ছোটগল্প: একদিন তুমিও দেখা পাবে তার (শেষ অংশ)

জ্বিনের বাদশা এর ছবি
লিখেছেন জ্বিনের বাদশা (তারিখ: বিষ্যুদ, ৩০/০৮/২০০৭ - ৩:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৩.
দুপুরে খেতে বসে কবুল বারবার আফসোস করছিল, কারণ যখন সে নিয়ত করেছিল বুড়োর থেকে পয়সা নেবেনা তখন তার ধারনা ছিল বুড়ো না হয় বিশ-পঁচিশ টাকার খাবারই খাবে, কিন্তু কপালের কি ফের, তাকে ছেড়ে দিতে হলো আড়াইশ টাকা! আড়াইশ' টাকা তো যা তা কথা না! দোকান চালিয়ে সারাদিনে তার লাভই হয় তিন থেকে চারশ' টাকা, সেখান থেকে প্রায় পুরোটাই আজ ঐ বুড়ো খেয়ে ফেলেছে।

তবে আশ্চর্য ব্যাপার হলো দুপুরের ঘটনাটা সে বিকেলের মধ্যেই যেন পুরোপুরি ভুলে গেছে, তার মাথায়ও নেই কোথাকার কোন বুড়ো তার মাথায় হাত বুলিয়ে আড়াইশ টাকার খাবার ফ্রি খেয়ে গেছে তার দোকানে। অন্যান্য দিনের মতো আজও কবুল কিছুক্ষণ ক্যাশে বসে, কিছুক্ষণ পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের সাথে হাসি-তামাশা করে, সিগারেট টানে। আবার, প্রতিদিনকার মতো আজও রাত দশটার দিকে বাসায় যায় কবুল, পথে নির্মলের দোকান থেকে দুটো সনপাপড়ির চাক কেনে, তার ছেলেটা বড় জ্বালায়, বাসায় গেলে একটাই শব্দ করে যেন, 'সনপাপড়ি কই, সনপাপড়ি কই'। বাসায় এসেও তার মাথায় দুপুরের ঘটনাটা নেই, কবুলের বউ নীলু যখন জিজ্ঞেস করে 'কেমুন হইল বিক্রীবাট্টা?', কবুল প্রতিদিনের মতোই জবাব দেয় 'এই আর কি! অইছে কুনুরকম, খারাপ অয়নাই।'

আড়াইশো টাকা লসের যন্ত্রণাটা সে আবার টের পায় খেতে বসে, যখন নীলু তার পাতে ইলিশ মাছের ভাজাটা তুলে দেয়, পটপট করে সবকিছু ফিরে আসতে থাকে তার স্মৃতিতে, সে তিন আঙুলে মাছভাজাটা হাতে নিয়ে অদ্ভুত হিংস্র একটা দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে, যেন খুন করে ফেলবে কাউকে। ঠিক এরকম একটা মাছভাজাই আজ দুপুরে বদরুল তুলে দিয়েছিল বুড়োর পাতে।

কবুলের হিংস্র ভাবসাব দেখে নীলু হকচকিয়ে যায়, পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে গলা একটু কড়া করেই বলে, 'তুমার হইছে কি? মাছে লবন ঠিক আছে, মজনু খাইয়া গেলনা একটু আগে!'

নীলুর ধমকের মতো কথা শুনে সম্বিৎ ফিরে পায় কবুল, হাল্কা হেসে দিয়ে বলে, 'নাহ্, তুমার হাতের রান্ধন মাশাল্লা। হইছে কি' বলে কবুল দুপুরের মজার ঘটনাটা পুরো খুলে বলে নীলুকে।

সবশুনে নীলু খানিকটা অগ্নিমূর্তি ধারন করে, 'হায় আল্লাহ, আমার শাড়ীডা তুমি কিনা দিতাছনা আইজ দুইমাস, আর দাতা হাতেম তাঈ অইছ? কত টেকার বিল উঠছিল?'

কবুল খানিকটা গাঁইগুঁই করে বলে, 'দ্যাড়শ টাকা।' বলেই নীলুর চোখের দিকে তাকিয়ে ঝটপট করে বলে ফেলে 'আড়াইশো টাকা।'

নীলুর প্রায় মুর্ছা যাবার জোগাড়, সে চোখ উল্টে বলে, 'কি! তুমি না কইলা ভাবছ বিশ-পঁচিশ টাকা!'

'সেইডাই তো কই' কবুলের ভাবসাবে মনে হয় সে গল্প জমিয়ে ফেলেছে, 'আরে যক্খনই আমি মনে মনে নিয়ত করলাম বুইড়ার থিকা পইসা নিমুনা, তকখনই ব্যাডা বদরুলরে ডাইকা দুপুরের খাউনের কথা জিগাইল। অহন নিয়ত করছি, ফালানোও তো ঠিকনা, নাকি কও?'

'কও কি?' বলে নীলু একটু চুপ মেরে যায়।
খানিক পরেই মাথা তুলে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করে, 'আইচ্ছা, বুড়ায় যখন বাইর হইয়া গেল, তুমরা কেউ দেখছ হ্যায় কুনদিকে গেছে?'

