজ।
আমেরিকার মতো সবকিছু খোলা বাজারে হলেই কি ভালো হতো? কোনও গোপনীয়তা নেই, দেখছো না কেমন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে।
কই আর পড়ছে? বরং সবকিছু রাষ্ট্র দখল করে নিচ্ছে।আমরা ফিরে যাচ্ছি সেই কমিউনিস্টদের কাছেই, হাহ্।
হে হে বালকগণ, আমাকে বলো, আমি কমিউনিস্টদের সম্পর্কে তোমাদের চেয়ে ভালো জানি।রাশিয়ান হিসেবে আমাকেতো তোমরা এটুকু ক্রেডিট দেবে, নাকি?
অবশ্যই, অবশ্যই। বলো মিশা, তোমার কি মনে হচ্ছে না আমরা কমিউনিজমে ফিরে যাচ্ছি?
আরে “মাদার ফাকারগণ” তোমরা জানো না কমিউনিজম কি জিনিস, যদি জানতে তাহলে এরকম কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারতে না। আমার দাদা মশাইকে স্তালিন সাইবেরিয়া পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেখান থেকে উনি আর ফেরেননি। ভাগ্যিস তার আগেই আমার বাবাকে তিনি জন্ম দিয়ে গিয়েছিলেন, নইলে আমারতো এ পৃথিবীতেই আসা হতো না। সাইবেরিয়া থেকে যারাই ফিরেছিল প্রাণ নিয়ে তারা কেউই আর পরবর্তীতে সন্তান উৎপাদন করতে পারেনি।
বাদ দাওতো ওসব পুরুনো কাঁসুন্দি। ক্যাপিটালিজম অন্য সবগুলো পথ বন্ধ করতে গিয়ে ওরকম ভয়ানক সব গল্প ফেঁদেছে, যার বেশিরভাগই কষ্ট-কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। মানুষ যখন পর্যাপ্ত খাবার পায়, পরনে বস্ত্র আর মাথার ওপর ছাদ থাকে তখন অন্য কিছু খোঁজে, নানা ইজমের কথা বলে। আরে আমাকে জিজ্ঞেস করো, যার পিতামহ দাস হয়ে এদেশে এসেছিল। এখনও যাও না, ব্রিস্টলে গিয়ে একটু হাঁটো, দেখতে পাবে আমার পিতামহ’র শরীরের রক্ত কোথাও না কোথাও লেগে থাকবে। আফ্রো-জিন ব্রিস্টল শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকবে সন্দেহ নেই।
আমি কিন্তু গর্ডন ব্রাউনের একনিষ্ঠ ভক্ত। দ্যাখো কি সুন্দর অর্থনীতিটা এক বারে সামলে নিলেন। ব্যাংকগুলোর মালিকানার শতকরা তেষট্টি ভাগ রাষ্ট্রের হাতে গেলে বাকি সাইত্রিশ ভাগ নিয়ে ওরা যা ইচ্ছে তাই করুগ্গে, আমাদের পয়সা মার না গেলেই হলো।
আরে এই তেষট্টি ভাগ কোত্থেকে এলো জানো তো? এই তেষট্টি ভাগ এসেছে গত তিনশ বছর ধরে সারা পৃথিবী লুট করে এনে ভর্তি করা ট্রেজারি থেকে। এর সঙ্গে জড়িত অনেক মন্বন্তর, রক্তপাত, দাস-ব্যবসা, বিভাজন, জালিয়ানওয়ালাবাগ, আন্দামান এবং আরও অনেক কিছু।
সেই সঙ্গে তোমাকে ডেমোক্রেসির কথাও কিন্তু বলতে হবে। এসবের বিনিময়মূল্য হিসেবে আমরা পেয়েছি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা।
উদার না আমার লিঙ্গ। আরেকজনের অন্ন কেড়ে নিজের অনঙ্গ মোটা করাকে যদি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা হয় তাহলে তা নিয়ে যতো কম কথা বলা যায় ততোই মংগল।
কার মঙ্গল, কিসের মঙ্গলের কথা হচ্ছে ভাই? আরসেনাল চেলসিকে দুই শূন্য গোলে হারিয়েছে কাল, আমি বাজি ধরেছিলাম আড়াইশ পাউন্ড, জিতেছি সাকুল্যে পাঁচশ। আজ সন্ধ্যায় আলেক্সেই-তে আমার তরফ থেকে সবার জন্য এক পাইন্ট স্টেলা, অবশ্য তোমাদের অন্য কোনও চয়েস থাকলে আমার আপত্তি নেই। ডিমোক্রেসির কথাই যখন হচ্ছে।
ওয়াও, গ্রেট। ডিমোক্রেসি জিন্দাবাদ।তা মুরাদ কি আসছো আমাদের সঙ্গে? তুমি বিয়ার নিও না, কোক তো পান করতে পারো।
আমি আমেরিকার তৈরি কোকাকোলাও পান করি না। আমাদের এখন আছে মেক্কা কোলা।
কিন্তু রেসিপিটা তো ওই আমেরিকা থেকেই পেয়েছো, তাই না?
