জাতি ও জাতীয় পরিচয়

মন মাঝি এর ছবি
লিখেছেন মন মাঝি [অতিথি] (তারিখ: রবি, ২৭/০১/২০১৩ - ১২:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মুখবন্ধের মুখবন্ধ

বেশ কয়েক বছর আগে ভাষা আন্দোলন ও ভাষার সূত্রে বাঙালি জাতীয়তাবোধের বিবর্তন নিয়ে ইংরেজিতে একটা লেখা দাঁড় করাতে গিয়ে একদম গোড়ার অ-আ-ক-খ প্রশ্নগুলি নিয়েই বেশ হাবুডুবু খেয়েছিলাম। জাতি কি, জাতীয়তাবাদ কি, জাতীয় পরিচয় (‘ন্যাশনাল আইডেন্টিটি’) কি এসবই যদি ঠিকমত না জানি, তাহলে জাতীয়তাবোধের বিবর্তন নিয়ে লিখি কিভাবে। এই প্রশ্নগুলি নিয়ে তখন থেকেই মনের মধ্যে কৌতুহল নাড়াচাড়া করছিল। সেইসাথে লিখতে গিয়ে আরও প্রশ্ন জেগেছিল - রাষ্ট্র, জাতি, জাতীয়তা, জাতীয় পরিচয়, জাতীয় স্বার্থ, দেশপ্রেম, জাতি বা সমষ্টির বেশে সমষ্টির নির্বাচিত বা স্বনির্বাচিত প্রতিনিধিত্বপরায়নদের এই ধরণের সামগ্রিক-সামষ্টিক গোষ্ঠীগত বিষয়গুলিতে কর্তৃত্বশীলতা, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঐ গোষ্ঠীভুক্ত বিভিন্ন ধরণের এলিট শ্রেণী বা মাইক্রো-গোষ্ঠী দ্বারা আর্টিকুলেটেড ও নির্ধারিত বা আরোপিত হয়ে থাকে - তার সাথে ব্যক্তি তার ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রেক্ষিত থেকে কিভাবে ও কতটুকু নিজেকে খাপ খাওয়াতে ও সম্পর্কিত করতে পারে, কিম্বা পারে না। না পারলে - পুরো বা আংশিক, সেই না পারাটার নৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার ও অনধিকার, বৈধতা বা অবৈধতা কতটুকু, এবং সেটা কিভাবে নির্ধারিত হবে বা হওয়া উচিত।

এর সাথে ছিল আমাদের ’৫২-র ভাষা আন্দোলন আর তার অগ্র ও পশ্চাৎ সূত্র ধরে বাংলাদেশে আমাদের ‘জাতীয় পরিচয়’ সংক্রান্ত চিন্তাভাবনার বিবর্তন ও পার্সেপশন সম্পর্কে আগ্রহ। রাজনীতির ময়দানে মুসলমান না বাঙালি, পাকিস্তানি না বাঙালি এবং পরে ‘বাঙালি না বাংলাদেশি’ – এইসব নিয়ে কম মাথা ফাটাফাটি তো হয়নি।

তো এগুলি বুঝতে হলে আগে জাতি, জাতীয়তা, জাতীয় পরিচয় – এইসব মৌলিক টার্মগুলি তো আগে পরিষ্কার হতে হবে। তার উপরে বাংলায় এই শব্দগুলি নিয়ে বেশ ধোঁয়াশা রয়েছে মনে হয়, যা বেশ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। ইংরেজি যে ‘নেশন’ শব্দের বঙ্গানুবাদ হিসেবে বাংলায় ‘জাতি’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়, যদ্দুর বুঝেছি ইংরেজিতে এবং পাশ্চাত্যের কনটেক্সটে তার বেশ সুনির্দিষ্ট একটা অর্থ রয়েছে যা বিশেষ একটা ফেনোমেননকে বোঝায়। অথচ বাংলায় আমরা ‘জাতি’ বলতে অনেক কিছুই বুঝি – ‘নেশনও’ বুঝি, আবার এথনিক/নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, ভাষিক গোষ্ঠী, থেকে শুরু করে ধর্ম, বর্ণ – ত্বকবর্ণ ও হিন্দু ধর্মীয় বর্ণপ্রথার বর্ণ, শ্রেণী, বংশ, পেশা, লিঙ্গ, প্রাণীর প্রজাতি হয়ে এমনকি ফুলফল বা প্রায় যে কোন সমলক্ষণযুক্ত শ্রেণীবিন্যাসকেই বুঝি। এর ফলে বাংলায় এই আলোচনা অনেক সময় একটি অর্থে শুরু হয়ে অনেক সময় নিজেদের অগোচরেই কাছাকাছি অন্য অর্থে পিছলে বা সুইচ করে অর্থের তালগোল পাকিয়ে ফেলে এবং তখন একটা থেকে আরেকটা কেন, কখন ও কতটুকু পৃথক সেই জট ছোটানো অনেক সময় বেশ কঠিন হয়ে পড়ে – এমনকি হয়তো সেটা নজরেই আসে না। আলোচনা তখন দিশা হারিয়ে ফেলে।

যাহোক, এই চিন্তাগুলি নিয়েই বেশ বিয়াকুল ছিলাম। উপরন্তু, কত আলাপ প্রসঙ্গেই যে এই গালভরা শব্দগুলি প্রায়ই উঠে আস। অথচ সমস্যা হল আমি কত কম জানি এসব বিষয়ে। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, বা ইতিহাসবিদও না, ঐসব বিষয়ের ছাত্রও না - নিতান্তই আম পাব্লিক। এসব বিষয়ে পড়া-জানা-শোনাও শূন্যের কোঠায়। আম-পাব্লিকের মত উপ্রে উপ্রে ভাসা-ভাসা সুপারফিসিয়াল আভিধানিক অর্থগুলি হয়তো জানি কিম্বা পত্রিকার কলামিস্টদের নিজেদের বিবিধ এজেন্ডা মাফিক পেচকি মারা ভাষ্য বা রাজনীতিবিদদের মাঠ-গরম করা বক্তিমা কিছুটা জানি, কিন্তু আমার সেই পল্লবগ্রাহীতার দৌড় বিষয়ের শিকড় তো দূরে থাকুক, এমনকি কাণ্ড বা শাখা-প্রশাখাও নয় - স্রেফ ঐ পল্লব পর্যন্তই। সুতরাং, এই লেখাটা আসলে আমার সেই পত্রপল্লবের স্তর থেকে কোনমতে স্রেফ শাখাপ্রশাখার স্তরেই উঠে আসার এক করুন প্রয়াস। অন্য কাউকে বোঝানো নয়, বরং নিজের কাছেই বিষয়টা পরিষ্কার করার একটা চেষ্টা মাত্র।

এই লেখাটা আসলে নতুন কোন লেখাও না। শুরুতেই যে ইংরেজি নিবন্ধের কথা বলেছি, এটা তারই মুখবন্ধ অংশের সামান্য পরিবর্ধিত অনুবাদ। মুখবন্ধ কোন স্বয়ংসম্পূর্ণ লেখা হয় না, ফলে এই লেখার মধ্যেও মনে হয় অসম্পূর্ণ ও কিছুটা খাপছাড়া ভাব রয়েই গেল। তবে এটাকেও একধরণের মুখবন্ধ বলা যেতে পারে হয়তো, কারন কাছাকাছি কিছু প্রসঙ্গে আমার পরবর্তী কিছু লেখার মুখবন্ধ হিসেবে একে বিবেচনা করা যেতে পারে।

সবশেষে এই শানে নুযুলটা এই বলে শেষ করা যায় যে - এই লেখাটাকে আসলে ‘আমার’ লেখা না বলে একটা উদ্ধৃতি-সংকলন বলাই বরং শ্রেয় হবে। এখানে আমার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আলোচ্য বিষয়ে বিশ্বের প্রথম সারির কিছু চিন্তাবিদ-বিশেষজ্ঞরা কি মনে করেন সেটা তুলে ধরা – যতটা সম্ভব তাদের উদ্ধৃত করার মাধ্যমে।

রাষ্ট্র কি?