'আরে না! আমগোর তিনডারই তখন খিদায় জান যায়, বুইড়া যেই জাহান্নামে খুশী যাউক।' কবুল ফ্যালফ্যাল করে বলতে থাকে।

নীলু চোখ গোলগোল করে উত্তেজনা চাপতে চাপতে বলে, 'আমার তো মুনে হয় বুইড়া পীর-দরবেশ কিছিমের কেও। ফেরেশতাও অইতে পারে।'

'আরে কি কও!' কবুলের গা ছমছম করতে শুরু করে, নিজেকে সামলে নিয়ে বলে 'দাড়ি-টুপি কিছু নাই, হাতে খালি একটা পুটলা। ঐ বুইড়া ঢাহার থেকা আইছে, মুনে অয় বাসে ডাকাইত পড়ছিল, সব খুওয়াইছে, সেইরকম কিছুই অইব।'

'তুমি জাননা।' নীলুর কন্ঠে রহস্য আরো বাড়তে থাকে, 'ফেরেশতারা এমুনিই আসে, মাইনষের পরীক্ষা নেয়, পরীক্ষায় পাশ করলে সোনা-মোহরের সন্দান দেয়, ফেল করলে শ্যাষ! হায় আল্লাহ! তুমি তো একটা কামের কাম করছ, জমিনের বাপ! তুমি তিনারে কুনুরকম বকাঝকা করনাই তো?'

'আরে না!' কবুল দ্রুত মনে করার চেষ্টা করে সে বুড়োর সাথে আসলেই কোন খারাপ ব্যবহার করেছে কিনা।

সেইরাতটা চমৎকার কেটে যায় কবুলের, সারারাত শুয়ে শুয়ে সে ভাবে বুড়ো তারজন্য কি উপহার দিবে। একটা বিরাট কিছু যে তার জীবনে ঘটতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে এখন আর তার কোন সন্দেহই নেই। কত শখ ছিল জীবনে তার! চাচাতো ভাই মাসুদ যেদিন সৌদি গেল আর খালাত ভাই নুরুন্নবী যেদিন সিঙ্গাপুর গেল, কবুলের কি মন খারাপ হয়েছিল। গায়েগতরে সে মাসুদ বা নুরুন্নবী, কারো চেয়েই কমনা। তার মনে হতো বিদেশ গেলে সে অনেক বেশী উপার্জন করতে পারত। আবার মনে হয়, হাতে ভাল কিছু ক্যাশ আসলে রেস্টুরেন্টটাকে সে হোটেলে রূপান্তর করতে পারত, বা অন্য কোন ব্যাবসা ধরতে পারত। এখন কথা হলো বুড়ো দরবেশ তাকে কি দেবে? উল্টোভাবে ভাবলে, দরবেশ তার কাছে কিছু চাইতে বললে সে কি চাইবে? বিদেশ যাওয়া, অনেক রত্ন সম্পদ নাকি ছেলের ভবিষ্যত। কবুল ভাবে, তার নিজেকে দিয়েতো আর কিছু হবেনা, তারচেয়ে ছেলেটাকে যদি দরবেশ বাবা ভালমতো দোয়া করে দিয়ে যায়, ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হয়, তাও খারাপ কি? আবার ভাবে, সে নিজেই যদি অনেক টাকার মালিক হয় তাহলে ছেলেকে পড়াশোনা করিয়ে ডাক্তার বানাতে পারবে। মাঝরাতের দিকে সে এলোমেলো বোধ করে, দরবেশ যদি একটা জিনিস চাইটে বলে তাহলে কোনটা চাইবে। কবুল আস্তে আস্তে নীলুকে ধাক্কা দেয়, নীলু ধড়ফড় করে উঠে পড়লে বদরুল বলে, 'বউরে, কি করমু কওতো? দরবেশ বাবার কাছে কি চাওয়া যায় কওতো?'

ঘুমের ঘোরে নীলু কবুলের কথা কি বোঝে কে জানে, মুখ ঝামটা দিয়ে বলে 'আরেকখান বিয়া করনের শখ অইছে, না?'

'দুরো! তুমি এইসব কি কও, অলকখুইন্না কথা!' কবুল মিটিমিট হাসতে হাসতে বলে।

সেরাতে কবুলের আর ঘুম হয়না, একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যত তারজন্য অপেক্ষা করছে, খোদাতালার পাঠানো ফেরেশতা বা দরবেশ তার জীবন পাল্টে দেবে, তার অনেক ধনসম্পদ হবে, তার ছেলেকে সে প্লেনে চড়াতে পারবে এরকম নানান ভাবনায় কবুল আচ্ছন্ন থাকে। কিন্তু দরবেশের কাছে কি চাইবে এনিয়ে তার মনে দ্বিধা থকেই যায়।
তখন সকালের আলো-আঁধারী আর নির্জনতা ভেঙে মুয়াজ্জিনের আযান শুরু হয়েছে মাত্র; হঠাৎ কবুলের মনে পড়ে যায় সে যখন বিয়ে করে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা ধরেছিল বাবার জমি বেচে, সেই সময়ের কথা। সেসময় সে একবার ঢাকা বেড়াতে গিয়ে হোটেল পূর্বানীতে গিয়েছিল, সেই হোটেল দেখে তার মনে মনে স্বপ্ন জেগেছিল যে একদিন সে নিজেও তার শহরে এমন একটা হোটেল তৈরী করবে, এত বড় না হলেও দেখতে এমন সুন্দর একটা হোটেল তার চাই। কবুল বুঝে ফেলে দরবেশের কাছে তার কি চাইতে হবে।