সে যেখান থেকেই পাই না কেন, সবই লেখা আছে আমাদের পবিত্র গ্রন্থে। এই যে অর্থনীতির ধস, একথাও আমাদের নবী দেড় হাজার বছর আগে বলে গেছেন। এই পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কী ঘটবে সবই প্রোগ্রাম করা আছে আমাদের পবিত্র গ্রন্থে।
যেমন তুমি প্রোগ্রাম করছো ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামের জন্য, তাইতো?
হ্যাঁ।আমার প্রোগ্রামে ভুল হতে পারে, কিন্তু সেই প্রোগ্রামে ভুল নেই। দেখবে একদিন এই বাকিংহাম প্যালেসের ওপরেও উড়বে ইসলামের পতাকা। সেদিন আর বেশি দূরে নেই। এই যে ভাঙন শুরু হয়েছে এর শেষ হচ্ছে পৃথিবীর সকল মানুষ জাহেলি ধর্ম ত্যাগ করে ইসলামে দীক্ষা নেবে। আর তাতেই মুক্তি।
হ্যাঁ, কিন্তু সেতো এখনও অনেক দেরি, কী বলো?
না না দেরি নেই, প্রসেস শুরু হয়ে গেছে। আজকে আমেরিকাকে তোমরা নেতা মানছো, একদিন আফগানিস্তানকে তোমাদের নেতা মানতে হবে।
আর ইউ সিরিয়াস?
ও ইনশাল্লাহ্।
সালাম আলেকুম ব্রাদার।
ওয়ালেকুম সালাম।আসছো তো কাল কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ডা. জাকির নায়েক ওয়াজ ফরমাবেন।
হাউ এক্সসাইটিং ব্রাদার!
ও হ্যাঁ, ভালো কথা। তুমিতো জানো ব্রিটেনে মসজিদগুলোর মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা হচ্ছে, কোন্ মসজিদ দেখতে সবচেয়ে সুন্দর। এখন সর্বশেষ ইস্ট লন্ডন মসজিদ আর রিজেন্ট পার্ক মসজিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। তুমি কিন্তু ইস্ট লন্ডন মসজিদকে ভোট করতে ভুলো না। আমি তোমাকে লিংক পাঠিয়ে দিচ্ছি।
আল্লাহ্র ঘর নিয়ে প্রতিযোগিতা? এটা কি ঠিক হচ্ছে?
আরে কি বলছো? ডা. জাকির নায়েক বলেছেন, প্রতিযোগিতায় কোনও অসুবিধা নাই। আমাদের প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকতে হবে, সবাইকে দ্বিনের পথে আনতে হবে। এখন আমাদের রিজেন্ট পার্ক মসজিদের কাছ থেকে ইসলামের সেন্টার সরিয়ে ইস্ট লন্ডন মসজিদে আনতে হবে বুঝলে। এজন্য যতো বেশি ভোট করা যায় ততো ভালো। তুমি এক কাজ করো না, আজ সবাই যখন চলে যাবে তখন সবার কম্পিউটারে একের পর এক লগ-ইন করে প্রত্যেক কম্পিউটার থেকেই একটা করে ভোট করে দাও না।
হ্যাঁ তা দেওয়া যায়, সবার পাসওয়ার্ডই তো আমার হাত দিয়েই করা। ঠিক আছে করে দেওয়া যাবে।
আরেকটা কথা, এইবার কিন্তু হজ্ব ফাণ্ড আরও বিশাল। তাই তুমি যতো জনকে সম্ভব হজ্বে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে বলো।
অবশ্যই বলবো। কিন্তু এবার আমরা কোথায় যাচ্ছি দাওয়াতের কাজে?
কেন স্কটল্যান্ড, তুমি জানো না? সেখানে তো এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। আমাদের স্কটিশ ব্রাদাররা হল ভাড়া করেছেন, মদিনা থেকে চীফ গেস্ট আসছেন। এবারতো আমাদের জন্য অনেক বড় চমক অপেক্ষা করছে জানো তো?
কি সেটা?
এক্ষুনি বলে দিলেতো আর চমক থাকলো না। তারপরও তোমাকে অব দ্য রেকর্ড বলছি, একজন রেভারেন্ড এবার সর্বসম্মুখে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ঘোষণা দিবেন।
কী বলো তুমি?
ইয়াহ্ ব্রাদার। তুমি কেন বুঝতে পারছো না, এদের অর্থনীতি ধ্বংস হচ্ছে, চার্চগুলোর হাতে আর পয়সা নেই, এখনই সুযোগ, এই সুযোগে সব চার্চ কিনে ফেলে মসজিদ করে ফেলতে হবে, বুঝলে।
আর সেই সাথেৃ
চুপ চুপ, এসব কথা প্রকাশ্যে বলতে নেই।
দ্যাটস্ ট্রু। লেটস্ ওয়ার্ক নাও।
ওক্কে ব্রাদার।

