লোকটা

মৃদুল আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন মৃদুল আহমেদ (তারিখ: বুধ, ১৮/০৬/২০০৮ - ১:৫০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লোকটাকে দেখলেই কেমন বুক শিরশির করে পিকুর।
বুক শিরশির করার হয়ত তেমন কোনো কারণ নেই, কারণ লোকটার হাবভাব অত্যন্ত নিরীহ মানুষের মতো। খুব একটা কথাও বলে না, চুপচাপই থাকে। তবুও কেমন যেন ভয় লাগে।
লোকটার চেহারা অবশ্য কিছুটা ভয় লাগার মতো। কোনো এক কারণে লোকটার একটুও ভুঁরু নেই, ভুঁরুর জায়গাটা একেবারেই ফাঁকা, আর পুরো মাথাটাও একেবারে চুলবিহীন চকচক করছে। যখন চোখ তুলে তাকায়, তখন যেন তার চোখের পাতা পড়ে না, মনে হয় যেন একটা সাপ নিষ্পলক তাকিয়ে আছে।
পিকুদের খেলার মাঠটার পাশেই একটা নতুন একটা গাড়ির ওয়ার্কশপ হয়েছে, সেখানে লোকটা সারাদিন কী যেন খুটখাট কাজকর্ম করে। ওয়ার্কশপটার মালিক বারো নম্বর বাড়ির নিপুর বাবা আকমল সাহেব, লোকটাকে চাকরি দিয়ে তিনিই কোত্থেকে নিয়ে এসেছেন। লোকটাকে যতদিনই দেখেছে পিকু, ততদিনই দেখেছে লোকটার সারা গায়ে কালিঝুলি মাখানো। লোকটা কি গোসলও করে না কখনো?
মাঠের পাশেই ওয়ার্কশপটা, ফুটবল কখনো সখনো সেখানে গিয়ে ঢুকে পড়ে। তাদের দল থেকে কেউ না কেউ সেখানে বল আনতে যায়, কিন্তু পিকু কখনো যায় না। একবারই গিয়েছিল, এরপর আর যায় নি।
সেদিন জমজমাট খেলার মাঝখানে পিকু নিজেই একটা জোরে শট কষিয়েছিল, সেটা গোলকির হাতে লেগে একেবারে পিছনের ওয়ার্কশপে!
কর্ণার কিক, পিকু তাড়াতাড়ি করার জন্য নিজেই বল আনতে ঢুকে গিয়েছিল ওয়ার্কশপের ভিতরে। ওয়ার্কশপে আসমত ভাই নামে একজন ম্যানেজার আছে, হাসিখুশি মানুষ, পিকুরা তাকে চেনে। কিন্তু সেদিন আসমত ভাই ছিল না। পিকু ওয়ার্কশপে ঢুকে দেখল, ঘরটা বেশ অন্ধকার। বাইরের আলো থেকে এসে ভিতরের অন্ধকারে কেমন ধাঁধাঁ লেগে যায়। ভিতরে ঢুকে সে খানিকটা থমকে গেল। আস্তে আস্তে চোখ সয়ে এলে সে দেখল, ঠিক তার এক হাত সামনেই একটা মানুষ বসে আছে। একদম তার চোখের সামনে দুটো চোখ, সাপের মতো ঠাণ্ডা, পলক পড়ে না।
পিকু চমকে এক হাত পিছিয়ে গিয়ে দেখে, সেই ভুরুচাঁছা লোকটাই বসে আছে। হাতে কী যেন একটা লোহার জিনিস। সেটা নিয়ে চুপচাপ কাজ করছিল।
পিকু ভয়ের চোটে ঢোক গিলে বলল, বলটা?
লোকটা কোনো কথাই বলল না, কাজ করতে করতে তার দিকে আগের মতোই স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। পিকু ঘুরে দৌড় দেবে কিনা চিন্তাভাবনা করছে, এমন সময় লোকটার হাত উঠল। ঘরের ডান দিকে একটা জায়গা নির্দেশ করেই হাতটা আবার নেমে গেল।
পিকু কাঁপা কাঁপা পায়ে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে বলটা তুলে নিয়ে বাইরে চলে আসল। আশ্চর্য লোকটা! একদম চোখের সামনে বসে আছে, অথচ কোনো কথাই বলল না!
বারো নম্বর বাড়ির নিপুকে একদিন জিজ্ঞেস করল পিকু, এই তোর বাবা কোত্থেকে ঐ লোককে ধরে নিয়ে এসেছে বল তো?
নিপু আশ্চর্য হয়ে বলল, কোন লোকটা?
ঐ যে, ওয়ার্কশপে চুপচাপ বসে থাকে। চুল নেই, ভুঁরু নেই, কীরকম বিচ্ছিরি চেহারা, তার মধ্যে কেমন সাপের মতো চেয়ে থাকে! দেখলেই তো গা শিরশির করে!
নিপু চোখ কুঁচকে বলল, তা তাতে তোর কী হয়েছে ? সে কি তোকে কোনোদিন দাঁতমুখ খিঁচিয়ে কামড় দিতে এসেছিল নাকি?