৪.
সারারাত না ঘুমানোর পরও সকাল সকাল উঠেই হোটেলের দিকে ছুটে কবুল। ভোর সাতটায় দোকান খুললেও দিলু রুটি বানানো শুরু করে ছয়টা থেকে, বদরুল তখন থালাবাসন সব ধোয় পিচ্চিকে নিয়ে। আজ কবুল সাতটার অনেক আগেই দোকানে চলে এসেছে, তার আর কিছুতেই তর সইছেনা। তার মনে হচ্ছে সকাল সকালই বুড়োটা নাস্তা খেতে হাজির হবে, অনেক কষ্ট করে সে মনের কথা চেপে রাখছে, কারণ নীলু বলে দিয়েছে এখনই বদরুল বা দিলুকে কিছু জানানোর দরকার নেই। সকালে লোকজন সাধারণত নাশতা কিনতে আসে এখানে, বসে নাশতা খায় খুব কম লোক। কবুল ক্যাশে বসে বারবার বাইরের দিকে তাকাচ্ছে, কখন আসবে বুড়ো। সাদা পাজামা টাইপের কিছু দৃষ্টির ভেতরে আসলেই সে অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে পড়ছে নিজের অজান্তেই, একটু নড়েচড়ে বসছে। নাশতা কেনার ভীড়টা একটু কমে আসলে কবুল সাধারনত একটু রেস্ট নেয়, রান্নাঘরের পাশের ছোটঘরটায়, যেখানে বদরুল, দিলু আর পিচ্চি রাতে ঘুমায়। আজ সেই বিশ্রামটুকুও নিতে ইচ্ছে করছেনা। কবুল ভাবে, এমনও তো হতে পারে আজ সেই দরবেশ বাবা অন্যকোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবে, এভাবে এই বাজারের সব দোকানে খাওয়ার পর যাদের ব্যবহার সবচেয়ে ভাল আর রান্না সবচেয়ে স্বাদের তাদেরকে 'বর' দিবে। সেজন্যই কবুল একটা মুহূর্তও মিস করতে চায়না, দরবেশ বাবাকে দেখা গেলেই হলো, দৌড়ে ছুটে যাবে।

অথচ বেলা দশটার পরও দরবেশ বাবা নাস্তা খেতে আসলনা; হয়ত কালকে ক্লান্ত ছিল, হয়ত আজ সকালে বেশীক্ষণ ঘুমাচ্ছে, হয়ত দুপুরের দিকে আসবে। এমনও হতে পারে কালকে যে সময়ে এসেছিল, আজও সেসময়ে আসবে। দরবেশ বাবারাতো অনেক ব্যাস্ত থাকেন, তারা তো খালি ছোট্ট একটা মফস্বলে পরে থাকেননা, তারা হয়ত এই মুহূর্তে ঢাকায়, আবার পরের মুহূর্তে চিটাগাংয়ে, আবার পরের মুহূর্তে রাজশাহীতে। কবুল সাত-পাঁচ এটাসেটা ভাবতে থাকে, আজ তার ক্যাশে মন নেই মোটেও। বদরুল বোকাসোকা লোক, একটু বুদ্ধি থাকলেই সে দেখতে পেত কবুলের আজ কাজে মন নেই, ইচ্ছেমতো উল্টাপাল্টা করতে পারত বিল নিয়ে। অথবা হয়ত বদরুল খুবই বিশ্বস্ত।

বেলা এগারোটার কাছাকাছি সময়ে কবুলের উত্তেজনা খুব বেড়ে যায়, তার মনে হয় জীবনে কোনকিছুর জন্য সে এত অধীরভাবে অপেক্ষা করেনি। তার মনে হয় সেই দরবেশ বাবা আসবেনই, তাঁকে তার আরেকবার দেখতে হবেই। সে পিচ্চিকে বারবার বলতে থাকে টেবিল আর বেঞ্চিগুলোকে মুছে পরিস্কার করে রাখতে, আজ সে দরবেশ বাবাকে দেখিয়েই ছাড়বে আতিথেয়তা কাকে বলে।

বেলা এগারোটা পেরিয়ে বারোটা বাজে, দরবেশ বাবা আসেননা। একটা, দুটো, তিনটা বেজে যায়, তাঁকে দেখা যায়না। কবুল মর্মাহতভাবে খেতে বসে, এতক্ষণে তার মনে দেখা দেয়া ক্ষীণ সন্দেহটা আবার বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠে, সে ভাবে 'নীলু হইল মেয়েমানুষ, কি বুঝতে কি বুঝছে, ঐ বুইড়া দরবেশ পীর ফকির কিছুনা, এমনেই এক বুইড়া।'
খানিকটা হতাশভাবেই কবুল গায়ের জোরে পালংশাক ভাজি আর ভাত মাখাতে থাকে।

ভাত খেতে খেতে কবুল বদরুলকে জিজ্ঞেস করে, 'বদরুল, কাইলকা যে বুইড়া আইসা ফাও খাইয়া গেল, হ্যারে দেইখা কি তর কিছু মনে অইছে।'

'হ মনে অইছে' বদরুল সোৎসাহে বলতে থাকে, 'বুইড়া চেহারা-সুরুতে বালা মাইনষের মতো মনে অইলে কি অইব, সারা বজ্জাত!' বদরুলের টিপস না পাওয়ার ক্ষোভ এখনও যে কাটেনি সেটা বোঝা যায় পুরোপুরি।

কবুল অধৈর্য্য হয়ে বলে, 'আরে বেকুব! সেইটা তো আমিও বুঝি, কইতাছি অন্যকিছু। ব্যাডারে দেইখা তর মনে অইছে নাকি, মানে পীর ফকির দরনের কিছু?'