জাতি ও জাতীয় পরিচয় কি তা বোঝার আগে আসলে বোঝা দরকার রাষ্ট্র কি, যদিও রাষ্ট্রটা আপাতদৃষ্টে পরের বিষয় মনে হতে পারে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিক ম্যাক্স ওয়েবারের ক্লাসিকাল সংজ্ঞা অনুযায়ী, “রাষ্ট্র হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট মানব সম্প্রদায় যা একটি নির্দিষ্ট ভূঃসীমার মধ্যে বৈধ শক্তি-প্রয়োগের একচেটিয়া অধিকার (সফল ভাবে) দাবী করে”।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী চার্লস টিলি-র মতে রাষ্ট্র হচ্ছে,“একটি বিশেষ সংগঠন যা একটি সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে বলপ্রয়োগের প্রধান উপায়কে নিয়ন্ত্রণ করে, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঐ ভূখণ্ডের ভিতর পরিচালিত অন্য সকল সংগঠনের উপর অগ্রাধিকার চর্চা করে থাকে”।

জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে রাষ্ট্র হচ্ছে, “মানবজাতির এমন একটা অংশ যার সদস্যরা নিজেদের মধ্যে কিছু সাধারণ সহমর্মিতা/একাত্ন বোধের (common sympathies) মাধ্যমে একতাবদ্ধ – যে সাধারণ সহমর্মিতা বা একাত্ন বোধ তাদের সাথে অন্য কোন গোষ্ঠীর নেই, যে বোধ তাদের অন্য কোন জনগোষ্ঠীর সাথে করার চেয়ে নিজেদের মধ্যে একে অপরের সাথে সহযোগিতামূলক আচরণ করতে বেশি উদ্বুদ্ধ করে, যারা একই সরকার ব্যবস্থার অধীনে থাকতে চায়, এবং চায় যে সেই সরকার ব্যবস্থা শুধুমাত্র তাদের বা তাদের একটি অংশের দ্বারাই পরিচালিত হোক।”

জাতি ও জাতীয়তাবাদ: জেঙ্কিন্স ও সোফোস জাতীয়তাবাদকে সংজ্ঞায়িত করেন এভাবে: “জাতীয়তাবাদ এক ধরণের ‘রাজনৈতিক কল্পনা’, এক রাজনীতিকায়নকারী শক্তি যা সংস্কৃতি-ভিত্তিক গোষ্ঠী ও অন্যান্য সমষ্টিগুলিকে (collectivities) ফলাকাঙ্খী রাজনৈতিক সত্তায় রূপান্তরিত করে। একটি জাতির ‘অস্তিত্বের’ কথা ততটুকুই বলা যেতে পারে যতটুকু তা একটা রাষ্ট্রগঠনের কোন ধরণের আকাঙ্ক্ষা, বা সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি বা রাজনৈতিক মানসপ্রতিমা (political subjectivity) ধারণ বা প্রকাশ করে।”

জাতি, জাতীয় পরিচয়, ও জাতীয়তাবাদ বিষয়ে বিখ্যাত চিন্তাবিদ এন্থনি স্মিথের মতে জাতীয়তাবাদ হচ্ছে, “একটি জনগোষ্ঠীর পক্ষে তাদের কিছু সদস্য দ্বারা তাদের মতে একটি বাস্তব বা সম্ভাব্য “জাতি” নির্মাণকারী স্বায়ত্তশাসন, ঐক্য ও সামষ্টিক আত্মপরিচয় - অর্জন ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে পরিচালিত মতাদর্শিক আন্দোলন।”

জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় পরিচয়ের (national identities) অভ্যুদয়ের উপর একটা বিখ্যাত ও বহুল বিতর্কিত তাত্ত্বিক ফ্রেইমওয়ার্কের প্রবক্তা হচ্ছেন বেনেডিক্ট এণ্ডারসন। এই ক্ষেত্রে তার সুপরিচিত গ্রন্থ ‘ইমাজিন্‌ড কমিউনিটিজ’ (১৯৮৩) অত্যন্ত প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছে। এণ্ডারসনের বিখ্যাত জাতি-সংক্রান্ত সংজ্ঞা মতে জাতি “একটি কল্পিত (‘কাল্পনিক’ অর্থে নয়– মনমাঝি) রাজনৈতিক সম্প্রদায়, এবং তা সহজাত ও সার্বভৌম উভয়ার্থেই কল্পিত। এটা কল্পিত কারন - এমনকি ক্ষুদ্রতম কোন জাতির সদস্যরাও কোনদিন তাদের জাতির বেশির ভাগ সহ-সদস্যের সম্পর্কে কিছু জানবেন না, শুনবেন না, এমনকি তাদের সাথে দেখাও হবে না কোনদিন। অথচ তা সত্ত্বেও সব সদস্যের মনেই তাদের ঐক্য ও সংহতির মানসচিত্র ভাস্বর হয়ে থাকে।”

এণ্ডারসনের মতে, “জাতীয়তা, বা... জাতিত্ব, এবং সেইসাথে জাতীয়তাবাদও, এক বিশেষ ধরণের সাংস্কৃতিক সৃষ্টি”। তার মতে প্রাক-আধুনিক যুগের মানুষের ‘ইতিহাস’ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না: সময়কে তারা “একটি তাৎক্ষণিক বর্তমানে অতীত ও বর্তমানের যুগপৎ সহঘটন” মনে করতেন। তবে এই প্রত্যয় বদলে যেতে থাকে ইতিহাসের উপর ভিন্ন প্রকৃতির অর্থ আরোপ করার মাধ্যমে, এবং অবশ্যই পরবর্তীকালে আলাদা ভাবে ‘ইতিহাস’ সৃষ্টির মাধ্যমে। জাতীয় ইতিহাসগুলি যেহেতু একটি সুনির্দিষ্ট অর্থসমষ্টিতে জারিত করে লেখা হয়, তাই এডওয়ার্ড সাঈদ মনে করেন জাতি “ কল্পিত সম্প্রদায় হওয়ার পাশাপাশি একটি ‘ভাবার্থানুসারী সম্প্রদায়ও’ বটে” (‘ইন্টারপ্রিটিভ কমিউনিটিজ’)।

যদিও এণ্ডারসনের সংজ্ঞা সর্বজনীন বা একক ভাবে স্বীকৃত কোন সংজ্ঞা নয় – তারপরও এটা বিভিন্ন রূপ ধারণ করে জাতি ও জাতীয় পরিচয়ের বেশির ভাগ আধুনিক সংজ্ঞার একটা গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে।

উপরের আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, রাষ্ট্রগঠন বা কোন ধরণের রাজনৈতিক মানসপ্রতিমা (political subjectivity) প্রত্যাশী জাতীয়তাবাদ ছাড়া ‘জাতি’ বা ‘জাতীয় পরিচয়’ সম্ভব হয়ে উঠে না।

এই প্রসঙ্গে জাতির উৎস ও প্রকার সম্পর্কে আরও দু’টি তত্ত্ব উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি হল আর্নেস্ট গেলনারের অত্যন্ত প্রভাবশালী জাতিগঠন সংক্রান্ত তত্ত্ব। জাতি ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে গেলনারের প্রধান বক্তব্য হচ্ছে, ‘জাতি’ আধুনিক যুগের (modernism) ফসল – বিশেষ করে শিল্প বিপ্লবের। তার মতে শিল্পভিত্তিক (industrial) সমাজের জন্য ‘জাতি’ হচ্ছে একটি অতি স্বাভাবিক লেবেল বা তকমা, যে সমাজ কিনা তার পূর্বসুরী কৃষিভিত্তিক বা তার ভাষায় “এ্যগ্রো-লিটারেট” সমাজ থেকে রূপান্তরিত হয়েছে। তার মতে এই প্রাক-শিল্পায়ন ও প্রাক-আধুনিক “এ্যগ্রো-লিটারেট” সমাজের শাসকদের জন্য শাসিতদের মধ্যে সাংস্কৃতিক সমরূপতার (homogeneity) তেমন কোন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু শিল্পায়িত সমাজে যন্ত্র ও প্রযুক্তি অর্থনীতি, জনশক্তি ও সমাজের চেহারা আমূল বদলে দেয়। যে সমাজে কাজ, অর্থনীতি, সম্পদের নিয়ন্ত্রন, এবং সাধারণভাবে রাষ্ট্রের অস্তিত্ত্ব ও প্রগতির স্বার্থেই নৈর্ব্যক্তিক ও কনটেক্সটমুক্ত যোগাযোগ, উচ্চ মাত্রার সাংস্কৃতিক প্রমিতকরণ, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান জরুরী ও বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। শিল্পবিপ্লবজাত শিল্পায়ন থেকে উদ্ভূত নতুন পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিতে জাতি ও জাতি-রাষ্ট্রের চেয়ে ভাল কিছু কল্পনা করা সম্ভব ছিল না। গেলনারের মতে তাই ‘জাতি’ ও ‘জাতীয়তাবাদ’ – দুটিই সম্পূর্ণ নতুন উদ্ভাবন, এবং আধুনিক যুগের আগে এদের কোন অস্তিত্ত্ব ছিল না, বা সেটা থাকা সম্ভবও ছিল না।

