ধাওয়া (পর্বঃ ১)

অবনীল এর ছবি
লিখেছেন অবনীল (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৪/১২/২০২০ - ৩:১৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।

নিকষ কালো আকাশের বুক চিরে ধমনীর মত আলো ঝলকে উঠলো। ঝলকের মাঝে দেখে মনে হবে, কোটি কোটি শীতল, পড়ন্ত বৃষ্টি ফোটা হঠাৎ যেন মাঝপথে থমকে গেছে। পানিজমে থাকা রাস্তায় প্রতিফলিত হলো সেই স্বর্গীয় অগ্নিঝলক। যেন ভাঙা কাচের টুকরো দিয়ে সাজানো ঢালাই করা রাস্তাটা। তারপর আবার নিকষ আঁধারে ফিরে গেলো বজ্রাহত আকাশ। আর ফের শুরু হলো যেন অব্যহত বৃষ্টির ধারা। ফুটপাথটা অন্ধকার। নিকষ কালো রাতের পেশী যেন চারিদিক থেকে চেপে ধরতে চাইছে। দাতে দাত চেপে, ডানপাশের ব্যাথাটা অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করলো গোয়েন্দা ফ্র্যাঙ্ক শ' । অন্ধকারের মধ্যে তার চোখদুটো কুচকে রয়েছে। দু-হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে স্মিথ এন্ড ওয়েসন পয়েন্ট আটত্রিশ চিফ'স স্পেশাল। একজন শুটারের ভংগিতে দাড়িয়ে দুই রাউন্ড গুলি করলো সে। ফ্র্যাঙ্কের কিছু সামনে, দ্রুত দৌড়ে কাছের একটা গুদামঘরের কোনায় আশ্রয় নিয়ে কোনমতে নিজেকে বাচালো কার্ল স্ক্যাগ। প্রথম গুলিটা শীষ কেটে চলে গেলো পেছন দিয়ে, আর দ্বিতীয়টা গুদামঘরের দেয়ালের কোনায় লেগে চলটা উঠিয়ে ফেললো। গুদামঘরের ধাতব চালায় আর ফুটপাথে আছড়ে পড়া অবারিত বৃষ্টির গর্জন, আর এর সাথে বিদ্যুতচমকের শব্দ, দুয়ে মিলিয়ে গুলির শব্দকে প্রায় ঢেকে দিলো। ব্যক্তিগত প্রহরীররা যদিও কাছেপিঠে থেকে থাকে , তারা মনে হয় কোন কিছু শুনতে পায়নি। তাই ফ্র্যাঙ্ক-এর সাহায্য পাবার আশা সুদূর পরাহত। সাহায্য পেলে ও অবশ্য স্বাগতই জানাতো, স্ক্যাগ বিশালদেহী, শক্তিশালী এক সিরিয়াল খুনি । এ পর্যন্ত কমপক্ষে বাইশটা খুন করেছে সে। সবচেয়ে ভালো দিনেও লোকটা ভয়ঙ্কর-রকম বিপদজনক, আর এই মূহুর্তে সে একটা ঘুর্ণায়মান কাঠচেরা করাতের মতোই ভয়াবহ। একা একজন পুলিশের কাজ যে এটা না - সেটা নিশ্চিত। ফ্র্যাঙ্ক ভেবে দেখলো গাড়িতে ফিরে ব্যাকাপের জন্য কল করবে কিনা । কিন্তু সে ভালো করেই জানে এলাকাটা পুলিশ দিয়ে ঘেরাও করে ফেলার আগেই স্ক্যাগ ফাক গলে পালাবে। কোন দায়িত্ববোধসম্পন্ন পুলিশের পক্ষেই নিজের ভালো চিন্তা করে আসামীর পিছু ধাওয়া ছেড়ে দেওয়া সম্ভবপর নয় - বিশেষ করে ফ্র্যাঙ্ক শ' এর পক্ষে ত নয়-ই। বিশালাকার দুই গুদামঘরের মাঝখানের পানি জমে থাকা সার্ভিসওয়ের ওপর দিয়ে ছপ ছপ শব্দ করতে করতে এগোলো ফ্র্যাঙ্ক । একটু দূরত্ব বজায় রেখে কোনটা ঘুরলো ফ্র্যাঙ্ক, যদি স্ক্যাগ ঠিক বাঁকের শুরুতে তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। কিন্তু স্ক্যাগ-এর দেখা নেই। গুদামঘরের সামনের দিকটা যেরকম , যেখানে ঢালু কংক্রিটের লোডিং র‍্যাম্প সোজা চলে গেছে গুদামঘরের বিশাল রোল-আপ গ্যারাজের দরজা পর্যন্ত, সেরকম না এদিকটা। অনেকটাই ফাঁকা । দুইশ ফিট দুরে, কাটাতারের নিরাপত্তা খাচায় লাগানো একটা অনুজ্জ্বল বালবের নিচে, এক মানুষ সমান উচু এক ধাতব দরজা। আধখোলা। ধীরে ধীরে কপাট ফিরে যাচ্ছে আগের জায়গায়। চোখমুখ কুঁচকে পাশের ব্যাথাটা সামাল দিতে দিতে, ফ্র্যাঙ্ক দ্রুত প্রবেশদ্বারের দিকে এগোলো। আশ্চর্য হয়ে দেখলো দরজার হ্যান্ডেল ছিড়ে আলাদা করে ফেলা হয়েছে। আর তালাটা বিচূর্ন। যেন স্ক্যাগ কোন ক্রোবার অথবা স্লেজহ্যামার ব্যবহার করেছে। গুদামঘরের দেয়ালের আশেপাশে কি সেরকম কিছু পড়ে ছিলো ? সেটাই কি সে ব্যবহার করেছে দরজা ভেঙ্গে ঢোকার জন্য ? মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখের আড়াল হয়েছে লোকটা, আধা মিনিট হবে বড় জোর, স্টিলের দরজা ভাঙ্গার জন্য যথেষ্ট সময় নয় সেটা। বার্গ্লার এলার্ম বাজলো না কেন ? গুদামঘর নিশ্চই নিরাপত্তা সিস্টেম দিয়ে সুরক্ষিত। আর স্ক্যাগ যে চতুরতার সাথে আলার্ম এড়িয়ে ঢোকেনি সেটা তো দেখে বোঝাই যাচ্ছে। ভিজে চুপচুপে অবস্থায় দরজার পাশের ঠান্ডা দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠলো ফ্র্যাঙ্ক। দাঁতে দাঁত চেপে মনের জোর দিয়ে কাপুনি থামালো সে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো। শুধু ধাতব ছাদে আর দেওয়ালে বৃষ্টি পড়ার ফাকা শব্দ শুনলো ও। আর ভেজা শান বাধানো রাস্তায় বৃষ্টির ছাঁটের নাচ, নর্দমায় আর ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামা কুলকুল করে পানি প্রবাহের মৃদু শব্দ, বাতাসের মৃদুমন্দ থেকে ঝাপটা দিয়ে ওঠার শব্দ। রিভলবার নল ভাজ করে সিলিন্ডারটা বের করে আনলো ফ্র্যাঙ্ক। অব্যবহৃত কার্ট্রিজদুটো ঝাকিয়ে হাতের উপর ফেললো। সেগুলো পকেটে চালান করে একটা স্পিডলোডার ভরলো। খেলার জন্য তৈরী সে, হাতের অস্ত্র গুলিতে পরিপূর্ন। দপদপ করে উঠলো ডানপাশটা। মিনিট কয়েক আগে স্ক্যাগের আচমকা আক্রমনের স্বীকার হয় সে। কন্সট্রাকশান সাইট থেকে তুলে নাওয়া একটা ইস্পাতের রড নিয়ে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে স্ক্যাগ। সাকিব যেভাবে ব্যাট ঘুরিয়ে ছক্কা পিটায় সেভাবে সেটা দিয়ে তার উপর আঘাত করে সে। ফ্র্যাঙ্কের মনে হচ্ছে যেন টুকরো টুকরো কাচ যেন তার পেশী আর হাড়ের সাথে ঘষা খাচ্ছে। প্রতি নিশ্বাসের সাথে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে যেন যন্ত্রনাটা। মনে হয় একটা কি দুটো পাঁজরের হাড় ভেঙেছে, সম্ভবত না...তবে হতে পারে। ভিজে জবজবে, ঠান্ডায় জমাট, আর ক্লান্ত সে। তবে সেইসংগে বেশ একটা মজাও পাচ্ছিলো ।