পিকু বিরক্ত হয়ে বলল, আমি কি তাই বলছি নাকি ? আমি বললাম যে, লোকটার চেহারা হাবভাব সবই কেমন যেন অদ্ভুতুড়ে, কেমন যেন গা ছমছম করে!
নিপু একটু চিন্তা করে গম্ভীর মুখে বলল, হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক। লোকটা যেন কেমন কেমন। নড়েও না চড়েও না।
পিকু উৎসাহ পেয়ে বলল, হ্যাঁ, লোকটা এরকম কেন বল তো ? কীরকম সাপের মতো তাকিয়ে থাকে, কোনো কথা বলে না!
নিপু একটা ঘাস ছিঁড়ে নিয়ে চিবুতে লাগল। তারপর উদাস মুখে বলল, আমার কী মনে হয় জানিস?
পিকু তার সব মনোযোগ একত্র করে তাকিয়ে বলল, কী মনে হয়?
নিপু বলল, আমার মনে হয়, লোকটা একটা জিন। জানিস তো আল্লাপাক ইনসান আর জিনদেরা পাশাপাশি দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। মাঝেমধ্যে কোনো কোনো জিন মানুষের রূপ নিয়ে মানুষদের ভেতরে মিশে থাকে, এ বোধহয় সেরকমই কেউ একজন। দেখিস না, ভাবভঙ্গিই আলাদা!
পিকু সরু চোখ করে নিপুর দিকে তাকিয়ে রইল। নিপু একটা ফিচেল হাসি হেসে বলল, এদের অসাধ্য কিছুই নেই। কোনদিন দেখবি ওয়ার্কশপের ভেতর থেকে প্লাস্টিকম্যানের মতো লম্বা একটা হাত বের করে খেলার মাঠে তোর কান মুচড়ে দিচ্ছে!
পিকু ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিপুর মতো ফাজিলের কাছে তার এই প্রসঙ্গ তুলতে যাওয়াই ভুল হয়েছে।
কিন্তু ভুলটা যে কত বড় হয়েছে, সেটা বুঝতে পিকুর আরো দুদিন লাগল...
পিকুর বাবা ল-ইয়ার, তার কাছ থেকে মাঝেমধ্যে কাগজপত্র দেখিয়ে নিতে নিপুর বাবা আকমল সাহেব প্রায়ই আসেন। দুদিন বাদে তাদের বাসাতেই পিকুর সঙ্গে তাঁর দেখা হল। পিকুর বাবার সামনেই তিনি বললেন, কী হে পিকু মাস্টার, তুমি নাকি জিন বিশারদ? তুমি নাকি বলেছ, আমার ওয়ার্কশপে আমি একটা জিনকে চাকরি দিয়েছি?
পিকু হতভম্ব হয়ে বলল, কে বলেছে একথা ?
আকমল সাহেব একগাল হেসে বললেন, তোমার প্রাণের বন্ধু নিপুই তো বলল। তুমি নাকি দেখেই বুঝে ফেলতে পার, কে মানুষ আর কে জিন! আমার ওয়ার্কশপের ইউসুফকে নাকি এক নজর দেখেই নাকি তুমি চিনে ফেলেছ!
পিকু মুখ লাল করে বলল, না না, আমি মোটেই এ ধরনের কথা বলি নি!
আকমল সাহেব আরেকটু মজা করার জন্য বিষণœ মুখ করে বললেন ,তাহলে তুমি বলছ, আমার ইউসুফ জিন নয়, মানুষ। আহা, একটা জিন নিজের চোখে দেখার কতই না শখ ছিল! সেটা এভাবে নষ্ট হয়ে গেল! চুক্ চুক্!
পিকু বোকার মতো একটা ফ্যাকাশে হাসি হাসল, তারপর আকমল সাহেবের সামনে থেকে চলে এল নিজের ঘরে। রাগে তার সমস্ত শরীর জ্বলছিল। সবকিছুর একটা সীমা আছে। নিপুটা তার সঙ্গে ফাজলামি করতেই পারে, তাই বলে তার নামে এরকম চাপা মারতে হবে?
কয়দিন পর একটা বাজে ব্যাপার ঘটে গেল। খেলার মাঠে পাড়ার ছোটখাট গুণ্ডা রবিউলের সঙ্গে একটা ভয়ানক ঝগড়া হয়ে গেল পিকুর!
রবিউল তাদের চেয়ে বছর তিনের বড় হবে, যদিও কয়েক বছর গাড্ডা মেরে একই ক্লাসে পড়ে। তার আকৃতিও দেখার মতো, গাঁট্টাগোট্টা, ঘাড়ে গর্দানে তাগড়াই, তাদের চেয়ে বেশ লম্বাও। এমনিতে কেউ তাকে ঘাঁটাতে সাহস করে না, কিন্তু গোল ঠেকাতে গিয়ে সে যখন পিকুদের দলের সবচেয়ে ছোট সদস্য অন্তুর পা ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম করল, তখন পিকু হঠাৎ করেই মারাত্মক রকম ক্ষেপে গেল।