২য় তত্ত্বটি হল, হাঞ্জ কোহনের (Hans Kohn) প্রাচ্য বনাম পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদের দ্বৈততা বা বৈপরীত্য (dichotomy) সংক্রান্ত। অতি সংক্ষেপে বললে, কোহনের মতে পশ্চিমী জাতীয়তাবাদ এক ধরণের রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক ও নাগরিকত্ববাদী (civic) জাতীয়তাবাদ। পক্ষান্তরে প্রাচ্য জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটা এথনিসিটি (নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়) ও রক্তসম্পর্ক ভিত্তিক, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্মবিজড়িত। সিভিক বনাম এথনিক জাতীয়তাবাদের এই পরিষ্কার বিভাজন নিয়ে এই বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত প্রসঙ্গটি এখানে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। তবে পরের কোন লেখায় হয়তো প্রসঙ্গক্রমে আসবে।

জাতীয় পরিচয় ( National Identity ) : এই পর্যায়ে এসে রাষ্ট্র এবং জাতীয়তাবাদ মানুষের পরিচয় এবং পরিচয়বোধে রূপান্তর ঘটায় - আত্মপরিচয় এবং জাতীয় পরিচয়ের ইস্যুগুলি প্রকট হয়ে উঠে তখন। ‘পরিচয়’ মূলত একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রত্যয়। পরিচয় বলতে এর ধারকের আত্ম-ভাবমূর্তি বা মানসিক আত্নপ্রতিমাকেই (self image) বোঝায়।

রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানী লিয়া গ্রীনফেল্ড ‘পরিচয়’-এর সংজ্ঞা দেন এভাবে, “পরিচয় একটা কমবেশি বিস্তৃত সমাজজীবনের এক বিশেষ পরিসরে এর ধারকের (ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর) অবস্থানকে সংজ্ঞায়িত করে এবং সেই পরিসরে তার জন্যে এক রকম মানচিত্র বা নীলনকশা হিসেবেও কাজ করে – যার সাহায্যে তার পৃথিবী প্রতিনিয়ত পূণর্নির্মিত হয়। অন্য ভাবে বললে - একটি পরিচয়, সকল পরিচয়, এর ধারকের সামাজিক বাস্তবতা নির্মাণ ও সংজ্ঞায়িত করার একটি মাধ্যমকে প্রতিনিধিত্ব করে।”

এই সংজ্ঞা ব্যক্তি, এবং সেই সাথে সমষ্টিসমূহেরও সামাজিক ও রাজনৈতিক উপলব্ধি নির্মাণে ‘পরিচয়ের’ শক্তি ও সক্ষমতাকে স্পষ্ট করে তুলে। ‘জাতীয় পরিচয়’ আধুনিক যুগেরই সৃষ্টি, যদি আমরা স্বীকার করে নেই যে জাতীয়তাবাদও আধুনিক যুগের সৃষ্টিঃ

“[…] এমন কোন অনুরূপ রাজনৈতিক পরিচয় নেই যা জাতীয়তাবাদের পূর্বগামী এবং যাকে [পরে] জাতীয়তাবাদ প্রতিস্থাপিত করেছে। বরং, আধুনিক যুগেরগুলির তুলনায় প্রাক-আধুনিক পরিস্থিতিতে ‘গণ’ পরিচয়গুলি রাজনৈতিক চরিত্রসম্পন্ন হওয়ার বদলে অনেক বিক্ষিপ্ত, অস্পষ্ট, দূর্বল, স্থানীয়, এবং সাংস্কৃতিক ছিল।” (গ্রিনফেল্ড,২০০০)।

হ্যারিসন হোয়াইটের সামাজিক পরিচয় তত্ত্ব অনুসারে, “একটি পরিচয়, পরিচয় হিসেবে নির্ধারিত এবং স্বীকৃত হয় শুধুমাত্র কিছু সামাজিক সম্পর্কের প্রেক্ষিতে – যা কি গ্রহণযোগ্য আর কি গ্রহণযোগ্য না সে বিষয়ে কিছু নিয়মনীতি নির্দিষ্ট করে দেয়।” বেলিয়ার এবং উইলসন মনে করেন, “পরিচয় তার ‘অপরের’ (the other) সম্মুখীন হওয়ার স্থান ও সময়ে – বাস্তব কিম্বা রূপকাত্নক সীমান্তে - যতটা অনুভূত বা উপলব্ধ হয়, ততটা ভাল ভাবে আর কখনই হয় না।”

রাজনৈতিক-নৃতত্ত্ববিদ ক্যাথারিন ভার্ডারির মতে ‘জাতীয় পরিচয়’ দুইটি স্তরে ক্রিয়াশীল হয় – ব্যক্তিগত স্তরে: একটি নির্দিষ্ট জাতির সদস্য হিসেবে আত্মবোধে; এবং সামষ্টিক পরিচয়ের ক্ষেত্রে: একই ধরণের অন্যান্য সমষ্টিগুলির সাথে সম্পর্কের স্তরে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফুরিও চেরুত্তির মতে, “জাতীয় পরিচয়ের উপাদানগুলি (ভাষা, সাহিত্য, কমন ইতিহাস, রেইস, ধর্ম, ইত্যাদি) যাই হোক না কেন, রাজনৈতিকভাবে “জাতীয় পরিচয়” হিসেবে এই উপাদানগুলির সম্মিলিত রূপের ঘোষণার উপরেই জোর দেয়া হয়। অন্যভাবে বললে, রাষ্ট্রের আগে কোন জাতি হয় না, অন্তত রাষ্ট্রগঠন প্রত্যাশী একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের আগে তো নয়ই।”

এন্থনি স্মিথ জাতি ও জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য একটি প্রয়োজনীয় চেকলিস্ট দেন এভাবে:

(১) একটি ঐতিহাসিক ভূখণ্ড বা হোমল্যান্ড, (২) সাধারণ ভাবে গৃহীত মীথ ও ইতিহাস-সংক্রান্ত স্মৃতিভাণ্ডার, (৩) একটি সর্বসাধারণে গৃহীত গণ সংস্কৃতি, (৪) জাতির সমস্ত সদস্যের জন্য সর্বসাধারণ ভাবে প্রযোজ্য আইনি অধিকার ও কর্তব্যমালা, এবং (৫) জাতির সমস্ত সদস্যের জন্য একটি সাধারণ (common) অর্থনীতি এবং সমগ্র ভূখণ্ডে যাতায়াতের অধিকার (territorial mobility)।

এন্থনি স্মিথের রূপরেখায় ‘জাতীয় পরিচয়’ বলতে বোঝায়, “জাতির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঐতিহ্য নির্মাণে ব্যবহৃত প্যাটার্নের মূল্যবোধ, প্রতীক, স্মৃতি, মীথ ও প্রথার রক্ষণাবেক্ষণ ও অব্যাহত পূনরুৎপদন, এবং ঐ বিশেষ ঐতিহ্য আর ঐসব মূল্যবোধ, প্রতীক, স্মৃতি, মীথ ও প্রথার সাথে ব্যক্তির একাত্মবোধ জারি রাখা।”