'কি কন কবুল বাই' বদরুল পন্ডিতের মতো করে বলে, 'দাড়ি নাই জটা নাই, ঐটা পীর ফকির না। আমি এক বসসর মাজারে ছিলামনা, আমি এইগুলান কমবেশি জানি।'

কবুল পাততা দেয়না, বরং বদরুলের এই নাকচই কবুলের মনে নতুন করে আশার সঞ্চার করে, কারন বদরুল সাধারণত যা বলে তার উল্টোটা হয়। এমনকি আকাশে ঘনকালো মেঘ দেখে বদরুল যদি একবারও বলে,'আল্লারে! আইজকাতো বিস্টি অইয়া ভাইসসা যাইব' তাহলেই আর বৃষ্টি হয়না বলেই কবুলের ধারনা। সে তাই বদরুলের পন্ডিতিকে পাত্তা দেয়না, বলে,
'যাউকগা, বদরুল আর পিচ্চি, শুন, ঐ বুইড়ারে যদি কোনহানে দেহস, তাইলে আমগোর দোকানে লইয়া আনবি। তার পর ব্যাডা যখন খাওয়া শেষে বাইর অইব তখন ব্যাডার পিছেপিছে যাবি, আমি শুনী হ্যারা নাকি হঠাৎ উধাও হইয়া যাইতে পারে। আর বালা কতা, এইডা এখনই কাউরে কওনের দরকার নাই, বুঝছস!'
বদরুল, পিচ্চি দুইজঐ সোৎসাহে মাথা নাড়ে।

সেই বিকেলেও বুড়োকে যখন দেখা গেলনা, তখন কবুল মোটামুটি হতাশই হয়ে পড়ল। এখন পর্যন্ত দরবেশের কথা জানে শুধু তার দোকানের লোকজন, সে সাহস পাচ্ছেনা আর কাউকে বলার। সন্ধ্যা আটটার দিকে যখন প্রতিদিনকার মতো আজও বন্ধু মোস্তাক আসল, যারকিনা জগতের তাবৎ বিষয়ে অসাধারণ জ্ঞান বলেই কবুলের ধারনা, তখন সে আর ব্যাপারটাকে চেপে রাখতে পারলনা। মোস্তাককে যখন সে পুরো ঘটনাটা ব্যাখ্যা করছিল, তখনই দোকানের ঢোকার পথে চোখ পড়ে তার প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। মোস্তাক দেখল কবুলের চোখ গোলগোল বড়বড় হয়ে গেছে, সে যেন দম নিতে পারছেনা, উত্তেজনায় কাঁপছে।
মোস্তাক আস্তে করে বলল, 'কবুল, এই ব্যাডা নি?'
কবুল ম্রিয়মান স্বরে বলল, 'হ'।

বুড়োটা দোকানে ঢুকে ক্যাশের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কবুলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিল, ভদ্রতার সম্ভাবষনের মতো। কবুলও যন্ত্রের মতো মাথা নাড়ল, সে বুঝতে পারছে তার ভেতরে এখন কতটা আনন্দ কাজ করছে। সেতো সব আশা ছেড়েই দিয়েছিল, কালরাত থেকে আজ দুপুর পর্যন্ত সে কি ভীষন উত্তেজনায় কাঁপছিল এই ভেবে যে একটা বিরাট কিছু ঘটবে তার ভাগ্যে, অথচ বিকালের দিকে আশাটা প;রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। অথচ, এখন এই মুহূর্তে আবার সেই আশাটা প্রবলবেগে ফিরে আসল যেন, কবুল পারলে মোস্তাককে জড়িয়ে ধরে। মহাজ্ঞানী মোস্তাক অবশ্য কবুলের 'দরবেশ তত্ব'কে পাততাই দিলনা, যাবার আগে বলে গেল এসব ছাইপাশ না ভেবে যাতে বুড়োর থেকে আজ কালকের টাকাটাও রেখে দেয়, সেটুকুই কবুলের লাভ হবে।

বুড়ো গতকালের মতোই যাথারীতি খেতে বসে আর নড়ছেনা, আজ অবশ্য সে অত বেশী অর্ডার দেয়নি। কিন্তু খাচ্ছে খুব ধীরে, অর্ডারও দিচ্ছে ধীরেধীরে। রাত দশটার দিকে যখন দোকান বন্ধ করার সময় চলে এলো তখন দোকানে কাস্টমার বলতে শুধু বুড়ো একাই, ব্যাপারটা কবুলকে যারপরনাই আনন্দ দিচ্ছে। সে নিশ্চিত ধরে নিয়েছে বুড়ো এতক্ষণ অপেক্ষা করছে যাতে যখনসে কবুলকে 'বর' দেবে তখন সেটা কেউ দেখে না ফেলে। টেবিল-চেয়ার মুছতে মুছতে বদরুল যখন বুড়োকে বলল, 'মুরুব্বী, দোকান বন্ধ করার সময় অইয়া গ্যাছে', বুড়ো হড়মড় করে নড়ে উঠে দাঁড়ালো। তআরপর ধীর পায়ে ক্যাশকাউন্টার পর্যন্ত এসে কবুলের দিকে তাকালো, সেই চাহনিতে আগের দিনের মতোই করুণাভিক্ষার ছাপ। কবুল ইশারায় বদরুল আর পিচ্চিকে রান্নাঘরের দিকে চলে যেতে বলল, রান্নাঘর থেকে দিলু, বদরুল, পিচ্চি সবাই শ্বাসরুদ্ধকর এই দৃশ্য দেখছে, কবুল ভাইকে দরবেশ বাবা কি দিয়ে যান!