অন্তু পা চেপে ধরে গড়াগড়ি খেতে খেতে মা-বাবার নাম নিচ্ছে, আর অনবরত কাঁদছে, পিকু গিয়ে সোজা রবিউলের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, শোন ভোটকার বাচ্চা, খেলার সময় কি জানোয়ার হয়ে যাস নাকি, মানুষকে মানুষ বলে মনে হয় না?
রবিউল একথা শুনে দাঁড়িয়ে থাকার পাত্রই নয়। তখনই সে ঘুষি পাকিয়ে ছুটে আসছিল, অন্যরা তাকে ধরে ফেলল। সবাই মিলে তাকে ধরে ফেলাতে আর মারামারিটা বাঁধল না, কিন্তু রবিউল হিংস্র চেহারা করে বলল, বাপের ব্যাটা হোস তো আজকে সন্ধ্যাবেলায় আবার আসিস মাঠে, তখন বোঝা যাবে আমি মানুষ নাকি জানোয়ার!
পিকুও মুখ খিঁচিয়ে বলল, আচ্ছা আসব, থাকিস তুই!
পিকুর মাথায় খুন চেপে গিয়েছিল। অন্তু একেবারেই বাচ্চা ছেলে, হাত-পা চিকন চিকন, ছেলেটা অসম্ভব ব্যথা পেয়েছে সন্দেহ নেই, তার পাটা ভেঙ্গে যাওয়াও অসম্ভব ছিল না। এই হাতির বাচ্চা রবিউলকে একটা শিক্ষা দেয়া দরকার। তার সঙ্গে পেরে ওঠার কোনো সম্ভাবনাই নেই, কিন্তু পাল্টা মার না দিয়ে ফেরত গেলে তার সাহস আরো বেড়ে যাবে।
খেলার মাঠ থেকে সন্ধ্যার মধ্যেই বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা, কিন্তু পিকু ফিরে গেল না। কাছেই একটা বস্তির পাশে চাপকল আছে, সেখানে হাত-মুখ ধুয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে আরেকটু অপেক্ষা করে তারপর আবার মাঠে ফিরে গেল।
সূর্যের শেষ আলোটা নিভে যাবার পর পরই দেখা গেল অন্ধকারের মধ্যে রবিউল মাটি দাপিয়ে হেঁটে আসছে!
পিকু বুকের মধ্যে একটা ফাঁকা ফাঁকা অনুভূতি বোধ করতে লাগল। সে একটা ভয়ানক রকমের মার খেতে যাচ্ছে, এতটা সাহস না দেখালেই হত। তার হাঁটু দুটো কেমন দুর্বল মনে হচ্ছে... পিকু অনুভব করল, সে আসলে সেরকম কোনো সাহসী ছেলেই নয়, স্রেফ ঝোঁকের মাথায় একটা বিরাট বোকামি করে ফেলেছে। কিন্তু এখন আর পালাবার কোনো পথ নেই, তাহলে আর কোনোদিনই মুখ দেখানো যাবে না!
রবিউল তার কাছাকাছি এসে পড়েছে, পিকু ভাবল, মারামারি শুরু হওয়ার আগে নিশ্চয় একটা কথাবার্তা হবে। টিভির কুস্তিতে যেরকম হয়। রবিউল দেখা গেল সেসবের ধারই ধারল না, আরেকটু কাছে আসতেই হঠাত্ একটা গর্জন করে খ্যাপা ষাঁড়ের মতো ছুটে এল...
গদাম করে একটা ভয়াবহ ঘুষি এসে নাকে পড়তেই চোখে অন্ধকার দেখল পিকু... তার মনে হল হঠাত্ করেই তার মাথাটা একদম ফাঁকা হয়ে গিয়েছে, সারাটা শরীর কেমন হালকা। গদাম করে আরেকটা ঘুসি এসে পড়ল তার পেটে, ঝপ করে পুরোটা দম বেরিয়ে গেল। সারা নাক-মুখ জুড়ে ভোঁতা অথচ তীব্র একটা ব্যথা, পেটের ভেতরে একবিন্দু বাতাস নেই, বরং সারাটা পেট অসহ্য ব্যথায় গুলিয়ে উঠছে। পিকু সেই অবস্থাতেই দেখল, রবিউল আরেকটা ঘুসি পাকিয়েছে। সেটা ঠেকাবার সাধ্য পিকুর কোনোমতেই নেই। সে চোখ-নাক বন্ধ করে ঘুসির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
কিন্তু অবাক ব্যাপার, ঘুসিটা তার মুখে এসে লাগল না। পিকু চোখ খুলে দেখল, রবিউল হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে পিকুর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে কী যেন দেখছে, তার মুঠি পাকানো হাত কোন অদৃশ্য শক্তিবলে যেন থমকে আছে।