২।

অন্য হত্যাকান্ড বিষয়ক গোয়ান্দাদের কাছে ফ্র্যাঙ্ক 'কঠিন চীজ' শ' নামে পরিচিত। পচিশ বছর আগে যখন মিলিটারীর ট্রেইনিং নিচ্ছিল তখনো তার বন্ধুরা তাকে এই নামে ডাকত। কারন তার নিরাবেগ মনোভাব, দৃঢ়চেতা আচরন আর সহজে ভেঙ্গে না পড়ার মানসিকতা। মিলিটারী থেকে অবসর নিয়ে যখন এলএপিডি-তে যোগ দেয় - সেই ডাকনাম-ও এখানে চাউর হয়ে যায়। নিজে অবশ্য এই ডাকনাম ব্যবহার করতে উৎসাহ দেয়নি, কিন্তু তারা এমনিতেই ব্যবহার করা শুরু করে দেয়। কারন নামটা একেইবারেই যথার্থ। পাথরের মত শরীর ফ্র্যাঙ্ক-এর, সেই সাথে দীর্ঘদেহী, চওড়া কাঁধ, সরু কোমড় আর নিতম্ব । বিশাল হাত, যা মুঠো অবস্থায় দেখেই যেকোন প্রতিপক্ষের মনে সমীহের উদ্রেক হবে। সাথে সাথে সহযোগীতা করতে রাজী হয়ে যাবে, ব্যবহারের প্রয়োজন পড়বে না। চেহারা যেন গ্র্যানাইট-কুদে, অনেক ছেনি-হাতুড়ীর আত্মদানের বিনিময়ে, কষ্টসৃষ্টে তৈরী করা। এলএপিডির হোমিসাইড বিভাগের সহকর্মীদের মতে ফ্র্যাঙ্ক শুধু দুই ধরনের অভিব্যক্তি করতে জানেঃ জঘন্য এবং জঘন্যতর। তার বৃষ্টির পানির মত স্বচ্ছ, ফ্যাকাশে নীল চোখ পৃথিবীটাকে বরফশীতল সন্দেহের সাথে নিরীক্ষণ করে। যখন সে চিন্তা করে, সেসময় প্রায়ই দীর্ঘ সময় ধরে সম্পুর্ন নিশ্চলভাবে দাড়িয়ে বা বসে থাকে, শুধু তার নীল চোখদুটোর ক্ষীপ্র আর সতর্ক বিচরন নিশ্চল শরীরের সাথে একধরনের বৈপরিত্যের সৃষ্টি করে। দেখে মনে হয় যেন একটা খোলসের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে। তার বন্ধুদের দাবী সেই খোলস সাংঘাতিক শক্ত। কিন্তু এ শুধু তার সম্বন্ধে বলা কাহিনীর অর্ধেকমাত্র।