জাতি ও জাতীয় পরিচয়ের পূর্বসুরীঃ

“জাতি ও জাতীয় পরিচয়ের আগে কি ছিল?”, এই প্রশ্নের উত্তর ইতিহাসবিদ এরিক হব্‌সবওম তাঁর প্রোটো-ন্যাশনালিজম (ভ্রূণ-জাতীয়তাবাদ?) তত্ত্বের মাধ্যমে দেন। তাঁর মতে জাতীয় পরিচয়গুলির উদ্ভব, তিনি যাকে ‘প্রোটো-ন্যাশনাল’ (ভ্রূণ-জাতিক?) বন্ধন বলেন – সেসবের ফলাফল হতে পারে, যা কিনা দীর্ঘকাল ধরেই অস্তিত্ত্বশীল ছিল এবং যা ম্যাক্রো-রাজনৈতিক স্কেলে আধুনিক রাষ্ট্র ও জাতির পূর্বলক্ষণ বা পূর্বছায়া হিসেবে হয়তো পরিগণিত হতেও পারে। তাঁর মতে প্রোটো-ন্যাশনাল বন্ধন দুই রকম : একটা হল ‘সুপ্রা-লোকাল’ (supra-local) - অর্থাৎ এতে ব্যক্তি যে অব্যবহিত কমিউনিটি – গোত্র বা সমাজে বসবাস করছে, একাত্মতাবোধের ক্ষেত্রে সেই নির্দিষ্ট কমিউনিটি থেকে বোধটাকে আরও প্রসারিত করতে পারা বোঝায়। আর অন্য প্রোটো-ন্যাশনাল বন্ধনটা হল – ঐ কমিউনিটির এলিট শ্রেণীয়, যাদের কিনা বৃহত্তর রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক সত্তা ও প্রতিষ্ঠানগুলির সাথে আম-মানুষের চেয়ে অধিকতর সম্পর্ক থাকে, থাকে রাজনৈতিক যোগাযোগ, ফলত থাকে একটা সমৃদ্ধতর শব্দ-ভাণ্ডার। যে শব্দ-ভাণ্ডার তারা চাইলে হয়তো নিজস্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচার-প্রসার ঘটিয়ে জনপ্রিয় করে তুলতে পারেন। কিন্তু, এই দুই রকম বন্ধনের মধ্যে কোনটাই ‘জাতি’ হয়ে উঠার সাথে তুলনীয় নয়, কারন কোনরকম টেরিটোরিয়াল বা ভূঃসীমাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে তাদের কোন “অবধারিত সম্পর্ক” নেই।

এন্থনি স্মিথের দৃষ্টিতে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় পরিচয়ের উৎসঃ এন্থনি স্মিথের ভাষায় ‘এথনি’ (ethnie)হচ্ছে জাতি ও তার পরিচয়ের সূতিকাগার। স্মিথের সংজ্ঞায়, “একই গোষ্ঠীগত উৎস (common ancestry)সংক্রান্ত মীথ, অতীত সংক্রান্ত কিছু যৌথ স্মৃতি, যৌথ সংস্কৃতির এক বা একাধিক উপাদান, কোন মাতৃভূমি বা জন্মভূমির (হোমল্যাণ্ড) সঙ্গে সংযোগ,এবং কিছুমাত্রায় ঐক্যবোধ – অন্তত এলিট শ্রেণীর মধ্যে – এইসব বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কোন প্রাক-জাতিক নামাঙ্কিত জনগোষ্ঠীই হচ্ছে ‘এথনি’। ”

স্মিথের মতে জাতি ও জাতীয় পরিচয় শুন্য থেকে সৃষ্টি হয় না – এই ‘এথনি’ জাতীয় কোন ভ্রূনরূপী সত্তাকে ভিত্তি করেই জাতীয় পরিচয় অঙ্কুরিত হয়। এজন্যেই তিনি আরেক জায়াগায় বলেন, “জাতীয়তাবাদ আর জাতীয়তাবাদীদের সক্রিয় ভূমিকা ত্রিবিধঃ গোষ্ঠীর পুনরাবিষ্কার, পুনর্তর্জমা, এবং পুনর্জাগরণ। ”

স্মিথের ভাষায় জাতীয়তাবাদ হচ্ছে, “একটি জনগোষ্ঠীর কিছু সদস্য যারা নিজেদের গোষ্ঠীকে একটি জাতি বা সম্ভাব্য জাতি হিসেবে গণ্য করেন, নিজ জনগোষ্ঠীর পক্ষে সামষ্টিক স্বশাসন (autonomy), সংহতি, আর আত্নপরিচয় অর্জন ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে তাদের পরিচালিত এটি একটি মতাদর্শভিত্তিক আন্দোলন।” স্মিথের মতে এই জাতীয়তাবাদের মাধ্যমেই “এথনি-র রাজনীতিকরণ” ঘটে। আর এই প্রক্রিয়ার পথ ধরেই আসে জাতি ও জাতীয় পরিচয় গঠন ।

জাতীয় পরিচয়ের সৃষ্টিঃ

জাতীয় পরিচয়ের প্রকৃতি ও সৃষ্টি নিয়ে তাত্ত্বিক চিন্তা প্রধানত দু’টি ধারায় বিভক্ত – এসেনশিয়ালিস্ট (Essentialists) এবং কন্সট্রাক্টিভিস্ট (Constructivists)। এসেনশিয়ালিস্টদের মতে জাতীয় পরিচয় ঈশ্বর-প্রদত্ত, প্রাকৃতিক, এবং জন্মগতভাবে (inherited) প্রাপ্ত – ফলে এটা পরিবর্তনীয় নয়। ফরাসী চিন্তাবিদ মন্টেস্কু সহ আরও কারও কারও মতে- এটা এমনকি দেশের মাটি ও সাধারন ভাবে জলবায়ুর উপরও নির্ভরশীল হতে পারে। এই চিন্তাধারা ‘জাতীয় চরিত্র’, ‘জাতীয় মেজাজ’, ‘জাতীয় প্রতিভা’ – এই ধরণের পরিভাষাকে উৎসাহিত করে। জাতীয় পরিচয় সম্পর্কে এ ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি তার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল নাৎসী জার্মানিতে, আর্য বর্ণ বা রেইসের (race) ‘শ্রেষ্ঠতম চরিত্রের’ রূপে। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, ১৯৪৭-এ ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রটিও তাদের ধারণামত এবং তৎকালীণ বিদ্যমান রাজনৈতিক/রাষ্ট্রীয় এলিট-আর্টিকুলেটেড একটা শেয়ার্ড ইসলামি পরিচয় এবং ‘ভাতৃত্বের’ তর্কাতীতভাবে অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য, ও সেই বৈশিষ্ট্যের অনন্য প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্বের উপর ভিত্তি করে, অনেকটা এরকমই একটা ‘জাতীয় পরিচয়’ তৈরি করে জনগনের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। বলাই বাহুল্য,এখানে ‘ধর্মই’ ছিল সেই একমাত্র প্রকল্পিত মৌলিক (organic) ও এসেনশিয়াল ‘জাতীয় চরিত্র’ বা ‘জাতীয় বৈশিষ্ট্য’।

যাহোক, অপরপক্ষে কন্সট্রাক্টিভিস্টদের মতে জাতীয় পরিচয় ঈশ্বর-প্রদত্ত, প্রাকৃতিক / জন্মগতভাবে প্রাপ্ত, বা অর্গানিক – কোনটাই নয়। বরং তা এক ধরণের সাংস্কৃতিক সৃষ্টি - সংস্কৃতি যা কিনা (কন্সট্রাক্টিভিস্টদের মতে) “তার প্রতিনিয়ত বাস্তব চর্চাতেই কেবল অস্তিত্ত্বশীল, যা কখনই এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না এবং নিজের অর্থে পরিবর্তন না ঘটিয়ে পুনরাবৃত্ত হতে পারে না” (Baumann in Ifversen, 2002)। ফলে তা নিরন্তর নির্মিত ও পুনর্নির্মিত হতে থাকে – “সংস্কৃতি ‘থাকা’ মানেই হচ্ছে আসলে তাকে (প্রতিনিয়ত) নির্মান করে যাওয়া” (ibid.)।

এই ব্যাপারটা আবার ‘পরিচয়ের’ রাজনৈতিক চরিত্রের উপর আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করে, এই অর্থে যে - কোন নির্দিষ্ট কনটেক্সটে (অর্থাৎ দেশ/সমাজের ক্ষেত্রে) বিদ্যমান ক্ষমতা-সম্পর্কের প্রয়োজনগুলি হয়তো পরিচয়ের সৃষ্টি ও উপলব্ধির প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। বিভাগপূর্ব ও বিভাগোত্তর ভারতীয় উপমহাদেশের কথা এক্ষেত্রে ভেবে দেখা যেতে পারে হয়তো। ২০শ শতাব্দীর শুরুর দিকে বৃটিশ-হিন্দু-মুসলিম ক্ষমতা-ত্রিকোনের (মূলত এলিট শ্রেণীর) প্রেক্ষিতে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদের উত্থান বা ’৪৭-উত্তর পূর্ব-পাকিস্তানে পূর্ব-পশ্চিম বা শাসিত-বাঙালি বনাম অবাঙালি-শাসক দ্বৈততার প্রেক্ষিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনা, এবং নির্মান ও পুনর্নির্মান বা সংজ্ঞায়ন ও পুনসংজ্ঞায়নের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানের আগেকার ‘জাতীয় পরিচয়বোধের’ ক্রমশ বিবর্তন; এমনকি ’৭১-এ ‘বাংলাদেশ’ নামের ঘোষিত ভাবে ‘বাঙালি জাতীয়তা’-ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরও সেখানে ক্ষমতা-সম্পর্কের অপেক্ষাকৃত সুক্ষতর চক্রাবর্তে ভিন্ন মাত্রায় এই পরিচয়-বোধের ধারাবাহিক পরিমার্জন বা দোলাচল -- ক্ষমতা-সম্পর্কের প্রভাবের পাশাপাশি ‘এসেনশিয়ালিস্ট’ তত্ত্বের বিপরীতে সামষ্টিক পরিচয়ের খানিকটা ‘ফ্লুইড’ ও সম্ভবত পূর্বকথিত কন্সট্রাক্টিভিস্টদের পরিচয় সংক্রান্ত নির্মানশীল সংস্কৃতি তত্ত্বেরও খানিকটা লক্ষণাত্নক বলে মনে হয়। অন্তত ‘বহির্জৈবনিক’* (‘exteriority’) ক্ষেত্রে।

