স্মিথসোনিয়ানের টুকরো গল্প - ২

অবনীল এর ছবি
লিখেছেন অবনীল (তারিখ: রবি, ০২/০৬/২০১৯ - ১০:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চাঁদের পাথর

ভীড়ের মধ্যে খুজে পাচ্ছিলাম না জায়গাটা। জাদুঘরের এক নিরাপত্তা রক্ষীকে জিজ্ঞেস করাতে আঙ্গুল তুলে হলঘরের যেদিকে বিশাল সব নভোযান সগর্বে মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে, সেদিকে যেতে বলে দিলো। লোকজন এড়িয়ে কিছুদুর এগোনোর পর চোখে পড়লো ছোট একটা সিলিন্ডার আকৃতির প্লাটফর্ম। কাছে গিয়ে ভালো করে দেখতেই চোখে পড়লো অভিষ্ট বস্তু। বৃত্তাকার প্যানেলে লাগানো আবছা নীল আলোতে কালো ব্যাসল্ট পাথরটা দেখতে নিতান্তই বৈশিষ্ট্যহীন। কে বলবে এই অতি সাধারন দেখতে পাথরটা এখানে আনতে মানুষকে মহাশুন্যের মধ্যে দিয়ে পাড়ি দিতে হয়েছে প্রায় আড়াই লক্ষ মাইল ! এ আমাদের সবর্শেষ চন্দ্রাভিযানের সাক্ষী। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম। ঠান্ডা, উপরে খানিকটা ঢেউ খেলানো। খানিকটা শিহরিত হলাম এইভেবে যে - যে চাঁই থেকে ভেঙ্গে আনা হয়েছে এই ছোট্ট টুকরো সেই অংশটা এখন পড়ে আছে চন্দ্রপৃষ্ঠে । ঝট করে মনে পড়ে গেলো দিন কয়েক আগে কৌতুহল বশে পড়া এপোলো ১৭ এর চন্দ্রাভিযানের ঘটনা ...


ভিডিওঃ ১৯৭২ সালে এপোলো ১৭ -এর চন্দ্রাভিযানের সময়ে এক খনিজলৌহপুষ্ট বড়সড় এক ব্যসল্ট পাথর পাওয়া যায় চাঁদের টরাস-লিটরোউ (Taurus-Littrow) উপত্যকায়। সেই পাথরটাকে শুধুমাত্র জনসাধারণের স্পর্শযোগ্য এক চন্দ্রনিদর্শন হিসেবে ব্যবহারের জন্য বয়ে আনা হয়ে এই ভূমন্ডলে।

ডিসেম্বার ১১, ১৯৭২। এপোলো ১৭ চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরন করলো। এটা শুধু আমাদের সর্বশেষ চন্দ্রাবতরনই নয়, পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথ অতিক্রম করা সর্বশেষ মানববাহী মহাশুন্য অভিযান। তিনজন নভোচারী পরিচালিত করছিলো নভোযানটা - কমান্ডার ইউজিন এ কার্নান, কমান্ড মডিউল পাইল্ট রোনাল্ড ই ইভান্স এবং লুনার মডিউল পাইলট হ্যারিসন পি স্মিট। এপোলো ১৭ ই হচ্ছে প্রথম অভিযান যাতে একজন বিজ্ঞানীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মূল বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য ছিলো - "টরাস লিট্রো অঞ্চলের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ভূতাত্ত্বিক জরিপ চালানো এবং চন্দ্রপৃষ্ঠের বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক বস্তুর নমুনা সংগ্রহ, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সরঞ্জামাদি প্রস্তুত এবং সক্রিয়করণ, নভোযানে পরিভ্রমনের সময় বিভিন্ন পরিক্ষা সম্পাদন এবং চন্দ্র প্রদক্ষিনের সময় চিত্রগ্রহন।" হ্যারিসন "জ্যাক" স্মিট হার্ভার্ড থেকে ভূতত্ত্বে পিএইচডি করেছেন ১৯৬৪ তে, তিনি হলেন চন্দ্রপৃষ্ঠে পদার্পন করা প্রথম নভোচারী-বিজ্ঞানী । তার সাথে আছেন ইউজিন "জিন" কার্নান, একজন অভিজ্ঞ নভোচারী। তার প্রথম মহাশুন্য ভ্রমন ছিলো ১৯৬৬ তে, জেমিনি আইএক্স-এ অভিযানে। পরে আবার ১৯৬৯ সালে এপোলো ১০ অভিযানেও লুনার মডিউলের পাইলট হিসেবে কাজ করেছেন, সেই সময় চন্দ্রপৃষ্ঠের ৯০ মাইলের মধ্যে চলে আসেছিলেন তিনি।

কার্নান চ্যালেঞ্জার লুনার মডিউলটা টরাস লিট্রো উপত্যকায় অবতরন করালেন। মেয়ার সেরেনিটাটিস বা সি অফ সেরেনিটির ঠিক দক্ষিন পূর্বে। অভিযান পরিকল্পনাকারীদের আশা ছিলো এই এলাকা থেকে চন্দ্রপৃষ্ঠের ইতিহাস সম্বন্ধে মূল্যবান তথ্য আহরন করা সম্ভব হবে। অবতরনের পর নভোচারী কার্নান এবং স্মিট-এর প্রতিক্রিয়া রেকর্ড করা হয়েছে এভাবে -

কার্নানঃ "জানো, খেয়াল করে দেখলাম পৃথিবীকিরণ-এর সময় আর দ্বৈত-প্রচ্ছায়ার সময় চন্দ্রপৃষ্ঠের দৃশ্যের অনেক পার্থক্য। এক ক্ষেত্রে পৃথিবীকিরণ পাচ্ছি, আর অন্যক্ষেত্রে পৃথিবী আকাশে না দেখা গেলেও নক্ষত্ররাজি প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে। "

কার্ণান (কিছু পরে)ঃ "ওহ। ওই প্রস্তরখন্ডটা লক্ষ্য করো!"