পিকুর দিকে তাকিয়ে অবাক হবার কিছু নেই, নিশ্চয় পিকুর পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। পিকু পিছন ঘুরে দাঁড়িয়েই চমকে গেল। তার সামনে একজন মানুষ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে, এই সন্ধ্যার হালকা আলোতেও দেখা যায় তার মাথায় একটিও চুল নেই, মার্বেলের মতো ঝকঝকে সেই মাথায় সাপের মতো পলকহীন দুটো চোখ...
পিকুকে পাশ কাটিয়ে সে ক্ষিপ্র গতিতে সামনে এগিয়ে এল, তার শরীরও বেশ হালকা পাতলা, কিন্তু রবিউলের মতো গাঁট্টাগোট্টা ছেলেকেও সে অবলীলায় দুই হাতে ধরে মাথার ওপরে তুলে ফেলল, তারপর একটা বেড়ালের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে!
একটা ভারী বস্তার মতো রবিউলের শরীরটা শক্ত মাটির ওপরে ধপাস করে পড়ল!
রবিউল নিশ্চিত ভীষণ ব্যথা পেয়েছে, কিন্তু তার চেয়ে ভয় পেয়েছে আরো বেশি। মারামারিতে তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, সে পরিস্থিতি বোঝে। একটাও শব্দ না করে সে কোনোমতে উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড় মারল!
পিকু এমনিতেই অন্ধকার দেখছিল, এবার বোঁ করে তার মাথা ঘুরে উঠল। কিন্তু সে পড়ে যাবার আগেই তাকে শক্ত দুটো হাত ধরে ফেলল!
চোখের সামনে ধোঁয়াটা কাটলে সে দেখল, ওয়ার্কশপের ভেতরে বসে আছে। টিমটিম করে একটা লাইট জ্বলছে, আর লোকটা হালকা গরম পানিতে একটা ন্যাকড়া ভিজিয়ে তার নাক মুছিয়ে দিচ্ছে। পিকু চোখ মেলতেই লোকটা খুব আস্তে করে বলল, ব্যথা লাগছে?
পিকুর বেশ ব্যথাই লাগছিল, নাকের ভেতরে বেশ জ্বলছিলও। সম্ভবত নাকের ভেতরে কেটে গেছে অনেকটা। তবু সে মাথা নাড়াল। এভাবে একজন বাইরের লোকের কাছ থেকে সেবা নিতে তার কেমন লজ্জা করছিল। সে দেখল, লোকটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। এর আগে তার মনে হয়েছিল লোকটা চোখের পাতা ফেলে না, কিন্তু এখন সে দেখল, লোকটা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই চোখের পাতা ফেলছে।
পিকু নিজে থেকেই উঠে দাঁড়াল। দেখল, এখন আগের মতো মাথা ঘুরছে না। লোকটা আবার ন্যাকড়া মুখের কাছে আনতেই মাথা নাড়াল। বলল, ঠিক আছে, আর লাগবে না।
লোকটা চুপচাপ ন্যাকড়া সরিয়ে রাখল। পিকু বলল, আমি তাহলে এখন বেরোই?
লোকটা তার দিকে এমনভাবে তাকাল, যেন সে কথাটার কোনো অর্থই বুঝতে পারে নি।
পিকু তার হাতটা বাড়িয়ে দিল। বলল, আমার নাম পিকু, আপনার নাম আমি জানি, ইউসুফ। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আপনি না থাকলে ঐ গুণ্ডাটা আমাকে আজকে একদম মেরেই ফেলত!
ইউসুফ তার সঙ্গে হাত মেলাল, কিন্তু তার মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। মানুষটা সত্যিই খানিকটা অদ্ভুত। কিন্তু পিকু বেরোবার সময় সে তার পিছু পিছু এল।
পিকুর এখন আর মোটেই বুক শিরশির করছিল না। লোকটাকে মোটেই ভয় লাগছিল না। সে যে কোনোরকম কথা বলছে না, অথবা মুখ একেবারেই ভাবলেশহীন, তাতে তার কিছুই মনে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, মানুষটা তো এরকমই।
পা বাড়াবার আগে পিকু পিছন ফিরে বলল, আসি!
পিকুকে অবাক করে দিয়ে লোকটা গমগমে গলায় বলল, সাবধানে যেয়ো !
তারপর পিঠে একটা হাত রাখল।
বাসায় ফেরার পর পিকুর মার খাওয়ার কথা ছিল। সন্ধ্যা পার করে দিয়ে সে বাসায় এসেছে, তার মধ্যে মারামারির ফল কালসিটে পড়া চোখ আর ফোলা নাক নিয়ে।