কাউন্টারের কাছে এসে বুড়ো কবুলকে বলল, 'বাপজান গো, আমি কিন্তু আইজও পয়সা দিতে পারবনা। আপনার কাছে যদি গোল্ডলীফ থাকে তাইলে একটা দেন।' বলে বুড়ো মুখে সেই অশায় কাঁচুমাচু হাসি ঝুলিয়ে রাখল।

কবুল বুঝল, খোদাতা'লা তার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন, সে সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, 'একটা না, দুইটা নেন।'

'অশেষ শুকরিয়া' বলে বুড়ো তিনটা সিগারেট হাতে নিয়ে গটগট করে বের হয়ে গেল।

রাতে সবঘটনা স্ত্রী নীলুকে খুলে বলার পর নীলু তার মায়ের দেয়া দোয়াপড়া বিশেষ শাড়ীটা পরে নামাজের বিছানায় বসে গেল, আর কবুলকে বলল যে সে নিশ্চিত ইনি একজন দরবেশ বা ফেরশতা। আল্লাহতালা নিজে ধৈর্য্যশীল, এবং বান্দাদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিতে তিনি পছন্দ করেন। দীর্ঘ ২০ বছর পর কবুল আজ আবারও এশার নামাজ পড়ল, যদিও দোয়া কুনুত তার ভালমতো মনে নেই, এবং লজ্জায় সেটা সে তার স্ত্রীকে বলতে পারছেনা।

নামাজ পড়তে পড়তে কবুলের মনে পড়ল বুড়ো বের হয়ে যাবার বদরুল বা পিচ্চির দেখে আসার কথা ছিল যে ফুটপাথ থেকে ডানে বা বামে মোড় নেবার পরপরই বুড়ো উধাও হয়ে যায় কিনা, অথচ তখন বদরুল আর পিচ্চি রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে উত্তেজনায় কাঁপছিল। কালকে মিস করা যাবেনা ভাবতে ভাবতে কবুল নামাজে মনোনিবেশ করে।

৫.
পরদিন দুপুর এগারোটার সময় আসে বুড়ো, খায়দায়, পেপার পড়ে দাঁত খিলাল করে। আজ অবশ্য বুড়ো ঢোকার সময়ই ক্যাশকাউন্টারের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলেছে, 'বাবাজি, আমার হাতে কিন্তু কোন পয়সা নাই।' বলে একগাল হাসতে হাসতে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে। এদৈন বেলা তিনটার আগে আগেই বুড়ো বের হয়ে যায়, তখন খিদার জ্বালায় পেট চোঁ চোঁ করছিল কবুল, বদরুল পিচ্চি, দিলু, সবার। খেতে খেতে মাঝপথে কবুলের মনে পড়ল যে আজও বুড়োকে অনুসরন করতে ভুলে গেছে বদরুল আর পিচ্চি। মেজাজ ভীষণ খারাপ হয়ে গেল তার, বদরুল আর পিচ্চিকে ভয়ংকরভাবে শাসানো হলো এই বলে যে এরপর যেদিন দরবেশ বাবা আসবেন সেদিন যদি ওরা ভুলে যায় তাহলে দুজনেরই চাকরী যাবে। চাকরী যাবার ভয় দেখানোতে ওদের অবশ্য তেমন ভাবান্তর নেই, চাকরী একটা গেলে আরেকটা আসবে, এটা যেন ওরা সবাই জানে।
রাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে কবুল নিজেকে প্রবোধ দিল এই বলে যে আরো ধৈর্য্য ধরতে হবে, আল্লাহতালা ধৈর্য্যশীলদের পছন্দ করেন।

পরদিন অবশ্য কবুল আর বুড়োর পথ চেয়ে অপেক্ষা করলনা, কারণ সে জানে সময় হলে বুড়ো এমনিতেই আসবে। এদিন বুড়ো আসল রাত আটটায়, এসে হনহন করে গিয়ে একটা খালি টেবিলে বসল। যাবার সময় কবুলকে কিছু বললনা, শুধু একটা হাসি বিনিময় করল। খাবারেরও অর্ডার দিলনা, বদরুল যা যা নিয়ে এল তা খেয়ে, হাতমুখ ধুয়ে দ্রুত বের হয়ে গেল, এবং অবশ্যই তা পয়সা না দিয়ে।
কবুল ধৈর্য্য ধরে, বাসায় গিয়ে নামাজ পড়ে, তার স্ত্রীও একমনে নামাজ পড়ে। নামাজে আল্লাহর কাছে দুনিয়াবী কিছু চাওয়া যায়না, কবুলের বউ সেটা জানিয়ে দিয়েছে কবুলকে আগে আগেই, কাজেই সে নামাজের বিছানায় বসেও বুঝতে পারেনা তার কি করা উচিত।
এরমধ্যে বদরুল আর পিচ্চির দুজনেই তাদের উপর চেপে থাকা বিশাল দায়িত্বের বোঝা থেকে বেঁচে যায়, কারণ, কবুলের বউ নীলু কবুলকে মানা করেছে এই বলে যে, 'আল্লার নেক বান্দাই হন আর ফেরেশতাই হন, তেনারে সন্দেহ করা ঠিকনা; আপনে বদরুল আর পিচ্চিরে বইলা দিয়েন উনার পিছন পিছন যেন না যায়।'
কবুল ইদানিং খুব বউভক্ত হয়ে গেছে, আল্লারসুলের বিষয়ে নীলু খানিকটা বেশীই জানে বদরুলের তুলনায়, তার শ্বশুর মাওলানা মানুষ। আল্লাহ হয়ত তার কপালে ভাল কিছু রেখেছে, এখন বউয়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে তার অসুবিধে নেই।