আরও ভাল একটা উদাহরণ হতে পারে বোধহয় - ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পশ্চিম ইউরোপে ক্রমহ্রাসমান জাতীয়তাবাদ এবং সেইসাথে উত্তরোত্তর ইউরোপীয় ইন্টিগ্রেশনের সাথে সাথে জাতীয় পরিচয়ের বিবর্তনশীল সংজ্ঞা ও উপলব্ধি। যাকে কন্সট্রাক্টিভিস্টদের দৃষ্টিকোন থেকে উপরোল্লিখিত নির্মানশীল সংস্কৃতি ও জাতীয় পরিচয়ের একটা জীবন্ত পরীক্ষাগার বলা যেতে পারে হয়তো। এই বিশাল বিষয়ে এখানে আলোচনার সুযোগ নেই, তবে সংক্ষেপে জ্যান ইফ্‌ভার্সেনকে এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করা যেতে পারে –

“Although identity politics often assumes an existing identity that has to be discovered, the task being to uncover it, the focus is on the action of creating. The creation of identity may be seen as a necessary attempt to further the development of the EU, or as something that will follow from the functionalist logic of integration. In a hyper-functionalist view, not only identity but culture as such will follow from integration: ‘if a community of Europeans starts to coalesce, events will in due course provide it with the historical material required to weave retrospective national lore’ (Howe 1995: 32). Of course, it might be objected that the European nation Howe is imagining is one with very little cultural baggage. Still, he is talking about the possibility of generating ‘learned memories, symbols, habits, operating preferences and facilities’ (ibid.: 38).”

এসেনশিয়ালিস্ট আর কনস্ট্রাক্টিভিস্টদের মধ্যকার পার্থক্য আমাদের দু’টি উপসংহারে আসতে সাহায্য করে।

প্রথমটি হলো এই পার্থক্য – ইতিহাসে (মূলত ইউরোপের) ‘জাতীয় পরিচয়’ সংক্রান্ত দু’টি জনপ্রিয় ধারণাকে নির্দেশ করে। ২য় বিশ্বযুদ্ধকে রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে ধরলে, এসেনশিয়ালিজম ঐ যুদ্ধপূর্ব-কালের জাতীয় পরিচয় সম্পর্কে প্রচলিত সাধারণ ধারণাকেই নির্দেশ করে, পক্ষান্তরে কনস্ট্রাক্টিভিজম হল যুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপে বিরাজমান একটি সাধারণ জাতীয়তাবাদ-বিরোধী মনোভাবের প্রতিফলন, যা হয়তো আরও পরে একটি সংহত ইউরোপীয় পরিচয় ‘নির্মান’ প্রয়াসের পিছনে অনুপ্রেরনা হিসেবে কাজ করেছে। যে প্রয়াসের একটা আভাস আমরা উপরে জ্যান ইফ্‌ভার্সেনের উদ্ধৃতিতে পাই।

২য়টি হল - এসেনশিয়ালিজম একটি স্ট্যাটিক এপ্রোচ, এবং কন্সট্রাক্টিভিজম ডাইনামিক এপ্রোচ। তবে এই পার্থক্যের মূল্যায়ন কিন্তু অনেকাংশেই পরিচয়চেতনার উপর রাজনীতির প্রভাবকে প্রতিফলিত করে, বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ মোড়-পরিবর্তন এই পার্থক্যের গুরুতর পুনর্মূল্যায়ন, এমনকি পরিচয়ের নাটকীয় পুনঃসংজ্ঞায়নেরও কারন হতে পারে। বস্তুত, এই দুই ধারণার এই দ্বন্দ্বকে পশ্চিম ইউরোপে জাতীয় পরিচয়ের ইতিহাসের একরকম সার-সংক্ষেপ হিসেবেও অনেকে বিবেচনা করেন।

এই লেখার সারসংক্ষেপরূপী উপসংহারে চলে যাওয়ার আগে আমরা কন্সট্রাক্টিভিস্ট ফ্রেইমওয়ার্কের অধীনে কিন্তু খানিকটা ভিন্ন এপ্রোচে ‘পরিচয়’-এর বহুমাত্রিকতা বা বহুকেন্দ্রিকতাকে সংক্ষেপে ছুঁয়ে যেতে পারি।

সমাজভাষাতত্ত্ববিদ টোপি ওমোনিয়ি তাঁর “হায়ারার্কি অফ আইডেন্টিটিটিজ” গ্রন্থে একাধিক/বহুমাত্রিক পরিচয়সম্পন্ন ব্যক্তিদের পরিচয়চেতনা এবং এই পরিচয়গুলি ব্যক্তি ও গোষ্ঠী কিভাবে ম্যানেজ করে, সেই প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন।এই ‘পরিচয়ের স্তরক্রম’ -এর মাধ্যমে তিনি দেখান যে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উভয়ের ক্ষেত্রেই ‘পরিচয়’ জিনিষটার খানিকটা ‘ফ্লুইড’ চরিত্র আছে, এবং পরিপূরক বা বিরোধাত্নক পরিচয়ের উপস্থিতিতে বিশেষ বিশেষ ‘মুহূর্তে’এই পরিচয় বা পরিচয়বোধের ফোকাসটা বদলে যেতে পারে। ওমোনিয়ির মতে ভাষা ও পরিচয় সংক্রান্ত গতানুগতিক পুরনো মতবাদগুলি, যেমন এসেনশিয়ালিজম - পরিচয় যে ব্যক্তি এবং/কিম্বা গোষ্ঠী দ্বারা ‘নির্মিত’ হতে পারে সেই স্বীকৃতি দিতে এবং পরিচয়ের হাইব্রিডিটি বা সংকরত্বকে যথাযথভাবে ধারণ বা সংকুলান করতে অক্ষম। আরেক সমাজভাষাতত্ত্ববিদ ইয়াসির সুলেইমান তার ‘কন্সাট্রাক্টিং ল্যাঙ্গুয়েজেস, কন্সট্রাক্টিং ন্যাশনাল আইডেন্টিটিজ’নিবন্ধে বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, আঞ্চলিক এবং ভাষিক গোষ্ঠীসমূহ থেকে আসা ব্যক্তি সমন্বয়ে সৃষ্ট জাতির ক্ষেত্রে একটি ‘ফিক্সড্’ পরিচয়বোধের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। ওমোনিয়ির পরিচয়ের ‘হায়ারার্কি’র ধারণার বিপরীতে সুলেইমান একই জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিতে ‘ফ্লুইডিটির’ পরিবর্তে ‘পলিসেন্ট্রিসিটি’ বা ‘বহুকেন্দ্রিকতা’-র ধারণা ব্যবহার করেন।

কতটা প্রাসঙ্গিক হবে জানি না, তা সত্বেও এ প্রসঙ্গে এরিক হব্‌সবওম-এর একটি স্মরণীয় উক্তির উল্লেখ না করলেই নয় –

The concept of a single, exclusive, and unchanging ethnic or cultural or other identity is a dangerous piece of brainwashing. Human mental identities are not like shoes, of which we can only wear one pair at a time. We are all multi-dimensional beings. Whether a Mr. Patel in London will think of himself primarily as an Indian, a British citizen, a Hindu, a Gujarati-speaker, an ex-colonist from Kenya, a member of a specific caste or kin-group, or in some other capacity depends on whether he faces an immigration officer, a Pakistani, a Sikh or Moslem, a Bengali-speaker, and so on. There is no single platonic essence of Patel. He is all these and more at the same time. David Selbourne, a London ideologue, calls on "the jew in England" to "cease to pretend to be English" and to recognize that his "real" identity is as a jew. The only people who face us with such either-or choices are those whose policies have led or could lead to genocide.