স্মিটঃ "একেবারেই অবিশ্বাস্য। একেবারেই অবিশ্বাস্য।"

কয়েকঘন্টা ধরে প্রস্তুতি নেবার পর কার্নান লুনার মডিউলের বাইরে আসলেন। চন্দ্রপৃষ্ঠে পদার্পনের ঠিক আগের মুহুর্তে বলে উঠলেন -

"সিড়িতে দাড়িয়ে আছি আমি এখন, হিউসটন। টরাস-লিট্রো অঞ্চলের চন্দ্রপৃষ্ঠে পা রাখতে রাখতে আমি এপলো ১৭-এর এই প্রথম পদক্ষেপ উৎসর্গ করতে চাই সবাইকে যারা একে সম্ভব করেছেন... জ্যাক, আমি এখন চাদের পৃষ্ঠে। ওহ, অবিশ্বাস্য। অবিশ্বাস্য, কিন্তু জায়গাটা কি সুর্য্যের আলোতে উজ্জ্বল দেখাবে... আচ্ছা... আমরা একটা অগভীর নিম্নাঞ্ছলে অবতরন করেছি। এজন্য এলাকাটা একটু ঢালু কোন বিশিষ্ট। খুবি অগভীর, অনেকটা ডিনার-প্লেটের মত।"

লুনার রোভার বের করে আনলেন দুই নভোচারী মিলে। অবতরনকৃত এলাকার চারপাশে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা শুরু করলেন। বিভিন্ন পরীক্ষানিরিক্ষা একসাথে করার জন্য নির্মিত সুক্ষ্ম সব যন্ত্রপাতি এবং বিস্ফোরক - যা দিয়ে ভূকম্পনের সাহায্যে তথ্য আহরণ করা হবে। রোভার চালিয়ে প্রথম প্রদক্ষিন করার সময় নানারকম চন্দ্রপ্রস্তরের নমুনা সংগ্রহ করা হলো। পরের দুদিন ধরে, আরো দুবার চন্দ্রপৃষ্ঠে হাটলেন নভোচারীরা, চন্দ্রপৃষ্ঠে রোভার চালিয়ে ঘুরলেন এবং নমুনা সংগ্রহ করলেন।

পরে স্মিট নাসার ঐতিহাসিক ক্যারল বাটলারের কাছে অবতরনকৃত এলাকার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ "আপোলো অভিযানগুলোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে বৈচিত্রপূর্ন অবতরনকৃত এলাকা ছিলো। সেইজন্য বিশেষকরে এই এলাকা বেছে নেওয়া হয়েছিলো। পর্বতের উপস্থিতি কারণে আমরা তিন মাত্রায় নমুনা সংগ্রহের সুযোগ পেয়েছিলাম। ভুমিপৃষ্ঠে আর উচু এলাকায় পর্বতের দেয়ালে ছিলো মেয়ার ব্যাসল্ট পাথরের উপস্থিতি। আমরা এক নবীন আগ্নেয়গিরি উৎপাদিত উপাদানের সন্ধান পাই যেটা সংগৃহীত ছবিতে দৃশ্যমান হলেও প্রথম দেখায় বোঝা যায়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শর্টি জ্বালামুখে সেই কমলাবর্ণের মৃত্তিকা খুজে পাই।

small
ছবিঃ স্মিথসোনিয়ানের সেই জনসাধারনের স্পর্শের জন্য উম্মুক্ত চন্দ্রপ্রস্তরটা এসেছে ছবিতে দেখানো কৃষ্ণকায় বস্তু থেকে। ছবিতে লুনার মডিউলের ডান পাশে পেছনে দেখা যাচ্ছে সেটা এখানে। ব্যাসল্টের বড় একটা খন্ড, লৌহপুষ্ট এক আগ্নেয়শিলা, টরাস-লিট্রো অঞ্চল থেকে সংগৃহিত। প্রদর্শ্নের জন্য বিশেষ করে এই পাথরটি পৃথিবীতে বয়ে নিয়ে আসা হয়।

ঠিক ১৯৭২ সালের ডিসেম্বারের ১৪ তারিখে কমান্ডার ইউজিন কারনান পরিণত হন চন্দ্রপৃষ্ঠে পদচিহ্ন এঁকে দেওয়া সর্বশেষ মানুষে। চন্দ্রপৃষ্ঠ ত্যাগ করে পৃত্থিবীর উদ্দেশ্যে পাড়ি দেবার সময় তার মুখনিসৃত সর্বশেষ কথাগুলো ছিলো এরকম -

“বব, জিন বলছি। চন্দ্রপৃষ্ঠে আমি এখন। ফিরবার উদ্দেশ্যে হাটতে হাটতে চন্দ্রপৃষ্ঠে মানুষের সর্বশেষ পদচিহ্ন একে দিচ্ছি। তবে আমাদের বিশ্বাস খুব বেশী দিনের জন্য এগুলো অন্তিম পদচিহ্ন হয়ে থাকবে না। আমি শুধু বলে রাখতে চাই যে, আমার বিশ্বাস ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে আমেরিকার আজকের চ্যালেঞ্জ মানুষের আগামীকালের ভাগ্য নির্মান করে দিয়েছে। চাদের টোরাস লিট্রো অঞ্চল ছেড়ে যেভাবে এসেছিলাম সেভাবেই ফিরে যাচ্ছি। তবে ঈশ্বরের ইচ্ছায়, আমরা ফিরে আসবো। সকল মানুষের জন্য শান্তি আর আশার বাণী নিয়ে। এপোলো ১৭ এর নভোযাত্রীদের সফলতা কামনা করছি।"

