কম্পিউটার বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে প্রাণঃ এক প্রাগৈতিহাসিক, বিবর্তনশীল প্রাকৃতিক সফটওয়ার

অবনীল এর ছবি
লিখেছেন অবনীল (তারিখ: রবি, ১২/০১/২০২০ - ১১:০৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমরা যদি একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে জীববিজ্ঞানকে পর্যালোচনা করি তাহলে দেখবো, আসলে এর মূল উপজীব্য বিষয় হচ্ছে ইনফরমেশন বা তথ্য। তবে আজকের দিনে শুধু জীববিজ্ঞানেই নয় তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা, এমনকি কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এরও মূল উপজীব্য বিষয় হতে শুরু করেছে তথ্য - কিউবিটস। কিন্তু জীববিজ্ঞান পদার্থবিদ্যা থেকে একটু ভিন্ন ধরনের তথ্য নিয়ে কাজ করে যাকে বলা হয় - এলগরিদমিক তথ্য - বিজ্ঞানীরা যখন বলেন ডিএনএ একটা কম্পিউটার প্রোগ্রামের মত, যখন এভো-ডেভো (এভোলিউশনারী ডেভেলপমেন্টার বায়োলজি) ভ্রূনের ক্রমবিকাশে ডিএনএ প্রোগ্রামের বর্ণনা দেয়, সেটা এক প্রকার এলগরিদমিক তথ্যের কথাই বলে।

এভো-ডেভোর উপর লেখা চমৎকার একটি বই নেইল শুবিনের 'ইয়োর ইনার ফিশ'। সেটা পড়লে উপলব্ধি করা যায় আমাদের দেহ এক সফটওয়ার দিয়ে পূর্ণ। অত্যন্ত আদিম এক সফটওয়ার। এই সফটওয়ারে রয়ে গেছে স্পঞ্জের সাবরুটিন, উভচরপ্রানীর সাবরুটিন, রয়ে গেছে মাছের সাবরুটিন। মানুষের গর্ভাবস্থায় একটি পর্যায়ে রয়েছে যে সময়ে ভ্রূণের কাণকো থাকে ! প্রতিটা কোষে রয়েছে এই ডিএনএ সফটওয়ার এর সম্পূর্ন প্রতিরূপ, তার মানে জীবনের সম্পূর্ন ইতিহাস সঞ্চিত রয়েছে কোষে কোষে। এর কারণ ? কারণ হলো বিবর্তন এমন একটি প্রক্রিয়া যা জীবের মধ্যে অভিযোজনের জন্য সংক্ষিপ্ততম পরিবর্তন ঘটায়। যতটা কম সম্ভব পরিবর্তন করে জীব টিকে থাকা যায় ঠিক ততটুকু পরিবর্তন ঘটায় এই অন্ধ প্রক্রিয়া।

বিবর্তনের এই বৈশিষ্টের সাথে কি আমরা মানুষের তৈরী বড়ধরনের সফটওয়ার নির্মান প্রকল্পের মিল পাই ? হ্যা, একইভাবে এই ধরনের প্রকল্পের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের পরিবর্তন অনায়ন অথবা পুরো প্রকল্পকে প্রথম থেকে ঢেলে সাজানো সম্ভবপর হয় না, কোন "বাগ" বা ত্রুটি আবিস্কার হলে মুল কোডকে এড়িয়ে যতুটকু ঠিকঠাক করা সম্ভব তার চেষ্টা করা হয়। যেটাকে প্যাচিং বলে অভিহিত করা হয়। নোবেল বিজয়ী ফরাসী বায়োকেমিস্ট জ্যাকুয়েস মোনোদ নাকি মন্তব্য করেছিলেন, ''প্রকৃতি হচ্ছে আসলে একজন মিস্তিরি।'' সে ফেলে যাওয়া পুরোনো জিনিসকে একরকম মেরামত করে আবার ব্যবহার করে। তাই আমরা যখন ডিএনএর দিকে তাকাই সেই ফেলে যাওয়া তথ্য থেকে প্রাণীর পূর্ন ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি। ব্যাপারটার সাথে অনেকটাই প্রত্নতত্ত্বের মিল রয়েছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানীর চোখে জীববিদ্যা আসলে এক ধরনের সফটওয়ার প্রত্নতত্ত্ব ! তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো ? দুরকমের সফটওয়ার রয়েছে এই পৃথিবীতে - মানবসৃষ্ট কৃত্রিম সফটওয়ার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম বলছি আমরা যেগুলোকে, আর রয়েছে প্রাকৃতিক সফটওয়ার - ডিএনএ। ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে মানুষের বহু আগেই প্রকৃতি সফটওয়ার আবিস্কার করে বসে আছে ! আমরা প্রাণের উৎপত্তিকে প্রাকৃতিক সফটওয়ারের উৎপত্তি হিসবেই অভিহিত করতে পারি - ডিএনএ-এর উৎপত্তি।