যাহোক, উপরের সংক্ষিপ্ত ও কিছুটা বিক্ষিপ্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা একটা ৪ দফা “জাতীয় পরিচয় প্যারাডাইম”-এ পৌঁছুতে পারি যার ব্যাপারে বিশেষ করে পশ্চিমা চিন্তাভাবনায় সম্ভবত মোটামুটি ঐক্যমত্য রয়েছে –

১। জাতি (নেশন) ও জাতীয় পরিচয় মূলত আধুনিক ধারণা এবং সাম্প্রতিক কালের উৎসজাত – বিশেষ করে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের । জাতীয় পরিচয় এর পূর্বতন সামষ্টিক পরিচয়গুলি, যেমন – ধর্মীয়, স্থানীয় ও ফিউডাল ইত্যাদি - থেকে চরিত্রগত ভাবেই ভিন্ন। এই পুরনো পরিচয়গুলি ‘জাতীয় পরিচয়’-এর মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়, অর্থাৎ জাতীয় পরিচয় রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন ধরণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে নানাবিধ পরিচয়ের এক জটিল কাঠামোতে স্থাপিত জনতার মুখ্য সামষ্টিক পরিচয়ে পরিণত হয়।

২। জাতীয় পরিচয় গঠনের একটা ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। অর্থাৎ এর একটা ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পশ্চাৎপট (longue durée বা প্রোটো-ন্যাশনালিজম) থাকে যা বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বা মতাদর্শের (developments) ভিত্তি জুগিয়ে দেয়।

এ প্রঙ্গে বেশির ভাগ লেখক বা তাত্ত্বিকই মনে হয় জাতীয় পরিচয়কে সম্পূর্ণ ‘কল্পিত’ (এণ্ডারসনের ভাষায় ‘ইমাজিন্ড’) মনে করেন না, বরং বাস্তব থেকে আহরিত এর কোন না কোন ভিত্তির ব্যাপারে তাঁরা মোটামুটি একমত। এ প্রসঙ্গেই হব্‌সবওম “প্রোটো-ন্যাশনাল” আর এন্থনি স্মিথ নৃতাত্ত্বিক বন্ধনের “পুনরাবিষ্কার”-এর কথা বলেন। উপরন্তু, এদের বেশির ভাগই একমত যে এই প্রসঙ্গে ‘জাতীয়তাবাদের’ কাজ হচ্ছে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে একটা যোগসূত্র স্থাপন করা এবং একটা ভবিষ্যতের রূপরেখা নির্মান করা।

৩। ‘পরিচয়’ নির্মিত হয়। এরা ‘ইনহেরেন্ট’ (জন্মগত, প্রাকৃতিক ও অপরিবর্তনীয়) না। যদিও আলোচিত মতবাদগুলির মধ্যে এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার ভূমিকা সম্পর্কে বক্তব্যে বড় কোন পার্থক্য নেই।

৪। জাতীয়তাবাদ ও জাতিরাষ্ট্র ‘জাতীয় পরিচয়’ নির্মান বা গঠনপ্রক্রিয়ার রাজনৈতিক রূপ এবং একই সাথে তার বিকাশের ক্ষেত্রে অপরিহার্য।


জাতীয় পরিচয় প্রসঙ্গে এই লেখা আপাতত এখানেই শেষ। পড়াশোনাও এখনও পর্যন্ত প্রায় এটুকুই। এই বিষয়ের উপর যে বিশাল লিটারেচার, সেই লিটারেচারের সমুদ্রের এক কোনে কোন এক কুক্ষণে ভুলক্রমে পা পিছলে পড়ে গিয়ে সেখান থেকে আছাড়পিছাড় খেয়ে কোনমতে পালিয়ে উঠার সময় গায়ে দু’য়েকটা ভাসমান খড়কুটো লেগে গিয়েছিল। ঐ খড়কুটোগুলিই এখানে উপস্থাপন করলাম, আর কিছু না। আর বিচ্ছিন্ন কিছু খড়কুটো বলেই, এই লেখার বক্তব্যে সংহতি, শৃঙ্খলা, লক্ষ্য ও প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু বজায় থাকল জানি না। আশা করি পাঠক সেটা খুঁজে পাবেন।না পেলে সে দায় নিঃসন্দেহে আমার, এবং সেইসাথে পাঠকের সময় নষ্ট করার দায়ও।আর যদি পাওয়া যায়, তাহলে আবারও ঐ সাগরে ছোট ছোট ডুব দিতে পারি হয়তো – উষ্কানি পেলে ন্যাড়া বার বার বেলতলায় যায় বৈকি!

তবে নিজের কথা বললে, এটা লিখতে গিয়ে আমি নিজে বুঝে হোক না বুঝে হোক যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছি। শিখেছিও অনেক কিছু, যা আগে তেমন একটা জানতাম না। সেই সাথে বলাই বাহুল্য, দু’য়েকটা প্রশ্ন মাথায় যে উদয় হয়নি তাও নয়। সেইরকম দুয়েকটা প্রশ্ন দিয়েই লেখাটা শেষ করতে চাই –

১। আধুনিক যুগে জাতি, জাতীয়তাবাদ, জাতীয় পরিচয় – এসবের প্রয়োজন কতটুকু? আদৌ কি আছে?

২। জাতি ও জাতীয় পরিচয়ের গতানুগতিক উপাদানগুলির (ধর্ম, ভাষা, ইতিহাস, মিথ, নৃতত্ত্ব, সুনির্দিষ্ট সংস্কৃতি, ইত্যাদি) পরিবর্তে বা সেগুলির নিরপেক্ষভাবে কিছু ওভারআর্চিং (ছত্রছায়াদানকারী?) সর্বজনীনতাবাদী ও সিভিলাইজেশনাল বিধিবদ্ধ মূল্যবোধ ও মূল্যবোধের সক্রিয়করণের সঙ্গতিপূর্ণ প্রক্রিয়ার সমষ্টিকেই কি ‘জাতীয় পরিচয়’ বা মুখ্য সামষ্টিক পরিচয় হিসেবে বাস্তবায়ন ও অভিহিত করা সম্ভব? এই মূল্যবোধে ও মুল্যবোধ নির্ধারণে ব্যক্তির অবস্থান ও ভূমিকা কি ও কতটুকু হবে এবং তার অবস্থান ও ভূমিকার সাথে বিভিন্ন শ্রেণী/গোষ্ঠীর সম্পর্ক কি ও কতটুকু হবে? সামষ্টিক পরিচয়ের প্রথাগত উপাদানগুলি (ধর্ম, ভাষা, ইতিহাস, মিথ, নৃতত্ত্ব, সুনির্দিষ্ট সংস্কৃতি, শ্রেণী, ইত্যাদি) বাদ দিয়ে বাস্তবে কোন স্তরেই এইরকম একটা সর্বজনীনতাবাদী মূল্যবোধ-ভিত্তিক পরিচয় আত্নপরিচয়ের আত্নবোধে আত্নস্থ করা সম্ভব – কি ব্যক্তি, কি গোষ্ঠীর পক্ষে? সম্ভব উপরে উল্লেখিত লিয়া গ্রীনফেল্ডের ভাষায় পরিচয়-ধারকের বাস্তবতা নির্মান ও পুনর্নির্মানের “মানচিত্র” হিসেবে এর সক্রিয়করণ? যদি এটা বাস্তবসম্মত হয়, তাহলে কি নাম হবে এমন পরিচয় বা জাতীয় পরিচয়ের?



মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার পোস্টির জন্য আন্তরিক দন্যবাদ।
শুভকামনা রইল।

তুহিন সরকার

মন মাঝি এর ছবি

পড়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ!