রিভলবারটা রীলোড করে গুদামঘরের ভাঙা দরজার সামনে এসে দাড়ালো ফ্র্যাঙ্ক। লাথি মেরে দরজটা খুললো। মাথা নিচু করে গুড়ি মেরে পয়েন্ট আটত্রিশ সামনে বাগিয়ে ধরে দ্রুত ঢুকে পড়লো, ডানে বামে চোখ রেখে। আশা করছে স্ক্যাগ আচমকা ক্রোবার, হাতুড়ী বা বিল্ডিং এর ভেতরে ঢোকার জন্য হারামজাদা যে জিনিসটা ব্যবহার করেছে সেটা দিয়ে আক্রমন করবে। ফ্র্যাঙ্কের বামপাশে বিশ ফিট উচু ধাতব শেলফ, হাজার হাজার ছোট ছোট বাক্সে তাকগুলো ভর্তি। ডানপাশে বড় সাইজের কাঠের বাক্স সারিবদ্ধভাবে একটার উপর একটা সাজিয়ে রাখা, সোজা উঠে গেছে ত্রিশ ফিট পর্যন্ত, আর বিল্ডিং অর্ধেক অংশ পর্যন্ত দখল করে আছে, দুই সারির মাঝে ফর্কলিফট চলাচলের জন্য গলির মতো ফাকা জায়গা করা আছে । গুদাম ঘরের পঞ্চাশ ফিট উচু ছাদ থেকে নেমে আশা ফ্লুরোসেন্টের লম্বা ঝুলন্ত বাতিগুলো এই মুহুর্তে নিভানো। শুধু কয়েকটা কোন-আকৃতির টিনশেডে ঢাকা নিরাপত্তা ল্যাম্প-এর নিস্তেজ আলোর আভা ছড়িয়ে আছে নিচের সংরক্ষিত জিনিসপত্রের উপর, বাকী বেশীরভাগ জায়গা অন্ধকারের চাদরে আচ্ছাদিত। সতর্কতার সাথে কোনরকম আওয়াজ না করে এগোতে লাগলো ফ্র্যাঙ্ক। ভিজে ভারী হয়ে যাওয়া জুতোগুলো প্যাচপ্যাচ শব্দ করছে , কিন্তু ছাদের বৃষ্টিপাতের তোড়ের শব্দে তা প্রায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। পানি ঝরে পড়ছে তার ভুরু, চোয়াল আর তার বন্দুকের ব্যারেল বেয়ে, এক সারি বাক্স থেকে আরেক সারিতে ক্ষীপ্রতার সাথে এগিয়ে যেতে লাগলো সে, প্রতিটা গলিতে উকি দিয়ে দেখছে।