এই শব্দগুলো বলার পর ছেল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত আর কোন মানুষ চন্দ্রপৃষ্ঠে পা রাখেনি।

***

টিনটরেটোর যীশু

ন্যাশনাল গ্যালারী অভ আর্ট-এ ঢুকে এক কামরা থেকে আরেক কামরায় ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছি। নজরকাড়া ভাস্কর্য আর নাম না জানা প্রাচীন সব চিত্রকর্মের চোখ ধাঁধাঁনো রং-এর খেলায় কিছুটা বিমোহিত অবস্থা। হাতে সময় নেই বেশ কয়েক্টা জাদুঘর ঘুরে ফেরত যেতে হবে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এই একটা গ্যালারীতেই গোটা দিন পার করে দেওয়া যাবে। তারপরো পুরো দেখা শেষ হবে কিনা ঠিক নেই। হঠাৎ বাক ঘুরে বামে তাকাতেই দেখি বিশাল এক দেয়াল তার দুপাশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে সারি সারি ক্যানভাস দেয়ালে টাঙানো । দেয়ালে লেখা 'ভেনেশিয়ান প্রিন্টসঃ এট দ্য টাইম অভ টিনটোরেটো' ।

small
ছবিঃ ভেনেশিয়ান প্রিন্টস হলঘরের প্রবেশমুখ।

রেনেসা সময়কার বিখ্যাত শিল্পীদের প্রেমে ত পড়েছিলাম ছোটবেলাতেই - "ভিঞ্চি, মাইকেলেঞ্জেলো, ডনাটেলো, রাফায়েল, বত্তিচেল্লি, মন্তেন্না...জানতেন না ?" দেরী না করে ঢুকে পড়লাম। এই হলের শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু তিনতোরেত্তো এবং তার সমসাময়িক ভেনিশিয়ে চিত্রশিল্পীদের কেন্দ্র করে। বিভিন্ন আসামান্য সৃষ্টির উপর চোখ বুলাতে বুলাতে হঠাৎ চোখ আটকে গেল চওড়া এক ক্যানভাসে। কাজটা তিনতোরেত্তোর নয়। তার অন্যতম বিখ্যাত চিত্রকর্ম 'দি ক্রুসিফিক্সান' এর খোদাইকৃত অনূরূপ । করেছেন তারই গুণমুগ্ধ আরেক শিল্পী আগোস্টিনো কারাচি ১৫৮৯ সালের দিকে।

small
ছবিঃ 'দি ক্রুসিফিক্সান' এর খোদাইক্ক্রত অনূরূপ । করেছেন শিল্পী আগোস্টিনো কারাচি । স্মিথসোনিয়ানের ভেনেশিয়ান প্রিন্টস নামক হলঘরে শোভা পাচ্ছে এটি বর্তমানে।

রেনেসাঁ সমকালীন মহান চিত্রশিল্পীদের মধ্যে অন্যতম হলেন টিনটোরেটো। ইতালিয়ান উচ্চারনে তিনতোরেত্তো। আরেক মহান চিত্রশিল্পী তিতিয়ানের উত্তরসুরী। ষোড়শ শতকের ভেনেশিয়ান চিত্রকলার অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে অভিহিত অরা হয় থাকে। তিনতোরেত্তোর অভিষ্ট লক্ষ্য ছিলো মাইকেলাঞ্জেলোর চিত্রাঙ্কনের ধরনের সাথে তার গুরু তিতিয়ানের রঙয়ের ব্যবহারের এক অভূতপূর্ব মিলন সৃষ্টি করা। যে অভিলাসের ফলাফল নিখুতভাবে চিত্রবন্দী করা হয়েছে 'দ্য ক্রুসিফিকশান' নামক এই অমর সৃষ্টিতে। ধর্মভীরু তিনতোরেত্তো তার জীবনের এক দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন ধর্মীয় ঘটনা বিষয়ক চিত্রকলা সৃষ্টিতে।

ভেনিসের স্কোলা গ্রান্ড দি সান রোকোর সম্মেলন কক্ষগুলোর জন্য আঁকা ৫০ টা বিশাল এবং জটিল ক্যানভাসকে তিনতোরেত্তোর সবচেয়ে মহান সৃষ্টিকর্ম ধরা হয় । অনেকটা মাইকেল এঞ্জেলোর সিসটাইন চ্যাপেলের কাজের অনুরূপ এই সৃষ্টি। এগুলো আঁকা হয়েছিলো ১৫৬৫ থেকে ১৫৮৭ এর মধ্যবর্তী সময়ে। বাইবেল বিষয়ক শ্রেষ্ঠ শিল্পকলাসমূহের মধ্যে অন্যতম এই পঞ্চাশটা ক্যানভাস। যীশুখৃষ্টের এবং মাতা মেরীর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা প্রদর্শন করে এরা দালানের উপর এবং নিচের হলগুলোতে। তিনতোরেত্তোর চিত্রাঙ্কনের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট ধারন করে 'দ্য ক্রুসিফিকশান' । পুরো ক্যানভাস জুড়ে ঘটনার ছড়াছড়ি। রেনেসাঁর যেসব শিল্পীরা বিশাল ক্যানভাসের ব্যবহার করেছেন প্রায়শই ক্যানভাস পূর্ণ করতে প্রচুর খুটিনাটি ঘটনার চিত্রায়ণ ধারণ করেছেন এর বুক জুড়ে। আর 'দ্য ক্রুসিফিকশান' এর ক্যানভাস তো পুরো একটা গোটা দেয়ালজুড়ে ছড়িয়ে।