****************************************

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

এ বিষয়ে আমার জ্ঞান খুব সামান্যই। আপনার লেখা থেকে কিছু জানা হলো।
আর বেলতলায় যাবার উস্কানিটা দিয়ে গেলাম। চলুক

মন মাঝি এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ! হাসি

****************************************

সুমন চৌধুরী এর ছবি

আপনি অনেক শ্রম দিয়ে লিখেছেন। ভালো লাগলো।

একটু সহজভাবে দেখার/বোঝার চেষ্টা করি।

সমকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের যে রূপটাকে ধরা ‌ছোঁয়া যায় সেই রূপটাকেই বোঝে। মোটের উপর সিভিল ও মিলিটারি আমলাতন্ত্র আর পুলিশ। এই তিনটা যন্ত্রই সমন্বিতভাবে রাষ্ট্র। ‌মাক্স ভেবারের যে সংজ্ঞার্থটা বললেন সেটার মূল জার্মানে ভদ্রলোক Gewaltsmonopol বলে একটা শব্দ ব্যবহার করেছেন। যার অর্থ monopoly of terror. সন্ত্রাসের মনোপলি যতক্ষণ টিকে থাকে রাষ্ট্র ততক্ষণ সফল। যখন এই মনোপলি ভেঙ্গে যায় তখন ব্যর্থ। যাই হোক যারা এই একচেটিয়া সন্ত্রাসের যন্ত্রগুলি চালায় তাদেরকে সরকার বলে। রাষ্ট্র একজাতিক, দ্বিজাতিক, বহুজাতিক সবরকমই হতে পারে। তবে একজাতিক রাষ্ট্র সম্ভবত এই মুহুর্তে পৃথিবীতে তেমন আর অবশিষ্ট নাই। আমার স্মৃতিমতে একটাও নাই। আগেও ছিল কিনা মনে পড়ছে না।

জাতিবোধ তৈরী হওয়া নিয়ে নানান ক‌্যাচাল থাকলেও প্রক্রিয়াটা রাষ্ট্র গঠণের তুলনায় সময় সাপেক্ষ এই বিষয়ে মোটামুটি সব সমাজবিজ্ঞানী একমত। আমি জাতি শব্দটাকে নেশানের বদলে এথনিক গ্রুপ অর্থে দেখি, যেটা অবিরাম পরিবর্তিত হতে থাকা প্রক্রিয়া। নেশান শব্দটার আড়ালে পরিবর্তনগুলিকে আড়াল করার প্রবণতা প্রবল।

এথনিক গ্রুপ অর্থে দেখলে কোন জাতির জাতিবোধ একটা প্রাকৃতিক তথ‌্য। কিন্তু জাতীয়তাবাদ কোন তথ‌্য না। জাতীয়তাবাদ একটা পলিটিক‌্যাল ডকট্রিন, যা কোন রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে নতুন রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রসমূহ নির্মাণ বা কখনো রাষ্ট্রসমূহকে জোড়া দিয়ে একটা রাষ্ট্র তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। এই ডকট্রিনে এথনিসিটি, আঞ্চলিকতা, অলৌকিক বিশ্বাস, ধর্ম (রিলিজিওন অর্থে) পরিস্থিতির সুবিধামতো ব্যবহৃত হয়। এর কোনটার প্রয়োজন আছে কোনটার নাই তার নির্ধারক ঐ সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের নির্ধারক আধিপত্যকারী শ্রেণী।

আপনার শেষের দুইটা প্রশ্নের একটাই জবাব। ঐ আধিপত্যকারী শ্রেণীর ইহজাগতিক প্রয়োজন যদি রাখে তাইলে থাকবে। নাইলে থাকবে না।

পুনশ্চ : ব‌্যবহৃত প্রতিটা পরিভাষা একেকটা ভ‌্যারিয়েবল।

দুর্দান্ত এর ছবি

চলুক

মন মাঝি এর ছবি

আপনার সুচিন্তিত ক্রিটিকাল মন্তব্য পেয়ে আমারও ভাল লাগল। এই রকম বিষয়ে একশটা থাম্বস আপ ইমোর চেয়ে একটা ক্রিটিকাল মন্তব্যও অনেক বেশি মূল্যবান।

রাষ্ট্র একজাতিক, দ্বিজাতিক, বহুজাতিক সবরকমই হতে পারে।

সেটাই, সাদা চোখে এবং কমন সেন্সে আমিও সেটাই বুঝি। জাতিকে এথনিক অর্থে ধরলে সেটা ঠিকও আছে। কিন্তু এইসব তত্ত্বকথা পড়তে গিয়ে এই নিয়ে বেশ ধন্দে আছি। এই লেখাটা লিখতে গিয়ে সামান্য যট্টুক পড়েছি তাতে মনে হচ্ছে পশ্চিমা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রের জন্য একটা সর্বজনীন, ওভারআর্চিং, নিজস্ব লেভেলে অবিভাজ্য এবং এক্সক্লুসিভ পলিটিকাল আইডেন্টিটি অপরিহার্য মনে করেন। এটাকেই তারা 'নেশান' মনে করেন। এই প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে তাদের বেশ নাছোড়বান্দা মনে হয়েছে। আমার মনে হয়েছে এইরকম একটা ঐক্যবদ্ধকারী রাজনৈতিক বন্ধন ছাড়া রাষ্ট্রের ফিজিবিলিটি/ভায়াবিলিটি তারা মানতে চান না। 'বহুজাতিক' রাষ্ট্র এরাও মানেন, কিন্তু সেই বহু জাতির জাতিত্ব তাদের কাছে 'কালচারাল' ডাইমেনশনের ব্যাপার - 'পলিটিকালের' বিপরীতে। এই ডিস্টিংশন তাদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তাদের মতে রাষ্ট্রের মত একটা চরম 'পলিটিকাল' সত্তা টিকিয়ে রাখতে 'পলিটিকাল' ডাইমেনশনে একটা অপ্রতিদ্বন্দ্বী, নিজস্ব লেভেলে এক্সক্লুসিভ, সর্বজনীন, মুখ্য সামষ্টিক বন্ধন অপরিহার্য। 'কালচারাল' ডাইমেনশনে জাতি (নেশান নয়) একটাও হতে পারে, দশটাও হতে পারে। কিন্তু তাদের সবার একটিমাত্র কমন ওভারআর্চিং বা প্রিন্সিপাল পলিটিকাল আইডেন্টিটি ও বন্ধন দরকার রাষ্ট্রবদ্ধ হতে হলে। অনেক জায়গায় দেখলাম বহুজাতিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ঐসব 'কালচারাল' জাতিগুলিকে তারা এথনিক এন্টিটি (entity) বলছেন, আবার কোথাও 'সাবন্যাশনাল' এনটিটি (শেষেরটার বাংলা কি 'জাতিসত্তা' হবে মনে হয়?)। কিন্তু এই এথনিক বা সাবন্যাশনাল এন্টিটিগুলিকে তারা 'নেশান' অর্থে জাতি বলে মানতে রাজি নন। (এ প্রসঙ্গে আমার ভারতের উদাহরণ মনে আসছে, অবশ্য কতটা প্রযোজ্য নিশ্চিত না)।

আমার পড়ার দৌড় যতটুকু এবং যাদের লেখা পড়েছি, তার ভিত্তিতে তাদের বক্তব্য সম্পর্কে আমি এ পর্যন্ত এটুকুই বুঝেছি। তবে এই বুঝা সম্পর্কেও আমি পুরোপুরি নিশ্চিত না, ধন্দে আছি এখনও। এ প্রসঙ্গে আপনার মতামতটা জানতে পারলে ভাল লাগবে।

নেশান শব্দটার আড়ালে পরিবর্তনগুলিকে আড়াল করার প্রবণতা প্রবল।

তাতো বটেই! আমার শেষের দু'টি প্রশ্ন তো সেজন্যেই।
তাছাড়া পাশ্চাত্যের অনেক নেতা এখন প্রায়ই নিজেদের 'ভ্যালু-বেইসড সোসাইটি' বলে অভিহিত করেন। নেশান শব্দটা তাদের মুখে এখন খুব বেশি শুনি না। ওবামার ২য় টার্মের ইনগরাল ভাষনেও বোধহয় এই শব্দবন্ধটা ছিল। এতদিন ভাবতাম এইটা তারা বড়াই করার জন্য বা অন্যদের খাটো করার জন্য বলেন। যেন অন্যদের 'ভ্যালু' নাই। কিন্তু এই লেখাটা লিখতে গিয়ে হঠাৎ করে মনে হল, এইটা হয়তো তারা ঐ 'নেশানের' নানাবিধ সমস্যাগুলি এড়ানোর জন্যই বলেন।
------------------------------------------------------------------

পরিভাষাগুলি ভ‌্যারিয়েবল তো বটেই, কিন্তু আমার কাছে সাক্ষাৎ মাইনফিল্ড!!! হাসি

****************************************

অতিথি লেখক এর ছবি

হুম। এটা আমার খুব কাজে লাগবে। কপি করে রেখে দিলাম।

মন মাঝি এর ছবি

--ঘ্যাচাং--

****************************************

পথিক পরাণ এর ছবি

পরিশ্রমী লেখা। ভাল লেগেছে।

রাষ্ট্র কিরূপে হবে- এই নিয়ে মতভেদ আছে। কেবল নিজে বৈধ শক্তি প্রয়োগের একচেটিয়া দাবী করলেই রাষ্ট্র নাও গঠিত হতে পারে। যেমন চেচনিয়া কিংবা নার্গানো কার্বাখ। রাষ্ট্রকে অন্য দেশের সাথে চুক্তি ইত্যাদি করবার সক্ষমতা ও স্বীকৃতিও পেতে হয়। এক্ষেত্রে প্যালেস্টাইনের উদাহরণও আনা যেতে পারে।

