ফিনিক্সের মঙ্গল অভিযান কেমন চলছে? - ২

শিক্ষানবিস এর ছবি
লিখেছেন শিক্ষানবিস (তারিখ: শুক্র, ১২/০৯/২০০৮ - ২:০৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ফিনিক্স মঙ্গলের মাটিতে পানি আর জীবন নিয়ে গবেষণা করছে। আমরা মানুষেরা পৃথিবীতে বসে তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছি, প্রয়োজনমত তাকে নিয়ন্ত্রণও করছি। মানবিক কৌতুহলের তুলনায় এ ধরণের অভিযান খুব বিস্ময়কর কিছু না। বরং বিস্মিত হই এই ভেবে, যে মানুষ ১৯৬৯ সালে চাঁদের মাটিতে পা রেখেছিল সেই মানুষেরই আজ কেন এই বেহাল দশা। আমার মতে, মহাকাশ অভিযানে আমাদের আরও অনেক এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। এতোদিনে আমাদের মঙ্গলে থাকার কথা ছিল। আর্থার সি ক্লার্কও কিন্তু ভেবেছিলেন ২০০১ সালের মধ্যে মানুষ মঙ্গলে যেতে শুরু করবে। তার ২০০১: আ স্পেস অডিসি উপন্যাস অন্তত সে কথাই বলে।

মানুষের কৌতুহলের সাথে তুলনা করার মত কিছু নেই। পৃথিবীর তাবৎ অভিযাত্রী আমাদের সে কথা মনে করিয়ে দেয়। জেম্‌স কুক বা রুয়াল আমুনসেনের অভিযানকে কি মহাকাশ অভিযানের সাথে তুলনা করা যায় না? আমার তো মনে হয়, তাদের অভিযাত্রায় আত্মত্যাগটা আমাদের থেকে বেশী ছিল। কারণ তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলতেন, আমরা তো পৃথিবীতে বসে কেবল যন্ত্র পাঠাচ্ছি। তারপরও কেন এতো অনীহা?

আমুনসেন দুই মেরুই জয় করেছিলেন। উড়োজাহাজে করে উত্তর মেরু দেখতে বেরিয়েছিলেন আমুনসেন। সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু এই উত্তর মেরুই পরবর্তীতে তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাড়ায়। সঙ্গীদের খুঁজতে গিয়ে নিজেও নিখোঁজ হন। সেইসব অভিযাত্রীরা আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। আর মহাকাশের প্রতি আমাদের আকর্ষণ তো সেই আদ্যিকাল থেকে। সাগরের চেয়ে পুরনো সেই আকর্ষণ। তারপরও কি পিছিয়ে থাকা মানায়? মার্স সোসাইটির সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে তাই মঙ্গলে উপনিবেশ স্থাপনের পক্ষে আমি। সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহ-উপগ্রহে কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনের প্রস্তাবেও আমি আছি। যেতে না পারি, মানুষের অভিযাত্রার কাহিনী তো অন্তত শুনে যেতে পারব।

এই প্রেরণাই মঙ্গলের প্রতিটি অভিযান নিয়ে আমাদেরকে ভাবিয়ে তোলে। এই প্রেরণাই অভিযাত্রার কথা বলতে বাধ্য করে। আমুনসেনের উত্তর মেরু অভিযান নিয়ে যেমন লেখা হয়েছে, তেমনি ফিনিক্সের উত্তর মেরু অভিযান নিয়ে লিখছি। এই কয় মাস মঙ্গলের উত্তর মেরুতে বসে সে কি কি করল তা-ই লিখব। আর আশা করবো, যেন তার পরিণতি আমুনসেনের মত না হয়।

২৭শে মে

২৭শে মে রোবটিক বাহু দিয়ে খননকাজ শুরু করার কথা ছিল। পরিকল্পনামাফিক পৃথিবী থেকে মার্স রিকনিসন্স অর্বিটারে কমান্ড পাঠানো হল। কিন্তু যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে সময়মত তা ফিনিক্সে পৌঁছাল না। অগত্যা একদিন নিজ বুদ্ধিতে কাজ করল ফিনিক্স। তার বুদ্ধি খারাপ না। মালিকের কাছ থেকে হুকুম আসেনি দেখে সে ২৬শে মে'র কয়েকটা কমান্ড অনুযায়ী কিছু অতিরিক্ত কাজ করে রাখে। তার অতিরিক্ত কাজ কেবল ছবি তোলা। সেরকম কিছু ছবিই পরদিন অর্বিটারের মাধ্যমে পৃথিবীতে পৌঁছায়।