ডিএনএ এক সার্বজনীন প্রোগ্রামিং ভাষা যা প্রতিটা কোষেই বিরাজ করে। এ এক শক্তিশালী প্রোগ্রামিং ভাষা, যা দিয়ে সম্ভবত যেকোন এলগোরিদম লেখা সম্ভব, একটা জীবকে তৈরী এবং পরিচালনার জন্য যেকোন প্রোগ্রামিং নির্দেশনার সেট এর দ্বারা বানানো সম্ভব। এই প্রোগ্রামিং ভাষাকে আমরা মাত্র বুঝতে শুরু করেছি, এ এক অতি জটিল প্রোগ্রামিং ভাষা, শত কোটি বছর ধরে সঞ্চিত হতে হতে এই ভাষা গড়ে উঠেছে। অনেকটা যেন খাজুরাহো-এলিফেন্টা-ইলোরার পাথর কুদে তৈরী সেইসব হিন্দু মন্দিরের দেওয়ালে স্তরে স্তরে সাজানো দেবতার উপর দেবতা যেভাবে খোদাই করা সেইরকম। কিংবা অনেকদিন ধরে যদি কোন ওয়াইনের বোতলকে মোমদানী হিসেবে ব্যাবহার করলে গলিত মোমের যেরকম বিভিন্ন স্তর তৈরী হয় ওরকম।

সফটওয়ারে পূর্ন আমাদের এই জীবমন্ডল। এর প্রতিটি কোষ সফটওয়ার দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে - তিন থেকে চার বিলিয়ন বছরের পুরোনো সফটওয়ার। এর তুলনায় আমাদের মানবসৃষ্ট কৃত্রিম সফটওয়ারের বয়স পঞ্চাশ কি তদোর্ধ। কিন্তু যতদিন না আমরা মানবসৃষ্ট কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ভাষা আবিস্কার করেছি, আমরা এটা উপলব্ধি করতে পারিনি যে প্রকৃতি সফটওয়ারে পরিপূর্ণ। এই বিশ্ব সফটওয়ারে পরিপূর্ন এমনি যখন আমরা জানতাম না সফটওয়ার জিনিসটা কি ! জীবমন্ডলের নমনীয় বৈশিষ্টের কারণ হচ্ছে সফটওয়ার । জীবনের উৎপত্তি হচ্ছে সফটোয়ারের উৎপত্তি। কোষেরা হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গঠিত এবং সফটওয়ার দ্বারা বা সফটোয়ারের ডিএনএ-এর ভাষা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমাদের দেহের প্রতিটি কোষ পুরো মানুষের সম্পুর্ণ ডিএনএ রয়েছে, যদিও কোষের প্রকারের উপর ভিত্তি করে আংশিক ভাবে এই সফটওয়ার ব্যবহ্ররত হয়ে থাকে। আর পৃথিবীর প্রতিটি জীবিত প্রাণ কার্যত একই ডিএনএ ভাষা ব্যবহার করে থাকে - এখন পর্যন্ত স্বাধীনভাবে প্রাণের উৎপত্তি বা সৃষ্টির কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

//তাই আমাদেরকে বিবর্তনকে বুঝতে হলে আমাদের সফটওয়ারের উপর মনোযোগ দিতে হবে । এই সফটওয়ারে বিবর্তিত হয়ে //হার্ডওয়ারে পরিবর্তন আনছে। হার্ডওয়ারের চেয়ে সফটোয়ারের গুরত্ব এক্ষেত্রে বেশী।