ষোড়শ শতকের জন্য তিনতোরেত্তোর যীশু ছিলো খুবি অস্বাভাবিক। ঘটনার মূল চরিত্রগুলোকে ক্যানভাসের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ধারণ না করে শিল্পী আমাদের গলগথার এক সামগ্রিক চিত্র উপহার দিচ্ছেন এতে। যে চিত্রে ভিড় করে রয়েছে বিচিত্ররকম বর্ণিল সব চরিত্র - সৈনিক, জল্লাদ, ঘোড়সাওয়ারি, বণিক, কৌতুহলী দর্শক, চোর, যীশুর বার্তাবহ - বিভিন্নরকম কর্মকান্ডে নিয়োজিত অবস্থায় তারা । পোকামাকড়ের মত তাড়াহুড়ো যেন তাদের মধ্যে। দুই তস্করের চিত্রায়ন রেনেসাঁর চিত্রকর্মগুলোতে
খুবই দূর্লভ একটা ঘটনা। একজনকে ক্রুশে পেরেক দিয়ে বিদ্ধ করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে, আরেকজন ইতিমধ্যেই ক্রশবিদ্ধ - মাটিতে তা দন্ডবত অবস্থায় তুলে ধরার চেষ্টায় কিছু লোক। সম্মুখভাগে একেবারে ডান দিকে এক লোক আমাদের দিকে পেছন ফিরে মাটিতে গর্ত করছে। খুব সম্ভবত দ্বিতীয় ক্রুশের খুটি এতেই পোতা হবে। পুরো চিত্রকর্ম জুড়ে যে গতিময়তার ছড়াছড়ি তার একটা উৎকৃষ্ট উদাহরন এই ব্যক্তিটি। আরেকটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো বিপুল সংখ্যক দামী পোষাক পরিহিত দর্শকের উপস্থিতি, ভেনিসিয়ান চিত্রকলার এক চিরাচরিত ধরন। দর্শকের মনোযোগ সর্বোচ্চ মাত্রায় কেড়ে নেয় এই চিত্রকর্ম। কিছু কিছু খুটিনাটি দৃষ্টিকে অদ্ভুতভাবে আকর্ষন করে - যেমন বাম পাশের মাটিতে পড়ে থাকা মই। চিত্রপটের একেবারে নিচে। দর্শকের একেবারে সন্নিকটে। যেন চিত্রপটের ঘটনার ভিতরে নিমজ্জনের জন্য শিল্পীর গুঢ় আমন্ত্রণ।

দুই ঢালের ঠিক মাঝখানে যীশু। স্থির এবং শান্ত। চারপাশের হাঙ্গামা আর ডামাডোলের উর্ধে এক শান্তমূর্তি। মেঘ থমথমে আকাশ একইসাথে শান্ত, পুরো চিত্রপটকে এক রহস্যের বাতাবরনে অবগুন্ঠিত করে রেখেছে যেন। খৃষ্টের দেহের অবস্থান চিত্রপটের সাথে সমান্তরাল, স্থিরতার আবহকে আরো স্পষ্ট করে তুলেছে। ক্রুশের পদদেশে অবস্থিত মাতামেরী এবং বন্ধুদের দিকে তার মমতাভরা দৃষ্টি নিবদ্ধ। ক্রুশের একেবারে উপরে যীশুর অবস্থান, ক্যানভাসের একেবারে শেষ প্রান্তে। হাত আর পায়ে বিদ্ধ পেরেক পরিস্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু তার শারিরিক যন্ত্রণাকে সেভাবে তুলে ধরা হয়নি। খ্রিষ্টের মাথার চারপাশ বিকির্ণ আলোকধারার যেন পাখির ডানার মত মেলে আছে। মাথা সামনে হেলে থাকলেও তাতে ক্লান্তির চিহ্ন নেই। বরং মনে হচ্ছে যেন শান্তমনে তিনি চারপাশের ঘটনাবলী অবলোকন করছেন। আমাদের মতোই।

small
ছবিঃ স্কোলা গ্রান্ড দি সান রোকোর দেয়ালে টাঙানো তিনতোরেত্তোর 'দ্য ক্রুসিফিকশান'।

***

ইস্টার দ্বীপের রহস্য

"মহাসমুদ্রের ফেনীল জলরাশীর মাঝে লুকিয়ে আছে একটা জনবিচ্ছিন্ন রহস্যময় দ্বীপ। দানবীয় সব অতিকায় মূর্তি পোতা তীরের চারপাশে। অজানা কোন এক জাতীর ফেলে যাওয়া কীর্তি। আজ তারা হয়ত কালের অতল গহবরে বিস্মৃত। কিংবা বিলুপ্ত। তাদের পরিত্যাক্ত বিশালাকার ভগ্নাবশেষ যেন আমাদের জন্য রেখে যাওয়া দুরূহ এক হেঁয়ালী।"
--উনিশ শতকের ফরাসী সমুদ্রযাত্রী এবং শিল্পী পিয়েরে লতির রেখে যাওয়া ডায়রীর পাতা থেকে।