জাতি বিমুর্ত ধারণা। রাষ্ট্র নয়। রাষ্ট্র মূর্ত হয়ে উঠে এর তিনটি অঙ্গের ভেতর- আইন বিভাগ (সংসদ), শাসন বিভাগ (সরকার) আর বিচার বিভাগের মাধ্যমে। এই তিনটি বিভাগের ভেতর রাষ্ট্র তার সার্বভৌম ক্ষমতা বিভাজন করে দেয়। তিনটি বিভাগের ভেতর ক্ষমতার ভারসাম্য যথেষ্ট হলেই কেবল রাষ্ট্র সুসংহত থাকে।

মন মাঝি এর ছবি

পরান ভাই,
আপনি মনে হয় সংজ্ঞাটা একটু উলটো দিক থেকে বুঝেছেন। বৈধ শক্তি-প্রয়োগের একচেটিয়া অধিকার দাবী করে - কথাটা ঐ অধিকারের দাবীকারী "প্রার্থী" অর্থে বোঝানো হয়নি মনে হয় এখানে - বরং যে সেটা অর্জন করে ফেলেছে এবং প্রয়োগ করে যাচ্ছে তাকেই বোঝানো হচ্ছে। উদ্ধৃতিটা আবার লক্ষ্য করুন -

বৈধ শক্তি-প্রয়োগের একচেটিয়া অধিকার (সফল ভাবে) দাবী করে

অর্থাৎ যে একটি নির্দিষ্ট ভূঃসীমার মধ্যে বৈধ শক্তি-প্রয়োগের একচেটিয়া অধিকার দাবী করে সফল হয়েছে এবং বৈধ ভাবেই তার একচেটিয়া অধিকার প্রয়োগ করে যাচ্ছে - তার কথাই বোঝানো হচ্ছে। এখানে সফলতা ও বৈধতা হচ্ছে কিওয়ার্ড। অন্যভাবে বললে, বৈধ শক্তি-প্রয়োগের একচেটিয়া অধিকার দাবী করলেই রাষ্ট্র হবে বলা হচ্ছে না, তবে রাষ্ট্র হলে এই বৈশিষ্ট্যটা তার থাকবে বলা হচ্ছে। এই দুইয়ের মধ্যে যে পার্থক্য আছে সেটা আশা করি লক্ষ্য করেছেন। এটা একটা জেনেরিক সংজ্ঞা - রাষ্ট্র কিভাবে মূর্ত হয়ে উঠবে সেটা পরের ব্যাপার। এবং আমার ধারণা এই মূর্ত অনেক ফর্ম্যাটেই হয়ে উঠতে পারে - শুধু আইন বিভাগ (সংসদ), শাসন বিভাগ (সরকার) আর বিচার বিভাগ - এই ফর্ম্যাটেই হতে হবে তা হয়তো না।

'জাতি'টা বিমুর্ত ধারণা হলেও, এই লেখায় রাষ্ট্রের চেয়ে এই বিমুর্ত ধারণাটাই আসলে আমার আগ্রহের বিষয় ছিল বেশি। রাষ্ট্রটা নেহাৎ প্রসঙ্গক্রমে অবধারিত বলেই চলে এসেছে।

পড়া ও মন্তব্যের জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

রাষ্ট্র, জাতি, জাতীয়তাবাদ, এ বিষয়ক সংজ্ঞাসমূহ দেখলে আমার নাসিরুদ্দিন হোজ্জার সেই পন্ডিতসভার কথা মনে পড়ে যায়। একখন্ড রুটির সংজ্ঞা নিয়ে পন্ডিতগন যে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষন করেন, তার সবগুলো না হলেও অধিকাংশই হয়তো সঠিক, কিন্তু তাতে করে রুটির স্বাদ, বর্ন বা গন্ধে কোন পার্থক্য সূচিত হয় না। এসব বিষয়ে আমরা যখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সংজ্ঞা পাঠ করি, তখন মূলতঃ বিভিন্ন পন্ডিতজনের বিভিন্নরকম(ক্ষেত্রবিশেষে পরস্পরবিরোধী) মতামত পাঠ করি। তার সংগে নিজের ধারনা এবং বিবেচনাবোধ অনুযায়ী আমাদের নিজেদের মত করে একটি সংজ্ঞা নিরুপন করে নেই।
নানারকম সংজ্ঞার উদ্ভব হওয়ার আগেও হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে ছোট বড় বহু জাতির অস্তিত্ব ছিল, অনেক রাষ্ট্রেরও অস্তিত্ব ছিল। সুতরাং এগুলো আর যাই হোক, পাশ্চাত্যের শিল্প বিপ্লবের ফসল নয় কোনমতেই। শিল্পবিপ্লবের পর হয়তো প্রধানতঃ রাষ্ট্রীয় আকৃতি প্রকৃতিতেই কিছুটা পরিবর্তন এসেছে, নানারকম সংজ্ঞার উদ্ভব হওয়া সত্বেও জাতিসত্বার উদ্ভব, বিকাশ এবং স্থিতি বা বিলুপ্তির ধরনে তেমন কোন পার্থক্য সৃষ্টি হয় নি।

আব্দুল্লাহ এ.এম.

মন মাঝি এর ছবি

কিন্তু তাতে করে রুটির স্বাদ, বর্ন বা গন্ধে কোন পার্থক্য সূচিত হয় না

তাই কি? আমার তো মনে হয় ধর্ম বা বর্ণভিত্তিক জাতীয়তাবাদ আর সেকুলার ও সিভিক জাতীয়তাবাদের মধ্যে স্বাদ, বর্ন বা গন্ধে ব্যপক পার্থক্য সূচিত হয়

হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে ছোট বড় বহু জাতির অস্তিত্ব ছিল

ছিল বৈকি! আমরা বাংলায় যে ধরণের বিস্তৃত অর্থে 'জাতি' শব্দটা ব্যবহার করি, সে অর্থে অবশ্যই ছিল। এই অর্থে আমি উপরে যেসব রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের উদ্ধৃত করেছি, তারাও সেটা স্বীকার করেন ('এথনি' বা 'প্রোটো-ন্যাশনাল' দ্রঃ)। কিন্তু 'নেশান' ছিল কি? সেটাই প্রশ্ন। এজন্যেই আমি মুখবন্ধেই 'জাতি' প্রসঙ্গে লিখেছি -

তার উপরে বাংলায় এই শব্দগুলি নিয়ে বেশ ধোঁয়াশা রয়েছে মনে হয়, যা বেশ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। ইংরেজি যে ‘নেশন’ শব্দের বঙ্গানুবাদ হিসেবে বাংলায় ‘জাতি’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়, যদ্দুর বুঝেছি ইংরেজিতে এবং পাশ্চাত্যের কনটেক্সটে তার বেশ সুনির্দিষ্ট একটা অর্থ রয়েছে যা বিশেষ একটা ফেনোমেননকে বোঝায়। অথচ বাংলায় আমরা ‘জাতি’ বলতে অনেক কিছুই বুঝি – ‘নেশনও’ বুঝি, আবার এথনিক/নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, ভাষিক গোষ্ঠী, থেকে শুরু করে ধর্ম, বর্ণ – ত্বকবর্ণ ও হিন্দু ধর্মীয় বর্ণপ্রথার বর্ণ, শ্রেণী, বংশ, পেশা, লিঙ্গ, প্রাণীর প্রজাতি হয়ে এমনকি ফুলফল বা প্রায় যে কোন সমলক্ষণযুক্ত শ্রেণীবিন্যাসকেই বুঝি। এর ফলে বাংলায় এই আলোচনা অনেক সময় একটি অর্থে শুরু হয়ে অনেক সময় নিজেদের অগোচরেই কাছাকাছি অন্য অর্থে পিছলে বা সুইচ করে অর্থের তালগোল পাকিয়ে ফেলে এবং তখন একটা থেকে আরেকটা কেন, কখন ও কতটুকু পৃথক সেই জট ছোটানো অনেক সময় বেশ কঠিন হয়ে পড়ে – এমনকি হয়তো সেটা নজরেই আসে না। আলোচনা তখন দিশা হারিয়ে ফেলে।

পড়া ও মন্তব্যে জন্য ধন্যবাদ। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।