তিন.
পাদ্মা প্লিজ আমাদের তেলের খরচ কমাও, অনেক বেশি তেল খরচ হচ্ছে।
কী বলছো তুমি? আমিতো এক লিটার তেল দিয়ে মাস চালাচ্ছি। এর চেয়ে আর কমাবো কি করে?
আজ থেকে দোসা খাওয়া বন্ধ, দোসা ভাজতে তেল লাগে অনেক।
ঠিক আছে, তোমার অসুবিধে না হলে আমার কোনও অসুবিধে নেই।
তার চেয়েও বড় কথা হলো, আমাদের ল্যান্ডলেডির সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমরা এই বড় রুমটা ছেড়ে দিয়ে ছোট রুমটাতে চলে যাবো, বড় রুমটার ভাড়া সাড়ে চারশ পাউন্ড, ছোট রুমটাতে গেলে অন্ততঃ একশ পাউন্ডতো বাঁচানো যাবে।
কিন্তু ছোট রুমটাতে তো একটা সিঙ্গল খাট ফেলার পরে আর কোনও জায়গাই নেই। তোমার ছেলে যে রকম দৌঁড়ঝাঁপ করে, ওর জন্য তো একটু খানি হলেও জায়গা দরকার, নাকি?
দ্যাখো, সামনে খুব খারাপ সময় আসছে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে এখানে টেকাই মুশকিল হয়ে যাবে। যে কোনও মুহূর্তে আমাদের অফিসে ছাঁটাই শুরু হবে।
কিন্তু শুনেছি লেম্যান ব্রাদার্স, সিটি ব্যাংক আর মেরিল লিঞ্চের বসরা নাকি একেকজন কয়েক মিলিয়ন করে শুধু বোনাসই নিয়েছে এ বছর? তাহলে তোমাদের মতো ছোট কর্মটচারীদের শুধু শুধু ছাঁটাই করবে কেন?
সেটাতো আমি জানি না। আমার চিন্তা আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তুমি প্লিজ তেল খরচ কমাও। ভেবেছিলাম আরও কিছু টাকা জমলে তোমাদের নিয়ে লন্ডন আই দেখতে যাবো, তা আর হলো না। দেখি সামনে পরিস্থিতি ভালো হলে অবশ্যই নিয়ে যাবো। ছেলেটাকে এখনও লন্ডন শহরটাই ঘুরিয়ে দেখানো হয়নি।
বাদ দাও ওসব। তুমি অন্য কোনও বাসা দ্যাখো না, প্রয়োজন হলে লন্ডনের একটু বাইরে হলেও অসুবিধে নেই, অন্ততঃ ভাড়াতো কমবে।
তুমি কী বলো পাদ্মা, পাগল হলে? এই যে এখান থেকে ক্যানারি ওয়ার্ফ মাত্র দশ মিনিটের হাঁটা পথ। লন্ডনের বাইরে গেলে মাসে মাসে ট্রাভেল কার্ড কিনতেই বেরিয়ে যাবে শ’দুয়েক পাউন্ড। না না আমাদের ওই ছোট রুমটাতেই শিফ্ট করতে হবে। না হলে তখন অন্য কোথাও দেখবো। দরকার হলে তোমরা ইন্ডিয়ায় চলে যাবে, আমি কারো সঙ্গে রুম শেয়ার করে থাকবো।
আমিতো আগেই বলেছিলাম, আমরা ইন্ডিয়াতেই থাকি। তুমিইনা জোর করলে।
আমি কি আর জানতাম, পরিস্থিতি এতোটা খারাপ হবে?
তাহলে এক কাজ করো, আমি ছেলেকে নিয়ে চলে যাই ইন্ডিয়া, তুমি ওই ছোট রুমটাতে একা থাকো, ক্যামন? দেখবে অনেক খরচ কমানো যাবে। কী বলো?
ঠিক আছে, ভেবে দেখি আরেকট্।ু তাছাড়া মাস খানেক পরেই তো কোম্পানীর টিকিট পাচ্ছি ইন্ডিয়া যাওয়ার।
সেটাও ঠিক।