স্ক্যাগ ছিলো তৃতীয় সারির দূরের প্রান্তে, প্রায় একশ পঞ্চাশ ফিট দুরে, অর্ধেক ছায়া, অর্ধেক দুধ-সাদা আলোতে, অপেক্ষা করে দেখছিলো ফ্র্যাঙ্ক তার পিছু নিয়েছে কিনা। সে নিজেকে পুরোপুরি আলো থেকে দূরে রাখতে পারতো, গুড়ি মেরে বাক্সগুলোর আড়ালে লুকিয়ে ফেলতে পারতো নিজেকে। দৃষ্টিসীমার নাগালে দাড়িয়ে মনে হচ্ছে সে ফ্র্যাঙ্ককে কটাক্ষ করতে চাইছে। ইতঃস্তত করলো স্ক্যাগ, যেন নিশ্চিত হতে চাইছে ফ্র্যাঙ্ক তাকে দেখতে পেয়েছে কিনা, তারপর কোনায় অদৃশ্য হয়ে গেলো। নিঃশব্দে কার্টন আর বাক্সের গোলকধাধার ভিতরে ঘুরে ঘুরে পাক্কা পাচ মিনিট ধরে তাদের লুকোচুরি খেলা চললো। তিনবার স্ক্যাগ নিজেকে দেখতে দিলো, যদিও ফ্র্যাঙ্ককে কাছিয়ে আসার কোন সুযোগ দিলো না। সে-ও মজা পাচ্ছে, ফ্র্যাঙ্ক ভাবলো। ভাবনাটা তাকে ক্ষেপিয়ে তুললো। দেওয়ালের একেবারে উঁচুতে যেখানে মাকড়শার জালে ছেয়ে থাকা দেয়াল ছাদে গিয়ে ঠেকেছে, সেখানে খুপরীর মতো সরু জানালা রয়েছে, এই গুহার মত দালানকে দিনের বেলা আলোকিত করে তোলে তারা। এখন, শুধু বিদ্যুৎচমকের আলোতেই শুধুমাত্র তাদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। থেকে থেকে বিদ্যুতচমক যদিও গুদামঘরটাকে আলোকজ্জ্বল করার জন্য যথেষ্ট নয়, তবু মাঝে মাঝে অস্বস্তিকর সব ছায়ার খেলা তৈরী করছিলো। দুইবার ফ্র্যাঙ্ক প্রায় গুলি করেই বসেছিল সেইসব নিরীহ অশরীরীগুলোকে। দুধারের অন্ধকার খুটিয়ে দেখতে দেখতে আরেকটা চলাচলের রাস্তা নিঃশব্দে পার হবার সময়, ফ্র্যাঙ্ক একটা শব্দ শুনলো। তীক্ষ্ণ ঘর্ষনের শব্দ। চট করে বুঝে ফেললো সে কিসের শব্দ সেটা - একটা বাক্স আরেক্টার উপর ঘষটে যাচ্ছে। উপরের দিকে তাকালো সে। বেশ উচুতে আবছা অন্ধকারে একটা সোফা-সাইজের বাক্স কালো অবছায়া হিসেবে দেখতে পেলো, ঠিক নিচের বাক্সের একেবারে ধারে এসে পৌছেছে বাক্সটা। তারপর টাল হারিয়ে সোজা নিচে দাড়িয়ে থাকা ফ্র্যাঙ্কের দিকে পড়তে থাকলো। জান বাঁচানোর সময় এখন। সামনের দিকে ঝাপ দিলো ফ্র্যাঙ্ক, মেঝেতে পড়ে সামনের দিকে গড়িয়ে এগোনোর সাথে সাথে বাক্সটা কংক্রিটের মেঝেতে আছড়ে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো, কয়েক মুহুর্ত আগে যেখানে দাড়িয়ে ছিলো ও। বিস্ফোরিত কাঠের টুকরো থেকে মুখ ফিরিয়ে চেহারা বাচানোর চেষ্টা করলো সে। বাক্সটা প্লাম্বিং -এর জিনিসপত্র দিয়ে ভর্তি ছিল - রূপার মত চকচকে, ক্রোমপ্লেটেড পানির কল আর শাওয়ারহেড ছিটকে পড়লো মেঝের উপর, এর মধ্যে কয়েকটা এসে লাগলো ফ্র্যাঙ্কের পিঠ আর উরুতে। ব্যাথার চোটে চোখ পানিতে ভরে উঠলো ওর, ডানদিকের ব্যাথাটা আরো তীব্র হয়ে জেগে উঠলো। এইসব ছুটোছুটির জন্য, বিক্ষত পাঁজরটা মনে হচ্ছে যেন শুধু ভেঙ্গেই যায়নি, একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। উপর থেকে স্ক্যাগ একটা রাগী চিৎকার দিয়ে ঊঠলো, যা কিছুটা শিকারের উত্তেজনায় উচ্ছাসিত জান্তব উদযাপন, আর কিছুটা মনোবিকারগ্রস্থ হাসি। কোন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে ফ্রাঙ্ক হঠাৎ করেই বুঝতে পারলো, এক রক্তলোলুপ অস্তিত্বের। ডানদিকে গড়িয়ে, যে বাক্সের সারির দেওয়ালের উপর স্কাগ দাঁড়িয়ে আছে তার সাথে পিঠ ঠেকালো। ঠিক পিছনে, আরেকটা বিরাট-সাইজের বাক্স গুদামঘরের মেঝেতে আছড়ে পড়লো। "বাঁইচা আসোস?" স্ক্যাগ হাঁক দিলো। ফ্র্যাঙ্ক উত্তর দিলো না। "তুই নিচেই আসোস। কারন তোর চিক্কুর তো শুনলাম না। চটপটে একটা হারামী তুই, তাই না?" আবার হেসে উঠলো স্ক্যাগ। যেন বেসুরো এক বাঁশীতে বাজানো বেসুরো কোন গান - ঠান্ডা, ধাতব শব্দ। অমানুষিক। শিউরে উঠলো ফ্র্যাঙ্ক। চমক হচ্ছে ফ্র্যাঙ্কের প্রিয় কৌশল। যেকোন পিছু ধাওয়ার সময়, সে চেষ্টা করে এমন কিছু করতে যা তার শিকার একদমই আশা করবে না। ঢেউ-খেলানো ইস্পাতের ছাদে বৃষ্টির তোড়ে সব শব্দ চাপা পড়ে যাবার সুযোগটা নিতে চাইলো ও, অন্ধকার বাক্সের দেওয়ালের পাশে উঠে দাড়ালো, রিভলবারটা হোলস্টারে ভরে ঘনঘন চোখের পাপড়ি ফেলে চোখের পানি দূর করলো। বাক্স বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলো তারপর। "ইদুরের মত আন্ধারে লুকিয়া থাকিস না ব্যাটা।" স্ক্যাক চিৎকার করলো। "সাহস থাকলে বের হয়ে এসে একটা গুলি কর আমাকে। তোর ত বন্দুক আছে। আমার নেই। তোর হাতের বন্দুকের জন্য আমার হাতে ছুড়ে মারার মত যা কিছু আছে। এর থেকে ভালো অবস্থা তোর জন্য কি হতে পারে মুরগীর বাচ্চা পুলিশ ? " ত্রিশ ফিট উচু কাঠের বাক্সের দেওয়ালের বিশ ফিট-এর কাছাকাছি উঠে কিছুক্ষনের জন্য থামলো ফ্রাঙ্ক। ওর ঠান্ডা আঙ্গুলগুলো কোনমতে সামান্য কিনার আঁকড়ে আছে, আর জুতোর মাথা এক চিলতে থাকে সজোরে চেপে রয়েছে। ডানপাশের ব্যাথাটা দড়ির ফাসের মত চেপে ধরেছে, ব্যাথা আর বাড়লে প্রায় দুতলা সমান উচু এই উচ্চতা থেকে খসে পড়ার অবস্থা হবে। বিপদজনক অবস্থানটায় ঝুলে থেকে চোখদুটো শক্তকরে বন্ধ করলো ও, ইচ্ছাশক্তি দিয়ে ব্যাথাটাকে দুর করার চেষ্টা করলো।

