সর্ষেয় ভূত

নাসিফ এর ছবি
লিখেছেন নাসিফ [অতিথি] (তারিখ: শনি, ১৩/০৬/২০০৯ - ১১:৪৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ছোটবেলায় আমার ভয় ছিল দুটি । একটি ভূতের ভয়, অন্যটি কোন অন্যায় করে ফেললে আম্মার মুখখানা যখন গম্ভীর হয়ে যেত সেই মুখখানা । আম্মা শারীরিক শাস্তির ধারে-কাছেও যেতেন না, বরং আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিতেন- আর আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়তাম, কারন তাঁর সাথে কথা বলতে না পারলে আমার দমবন্ধ হয়ে আসত । এই দুটি ভয়ই এখন অতীত । প্রথমটি ভূতে এখন আর বিশ্বাস নেই তাই, দ্বিতীয়টি- কালেভদ্রে বাড়ী যাই আর গিয়ে ভয়াবহ রকমের ভাল ছেলে সাজার চেষ্টা করি সেজন্যে ।

আমাদের বাড়ীর পেছন দিকে একটা মিনি-জঙ্গল ছিল । সেখানে বাঁশ, আমগাছ, গাবগাছ আর শেওড়া গাছের সংখ্যা ছিল বেশি । গাবগাছ আর শেওড়া গাছকে মনে করা হত ভূতসমাজের আবাসস্থল । গাবগাছে উঠে বাড়ীর দুএকটা কাজের ছেলে ভূতগ্রস্তও হয়েছিল । ভূতব্যাটারা সামাজিক শ্রেণীবিভেদএর ব্যাপারে সচেতন ছিল । প্রায় সবগুলো কাজের লোকের উপর বিভিন্ন সময়ে ভর করলেও আমাদের পরিবারের কারো দিকে কখনোই কুদৃষ্টি(!) দেয় নি ।

আমাদের অনেকের কাছে ভূত একটা বিলুপ্ত প্রজাতি হলেও কেউ কেউ মনের মধ্যে সযতনে ভূতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে । তাদের একজন আমিন (ওরফে মেরাজ), সেই এই লেখার কেন্দ্রীয় চরিত্র ।

লেভেল-৩ টার্ম-১ এর পর আমরা চারজন মাহমুদ, আমিন, কায়েস এবং আমি বগালেক ট্যুরে গিয়েছিলাম । যাওয়ার পথে রুমাবাজারে আমাদের একরাত থাকতে হয় । বাজার থেকে একটু দূরে একটা পুরনো বাড়ী আমরা রাতে থাকার জন্য ঠিক করি । দোতলা বিল্ডিং, উপরতলার একটা স্যাঁতস্যাঁতে রুম আমাদেরকে দেওয়া হয়, অ্যাটাচড টয়লেট নেই, রুম থেকে বেরিয়ে কয়েকগজ দূরে ছোটঘরের অবস্থান । বুয়েটের আরেকটি গ্রুপ দোতলায় অন্য একটি রুমে ছিল, রুমাবাজার যাওয়ার পথে ওদের সাথে আমাদের দেখা হয় ।
যাহোক, সন্ধ্যার পরপরই এলাকাটি পুরো নিরব হয়ে গেল। আটটার দিকে খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা রুমে এসে গল্পগুজবে মেতে উঠলাম । মাহমুদ স্বভাবমতো নয়টার দিকে ঘুমিয়ে পড়ল । রাত দশটার দিকে আমিন আমাকে বলল সে টয়লেটে যাবে, আমি যেন রুম থেকে বেরিয়ে ওকে পাহাড়া দেই । ওর ভীতুপনায় বিরক্ত হয়ে কায়েস আর আমি ওকে ঝাড়ি দেই, কিন্তু কাজ হয় না, সে একা কোন ভাবেই রুমের বাইরে যাবে না । কায়েসের মাথায় তখন দুষ্টবুদ্ধি খেলল, সে ওকে আরো ভয় দেখানোর জন্য বলল যে, সে সবশেষ যখন টয়লেটে যায় তখন তার কেন জানি মনে হচ্ছিল এই জায়গাটাতে কোন একটা সমস্যা আছে, মনে হচ্ছিল অদৃশ্য কেউ যেন আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে । আমি আরেক কাঠি অগ্রসর হয়ে বললাম, “আমি টয়লেটে গিয়ে একটা ক্ষীণ গোঙানীর আওয়াজ পাচ্ছিলাম, কিন্তু তোরা বিশ্বাস করবিনা বলে তখন বলি নাই, এখন কায়েসের কথা শুনে মনে হচ্ছে কোন একটা সমস্যা আসলেই আছে ।” আমিনের সত্যিকারের ভয় পাওয়া তখন থেকে শুরু হল । কায়েস আর আমি মিলে আশেপাশে হাস্যকর সব অসঙ্গতি খুঁজতে লাগলাম- তেলাপোকাটা এইভাবে হাঁটছে কেন? টিকটিকিটা ঐভাবে স্থির হয়ে আছে কেন? কিসের যেন ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে ! আর আমিনের মনে হতে লাগল- না!তেলাপোকা এইভাবে হাঁটতে পারে না! টিকটিকিটার ঐরকম স্থির হয়ে থাকাটা বড়ই অস্বাভাবিক, টিকটিকি কেন স্থির থাকবে ? নিশ্চই এর অন্য কোন রহস্য আছে । যে ঘ্রাণের কোন অস্তিত্ব নেই, সেই অনুপস্থিত ঘ্রাণকে তার অপার্থিব মনে হতে লাগল । এইভাবে চলল বেশ কিছুক্ষণ- আমরা একটা একটা করে অসঙ্গতি খুঁজে বের করি, আর আমিন একটু একটু করে ভয়ে চুপসে যেতে থাকে ।