কিন্তু পিকুর মার খাওয়া হল না কারণ রাতেই তার প্রচণ্ড জ্বর এসে গেল। অসম্ভব উত্তপ্ত শরীর নিয়ে তাকে পর পর তিন দিন শুয়ে থাকতে হল। জ্বর আসা খুবই স্বাভাবিক, জীবনে সে কোনোদিনই এত ভয়ানক মার খায় নি।
চারদিনের দিন সে কিছুটা হাঁটাচলার অবস্থায় এল। সেদিন সন্ধ্যায় সে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় দুর্বল পায়ে হাঁটছে, এমন সময় এক তাড়া কাগজ নিয়ে আকমল সাহেব তাদের ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে এলেন। তার পিছনে পিছনে পিকুর বাবা। তিনি বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, পিকুকে দেখে থামলেন। বললেন, কী হে তোমার জ্বরের অবস্থা কী?
পিকু একটু ফ্যাকাশে হেসে বলল, এই তো ভালো!
আকমল সাহেব হেসে বললেন, হ্যাঁ সেরে ওঠো। মাঠে খেলতে যেতে হবে না? তোমার জিনকে তো আমি বিদায় করে দিয়েছি!
পিকু থমকে দাঁড়িয়ে চোখ তুলে তাকাল।
পিকু তাকিয়ে আছে দেখে আকমল সাহেব সহজ করার জন্য বললেন, আরে, ঐ যে আমার ওয়ার্কশপের ইউসুফ, চান্দিছিলা, ভুঁরুচাঁছা!
বলেই বাবার দিকে ফিরে বললেন, বুঝলেন ভাইসাহেব, মানুষের স্বভাব সহজে পাল্টায় না। লোকটা একটা জেলফেরত খুনের আসামি। কী যেন এক ঘটনা, কে নাকি জমিজমা নিয়ে না কী নিয়ে শত্র“তা করে তার বৌ-ছেলেকে মেরে ফেলেছিল, সেটার বদলা নিতে গিয়ে জেল খেটে লোকটা বের হয়ে এসেছিল। কে জানে কতটুকু সত্যি ঘটনা! চেহারায় তো মনে হয় একেবারে শয়তানের চেলা! তবু একজন আমাকে ঘটনাটা বলল, আমি দয়া করে লোকটাকে কাজে নিলাম... কাজ শিখবে, যে করে হোক, একটা রুজি রোজগার তো হল! কিন্তু ক্রিমিনালের স্বভাব আর কোথায় যাবে? পাড়ার একটা ছেলেকে এই সেদিন শুধু শুধু মেরে তক্তা বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে! ব্যাপারটা তো পরে প্রায় পুলিশ পর্যন্ত গড়ানোর অবস্থা, সেই ছেলের বাপ এসে সে কী হম্বিতম্বি! ছেলেও অবশ্য সেরকমই, একই পদের। এখন আমি আর কী করব... পরোপকার করতে গিয়ে নিজের পায়ে কুড়–ল মারার কোনোই দরকার নেই! দিয়েছি ব্যাটাকে ভাগিয়ে! যাও বাবা, চড়ে খাও গিয়ে! দুনিয়াতে বহুত জায়গা আছে!
পিকুর বাবা আর আকমল সাহেব কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেলেন।
পিকু বারান্দার গ্রিল ধরে দুর্বল পায়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার জন্য, পুরোটাই তার জন্য। সে এরকম বোকামি না করলে লোকটার এই দুর্গতি হত না। তার চোখ ফেটে জল এল। বারান্দার এক পাশে দাঁড়িয়ে সে চুপচাপ কাঁদতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর তার মনে হল, সে লোকটাকে দেখতে পাচ্ছে। লোকটার কাঁধে একটা ঝোলা, সে রাস্তার একপাশ দিয়ে কাঠফাটা রোদের ভেতরে হেঁটে যাচ্ছে। তার মুখ ভাবলেশহীন, তার দুঃখ অথবা আনন্দ কোনোটাই তার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। চুলবিহীন চকচকে মাথার নিচে স্থির দুটো চোখ। কোথায় যাচ্ছে, কী করবে, কেমন করে থাকবে, কোনোকিছু নিয়েই তার মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। বিনা অপরাধে চলে যাওয়া চাকরির জন্য কোনো আক্ষেপও নেই...
পিকু কান্নামেশা দুর্বল গলায় ফিসফিস করে বলল, সাবধানে যেয়ো!