২৮শে মে

পৃথিবী থেকে কমান্ড পেল ফিনিক্স। হুকুমমাফিক আশপাশের কিছু ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠালো সে। ছবিগুলো বেশ আশাব্যঞ্জক। ফিনিক্স এমন এক স্থানে অবতরণ করেছে যেখানে বহুভুজাকৃতির গর্ত খনন করা খুব একটা কঠিন হবে না। ফিনিক্সের বর্তমান অবস্থান গ্রিন ভ্যালিতে যা উত্তর মেরুর বেশ কাছে। আরও জানা গেল এখানকার মাটি পৃথিবীর পার্মাফ্রস্টের মত। অর্থাৎ পানির ঘনীভবন তাপমাত্রার চেয়েও এখানকার মাটির তাপমাত্রা কম। এই মাটির একটু নিচেই বরফ থাকার কথা।

৩১শে মে

প্রথমবারের মত মঙ্গলের লাল মাটি স্পর্শ করল ফিনিক্সের রোবটিক বাহু। আবেগ থাকলে হয়তো আগে একটু ছুঁয়ে দেখতো। কিন্তু যন্ত্র বলে তেমনটি করেনি। একেবারে গোড়া থেকেই কাজ শুরু করে দিল। মঙ্গলের প্রথম নমুনা সংগৃহীত হল তখনই। মঙ্গলের দিনগুলোকে সল (sol) বলা হয়। ফিনিক্সের মঙ্গলে অবতরণের পঞ্চম সলে ল্যান্ডারের ঠিক নিচের মাটির ছবি তোলা হল। অবতরণের সময় তীব্র বেগে বাতাস নির্গমণের কারণে ল্যান্ডারের নিচে আলগা মাটিগুলো সরে গিয়েছিল। সে কারণেই নিচের স্তরটি ভেসে উঠেছে। অনেকে বললেন, এটাই বরফের স্তর হতে পারে।

১৯শে জুন

রোবটিক বাহুর খনন করা প্রতিটি গর্তের নাম রাখা হয়েছে। একটি গর্তের নাম "ডোডো-গোল্ডিলক্‌স"। এই গর্ত থেকে পাওয়া নমুনায় এক ধরণের উজ্জ্বল বস্তু ছিল যা মাত্র চারদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ বাষ্পীভূত হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা বলেন, কেবল পানি বরফের পক্ষেই এভাবে বাষ্পীভূত হওয়া সম্ভব।

২৪শে জুন

নাসার বিজ্ঞানীরা বেশ তৎপর হয়ে উঠেন। রোবটিক বাহু পরপর তিনটি নমুনা সংগ্রহ করে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন বিশ্লেষকের কাছে পাঠায়। ২৯তম সলে (২৪শে জুন) মেকা-তে অবস্থিত ওয়েট কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরি নমুনা পায়। সাথে সাথেই কাজ শুরু করে।

২৬শে জুন

ওয়েট কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরির গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়। জানা যায়, মঙ্গলের মাটি সাধারণ ক্ষারীয়, পিএইচ ৮ থেকে ৯ এর মধ্যে। এতে ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, সোডিয়াম ও ক্লোরাইড আয়ন আছে। লবণাক্ততা স্বাভাবিক। জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মঙ্গলের মাটির লবণাক্ততা ও পিএইচ মৃদু তথা বিনাইন।