১৭২২ সাল। সেদিন ছিলো ইস্টার দিবস। ডাচ অভিযাত্রী জ্যাকব রগেভিন চোখে ধরা পড়ে বিস্তীর্ণ দক্ষিন সাগরের মাঝে এক ছোট্ট এক ফোটা আগ্নেয়শিলাসম এক দ্বীপ। ইস্টার দ্বীপ নাম দেন তিনি এর। আজকের দিনেও পৃথিবীর অন্যতম জনবিচ্ছিন্ন আবাসস্থল এই ইস্টার দ্বীপ। বর্তমানে চিলি-র অন্তর্গত। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এই দ্বীপের তীর ঘেষে সমুদ্রের পানে মুখ করে দাড়িয়ে রয়েছে সারিবদ্ধভাবে প্রায় এক হাজার মূর্তি। কোন কোনটা প্রায় ত্রিশ ফিট পর্যন্ত লম্বা আর ওজনে প্রায় আশি টন! কেন তৈরী করা হয়েছিলো এই সব বিশাল স্থাপত্য? কি ছিলো তাদের উদ্দেশ্য ? কেমন করেই বা সেই প্রাচীন দ্বীপবাসীরা এই অসাধ্য সাধন করেছিলো? এইসব প্রশ্নের উত্তর আজও রহস্যের জালে ঢাকা।

মাত্র ১৪ মাইল দীর্ঘ আর ৭ মাইল চওড়া এই দ্বীপ। দক্ষিন আমেরিকার সমুদ্রতট থেকে ২০০০ মাইল দূরে। চার্লস নর্ডহফ এবং জেমস নরম্যান হল রচিত বাউন্টি উপন্যাসত্রয়ীর সর্বশেষটি যে নামে পরিচিত সেই পিটকেয়ার্ন্স আইল্যান্ড, যেখানে এইচএমএস বাউন্টির বিদ্রোহীরা লুকিয়েছিলো ১৯ শতকে, সেই পিটকেয়ার্ন্স আইল্যান্ডই হলো ইস্টার দ্বীপের সবচেয়ে নিকটবর্তী পলিনেশিয়ান প্রতিবেশী। কিন্তু সেটাও ইস্টার দ্বীপ থেকে ১১০০ মাইল দূরে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুর নাগালের বাইরে একটু বেশী দক্ষিনে। প্রবাল প্রাচীর নেই। নিখুত দৃষ্টিনন্দন সৈকত নেই। বর্ষব্যাপী ঝড়ো বাতাস এবং প্রবল বর্ষনের অত্যাচারে জর্জরিত। তারপরও ইস্টার দ্বীপের রয়েছে এক ধরনের কাঠিন্যমন্ডিত সৌন্দর্য। আছে কৌণিক আকারের আগ্নেয়শিলা, ধীরলয়ে বহমান লাভা প্রবাহ, খাড়া পর্বত প্রাচীর এবং পাথুরে খাঁড়ি। আর সেই বিশালাকায় পাথর কুঁদে তৈরী জবরদস্ত মূর্তিগুলো এর প্রাকৃতিক ভূদৃশ্যের চেয়েও বেশী বৈচিত্রময়।

প্রথমদিককার অভিযাত্রীরা এই মূর্তিগুলো আবিস্কার করে হতবাক হয়ে যায়। এইসব বিশাল পাথুরে স্থাপনার দৃশ্য অবলোকন করা ছিলো তাদের কল্পনারও বাইরে। দ্বীপের জনসংখ্যা ছিলো খুবি অল্প। আদিম সমাজ, সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের পক্ষে এইরকম উচ্চমার্গের শৈল্পিক এবং প্রকৌশলগত দূরহ কীর্তি নির্মান করা সম্ভব নয়। ব্রিটিশ নাবিক ক্যাপ্টেন জেমস কুক ১৭৭৪ সালে লিখে গেছেন এদের সম্পর্কে - " চিন্তায় কুলাচ্ছিলো না যে এই দ্বীপবাসীরা, যাদের যান্ত্রিক শক্তি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, তারা কিভাবে এইসব বিস্ময়কর আকৃতিগুলো তৈরী করতে পারে।" কুক নিজে চিন্তা করে বের করার চেষ্টা করেন, তার ধারনায় মুর্তিগুলো এক্টু একটু করে দন্ডবত অবস্থায় নিয়ে আশা হয়েছিলো স্তুপকৃত পাথর আর মাচার সাহায্যে। এ রহস্য উদ্ঘাটনে পরবর্তী শত শত বছর ধরে অনুমান আর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের কোন অভাব ঘটেনি। কুকের সময়েই স্থানীয়রা অনেক মূর্তি উল্টে দিয়েছিল আর যেগুলো দন্ডবত ছিলো সেসবের ব্যাপারে তাদের কোন মাথাব্যথা ছিলো না। স্থানীয় আদিবাসীদের মধ্যে গল্প চালু আছে - দ্বীপের প্রথম রাজা হোটু মাটু'আ , প্রথম নিবাসীদের নিয়ে এসেছিলো ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়ার মারকুয়েসাস দ্বীপপুঞ্জের হিভা দ্বীপ থেকে। তাদের স্থানীয় ভাষায়, ইস্টার আইল্যান্ডকে ডাকা হয় রাপা নুই। আর সেই বিশালাকায় দানব মুর্তিদের কে বলা হয় মোয়াই। প্রায় ৯৫ শতাংশ মূর্তি রানো রারাকু নামক কোণিক আকৃতির আগ্নেয়শিলা দ্বারা গঠিত এলাকায় কোঁদা। মুর্তি কারিগররা, যারা বংশপরম্পরায় এই কাজ করে আসছে, টোকি নামক এক প্রকারের পাথরের হাতিয়ার দিয়ে এই মূর্তিগুলোকে প্রাথমিক অবয়ব দিত। তার পর অবসিডিয়ান পাথরের তৈরী হাতিয়ার ব্যবহৃত হত আরো সুক্ষ্ম কাজের জন্য। কিন্তু আসল রহস্য হলো কিভাবে এরকম ছোট জনবিচ্ছিন্ন এক নৃগোষ্ঠী এই সব দানবাকৃতির মূর্তিগুলো বিভিন্ন আচার-অনুষ্টানের জন্য নির্দিষ্ট জায়গাগুলোতে পরিবহন করে নিয়ে গেছে?