"ঐ, হারামখোর।" স্ক্যাগ চেঁচালো।
কি রে ?
"আমাকে চিনসস তুই ? "
পাগল পাড়ার জাম্বু না তুই ?
"খবরের কাগজগুলো আমার নাম দিয়েছে নিশিরাতের কসাই।"
হ্যা, জানি জানি, প্রলাপ বকা বানচোত।
"এই পুরো শহর আমার ভয়ে রাতে জেগে থাকে। ভাবে কোথায় আমি।" চেঁচিয়ে উঠলো স্ক্যাগ ।
আরে পুরো শহর না রে । আমার ঘুমের কোন সমস্যা হয়নি অন্তত।

আস্তে আস্তে উষ্ণ, পাজর পিষে ফেলা ব্যাথাটা দূর হলো। একেবারে হারালো না অবশ্য, কিন্তু এখন একটা ভোতা ধড়ফড়ানির মত সেটা। মিলিটারী আর পুলিশ ফোর্সে তার বন্ধুদের মাঝে ফ্র্যাঙ্কের খ্যাতি আছে এমন সব ক্ষত সহ্য করে এগিয়ে যাবার , জয় অর্জন করার, যা অন্য যে কাউকে সাথে সাথে অক্ষম করে ফেলতে পারত। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ভিয়েতকং মেশিনগানের দুটো গুলি আঘাত করে তাকে, একটা বাম কাঁধে আর অন্যটা বাম কিডনির ঠিক উপরে। গুলি খাবার পরো সে এগিয়ে গিয়ে গ্রেনেড দিয়ে গানার-কে উড়িয়ে দেয়। আঝোরে রক্তপাত হওয়া সত্ত্বেও, নিজের ভালো হাতটা ব্যবহার করে তার বাজেরকম আহত সহযোদ্ধাকে তিনশ গজ দূরের লুকোন আস্তানায় টেনে টেনে নিয়ে আসে সে। যেখানে তারা শত্রু স্নাইপারদের থেকে নিরাপদ যতক্ষন না হতাহতবাহী হেলিকপটার তাদেরকে খুজে বের করতে পারে। মিলিটারী ডাক্তার যখন তাদেরকে হেলিকপ্টারে তুলছিলো, তখন সে বলে উঠেছিলো, "যুদ্ধ মানে নরক গুলজার, কিন্তু একইসাথে উদ্দিপনাদায়কও বটে সেটা নিশ্চিত।" তার বন্ধুরা বলত সে লোহার মত কঠিন, পেরেকের মত শক্ত। কিন্তু এ শুধু তার সম্বন্ধে বলা কাহিনীর কিছু অংশমাত্র।

উপরে, স্ক্যাগ বাক্সগুলোর উপর দিয়ে দ্রুত হেটে চলেছে। এত কাছাকাছি যে বৃষ্টির তোড় ছাপিয়েও সে তার ভারী পদশব্দ শুনতে পেল। যদি কিছু না-ও শুনতে পেত, তারপরো সে জানত স্ক্যাগ এক জায়গায় বসে নেই। দুই-বাক্স সমান প্রস্থের দেওয়াল কাঁপতে লাগলো খুনিটার প্রস্থানের সময়, তবে ঝাকুনি এত বেশী নয় যে ফ্র্যাঙ্ককে তার বেকায়দা জায়গা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারে। বাক্স বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো আবার সে। সাবধানে হাত রাখার মত জায়গা অন্ধকারের মধ্যে অনুভব করে করে, ইঞ্চি ইঞ্চি করে উঠতে লাগ্লো প্লাম্বিং এর জিনিস্পত্রের ডাঁই বেয়ে। কয়েকটা কাঠের চুচি ঢুকে গেল তার আংগুলে মধ্যে উঠতে উঠতে। তবে ওসব ছোটখাট চোখা আঘাত পাত্তা না দেবার মতো । ওদিকে দেওয়ালের উপরে তার নতুন অবস্থানে এসে গুদামঘরের আরেকটা ছায়াবৃত অংশের দিকে ফিরে, যেখানে ফ্র্যাঙ্ক সরে গেছে মনে করে, হাঁক দিলো স্ক্যাগ।

"কিরে মুরগীর বাচ্চা!"
ডাকছ নাকি বাছা ?
"তোর জন্য একটা জিনিস আছে আমার কাছে, মুরগীর বাচ্চা।"
আমরা কি উপহার আদানপ্রদান করছি নাকি ? জানতাম নাতো !
"ধারালো একটা জিনিস।"
আহা তাই? টিভিসেট হলে ভালো হতো।
"অন্যদের উপর যে জিনিসটা ব্যবহার করেছি ঠিক সেই জিনিস তোর জন্য রেখে দিয়েছি।"
আচ্ছা, টিভি বাদ দাও। এক বোতল সুগন্ধি হলেও বেশ হয়।
"আয়, তোর ভুড়ি কিভাবে গালাই দেখে যা মুরগীর বাচ্চা। "
আসছি বাছা। আসছি।

বাক্সের দেওয়ালের উপরের প্রান্তে পৌছুল ফ্র্যাঙ্ক। দেয়ালের প্রান্ত থেকে মাথা উচু করে ডানে বামে তাকালো ও। প্রায় ত্রিশ ফিট দুরে স্ক্যাগ দাড়িয়ে। খুনিটা ফ্র্যাঙ্কের দিকে পিছন ফিরে আছে আর নিচের আরেকটা চলাচলের রাস্তার দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে।

