শরীরী-অশরীরী

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: বুধ, ০১/০৪/২০০৯ - ৬:১৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ধরো এক নদী আমি, চোখ পাতলে স্রোতধারা; বুক রাখলে কলকল; শরীর ডোবালে বীনা বাজে, অসংখ্য জলপরী প্রতিটি রোমে ঠোঁটের চিহ্ন আঁকে, আরব্য রজনী থেকে রক্তমাংসের নারী বেরিয়ে এসে নাভির নীচে ঘূর্ণি তুলে নাচে; ধরো আমি এক নদী, উদাম রাতে পূর্বদেশীয় মোলায়েম চাদর ওড়ানো নদী।

২.
যা বলি, যা বলি না, একেবারেই তুচ্ছ কোনও কথা, বলতে চেয়েও ফিরিয়ে নিই, যেমন ধরো, কখনও কি বলেছি, এসো আমাদের দু’জনের হাতখানি মেপে দেখি, জানি তোমারটা লম্বা, দৃঢ়, আঙুলে আঙুল রেখে মেপে দেখি হাতখানি, বলিনি কখনও, যদিও এই ভাবনাতেই হৃদয়ের কাঁপুনি বাড়ে, তোমার হাতখানি আমার ধরা হাতে আমার হয়ে যায় সম্পূর্ণ – আমি তখন খেলতে বসি আদিম শিশুর রান্নাবাটি।

৩.
তোমার নগ্নতায় ঘামে জিহবায় ধীরে ধীরে তুলে দিতে ভাবনা, বেশ লাগে; কাতরে কাতরে ভেজা মৃত্যু চাইতেও লাগে ভালো, চোখের ডাকবাক্সে সময় তারিখ ফেলেছি তাই, উদোম রাত আসছে শিগ্‌গিরই।

৪.
বাহু ও চুম্বণ পড়েছি বহুকাল আগে, ভুলে গেছি, এখন চতুর্থ চুম্বণে মূর্ত করে তোলা যায় আমায়, ভুলে যাওয়া প্রার্থণার ভাষাও মনে পড়ে যায় গরম নিঃশ্বাসে, স্বর্গের সিঁড়ির প্যাচানো দেয়া, বদ্ধ দরোজা সব উন্মুক্ত হয়ে যায় আঙুল পৌঁছুলে কবাটে; একের পর এক আলো জ্বলে ওঠে লজ্জারা প্রজাপতি হয়ে যায়, ওড়াওড়ি করে বিছানার চারপাশে, ঠিক তখন একসঙ্গে অনেক স্বর্গপ্রত্যাশী গোলাপ ফুঁপিয়ে ওঠে; গোলাপ অবহেলা সইতে পারে না।

৫.
চোখে চোখ ছোঁয়ালে মুহূর্ত থেমে যায়, ক্রমশঃ সম্মোহিত হয় মন, শীতে সিঁটিয়ে যাওয়া হাত জলঢোঁড়ার মতো লকলকিয়ে ওঠে মুখের ওপর, শুষ্ক ঠোঁটের ওপর পুড়ে বাষ্প হওয়ার আগে মোম গলে পড়ে, ঘুম ভাঙলেই তৃষ্ণার মতো আড়মোড়া ভাঙে শরীরে শরীর ডোবানোর ইচ্ছে।চোখ আসলে জ্বলে ওঠে না, চোখ কথা বলে, ডাকে, নিবেদন করে,যতোক্ষণ না সে মৃতের যাত্রায় যায়, চোখের ঝরা জল শুকোলে তার দাগতো শবযাত্রাই; তাই জেগে উঠে নিজেকে ফসিলের মতো মনে হয়, যার বহুকাল আগেই মৃত্যু হয়েছে। জিভে জিভ ছোঁয়ালে রাত ডুবে যায় সরস নিকষ ভালোবাসায়।