চার.
এ মাসে কিন্তু এখনও টাকা পাঠানো হয়নি দেশে।
এইতো কালই পাঠাবো।
আর বিলগুলো?
কতো হয়েছে সব মিলিয়ে দেখেছো?
হ্যাঁ, প্রায় ছ’শোর কাছাকাছি।
মর্গেজ যাবে এগারো তারিখে। তারপরই যা থাকে তাই দিয়ে বিল মিটিয়ে যা বাকি থাকে তাই-ই দেশে পাঠাবো।
কতোই বা আর বাকি থাকবে? তাছাড়া এখানকার খরচও তো আছে নাকি?
কিন্তু দেশে না পাঠালে যে, ওরা সামলাতে পারবে না। এখানে আমরা এক ভাবে না একভাবে চালিয়ে নিতে পারবো, কিন্তু ওরা?
এক ভাবে না এক ভাবে মানে? এখানে কি আমরা মাটি খেয়ে থাকবো নাকি?
খেপছো কেন? খ্যাপার কি হলো?
খেপবো না মানে? তুমি যা বলো তা কি ভবেচিন্তে বলো?
না ভেবে বলার কি আছে? রুম দু’টোর ভাড়া, তোমার-আমার বেতন মিলিয়ে মর্গেজ দেওয়ার পর যা বাকি থাকে তা নিয়েই তো আমাদের হিসেব কষতে হয়। প্রতি বারই তুমি দেশে টাকা পাঠানোর কথা উঠলেই রেগে যাও। কিন্তু তোমাকে তো প্রথম থেকেই বলেছি যে, এখানে খেয়ে থাকি বা না খেয়ে থাকি, দেশে টাকা পাঠাতেই হবে। কিন্তু তুমি প্রতি মাসেই এটা নিয়েই ঝগড়া শুরু করো।
আমি ঝগড়া শুরু করি?
হ্যাঁ, করোই তো। তুমি নিজে একটু বুঝেশুনে খরচ করলেই কিন্তু অনেকখানি সেভ করা যায়।
আমি বুঝে-শুনে খরচ করা মানে?
যখন ইচ্ছে তখন বাজার করতে যাও, প্রয়োজন না থাকলেও তোমার ইচ্ছা হলেই কিনে ফেলছো যখন যা দেখছো, প্রতি সপ্তাহেই মেহমান দাওয়াত দিচ্ছো, তাদের জন্য যেখানে দু’পদের রান্না হলে চলে, সেখানে তুমি রান্না করছো সাত-আট পদ। তুমি যে ভালো রান্না করো সেটা সবাই জানে, কিন্তু তাই বলে এই দুঃসময়েও মানুষ ডেকে বার-তের পদ রান্না করে রান্নার প্রশংসা শুনতে হবে, তার কি মানে আছে?
আসলে কি জানো? তোমার সঙ্গে কথা বলাই উচিত না। আর একটা কথা শোনো, আমি এরকমই, পারলে সহ্য করবে, না পারলে নেই।
হ্যাঁ, সেটাতো জানি। পকেটে পয়সা নেই, তুমি ধার করে রেস্টুরেন্টে খাবে। তুমি ফুটানি দেখানোর জন্য ভালো ভালো গিফট্ কিনবে। কিন্তু পরে যখন এ্যাকাউন্টে টাকা থাকবে না, মর্গেজ ডিফল্ট করবে তখন তোমাকে কিছুই বলা যাবে না।
ঠিকাছে, এখন থেকে তোমার আয় তোমার ব্যায় তুমিই দেখো। আর আমারটা আমি।সবাই প্রতিটি খরচে অর্ধেক অর্ধেক দেবো। দেখি তারপর কি হয়।
সেটা যে আমরা পারবো না সেটা তুমিও ভালো করে জানো, আমিও জানি। দ্যাখো, তোমাকে আবারও বলছি, শুধু একটু সামলে চলো, দেখবে ধীরে ধীরে সামলে উঠছি আমরা। আরেকটা কথা, যতো কিছুই হোক, রিসেশন হোক আর ক্যাপিটালিজমের মরণ হোক, আমাদের তো দেশের মুখগুলোকে চালাতে হবে, আমাদের মধ্যবিত্ত অবস্থান বজায় রাখতে হবে, নিজেদের শখ আহ্লাদও এক-আধটু পুরণ করতে হবে। আমার মা কিংবা তোমার মাকে দ্যাখোনি, তারাতো বাবার ওই বেতনটুকু দিয়েই এতোগুলো মুখ সামলে একেকদিন একটু পায়েস কিংবা মাসে একদিন পোলাও মাংস খাওয়াতেন আমাদের। তাহলে আমরা পারবো না কেন বলো? আমরাও পারবো।
সত্যিই পারবো তো?
অবশ্যই পারবো।
আমাকে একটু আদর করো।
এইতো আমার লক্ষ্মী বউ।