"ঐ পুলিশের বাচ্চা, আমার দিকে তাকা, এই যে ঠিক এখানে আলোতে দাড়িয়ে আমি। কোন সমস্যা ছাড়াই গুলি করতে পারিস তুই। শুধু অন্ধকার থেকে বের হয়ে সে আমার দিকে বন্দুক তাক করতে হবে তোকে। সমস্যা কিসের ? এটুকু সাহস করার মত বিচি নাই তোর, হারামীর বাচ্চা? " আরেকটা বজ্রপাতের জন্য অপেক্ষা করছিলো ফ্র্যাঙ্ক। হবার সাথে সাথে, কিনার থেকে নিজেকে বাক্সের স্তুপের উপরে নিয়ে আসলো সে, তারপর হাটুগেড়ে বসলো। বৃষ্টির তোড়ের শব্দ এখানে আরো বেশী, বজ্রপাতের সাথে মিলে সেটা তার করা যেকোন শব্দকে ছাপিয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট।

"এই যে নিচে লুকিয়ে পুলিশের বাচ্চা ! তুই জানোস আমি কে?"
তুমি একই কথা আবার বলছ। বিরক্তিকর...একঘেয়ে।
"আমি হচ্ছি আসল পুরস্কার। সেইরকম পুরস্কার যা পুলিশ শুধু স্বপ্নেই পাবার আশা করে। "
তা ঠিক। তোমার কাটা মাথাটা ভালৈ দেখাবে আমার বাসার দেওয়ালে।
"কর্মজীবনে বিশাল উন্নতি যদি আমাকে ধরতে পারো। পদোন্নতি আর মেডেল, বুজছো মুরগীর বাচ্চা ?"

ছাদের আলোগুলো তাদের মাথা থেকে এখন মাত্র দশ ফিট উপরে । এত কম দূরত্ব যে এই কমজোর বালবের ফিকে আলোও যে বাক্সগুলোর উপর তারা দাড়িয়ে তাদের অর্ধেকটা আলোকিত করার জন্য যথেষ্ট। সবচেয়ে আলোকিত জায়গাটাতে স্ক্যাগ দাঁড়িয়ে, তার প্রত্যাশিত নিচের একমাত্র দর্শকের জন্য ভঙ্গি করে দাড়িয়ে আছে সে। পয়েন্ট আটত্রিশটা বের করে ফ্র্যাঙ্ক সামনে এগোলো। ছায়াঘেরা জায়গা থেকে বের হয়ে এলো ফিকে হলুদ আলোতে । স্ক্যাগ চিৎকার করলো, "তুই যদি আমাকে ধরতে না আসোস, মুরগীর বাচ্চা, আমি তোকে ধরতে আসবো।"

"কাকে তুমি মুরগীর বাচ্চা বলছো?" ফ্র্যাঙ্ক জিজ্ঞেস করলো। চমকে, স্ক্যাগ দ্রুত তার দিকে ঘুরে তাকালো আর মুহুর্তের জন্য বাক্সের কিনারায় টলে উঠলো। হাত দুটো ছড়িয়ে নিজেকে পেছনদিকে ঢলে পড়ার হাত থেকে বাচাতে গেলো সে। দুইহাতে রিভলবার চেপে ধরে, ফ্র্যাঙ্ক বললো,"হাত দুটো ছড়িয়ে হাটু গেড়ে বসো, তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ো।"

মনোবিকারগ্রস্থ নরঘাতকদের সচরাচর যেরকম চেহারা লোকে কল্পনা করে, ভারী ভুরু, ইটের মত চোয়াল, আবেগশূন্য চেহারা - এরকম কোন বৈশিষ্ট্যই কার্ল স্ক্যাগ নেই। বরং সে সুদর্শন। চিত্রনায়কদের মত সুদর্শন। চওড়া, সুন্দরভাবে কোঁদা চেহারা -পুরুষালি কিন্তু অনুভূতিপ্রবন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। তার চোখ সাপের বা গিরগিটি বা অন্য কোন বন্যপ্রাণীর মত নয় । সেগুলো বাদামী, স্বচ্ছ, আর আবেদনময়।

"উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ো।" আবার বললো ফ্র্যাঙ্ক। স্ক্যাগ নড়লো না। বাঁকা একটা হাসি ওর মুখে। হাসিটা তার চিত্রনায়কোচিত চেহারাটাকে নষ্ট করে দিলো। কারন ওতে কোন আকর্ষনীয় কিছু ছিলো না। যেন একটা রসবোধহীন কুমিরের মতো লোলুপ। লোকটা বিশাদেহী, এমনকি ফ্র্যাঙ্কের চেয়েও। লম্বায় ছয় ফিট পাঁচ কি সাড়ে ছয় ফিট। স্বাস্থ্যবান শরীর দেখে বোঝা যায় লোকটা আজীবন নিবেদত ভারোত্তলনকারী ব্যায়ামবিদ। ঠান্ডা নভেম্বরের রাত হওয়া সত্ত্বেও তার পায়ে দৌড়াবার জুতো, পরনে জিন্স আর একটা নীল সুতির শার্ট। বৃষ্টি আর ঘামে ভিজে সেই সার্ট তার পেশীবহুল ছাতি আর হাতের সাথে চটকে গেছে। সে বলে উঠলো,

- "তো আমাকে এখান থেকে নামাবে কি করে, পুলিশ ? তোমার কি ধারনা আমি হাতকড়া পড়ে এখানে শুয়ে থাকব আর তুমি ব্যাকাপ আনতে যাবে?" কোনমতেই না শুয়োরমুখো"
- "ভালো করে শোনোঃ বিশ্বাস করো সামান্যতম ইতস্তত না করে আমি তোমাকে উড়িয়ে দেবো।"
- "তাই ? তোমার হাত থেকে ঐ বন্দুক আমি ছিনিয়ে নেবো তুমি কিছু ভেবে ওঠার আগেই। তারপর তোমার মাথাটা ছিড়ে শরীর থেকে আলাদা করে পাছার মধ্যে ঢুকিয়ে দেবো। "