৬.
যখন দেখি, তখন শুধু তোমাকেই দেখতে চাই; যখন গায়ে গা লাগিয়ে থাকি তখন শুধু তাই-ই চাই, চুম্বণ চুম্বণেই থাকতে চাই, ঘুমন্ত তোমার মুখ শিশুর সরলতা জেগে থেকে দেখি রাতের পর রাত, বিকেল থেকে যে রাতের অপেক্ষার শুরু, কখনও শেষ না হওয়ার প্রার্থনা চলে দিনভর, রাত ঘুম ঘুমন্ত সরলতা সব শোবার ঘরময় এলোমেলো ছড়ানো, এই সব অগোছালো ইতিউতি আলমিরায় সাজাতে বলো না আমায় কখনও।

৭.
হাত কখনও মিথ্যে বলে না, তারা পরতের পর পরত ছায়া দেয়, যতোক্ষণ আমি নগ্ন থাকি, যতোক্ষণ আমার শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে, যতোক্ষণ তুমি শেষ না হও, যতোক্ষন না আমার ভেতরের তোমাকে কষ্টদায়ী মনে হয়, যতোক্ষণ আমি সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ক্লান্ত না হই, ক্লান্তি শব্দটা খুব ছোট এবং তা সম্পূর্ণ বোঝার জন্য যথেষ্ট নয়; এর ব্যাপকতা জানে শুধু তোমার ঘামগন্ধ বুক, যেখানে ফোঁটা ফোঁটা ক্লান্তি জমে থাকে।

৮.
পুরোনো উষ্ণতার শপথ, এসো আরেকবার আমরা মিলিত হই নাচে, হাত ধরো এক হাতে, আরেক হাত কোমরের খাঁজে, এখনও সেখানে জমেনি মেদ; শপথ সেই স্বপ্নের যা একসময় ছিল আমাদের সময়ের মাঝখানে জলের নদীর মতো, চলো নাচি আরেকবার, দিনের মতো দীর্ঘ সময় ধরে, অসম্পূর্ণ জীবন সম্পূর্ণ করার এই নাচ, চোখে যাদু ফিরে আসুক, সুরের ভেতর গলে যাওয়া যাক; শেষ শপথ সেই জরির জ্যোছনা রাতের, যে রাতে আঁধারের চাদর ছাড়া আর কিছুই ছিল না আচ্ছাদন, চলো সেই রাতের স্মরণে আরেকটি বার আমরা মিলিত হই, নাচে।

৯.

এক টুকরো মেঘ সারাক্ষণ আমার পিছে পিছে হাঁটে, কখনও মাথার ঠিক কাছে, কখনও ঘাড়ের কাছটাতে, আমি কাতর অনুরোধ করি, সরে যাও, যায় না, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, বৃষ্টিও ঝরায় না।
আমি দেখতে চাই না পেছন ফিরে কি আছে সেখানে, মেঘ না অন্য কিছু? আমি অতীত স্মরি না, ভাবতেও ভালোবাসি না, সেই সুখময়তার কথা। সেই প্রতিশ্রুতি, যা রাখেনি কেউ, বন্ধুতা যা ভেঙে গেছে মাটির বাসনের চেয়েও তুচ্ছতায়।
তার চেয়ে মেঘ তুমি ফিরে যাও আরাবল্লীতে, ঘন হও বৃষ্টির জন্য; কথা ছিল আমিও যাবো, এখন আর বৃষ্টি ভালো লাগে না আমার, কারণ আমার যা ছিল দেয়ার তা দিয়েছি, কালিদাস আমায় রাধা করে রেখে গেছে এই ঊষরতায়।

১০.
মরেছি সেদিন, পনুরুজ্জীবনের প্রতিশ্রুতি ছাড়াই ক্রুসবিদ্ধ হয়েছি, সেই মুহূর্তে পৃথিবীর অর্থ স্পষ্ট হয়েছে, কারণ একটা গোটা জীবন পার করার শক্তি ছিল আমার, শুধু শূন্যতায় ভরা ছিল না, তাও সত্য গোপন করেছি অনায়াসে, নিজেরই কাছ থেকে; চারদিকে উড়ছে শুকনো মাংসলোভী পাখি, তাদের চোখে উদাস চাউনি, তবে কি তাদের ক্ষিদে নেই? ক্রুসবিদ্ধ আমি তবে যীশুর চেয়েও মূল্যবান; এখন আকাশে তাকাবার আমার অখণ্ড সময়, গেল শীতে যেসব পাতা ঝরেছিল, তা এখন নতুন করে ফুটছে, যীশুকে তাদের প্রয়োজন নেই একটুও।