পাঁচ.
আপনার পেপারটা কিন্তু চমৎকার ছিল। গরীবের অর্থনীতি নিয়ে যেভাবে আপনি বললেন, তা কিন্তু আমাকে প্রচণ্ড ভাবিয়ে তুলেছে।
আপনার পেপারটাও অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে। কী করে এই মন্দার সময় আমরা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য জোগাতে পারি তা নিয়ে দিকনির্দেশনাগুলি আসলেই চমৎকার।
ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু একটি বিষয় আমাকে প্রশ্ন করতেই হচ্ছে, আচ্ছা বলুনতো এই যে, সারা বিশ্ব যখন মন্দা, বড় বড় কর্পোরেট ব্যাংকগুলোর পতন আর ক্যাপিটালিজমের ভাগ্য নিয়ে হেঁদিয়ে মরছে তখন আপনারা বলছেন যে, বিশ্বব্যাপী মন্দার এই আঘাত আপনাদের অর্থনীতিতে পড়বে না, আপনারা টাকার দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন, কী করে করছেন এসব বলুনতো?
সে অনেক বিস্তারিত বলতে হবে। বাদ দিননা ওসব।
ঠিক আছে, তাহলে অন্য কথাই হোক।
তাহলে কার্ল মার্কসই ঠিক ছিলেন। তার কথাই অক্ষরে অক্ষরে ফলে গ্যালো কী বলেন?
তাতো খানিকটা ফলবেই। এতো কথা বলেছেন ভদ্রলোক, একটা না একটা কথাতো ফলতেই হবে, তাই না? অর্থনীতি নিয়ে ভদ্রলোক কতো কথা বলেছেন অথচ নিজের পরিবারকেই উনি ঠিকমতো ভরণ-পোষণ দিতে পারেননি। পুরোপুরি নির্ভর করেছিলেন এঙ্গেলসের সাহায্যের ওপর। জার্মানী থেকে ইংল্যান্ড আসার ভাড়াটা পর্যন্ত তার ছিল না, ভাবতে পারেন?
এরকমই তো হয়, প্রদীপের নীচের আঁধার থাকে।
আরে ভাই রাখেন ওই সব তত্ত্ব কথা। সারা বিশ্বের মানুষের পেটের কথা নিয়ে বড় বড় বুলি ছেড়েছেন, অথচ নিজের পেটই খালি। গোড়াতেইতো যদি গলদ থাকে তাহলে এসব নিয়ে আর কথা বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
আপনি যাই-ই বলেন না কেন, ক্যাপিটালিজমের মৃত্যু ঘটেছে, এটা আপনাকে স্বীকার করতেই হবে। ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন প্রাইভেটাইজেশন যে আসলেই চলতে পারে না তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো লিম্যান ব্রাদার্স, গোল্ডম্যান সাকস্ কিংবা অন্যান্য পাবলিক লিমিটেড ব্যাংকগুলো। ব্যাক্তির লোভের কাছে এগুলো যখন পুড়ে ছাই হতে বসেছে তখনই রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হলো। কার্ল মার্কস বা সোস্যালিস্ট ইকনোমিক থিওরি কিন্তু এই রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের কথাই বলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, অনেক ফলাও করে ফ্রি মার্কেট ইকনোমি, গ্লোবালাইজেশন নানা অভিধা আমাদের গেলানো হয়েছে। এখন যখন ক্যাপিটালিজম নিজেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে বসেছে তখন আর এসব শব্দের কচকচানি শোনা যাচ্ছে না।আসলে এই সব শব্দ দিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী দেশগুলি অনুন্নত এবং অর্থনৈতিক ভাবে কম শক্তিশালী দেশগুলিকে বাধ্য করতো অস্ত্র কিনতে, দেশের সম্পদ লুট করার অবাধ স্বাধীনতা নিতো, শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করা কতিপয় শয়তানের হাতে ছেড়ে দিতো এই সব রাষ্ট্রগুলোকে। কি ঠিক বলিনি?