নিজের বিরক্তি কোনরকম রাখঢাক না করে ফ্র্যাঙ্ক বলে উঠলো, "এসব অশ্লীল কথাবার্তা বলার কি খুবই প্রয়োজন ?" বাঁকা হাসিটা আরো বিস্তৃত করে ওর দিকে এগোলো স্ক্যাগ। একেবারে কাছ থেকে তার বুকে গুলি করলো ফ্র্যাঙ্ক। ধাতব দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো গুলির আওয়াজ। পিছনে ছিটকে পড়লো স্ক্যাগ। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে পায়ের নিচের বাক্স সরে গিয়ে সোজা নিচের গলিতে লুটিয়ে পড়লো। ধপ করে মেঝেতে পতিত হবার সাথে সাথে গলা ফাটানো চিৎকার বন্ধ হয়ে গেলো মাঝপথেই। স্ক্যাগের জবরদস্ত প্রস্থান ফলাফলে বাক্সগুলোতে আন্দোলন সৃষ্টি করলো, মুহুর্তের জন্য আলগা বাক্সের দেওয়াল বিপদজনকভাবে দুলে উঠলো। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো ফ্র্যাঙ্ক। নিচের সারিবদ্ধ বাক্সগুলো স্থির হবার জন্য অপেক্ষা করলো। ভাবতে লাগলো এই গুলি করার জন্য কিরকম কাগজপত্র জমা দিতে হবে। কত কত ফর্ম জমা দিতে হবে সেইসব হৃদয়ের রক্তক্ষরন থামাতে যাদের প্রায় নিশ্চিত ধারনা প্রত্যেক পুলিশ কর্তৃক গোলাগুলির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ প্রতিটা ব্যাক্তি মাদার তেরেসার মত নিস্পাপ। আক্ষেপ করলো স্ক্যাগ তাকে এত দ্রুত ঐ অবস্থায় যেতে বাধ্য করার জন্য। তার আশা ছিলো খুনিটা আরেকটু বেশি চালাক হবে, আরেকটু কঠিন ইদুর-বিড়াল খেলা চলবে যবনিকা পাতের আগে। এখন পর্যন্ত এই ধাওয়াটা তাকে এত মজা দেয়নি যা সামনে যে পাহাড়সম নথিপত্র তৈরী করতে হবে তার জন্য যথেষ্ট। বাক্সগুলো দ্রুতই স্থিত অবস্থায় চলে আসলো। নিজের পায়ে উঠে দাড়ালো ফ্র্যাঙ্ক। দেওয়ালের কিনারায় এসে দাড়ালো ও, যেখান থেকে স্ক্যাগ গুলি খেয়ে শূন্যে ছিটকে পড়েছিলো। নিচের চলাচলের রাস্তায় তাকালো ও। নিরাপত্তা বাতির আলোয় কনক্রিটের মেঝেটা রূপোর মত আভা ছড়াছিল। স্ক্যাগ ওখানে নেই। গুদামঘরের ছাদের খুপরীসম জানালাগুলোতে ঝড়ের রাতের বিদ্যুতচমক থেমে থেমে আলো দিয়ে চলেছে। ফ্র্যাঙ্কের পাশে তার ছায়াটা লাফিয়ে বড় হচ্ছে, তারপর সংকুচিত হচ্ছে, আবার বড় হচ্ছে, সঙ্কুচিত হচ্ছে , যেন এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের, লুকিং গ্লাসের ওপাশের, যাদুপানীয় নিয়ে কাহিনীর অংশ ওটা। বজ্রাঘাতে জর্জরিত হচ্ছিল রাতের আকাশ, বৃষ্টির তোড় যেন আরো বেগ নিয়ে আছড়ে পড়ছে ছাদের উপর। ফ্র্যাঙ্ক মাথা নাড়লো, চোখ কুচকে নিচের চলাচলের রাস্তায় তাকালো আর অবিশ্বাসের সাথে চোখ পিটপিট করলো। স্ক্যাগ এখনো ওখানে নেই।