small
ছবিঃ স্মিথসোনিয়ান ন্যাচারাল হিস্টরি মিউজিয়ামে প্রদর্শিত একটি মোয়াই। ইস্টার দ্বীপের আহু ও-পেপে অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে আনা হয়েছে এটি।

প্রস্তরনির্মিত ভাস্কর্যশিল্প ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের প্রথাগত শিল্পচর্চার রেওয়াজ রয়েছে দ্বীপবাসীদের মধ্যে। কাঠ বা গাছের ছাল, সুতো আর পালক নির্মিত শিল্প। রয়েছে গান এবং নাচ-এর সংস্কৃতি। আর আছে রঙ্গোরঙ্গো নামের কালের আবর্তে হারিয়ে যাওয়া এক চিত্রনির্ভর লেখনপদ্ধতি - যা এখন পর্যন্ত কেউ পাঠোদ্ধার করতে পারেনি। প্রায় এক হাজার বছর ধরে বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন এক সমাজ গড়ে উঠেছে এখানে যেখানে আছে বংশপরম্পরায় গোত্রপ্রধান, ওঝা, বিশেষধরনের কারিগরী দক্ষতাসম্পন্ন বিভিন্ন গোষ্ঠী আর সংঘ। শিল্প এবং ইতিহাস দুইয়ে মিলে এই ইস্টার দ্বীপকে করেছে অদ্বিতীয় বৈশিষ্টমন্ডিত । কিন্তু সেই ইতিহাস পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে তৈরী হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন যুক্তি এবং ব্যাখ্যা। মিশনারী পাদ্রীদের উপাখ্যান, প্রত্নতত্ত্ববিদের বেলচা, এবং নৃতত্ত্ববিদের মৌখিক ইতিহাস আর বাক্স বাক্স হাড় এ-সবই দ্বীপের ইতিহাস সম্বন্ধে কিছু না কিছু আলোকপাত করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু সম্পূর্ন ইতিহাস আজো রয়ে গেছে অজ্ঞাত।

প্রথম অভিবাসীরা এই দ্বীপে কবে এসেছিলো ? কোথা থেকে এসেছিলো ? কেনইবা তারা এইসব বিশালাকার মূর্তি নির্মান করেছিলো ? কিভাবে সেগুলো স্থানান্তর করেছিলো আর পাটাতনের উপর খাড়া করে দাড় করালো ? আবার, শতাব্দী পরে কেনইবা সেগুলোকে উল্টে ফেলে দেওয়া হয়েছিলো ? এইসব প্রশ্নের উওর দেবার চেষ্টা করা হয়েছে বারবার, কিন্তু প্রতিবারই নতুন নতুন উত্তর নিয়ে হাজির হয়েছে বিশেষজ্ঞগণ। গত কয়েক দশক ধরে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ যে তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করেছেন তা থেকে বোঝা যায় যে প্রথম অভিবাসীরা এসেছিলো আরেক পলিনেশিয়ান দ্বীপ থেকে, কিন্তু তারা একমত হতে পারেননি কোনটি থেকে। আনুমানিক হিসেব অনুসারে প্রথম এবং ষষ্ঠ খৃষ্টাব্দের মধ্যবর্তী কোন একসময়ে মানুষ প্রথম এই দ্বীপে এসে পৌছেছিল । কিভাবে এই স্থান তারা খুজে পেল? তারা কি হিসেব করে বের করেছিলো না কি দৈবচক্রে সেখানে গিয়ে উপনিত হয়েছিল তা এখনো এক অমিমাংসিত প্রশ্ন। কেউ কেউ দাবী করেন প্রথম সহস্রাব্দের নাবিকদের পক্ষে এত বড় দূরত্বের সমুদ্রযাত্রার দিকনির্ণয় করা সম্ভব ছিলনা আধুনিক সুক্ষ্ম হিসেবের যন্ত্রপাতির সাহায্য ছাড়া। অন্যদের মতে আদি পলিনেশিয়ানরা ছিলো পৃথিবীর অন্যতম দক্ষ সমুদ্রযাত্রী - রাতের আকাশ এবং সমুদ্র স্রোতের ঠিকুজী ছিলো তাদের নখদর্পনে। এক প্রত্নজ্যোতির্বিজ্ঞানী ধারণা করেন একটা নতুন সুপারনোভা হয়ত তাদের পথনির্দেশনা দিয়েছীলো (স্টার অব বেথেলহেমের কথা বলা হচ্ছে খুব সম্ভবত)। কিন্তু অভিযাত্রীরা কি জানতো যে সমুদ্রযাত্রাপথ শেষে কোন তীরে তারা এসে আদৌ উপনিত হবে কিনা ? সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা কোন উত্তর দিতে পারেন না এখন পর্যন্ত।