মন্তব্য

এনকিদু এর ছবি

অসাধারন
চলুক


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

মুশফিকা মুমু এর ছবি

ইসস আপনি এত্ত ভাল লিখেন মন খারাপ খুব খারাপ লাগছে মন খারাপ
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

অনিন্দিতা এর ছবি

আবারো দুর্দান্ত!

নজমুল আলবাব এর ছবি
তারেক এর ছবি

অসাধারণ লাগলো!
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

পুরো গল্পটাই যেন চোখের সামনে দেখতে পেলাম। দারুণ।

আকতার আহমেদ এর ছবি

গল্পটা ভাল হয়েছে বস । তবে আরও ভাল হতে পারত। ব্যস্ততার জন্য লেখায় ফাঁকি দিতেছেন মনে হয় ! আপনার দুর্দান্ত সব লেখা পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম ।
ভাল থাইকেন বস

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ভালো লাগলো খুব।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

স্নিগ্ধা এর ছবি

সংসারে এক সন্ন্যাসী একবার এক মন্তব্যে আপনার লেখায় প্রবল মানবিকতার উপস্থিতির কথা বলেছিলেন - আমিও প্রকারান্তরে সেটা বলেছি বোধহয়, কিন্তু আজকে একদম স্পষ্ট করেই বলি - ভালো লিখিয়ে হবার জন্য যেটা সবচাইতে বড় গুণ, মানুষের জন্য ভালোবাসা, এত যার আছে, তার লেখা ভালো হবে এতে আর আশ্চর্য্য কি?! হাসি

স্পর্শ এর ছবি

অসাধারণ!! চলুক
ভাললাগলো! এবং মন খারাপ হল!
....................................................................................
অতঃপর ফুটে যাবার ঠিক আগে হীরক খন্ডটা বুঝলো, সে আসলে ছিল একটা মামুলি বুদবুদ!


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

রণদীপম বসু এর ছবি

সবাই সব কিছু বলে ফেলেছে ! আমি আর কী বলবো !
এককথায়, জবাব নাই !
ধন্যবাদ মৃদুল ভাই। আরো পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

হ... পছন্দ হইছে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

হুমম... গল্পটা আকতারের পছন্দ হয় নি সেরকম... আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে লিখতে হবে দেখছি...
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

আকতার আহমেদ এর ছবি

বস.. ৯২ কিন্তু খারাপ স্কোর না.. তবে ভক্তদের আক্ষেপ থেকে যায় তার প্রিয় খেলোয়াড় সেঞ্চুরি করতে না পারলে !
গল্পটা ভালো কিন্তু তাঁর মুগ্ধ পাঠক যে জেনে ফেলেছে প্রিয় লেখকের দুর্ধর্ষ ক্ষমতা সম্পর্কে ।
ভালো থাইকেন বস ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।