পঞ্চম দিন দেখা গেল যে কবুলের দোকানের সামনে মানুষের ভীড়, প্রচুর লোক খাবার কিনতে এসেছে। দিলু পুরী-পরোটা বানিয়ে খুলোতে পারছেনা, কিন্তু ভীড় কমেনা। কারণ, এরমধ্যে বদরুল। মোস্তাক আর পিচ্চির মাধ্যমে সারা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে যে 'এক বুড়া বিসমিল্লাতে প্রতিদিন ফাউ খাইতে আসে, সে দরবেশ হইতে পারে।' এধরনের কিছু।
প্রচুর কাস্টমার আসলে ব্যবসা ভাল হয়, এটাই কি ঐ দরবেশ আসার ফলে তার উপকার কিনা এটাও কবুল ভাবল। তারমানে কি এই বুড়ো সারাজীবন এখানে ফাও খাবে, আর তাকে দেখতে কাস্টমাররা এখানে খেতে আসবে, এটাই আল্লাহতালা চেয়েছেন? কবুল এটাও ভাবে, কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হয়, আগামী একমাসের মধ্যে তার ভাগ্যে যদি বড় ধরনের কোন পরিবর্তন না আসে, তাহলে মানুষ উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে, এই দরবেশের কারণে তার যে বিক্রীবাট্টা বৃদ্ধি সেটা সাময়িক।

পঞ্চম দিনে বুড়ো যথারীতি দুপুরের সময়ে আসল, এদিনও আগের মতোই কিছু না বলেই খেতে বসে যায় বুড়ো, তারপর সেই দাঁত খিলাল আর খবরপাঠ। কবুল লক্ষ্য করল যে বুড়ো প্রতিদিন একই পেপার পড়ে, হয়ত যেদিন বাসে এসেছিল এখানে সেদিন কিনেছিল, তারপর তো তারহাতে টাকাপয়সা নেই। কবুলের খানিক সন্দেহ হয় বুড়ো আসলেই পীরদরবেশ কিনা, আবার তার মনে হয় এটা হয়ত আল্লাহর পরীক্ষা। পীর-দরবেশ হলে তো সে আকাশে উড়ে উড়ে কতকিছুই করতে পারে, পীরদরবেশ প্রমাণ করার জন্য তো তার প্রতিদিন নতুন খবরের কাগজ পড়ার দরকার নেই।
এদিন বের হয়ে যাবার সময় বুড়ো খুব ব্যাস্ত ভঙ্গিতে হনহন করে বের হয়ে যায়, যাবার সময় কিছু না জিজ্ঞেস করেই কাউন্টারের উপর রাখা কবুলের গোল্ডলীফের প্যাকেট থেকে গোটা দুই সিগারেট নিয়ে যায়, একবা কবুলের দিকে তাকিয়ে ভদ্রতার হাসিও হাসেনা।

কবুলের খানিকটা রাগ হয়, পরমুহূর্তেই রাগটা গলে গিয়ে মুচকি হাসিতে পরিণত হয়। সে বুঝে নেয়, তার ধৈর্য্যের পরীক্ষা চলছে। তাও মাঝেমাঝে তার ধৈর্য্যের বাঁধে সন্দেহের বিশাল জোয়ার এসে আঘাত হানে। কবুল ব্যবসায়ী মানুষ, যদিও বয়েস তার ৩৫ এর বেশী হবেনা, তবুও গত ১২ বছর ধরে সে যে ব্যবসা করছে তাতে সবসময়েই সে হিসেব করে এসেছে পরের পদক্ষেপে তার লাভ না ক্ষতি হবে। আজ সে এক অলৌকিক লোভে পড়ে সেই লাভ-ক্ষতির হিসেব উঠিয়ে রেখেছে, অকাতরে এক বৃদ্ধকে ফ্রি খাইয়ে যাচ্ছে!

প্রতিদিনই কবুল ঘনীভূত সন্দেহ মাথায় নিয়ে বাসায় যায়, বউকে সব খুলে বলে, অদ্ভুত ঘটনা শুনে তার বউয়ের বিশ্বাস আরো যায় বেড়ে, বউয়ের বিশ্বাস দেখে কবুলের বিশ্বাস আবার বেড়ে যায়।

এভাবেই চলছে গত আটদিন, বুড়ো আসে, খায়দায়, রেস্ট নেয় তারপর চলে যায়। মানুষ ভিড় করে বৃদ্ধকে দেখতে, বেশ কয়েকজন ফলোও করেছে বৃদ্ধকে, একজন হাঁটতে হাঁটতে ছয় কি.মি দূরের পুল পর্যন্ত চলে গিয়েছিল, তারপর বুড়ো যখন পুলের ওপাড়ে চলে গেল অপেক্ষাকৃত নির্জন এলকায় তখন সে ভয় পেয়ে ফিরে এসেছে। পরে অবশ্য তার এই অপকর্মের জন্য যে যেমনে পেরেছে তাকে বকঝকা করেছে, মারধরও করার উপক্রম হয়েছে।

নবম দিন দুপুরে বুড়ো খাওয়াদাওয়ার পর আর নড়াচড়া করছেনা, প্রথমদিনের মতো আজও সে অনেক দেরী করছে, এটা সেটা খেতে চাচ্ছে। বদরুলের বেশ কয়েকবার মনে হয়েছে বুড়োকে বলে যে যেটা সে খেতে চাচ্ছে সেটা নেই, কিন্তু কবুলের রক্তচক্ষুকে সে এড়াতে পারেনা। রোবটের মতো বুড়োর অর্ডার পালন করে। দুপুর যখন তিনটেয় গড়ালো, বদরুলের দোকান গোছানোর ভাবসাব দেখে বুড়ো নিজেই উঠে পড়ল, ক্যাশের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছিল, তখন কবুল বলে উঠল, 'চাচামিয়া আজকে যে অনেক্ক্ষণ ছিলেন? কিছু বলবেন নাকি?'
বুড়ো কাঁচুমাচু হয়ে যায়, নরম স্বরে বলে, 'না বাবাজী। আমি আর কি বলব? আমি সামান্য মানুষ।'
কবুল কথা চালিয়ে যেতে চায়, আজ তার বুঝতেই হবে এই লোকের উদ্দেশ্য কি। সে জিজ্ঞেস করে, 'তা চাচামিয়া, আপনে উঠছেন কোথায়? এই এলাকায় আসছেন কি কাজে?'
প্রশ্ন শুনে বুড়ো মুচকি হাসে, বলে, 'প্রথম রাত ছিলাম মসজিদে, তারপরদিন দুপুরে আপনার মতোই আরেকজন দয়ালু লোকের সাথে দেখা হল। আল্লাহর অশেষ দয়া, এই এলাকায় দয়ালু লোকের সংখ্যা বেশী, আমি ওনার বাসায়ই আপাততঃ রাতযাপন করতেছি।'