****

কক্স মমির রহস্য

ওটমান সম্রাজ্যের সময়কার কথা। একবার মিশরে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন নিউ ইয়র্ক কংগ্রেসম্যান স্যামুয়েল কক্স। একদিন ওটমান সম্রাজ্যের মিশরীয় ভাইসরয় বা খেদিভ তাকে আমন্ত্রণ জানালেন স্থানীয় এক আচার অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। অনুষ্ঠান শেষে বিদায়ের প্রাক্কালে খেদিভ তাকে সম্মানসরূপ দিলেন অদ্ভুদ কিছু উপহার - প্রাচীন আমলের বিভিন্ন নিদর্শন - যার মধ্যে ছিল একটি মিশরীয় মমি। যাকে এখন কক্স মমি বলে অভিহিত করা হয়। বহু হাত ঘুরে আজকে সেই মমির ঠিকানা স্মিথসোনিয়ানের ন্যাচারাল হিস্টরী মিউজিয়াম। কক্স মমির স্মিথসোনিয়ান যাত্রা শুরু হয় লুক্সরে, নীল নদের পাড়ে ভ্যালি অফ কিংস থেকে। প্রতীকী দিক থেকে যদি বিচার করা হয় তাহলে এ এক প্রভাবশালী এবং গুরত্বপূর্ণ স্থান। বিভিন্ন ফারাওদের শেষ ঠিকানা, এমনকি তুতেনখামেন পর্যন্ত সমাধিস্থ ছিলেন এখানে। স্মিথসোনিয়ানের প্রত্নতাত্তিক মেলিন্ডা জেডার-এর মতে কক্স মমি এই জাদুঘরের সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত এবং অত্যন্ত সমৃদ্ধ ভাবে সজ্জিত এক নমুনা। তার মতে মমিটি রাজবংশীয় কোন ব্যক্তির নয়, তবে খুব সম্ভবত একজন ধনী ব্যক্তির।

দীর্ঘসময় ধরে সংরক্ষিত মমিগুলো হয় অত্যন্ত ভঙ্গুর। তাই এদের পরীক্ষণের সময় নিতে হয় বিশেষ সতর্কতা। তবে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি যেমন এক্স-রে এবং সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা কোন প্রকার স্পর্শ ছাড়াই এদেরকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষন করতে পারেন। স্মিথসোনিয়ানের বিজ্ঞানীদের মতে পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা এই ব্যাক্তি মাত্র ৪০ বছর বয়সে মারা যান আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে।

মমিকরন পদ্ধতি এক প্রাচীন মরদেহ শুষ্ককরন প্রক্রিয়া যা আধুনিক মরদেহ সংরক্ষন পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এককালে অনেক মানুষের জীবিকা নির্বাহ হতো এই কাজ করে। তবে খৃষ্টধর্মের আধিপত্যের সাথে সাথে এই পেশা বিলুপ্ত হয়ে যায়। মরদেহ অক্ষত রাখা কারন - মিশরীয়রা বিশ্বাস করত পরকালে এই দেহকেই আবার পুনরুজ্জীবিত করা হবে। এই মমিকরন প্রক্রিয়া ছিলো দীর্ঘ এবং জটিল ও সুক্ষ্ম সব রীতিনীতিতে পরিপূর্ণ। মরদেহ শুষ্ককরণ পদ্ধতি - যার কারণে পচনরোধ করা সম্ভব হত - তার মূল উপকরণ ছিলো নেইত্রন নামক চার প্রকার লবনের মিশ্রন, যা নীলনদের তীরে প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায় । এছাড়াও মমিপ্রস্তুতকারকগণ সুগন্ধী হিসেবে ব্যবহার করতেন তালের রস থেকে প্রস্তুতকৃত একধরণের মদ এবং ধুনো।

কোন কোন মিশরীয় প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ অনুমান করেন - যদিও লুক্সরে কক্স মমি উপহার হিসেবে প্রদান করা হয়েছিলো, তার মানে এই নয় সেটি সেখানেই খুঁজে পাওয়া গেছে। যে সামান্য তথ্য উপাত্ত উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়েছে তা থেকে কক্স মমির উৎস বের করা কোনদিন সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্টই সন্দেহ রয়েছে। তবে মমিকরণ প্রথা পর্যবেক্ষন করে শুধু এটুকু বলা যায় যে তাকে মমি করা হয়েছিলো মোটামুটি খৃষ্টপূর্ব ১০০ থেকে ২০০ খৃষ্টাব্দের মাঝামাঝি কোন সময়ে।