এসময় মাহমুদ জেগে উঠে, তোরা সব ভীতুর দল, বলে টয়লেটে গেল এবং কিছুক্ষণ পর বেশ একটা ভাব নিয়ে রুমে ফিরে আসল । কায়েসের বুদ্ধিবৃত্তির আকস্মিক স্ফূরণের ফলে মাহমুদকে তখন হতে হল ভূতগ্রস্ত প্রোল্যাতারিয়েত (ভূতের শ্রেণীজ্ঞানের ব্যাপারটা মাথায় আছে নিশ্চয়ই)। আমরা দুই বুর্জোয়া তখন বিপুল উদ্যমে মাহমুদের চলন-বলন, হাসি-কাশি ইত্যাকার বিষয়াদিতে অস্বাভাবিকতা আবিষ্কার করতে লাগলাম । আর গিনিপিগটা যখন মাহমুদ তখন হাজারো অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাওয়াটাই খুব স্বাভাবিক (কেন?) । মাহমুদও তখন নানারকম উলটাপালটা কাজকর্ম শুরু করল, হাবিজাবি বলা শুরু করল । আমিন ততক্ষণে চুপসাতে চুপসাতে আঙ্গুর থেকে কিসমিসে পরিণত হয়েছে । সে মাহমুদকে রীতিমত ভয় পাওয়া শুরু করল, কারণ মাহমুদ তার কাছে তখন ভূতের বলে বলীয়ান এক ডব্লিউ. ডব্লিউ. ই. সুপারস্টার । আমিন তখন আর মাহমুদকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলছিলনা, বলছিল ওর ঘারে চেপে থাকা ভূতটাকে । সে প্রস্তাব করল ভূতগ্রস্তটাকে অবিলম্বে পুকুরের পানিতে নিয়ে চুবানো হোক । আমরা ভেটো দিলাম- এই অশরীরি শক্তিকে টেনে পুকুরে নেওয়া ইম্পসিবল । আমিনের বিকল্প প্রস্তাব- ওর গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হোক । আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম সে দ্বিতীয় প্রস্তাবের ব্যাপারে সিরিয়াস নয়, কারণ এই উপায়ে ভূত তাড়াতে গেলে ভূতের সাথে বেচারা মাহমুদকেও পুড়িয়ে ফেলতে হবে । কিন্তু ভয়ে আতংকে ওর এমনই মতিভ্রম হয়েছিল যে, ওখানে একটি শ্মশান রচনা করতে ওর কিছুমাত্র দ্বিধা ছিল না। আমিন ম্যাচ হাতে নিল । মাহমুদ বোধহয় তখন ভয়ই পেয়েছিল । এঅবস্থায় অভিনয় চালিয়ে যাওয়াটাকে আমরা আর সঙ্গত মনে করলাম না । মাহমুদ তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসল । আমরা আমিনকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঠাণ্ডা করলাম ।

ট্যুরগুলোকে খুব মিস করব । মিডটার্মে বা টার্মফাইনালের পর বন্ধুরা সব মিলে হৈচৈ করতে করতে পাহাড় বা সমুদ্রের কাছে ছুটে যাওয়া- বুয়েটলাইফে এটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় আনন্দ ।


মন্তব্য

গৌতম এর ছবি

আপনার লেখা সাবলীল। আপনার কাছ থেকে নিয়মিত লেখা চাই।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

ইমরুল কায়েস এর ছবি

আপনার লেখা সাবলীল। আপনার কাছ থেকে নিয়মিত লেখা চাই।

হ্যাঁ, আমি তো ইনাকে অনেকদিন থেকে এটাই বুঝাতে পারছি না।
......................................................
পতিত হাওয়া

তানবীরা এর ছবি

এখন বুঝে গেছেন, আশাকরি নিয়মিত লিখবেন।
---------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

বেচারা..

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- আমিনকে বেক্কল বানাইছেন? আমার তো কেনো জানি মনে হচ্ছে উল্টা আমিন-ই আপনাদেরকে বেক্কল বানিয়ে ছেড়েছে! হাসি
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।