৩।

বাক্সের দেওয়াল থেক সাবধানে চলাচলের রাস্তায় নেমে ফ্র্যাঙ্ক ডানে বামে তাকালো। গভীর মনোযোগের সাথে ছায়াগুলো পরীক্ষা করলো, তারপর যেখানে কার্ল স্ক্যাগ উপর থেকে এসে পড়েছে সেই রক্ত মাখানো জায়গায় হাটু ভাজ করে বসলো। প্রায় কমপক্ষে এক লিটার রক্ত সংঘর্ষের জায়গাটাকে চিনিয়ে দিচ্ছে। এত তাজা যে কিছু অংশ কংক্রিট শুষে নেয় নাই এখনো, ছোট ছোট লাল চকচকে রক্তপিন্ড থোকা থোকা হয়ে আছে। কোন মানুষের পক্ষে পয়েন্টব্ল্যাঙ্ক দূরত্বে ছোঁড়া পয়েন্ট আটত্রিশের হলো-পয়েন্ট গুলি বুকের মধ্যে নিয়ে পড়ে গিয়ে সংগে সংগে উঠে দাড়িয়ে হেটে চলে যাওয়া সম্ভব নয়। কোন মানুষের পক্ষে তিন তলা উচু জায়গা থেকে কনক্রিটের উপর পড়ে আবার লাফ দিয়ে খাড়া দাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না। কিন্তু তারপরো মনে হচ্ছে স্ক্যাগ সেটাই সম্ভব করেছে। জমাট বাধা রক্তের দাগ লোকটার গমনপথ নির্দেশ করছে। পয়েন্ট আটত্রিশটা হাতে নিয়ে ফ্রাঙ্ক উম্মাদটাকে খুজতে খুজতে এক মোড়ের মাথায় এসে পৌছুলো। বামে মোড় নিয়ে নতুন এক গলিতে আসলো। তারপর নিঃশব্দে আলো আর ছায়ার পাল্টাপাল্টি মিশেলের মধ্য দিয়ে আরো দেড়শ ফিট এগুলো। ঠিক এইখানে, রক্তের দাগ এসে শেষ হলো। যেন হঠাৎ করেই গলির মাঝপথে এসে রক্তপাত বন্ধ হয়ে গেছে। ফ্র্যাঙ্ক উপরের দুই পাশের সারিতে ভালো করে নজর করলো। কিন্তু স্ক্যাগ ঝুলে নেই কোথাও। বাক্সের মধ্যে দিয়ে কোন অপ্রত্যাশিত গলিপথ বা সুবিধাজনক জায়গা নেই লুকিয়ে থাকার মত। যদিও বাজেভাবে আঘাতপ্রাপ্ত, আর ধাওয়াকারীর নাগাল পেরিয়ে দ্রুত পালাবার চেষ্টারত , তারমধ্যেও সে তার মারাত্মক ক্ষত সাবধানে বেধে রক্তপাত বন্ধ করতে পেরেছে । তাকে দৌড়ের মধ্যেই এই ক্ষত বাঁধবার কাজ করতে হয়েছে । কিন্তু কি দিয়ে ? নিজের পরনের শার্ট ছিড়ে তা দিয়ে ব্যান্ডেজ তৈরী করেছে ? ধুর ! স্ক্যাগের বুকের ক্ষতটা প্রাণঘাতী। ফ্র্যাঙ্ক তো দেখেছে একটা গুলি হাড়মাংশের কি মারাত্মক অবস্থা করে ছেড়েছে, সে তো স্ক্যাগকে উল্টো হয়ে পড়তে দেখেছে, দেখেছে তার রক্ত। লোকটার বুকেরহাড্ডি চূর্ণবিচুর্ণ হয়ে গেছে, গুলির ভিতেরের ধাতব কুচিগুলো তার অপরিহার্য দেহযন্ত্র ভেদ করে চলে গেছে। ধমনী আর শিরা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গুলিটা নিশ্চিত স্ক্যাগের হৃৎপিন্ড ভেদ করেছে। কোন কাপড়ের ফাঁস বা বান্ডেজ-এর পক্ষে এই রক্তপাত বন্ধ করা অথবা বিক্ষত হৃৎপেশীগুলোকে আবারো স্পন্দিত করতে সক্ষম নয়। কান পেতে রাতের শব্দগুলো শুনলো ফ্র্যাঙ্ক। বৃষ্টি, ঝড়ো বাতাস, বজ্রপাত। তাছাড়া নিঃশব্দ। মরা মানুষ-এর রক্তঝরে না, ফ্র্যাঙ্ক ভাবলো। হয়ত সেকারনেই রক্তের রেখা এইখানে এসে থেমেছে - কারন এতদূর আসার পরই স্ক্যাগ মারা গেছে। কিন্তু সে যদি মরে গিয়ে থাকে, মৃত্যু তাকে থামিয়ে দেয়নি। সে তারপরো চলমান। তাহলে এখন কিসের পিছু ধাওয়া করছি ? একটা হার-না-মানা মরা লাশ ? বেশীরভাগ পুলিশ হেসে উড়িয়ে দিত এধরনের চিন্তা, বিব্রত বোধ করত। কিন্তু ফ্র্যাঙ্ক না। কঠিন, একগুয়ে আর অদম্য হবার মানে এই না যে চিন্তাভাবনায়ও অনমনীয় হতে হবে। এই মহবিশ্বের রহস্যময় জটিলতার প্রতি তার রয়েছে পরম শ্রদ্ধা। এক চলমান মৃতমানব ? সম্ভাবনা কম। কিন্তু তা যদি হয়েও থাকে, তাহলে পরিস্থিতি জমজমাট। মনোমুগ্ধকর। হঠাৎ করেই ফ্র্যাঙ্ক গত কয়েক সপ্তাহের চেয়ে আরো প্রগাঢ়ভাবে তার নিজের কাজে নিমগ্ন হয়ে পড়লো ।


মন্তব্য

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

গালাগাল গুলো যেমন বাংলায় সুন্দর লাগলো, নামগুলো ও বাংলাতে বেশি জমতো মনে হয়!
ভালো অনুবাদ।

অবনীল এর ছবি

হাহা। একবার ভেবেছিলাম পুরো পরিস্থিতিটা দেশীয় পটোভূমিতে ফেলে দেবো। তারপর আলসেমি করে করা হয়নি। অনেক ধন্যবাদ । ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

এক লহমা এর ছবি

পরের পর্বের অপেক্ষায়

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অবনীল এর ছবি

ধন্যবাদ। আসছে শীঘ্রই।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ওয়েস্টার্ন?

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অবনীল এর ছবি

কিছু বলবো না। সিরিজ শেষ করলে আপনিই নিজেই জনরা বলে দেবেন। হাসি

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।