আপনি ঠিক কি বেঠিক, সেটা জানি না, কিন্তু আপনার কি ধারণা এসব এখন বন্ধ হয়ে যাবে? হাহ্ স্বপ্ন দ্যাখেন ভাই, স্বপ্ন দ্যাখেন, স্বপ্ন দ্যাখা খারাপ না।
হাসছেন আপনি? হাসুন। কিন্তু আমার মনে হয় একটা পরিবর্তন আসবেই। এই তো আমেরিকায় যদি এবার ওবামা ক্ষমতায় চলে আসে তাহলেই দেখবেন, পৃথিবী কেমন বদলে গিয়েছে।
এই ভবিষ্যদ্বাণীও কি আপনার কার্ল মার্কস করে গিয়েছেন নাকি?
আপনি ঠাট্টা করছেন। কিন্তু একটা পরিবর্তনতো আসবেই, আপনি দেখে নেবেন।
হ্যাঁ, তাতো দেখবোই। না দেখে চোখ বন্ধ করে তো আর রাখা যাবে না। কিন্তু সেই পরিবর্তনে আর যাই-ই হোক আপনার-আমার ভাগ্য বদলাবে না।
আপনি খুব মাইক্রো চিন্তা করছেন, ম্যাক্রো চিন্তা করতে শিখুন। ম্যাক্রো বদলালে মাইক্রো বদলাতে বাধ্য।
ওহ্ ভুলেই গিয়েছিলাম, আপনি তো আবার মাইক্রো ফিন্যান্সের দেশের মানুষ। ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে আপনারা বৃহৎ পুরষ্কার জয় করে নিয়েছেন। অবশ্যই, আপনার কথাই ঠিক। আপনার যুক্তির পরে আর কোনও যুক্তিই খাটে না। চলুন ডিনার সার্ভ করা হয়েছে। খেয়ে নিই গিয়ে। এই রিসেশনের সময় ডিনারটায় না আবার কৃচ্ছতা দেখানো হয়?
না না, এরা খাবারটা সব সময়ই দারুন সার্ভ করে। যতোবারই এদের সম্মেলনে এসেছি, থাকা-খাওয়ার ব্যাপারে এরা বরাবরই এক নাম্বার।আর দারুণ দারুণ সব পানীয়,সেই সঙ্গে পানীয় পরিবেশনকারীরাও কম যায় না। আমিতো সারা বছর ধরে এই কনফারেন্সটার জন্যই অপেক্ষা করে থাকি। নিশ্চয়ই এবারও আশাহত হবো না। চলুন যাওয়া যাক, ডিনারের পরে আবার আমার আরেকটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। আমাকে একটু আগেই বেরুতে হবে।
অবশ্যই, চলুন যাওয়া যাক।
চলুন।


মন্তব্য

রণদীপম বসু এর ছবি

ভালো লাগলো পড়ে।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

তানবীরা এর ছবি

সবই সত্যিই কথা কিন্তু কোন পরিবর্তন নেই, এর মধ্যেই বেচে থাকা।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

ভাল লাগলো। দৈনন্দিন জীবনের আর্থিক কষ্টের সাথে সবাই পরিচিত আমরা। এবার সাথে জুটেছে অর্থনৈতিক মন্দার কষ্টও।

স্পর্শ এর ছবি

বর্তমানের একটা সাবলীল বর্ণনা। একটা মেসেজও ছিল বোধ হয়। ধরতে পারিনি ঠিকমত। ভাল লেগেছে।
....................................................................................
অতঃপর ফুটে যাবার ঠিক আগে হীরক খন্ডটা বুঝলো, সে আসলে ছিল একটা মামুলি বুদবুদ!


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

রুমি [অতিথি] এর ছবি

যুগের লেখা,
সব জায়গাতে এই অবস্থা ... ... মাথা ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা

(ইসমতের ইমেইল ঠিকানাটা পেতে পারি কি? এক সময়ের বন্ধু। এ পাঠালে পেয়ে যাব)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।