কবুলের একবার ইচ্ছা হয় বলে যে খাওয়াদাওয়াও সেখানে করলেই তো পারেন, আবার ভাবে আসলেই যদি বুড়ো দরবেশ হয়! যে উল্টোপথে হাঁটে, বলে, 'চাচামিয়া, আমার বাসায়ও আপনে থাকতে পারেন। কোন সমস্যা নাই।'

বৃদ্ধ বলে, 'শুকরিয়া জনাব। কিন্তু দরকার নাই, আপনার রেস্তোরায় এমনিতেই বিনপয়সায় খাচ্ছি, আপনার তকলীফ হচ্ছে।'

বুড়ো চলে যায়, কবুলের সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। তার ধারনা ছিল বুড়োর কাছে কিছু জানতে চাইলে হয়ত বুড়ো গুপ্তধন টাইপের কিছুর সন্ধান দেবে, অথচ সে বলে কিনা 'আমি সামান্য মানুষ।' কবুল হতাশ হয়, আর মনে মনে ঠিক করে নেয় কাল বুড়োকে জিজ্ঞেস করবেই সে আসলে পীর-দরবেশ কিনা। যদি বলে না, তাহলে বলবে এর বেশী করা তার পক্ষে সম্ভব না, বুড়োকে আসতে নিষেধ করে দেবে।
সিদ্ধান্তটা যতটানা অর্থহানির জন্য, তারচেয়ে বেশী স্বাস্থ্যহানির জন্য। সেটাও বদরুল জানে,কারণ গত কয়েকদিন ধরে 'কি আছে ভাগ্যে?', 'বুড়ো আসলে কে?' এসব প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরতে ঘুরতে সে খুব ক্লান্ত। এখন সে মুক্তি চায়।

অদ্ভুত ঘটনা ঘটল পরদিন সন্ধ্যায়। কবুল দেখল বুড়ো তার সেই প্রথমদিনের পোটলাসহ এসে হাজির। আজ সে আসল একটু দেরীতে, রাত ন'টায়। খাওয়া দাওয়া শেষে সে বদরুলকে একটা টাকা দিয়ে বলল, 'এক খিলি পান এনে দাওতো বাবাজি।' পান চিবুতে চিবুতে সেই একই পত্রিকায় ডুবে গেল বুড়ো। পত্রিকার পেছনের পাতায় এরশাদ সাহেবের গালভরা হাসির একখানা ছবি আছে, সেটা দেখে কবুল বোঝে যে এই সেই একই পত্রিকা।
দশটার দিকে যখন দোকান গোছানো হবে তখন বুড়ো ক্যাশে আসল। বদরুলকে ইশারা করে কাছে ডেকে নিল, বলল, 'বাবাজী, অনেক কষ্ট দিলাম আপনারে। দোয়া করি আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন।' বদরুল বুঝতে পারচেনা সে খুশী হবে কিনা। দরবেশের দোয়া না পাঁচটাকা টিপস, কোনটা ভাল সেটা নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে তার মাথা ধরে যায়। তারওপর লোকটা আসলে দরবেশ না সাধারণ এক মানুষ, সেটা বদরুল এখনও নিশ্চিত না। মাজারে সে কখনও এমন পীর-দরবেশ দেখেনি। পীর দরবেশের মূল হলো চুলের জটা, যার জটা যত বড়, সে তত বড় দরবেশ -- এটাই সে জেনে এসেছে এতকাল।

বুড়ো এবারের কবুলের দিকে ফেরে, বলে, 'বাবাজী, আজকে আমি চলে যাচ্ছি, ঢাকা শহরে। আপনার অশেষ দয়া, অশেষ শুকরিয়া আপনার জন্য।'

কবুল আশ্চর্য হয়! কালই সে ঠিক করেছিল লোকটিকে আর আসতে মানা করে দেবে আর আজই সে চলে যাবে! দরবেশ বাবাকি তার মনের কথা শুনতে পেয়েছে? সে কি পরীক্ষায় ফেল করে ফেলেছে?

কবুল খানিকটা অস্থির হয়ে পড়ে, এবং বুড়োকে বলেই ফেলে, 'চাচামিয়া, আমি ভাবছিলাম আপনে কোন দরবেশ নাইলে আল্লার ফেরেশতা। আসছেন আমাদের পরীক্ষা নিতে।'

বৃদ্ধ মুখে অদ্ভুত কোমল একটা হাসি ঝুলিয়ে বলে, 'না বাবা। আমি সামান্য মানুষ।'

কবুল বলে, 'দোয়া কইরেন চাচামিয়া। আমি আরো ভাবছিলাম আপনে আসছেন, আমার পরীক্ষা নিছেন, এরপর আমার কপালে বিরাট কিছু একটা ঘটব। এখন দেখলাম কিছুই হইলনা।' কবুলের কন্ঠের হতাশা বোঝা যায়।

হঠাৎ বৃদ্ধ তাকে কানেকানে কিছু বলার জন্য ইশারা করে, কবুল কাউন্টার থেকে বের হয়ে এসে কান পাতে। বৃদ্ধ বিড়বিড় করে কি যেন বলে। তারপর কবুলের কানের কাছ থেকে মুখ সরিয়ে বলে, 'বাবাজী, গত দশদিনের আমাকে দেখে কি আপনি ব্যাপারটা বুঝেননাই?'