৩১শে জুন

মঙ্গলে পানি বরফের উপস্থিতি নিশ্চিত হল। নাসা থেকে জানানো হল, এর আগে ২০০২ সালে মার্স অডিসি যে পানি বরফের সম্ভাবনার কথা বলেছিল ফিনিক্স তা-ই প্রমাণ করল। এই আবিষ্কারের কৃতিত্ব ফিনিক্সে অবস্থিত "টেগা" নামক যন্ত্রটির। টেগার মধ্যে একটা ভর বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্র আছে। নমুনার তাপমাত্রা বাড়াতে বাড়াতে ০° সেলসিয়াস হওয়ার পরই যন্ত্রে পানি বাষ্পের উপস্থিতি ধরা পরে। মঙ্গলের নিম্ন চাপের কারণেই এত কম তাপমাত্রায় বাষ্পীভূত পানির অস্তিত্ব থাকে। এহেন সংবাদে আর্থলিঙেরা আরও উৎসাহী হয়ে উঠে।

১লা আগস্ট

এভিয়েশন উইকের প্রতিবেদনে বলা হয়, নাসা ফিনিক্সের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলে জীবনের সম্ভাবনার উপর একটি নতুন ঘোষণা দিতে যাচ্ছে বলে হোয়াইট হাউজকে জানিয়েছে। এই সংবাদকে কেন্দ্র করে মঙ্গলে প্রাণ আবিষ্কার নিয়ে নতুন করে কানাঘুষা শুরু হয়। অনেকে বলে, মঙ্গলে নাকি পারক্লোরেট পাওয়া গেছে এবং এ কারণেই সেখানে কোন জীব বেঁচে থাকতে পারবে না। নাসা এই সংবাদকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তাই মঙ্গলে উপনিবেশ স্থাপনের আশা এখনও জেগে আছে।

আজ এ পর্যন্তই। চলবে .....................


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

অসাধারন লেগেছে!! আরো লিখুন।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

শিক্ষানবিস এর ছবি

ধন্যবাদ। এইটা শেষ করার ইচ্ছা আছে। এই পর্বের শেষ করে দিতাম, কিন্তু বেশী বড় হয়ে যাবে ভেবে ক্ষান্ত দিলাম

অনিকেত এর ছবি

চমৎকার হয়েছে বস!

শিক্ষানবিস এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ বস। আপনার মত সহজ ভাষায় লিখতে খুব ইচ্ছা করে। অনেক সময়ই পারি না। তবে সবসময়ই চেষ্টা করছি।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

চাঁদ- মঙ্গলের এইসব খটমট অভিযান কাহিনী থেকে কিন্তু দস্যু বহুরের মঙ্গল অভিযান অনেক উত্তেজনাপূর্ণ

ইসসিরে
বহুদিন থেকে বনহুর ভাইয়ের সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই...
ছোটবেলা কত স্বপ্ন ছিল বনহুর ভাইয়ের ঘোড়া চুরি করে একদিন মঙ্গলে গিয়ে বিচিবিহীন কাঁঠাল খেয়ে আসবো...

শিক্ষানবিস এর ছবি

আসলেই, চাঁদ-মঙ্গলের কাহিনী এখনও খমটেই রয়ে গেছে। তবে ভবিষ্যতে কিন্তু এগুলো নিয়েও বনহুর বা রবিন হুডের মত কাহিনীর জন্ম হতে পারে। ভবিষ্যতের এলিস ইন দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ডের ওয়েন্ডারল্যান্ডটা কিন্তু মঙ্গলও হতে পারে। সেদিনের অপেক্ষাই করছি।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

আসলেই দারুন লিখসো। আমি ভাবতেসি, কখনো উত্তর মেরুতে বেড়াতে যেতে পারলে কি মজাই না হতো। দেঁতো হাসি
______________________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?

শিক্ষানবিস এর ছবি

‌ভয়ানক মজা হতো। কিন্তু জীবনের যে স্বপ্নগুলো স্বপ্ন হিসেবে থেকে যাওয়ার জন্যই জন্ম নেয়, এটা বোধহয় তার মধ্যেই পড়ে। কি আর করা। দেঁতো হাসি

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

এইজন্যই মাঝে মাঝে খুব আফসোস হয় কেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিক হলাম না! হলে অনেক ভাল হত, অনেক স্বপ্ন পূরণ করতে পারতাম! মনে হয় এইসব স্বপ্নগুলা অপূর্ণ রেখেই মরতে হবে! মন খারাপ
______________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।