মন্তব্য

অনীক আন্দালিব এর ছবি

অসাধারণ! এক কথায় বললে। আরো অনেকবার পড়বো আমি এই লেখাটা! যখনই ভাবছি এক একটা লাইনের পরে, যে এখানে হয়তো একটা রিলিফ পাবো। পাইনি। সেটাই হয়তো লেখাটার সৌন্দর্য। একটা একটা দৃশ্যের গাঁথুনি অনেক ভাল হয়েছে। আমার ভাল লাগছে পড়তে।

গৌরীশ রায় এর ছবি

সিম্পলী সুপার্ব

'''''''''''
তৃপ্তি আমার অতৃপ্তি মোর
মুক্তি আমার বন্ধনডোর

'''''''''''
তৃপ্তি আমার অতৃপ্তি মোর
মুক্তি আমার বন্ধনডোর

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আমি এইসব লেখায় মন্তব্য করিনা কারন মন্তব্য করার আর কিছু থাকেনা ।
এইসব লেখা কেবল আক্রান্ত করে, জড়িয়ে ধরে, নাড়িয়ে দেয় আমুল ।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নজমুল আলবাব এর ছবি

আমি এইসব লেখায় মন্তব্য করিনা কারন মন্তব্য করার আর কিছু থাকেনা ।
এইসব লেখা কেবল আক্রান্ত করে, জড়িয়ে ধরে, নাড়িয়ে দেয় আমুল ।

আমিতো এই কথাটাও বলতে পারছি না দুদিন থেকে।

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

মাল্যবান এর ছবি

অনেকদিন পর সচলায়িত হয়েছি। লেখা পড়তে পড়তে পেছন দিকে হাঁটতে হাঁটতে এ লেখাটির কাছে এসে থমকে দাঁড়ালাম । বার তিনেক পড়া হলো মাসুদা, এ মন্তব্য লেখার পর আর কোনো লেখা পড়বো না এখন।
উদ্ধৃতি দিলে পুরো লেখাটিকেই দিতে হয়। এমনই জরির কাজ । বুনন ।
তাই সে কাজটি করছি না । লেখাটির জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা।
আপনার লেখার সাথে আমার প্রথম পরিচয় একটি গল্পের মাধ্যমে। যতদূর মনে পড়ে, গল্পটির নাম ছিলো এই ধরণের- ' নাটকের ভেতর নাটক' বা 'নাটকের ভেতর খসড়া'। সঠিক নামটি দেখতে একটি তালাবন্ধ ঘর খুলে পুরোনো লিটল ম্যাগাজিনের ডাঁই থেকে "সাগ্নিক" নামক একটি লিটল ম্যাগ (যার সাথে আমি অল্পবিস্ত্রর জড়িত) বের করতে হবে। সেটা এই মুহুর্তে করতে চাইছি না । তবে একটি বৈরাম নামক পাগলের ও প্রিন্সেস --- (নামটা ভুলে গেছি) একটি যাত্রার নায়িকা ছিলো গল্পটিতে। সে গল্পটি ভালো লেগেছিলো এ লেখার মতই । এখানে আপনাকে দেখে ভালো লাগলো ।

অনিশ্চিত এর ছবি

অনেক না বলা কথা বলে দিয়েছেন। অনেক অনেকবার বলা কথাগুলো বলেছেন নতুনভাবে।
‌‌-------------------------------------
হাত বাঁধা, কিন্তু দড়ি মুক্ত - হায় পৃথিবী!

‌‌-------------------------------------
হাত বাঁধা, কিন্তু দড়ি মুক্ত - হায় পৃথিবী!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।