ভিডিও-১ঃ ন্যাচারাল হিস্টরী মিউজিয়ামে সংরক্ষিত কক্স মমি ।


ভিডিও-২: কক্স মমির সারকোফ্যাগাস - মমির কফিন।

****

নেপচুন এবং হিপোক্যাম্প

নেপচুন গ্রীক দেবতা পোসাইডনের রোমান অনুরূপ। নেপচুনের ভাই হচ্ছে জুপিটার এবং প্লুটো। তিনভাই মিলে শাসন করত স্বর্গ, মর্ত্য এবং পাতাল রাজ্য। পোসাডন (অনূরূপে নেপচুন) -এর ত্রিশুল হচ্ছে তাদের চিরাচরিত স্বর্গীয় বৈশিষ্ট। বহু প্রাচীন চিত্রকলায় চিত্রিত করা হয়েছে এই অস্ত্রকে। হেসিওড-এর বর্ণনা অনুসারে - পোসাইডনের ত্রিশুল তৈরী করেছিলো তিন একচক্ষু সাইক্লপ্স দানব। কারো কারো মতে পোসাইডনের ত্রিশুল আর জিউসের বজ্রশূল একসাথে হয়ে ছিলো এক পবিত্র দু-মাথাওয়ালা কুঠারে, পরে যখন পোসাইডন সমুদ্রদেবতা হলো তখন তাদের আলাদা করে ফেলা হয়। জিউস নিয়ে নেয় বজ্রশূল। পোসাইডন তার ত্রিশুল । ঐতিহাসিকদের মতে, এই ত্রিশুল আসলে মাছ ধরার বর্শা। গ্রীক উপকূলে বসবাসকারী জনপদের সচরাচর ব্যবহৃত অস্ত্র। ভূমধ্যসাগরের জেলেরা এক ধরনের তীরেরফলা বিশিষ্ট কাটাচামচের ন্যায় বর্শা ব্যবহার করত ইল শিকারের জন্য , তার সাথেও সাদৃশ্য পাওয়া যায়। উপকূলীয় দেশগুলোতে বিশেষকরে পোসাইডনের উপাসনা করা হত যেখানে মুল উপজীবিকা ছিলো মৎসভিত্তিক। কোন কোন ঐতিহাসিক এও দাবী করেন যে, পোসাইডনের ত্রিশুল আসলে জিউসের পদ্মমস্তক রাজদন্ড থেকে রূপান্তরিত। পোসাইডন আসলে জিউসেরই সামুদ্রিক অবয়ব। হিপোক্যাম্প-এর কথা রোমান এবং গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীতে পাওয়া যায়। সাধারণত উপরের অংশ ঘোড়ার মত এবং শরীরের নিম্নভাগ মৎসের মত করে এদের চিত্রিত করা হত। ইলিয়াডে হোমার পোসাইডনকে বর্ণনা করেছেন সমুদ্রের স্রোতের উপর ভেসে তার রথ চালিয়ে নিয়ে যাওয়া অবস্থায়, রথ টেনে নিয়ে যাচ্ছে পেতলের খুরবিশিষ্ট হিপোক্যাম্পরা।

প্রসংগক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে হাবল টেলিস্কোপের সাহায্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নেপচুন গ্রহের পাশে অতি ছোট্ট একটি উপগ্রহ আবিস্কার করেন। লম্বায় মাত্র ২০ মাইলের মত। খুব সম্ভবত প্রোটিয়াসের সাথে ধুমকেতুর সংঘর্ষে উৎপন্ন কোটি কোটি বছর আগে। আবিস্কৃত নেপচুনের এই উপগ্রহের নাম দেন হিপোক্যাম্প।


ভিডিওঃ রোমানদের সমুদ্র এবং স্বাদুজলের দেবতা নেপচুন তার ত্রিশুল বাগিয়ে। সাথে একটা হিপোক্যাম্প, অর্ধেক-অশ্ব-অর্ধেক-মৎসরূপী এক পৌরাণিক প্রাণী। ভাস্কর মিচেল এনগুয়ের। নির্মানকাল ১৬৫২।

***

-=ঃপ্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুনঃ=-


মন্তব্য

গগন শিরীষ এর ছবি

একসাথে এত কিছু দেখে ফেললেন, আপনাকে আমার রীতিমত হিংসে হচ্ছে

অবনীল এর ছবি

হাহাহা। এই মিউজিয়ামগুলো কিন্তু কাছাকাছি অবস্থিত ওয়াশিংটন ডিসির মনুমেন্ট মলের আশে পাশে। একদিন গিয়ে মোটামোটি সবগুলোতেই চোখ বুলিয়ে নেয়া যায়। সুযোগ পেলে ঘুরে আসুন। ধন্যবাদ।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

গগন শিরীষ এর ছবি

আমি থাকি প্রাচ্যের 'লস এঞ্জেলস ' ঢাকা শহরে। কোনদিন আমেরিকা গেলে ঘুরে আসব ইনশাল্লাহ।

অবনীল এর ছবি

হাহা অবশ্যই। প্রাচ্যের লস এঞ্জেলস থেকে প্রাতীচ্যের লস এঞ্জেলসে আপনার আশু আগমন হোক এই কামনা রইলো।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

তারেক অণু এর ছবি

দারুণ , আরো লিখে যা!

ইউজিন সারনান রকেটে ফেরার আগে উনার মেয়ের নাম লিখে এসেছিলেন চাঁদের ধুলোয়, যতদূর মনে পড়ে।

ইস্টার আইল্যান্ডে যে কবে যাবো! সেদিন পরিমল ভট্টাচার্যের বইতে ইস্টার আইল্যান্ডে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, য আকিনা অবশ্যই মানুষেরই তৈরি, নিয়ে ভালো লেখা পড়লাম, মূলত ডায়মন্ড ওস্তাদের লেখা 'কলাপ্স' বইটা থেকে নেওয়া।

অবনীল এর ছবি

ধন্যবাদ দোস্ত। ওহ উচ্চারণটা সারনান হবে ঠিকই ধরেছিস। পরে ঠিক করে নেব। হ্যাঁ তার মেয়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন চাঁদে তার নামের অদ্যক্ষর লিখে দেবেন । অপূর্ব । চল ইস্টার আইল্যান্ডের ট্রিপ প্ল্যান করে ফেলি, পরিবেশ বিপর্যয় দ্বীপটাকে পুরোপুরি শেষ করে দেবার আগেই । জ্যারেড ডায়মন্ডের কলাপ্স পড়া হয়নি এখনও। পড়তে হবে। আপাতত জোনাথান হেইড-এ মজে আছি।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

কর্ণজয় এর ছবি

কিছু লেখা থাকে- জানার, দেখার।।। কিছু বলতে হয় না।

অবনীল এর ছবি

চলুক আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

কীর্তিনাশা এর ছবি

অনেক কিছু জানা হলো। ধন্যবাদ।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

অবনীল এর ছবি

আমি নিজেও দেখতে দেখতে শিখেছি। ভালো লাগে নতুন কিছু জানতে, পুরোনো পৃথিবীর ফেলে যাওয়া চিহ্নের সাথে পরিচিত হতে। ধন্যবাদ।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

সৌখিন  এর ছবি

এক কথায় অসাধারণ

অবনীল এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।