কবুল হাসতে হাসতে মাথা নাড়ে। জগতসংসারের সবসত্য যেন তারকাছে পরিস্কার হয়ে যায়। বৃদ্ধ হাত উঁচিয়ে তাকে 'আসি' বলে সম্বোধন করে, সে দেখতেও পায়না যেন। অদ্ভুত এক আনন্দে সে বিভোর হয়ে থাকে।

বলা হয়, পরের তিনদিন কবুল শুধু হেসেছে আর হেসেছে, নিজে নিজে, মুচকি হসি। আর কতক্ষণ পরপর দুহাত মুঠ করে, দুবাহু ঝাঁকিয়ে আনন্দপ্রকাশ করেছে, যেটা খেলোয়াড়রা ফুটবলমাঠে গোলটোল দিলে করে থাকে।

৬.
১৫ বছর পরের কাহিনী। সেদিন কবুল খানের বিসমিল্লাহ গ্রুপের 'দ্য বিসমিল্লাহ ইন্টারন্যাশনাল' হোটেলের তিনতারা ঘোষিত হওয়ার উৎসব। অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস আর শ্রীলংকা থেকে হোটেল বিশেষজ্ঞরা এসেচেন পরিদর্শনে, তারা এই হোটেলকে 'তিনতারা' ঘোষনার যোগ্য বলে রায় দিয়েছেন। আজ সেই সেলিব্রেশন পার্টি। কবুল খানের এই হোটেলটা বাংলাদেশের মফস্বল শহরের প্রথম তিনতারা হোটেল হতে যাচ্ছে, কবুল খানের আরো গোটা দুয়েক হোটেল আর গোটা পাঁচেক রেস্তোরা আছে ঢাকায়।
গত পনের বছর সে অমানুষিক পরিশ্রম করেছে, অন্যায়-দূর্নীতি-অসাধুতা করেনি এমনটা সে বলতে পারবেনা, তবে একাগ্রতা আর পরিশ্রমটা অনেক বেশী শ্রদ্ধেয়। কবুলের স্বপ্ন ছিল তার মফস্বল শহরে সে পূর্বানী হোটেলের মতো একটা হোটেল বানাবে, আজ তার হোটেল পূর্বানীর চেয়েও অনেক বিখ্যাত।

সবাই জানে সেই ফকির বাবা বা ফেরশতা কবুলকে বিরাট সম্পত্তির খোঁজ দিয়ে গেছেন। যদিও কবুল বারবার বলেছে বৃদ্ধ তাকে একটা কানাকড়িও দিয়ে যায়নি, তবুও ব্যাপারটা এভাবেই ছড়িয়ে গেছে। কথাটা এভাবেই ছড়িয়েছে যে বুড়ো কানেকানে কবুলকে এমন একটা গুপ্তধনের সন্ধান দিয়েছে যেটা কখনও শেষ হয়না, যখনই প্রয়োজন হয়, কবুল সেখান থেকে খানিকটা তুলে আনে, আবার সেটা নিজেনিজেই পূরণ হয়ে যায়।
'কবুল খানের সম্পত্তি ক্ষয় হবার নয়' একথাটা ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র।

প্রায়ই কবুলকে এই প্রশ্নটার সম্মুখীন হতে হয় যে বুড়ো কবুলকে কোন জায়গার কথা বলেছে। কবুল খান সবসময় হেসে বলেছে, 'সেটা বলা যাবেনা।'

শুধু বদরুল ব্যাতিক্রম, কবুল খানের সাথে সাথে বদরুল হাসান চৌধুরীরও ভাগ্য বদলে গেছে। পুরোটা সময় সে কবুলের সাথে থেকেছে, দেখেছে কবুলের তিলে তিলে গড়ে তোলা ব্যবসা সাম্রাজ্য। তবে বদরুল জানে, বুড়োর কানেকানে বলা সেই কথাই কবুলকে আজ এখানে নিয়ে এসেছে।

কবুল বদরুলকে ঠকায়নি। সবসময় সাথে রেখেছে, যখন যতটুকু প্রয়োজন দিয়েছে। শুধু যখনই কবুলকে বদরুল জিজ্ঞেস করেছে, 'বুড়ামিয়া কি বলছিল?'
কবুল রহস্যময় হাসি হেসে বলেছে, 'একদিন তুমিও তার দেখা পাবে।'


মন্তব্য

শামীম এর ছবি

ধৈর্য আছে আপনার!

বুড়া বলেছিলো.... বদরুল যার কাছে থাকে সে উন্নতি করে দেঁতো হাসি
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

অতিথি এর ছবি

সুন্দর লেখা। একটানে পড়ে ফেললাম। অনেক ধন্যবাদ।

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

আমার তো কোন ধৈর্য্য ধরতে হয়নাই @শামীমভাই,
মনের খুশীমতো লিখে গেছি একটানে

আপনাকে বরং একটা বিশাল থ্যাংকস ধৈর্য্য ধরে এই অখাদ্য পড়ার জন্য হাসি

হুমম ,,, বদরুলের খোঁজ করতে হয় তাইলে চোখ টিপি
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

ধন্যবাদ @ অতিথি
অতিথিরা নাম বা নিকটা লিখে দিলে আরো ভাল লাগবে হাসি
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।