১৯৩৬ সালে লেখা টুরিং-এর পেপার "অন কম্পিউটেবল নাম্বারস, উইদ আন আপ্লিকেশন টু দি এনটশাইডুংস প্রবলেম" এ সর্বপ্রথম নমনীয় যন্ত্র, সার্বজনীন যন্ত্র, সাধারন-ব্যবহারযোগ্য কম্পিউটার এবং সফটওয়ার আর হার্ডওয়ার এর মধ্যে পার্থক্যের ধারনা উল্লেখ করা হয়। ডিএনএ খুব সম্ভবত একটি সার্বজনীন প্রোগ্রামিং ভাষা, যেটি যেকোন ধরনের এলগরিদম প্রকাশ করার মত উপযোগী। ডিএনএ শুধু প্রাণ -এর একটি জটিল এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রোগ্রামিং ভাষাই নয় , এ এমন এক বিন্যাস উপস্থাপন (pattern representation) পদ্ধতি যা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বিপুল পরিমান তথ্য ধারন করে আর এর ভেতরেই রয়েছে পারিপার্শিকতার সাথে অভিযোজিত হবার কলাকৌশল। ডিএনএ শুধু কোন জীব-এর বিভিন্ন অংশের গঠনপ্রকৃতি সম্পর্কে নির্দেশনাই ধারন করে না, উপরোন্তু এ এর প্রতিটি অংশ কিভাবে একে অন্যের সাথে সংযুক্ত হবে এবং নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান করার মাধ্যমে প্রাণহীন অণু থেকে এক বিশাল প্রাণ তৈরী করতে পারে তার পুরো পাকপ্রণালী ধারণ করে। ডিএনএর গঠনপ্রকৃতি অনেকটাই একটি উচ্চস্তরের প্রোগ্রামিং ভাষার মত। এক ধরনের সোর্স কোড যাতে বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রামিং ভাষার গঠন রয়েছে , যেমনঃ যদি বিবরন (if statement) - যদি কোন রাসায়নিক বিক্রিয়া 'ক' এর উপস্থিতি 'খ' পরিমানে থাকে, তাহলে প্রোটিন 'গ' উৎপন্ন কর - এরকম। এসব বিবরন শৃঙ্খলের মত একটার পর একটা আবদ্ধ এক অতি জটিল প্রক্রিয়ায়। কোন কোন অংশ আরেক অংশে কখন স্বয়ংক্রিয় বা "এক্সিকিউট" হবে তা নিয়ন্ত্রন করে। রাসায়নিক বন্ধনের মাধ্যমে একটা কোষ ডিএনএ এর নির্দেশনাবলীর কোন কোন অংশ নিস্ক্রিয় করে দিতে পারে, অনেকটা পোগ্রামিং এর সময় আমরা কোডের কোন অংশকে যেভাবে "কমেন্ট আউট" করে দিই। এভাবে একটা ডিএনএ সোর্স কোড থেকে বিভিন্ন ধরনের কোষ উদ্ভুত হতে পারে - এর হতে পারে প্রতিটিই অনন্য বৈশিষ্টের অথবা কাছাকাছি ধরনের আচরণ করে এরকম। কোষ কিভাবে ডিএনএ-এর নির্দেশনা সম্পাদিত করে ? ডিএনএ-এর "স্টেটমেন্ট" এর ভিতর সঞ্চিত তথ্য-কে প্রোটিন-এ রূপান্তরিত করার মাধ্যমে এর কার্য সম্পাদন করা হয়। এর সাথে কম্পাইলার যেমন সোর্স কোড থেকে মেশিন কোড উৎপন্ন করে তার সাথে সামঞ্জস্য পাওয়া যায়। তার মানে, এই উৎপাদিত প্রোটিন, মেশিন কোডের মত, প্রোগ্রামিং ভাষায় যে নির্দেশনাইয় দেওয়া হয়েছিলো সেটাকে সম্পাদিত করবে। তারমানে ডিএনএ একটি অপেক্ষাকৃত উচ্চস্তরের নির্দেশনা মাধ্যম - "হাই লেভেল রিপ্রেজেনটেশান"। এক ধরনের হাই লেভেল সোর্স কোড ।

//মানবশরীরের কিছু আশ্চর্য বৈশিষ্ট্যেকে বঝতে হলে , আপনাকে দেখতে হবে মাছেরা কিভাবে গঠিত হয়েছে। কারণ মাছ থেকে //স্তন্যপায়ীতে পরিবর্তিত হতে সংক্ষিপ্ততম পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে!

আমাদের ডিএনএ এক অতি প্রাচীন এক সফটোয়ার, অসঅংখ্যবার একে প্যাচ করা হয়েছে , কোড লিখনের দিক থেকে চিন্তা করলে একেবারেই অপরিচ্ছন্ন এবং দূর্বলভাবে ডিজাইন করা এর কোড। আমরা যদি প্রথম থেকে শুরু করতে পারতাম, সরাসরি স্তন্যপায়ী প্রাণীর কোড ডিজাইন করতে পারতাম, তাহলে কিন্তু এর থেকে অনেক ভালো কোড আমরা লিখতে পারতাম। কিন্তু তা সম্ভবপর নয়, যেমন মানবসৃষ্ট কৃত্রিম সফটওয়ার যা মাত্র অর্ধশতাব্দী পুরোনো (যেখানে ডিএনএ বিলিয়ন বছরের পুরোনো) বিশাল বিশ্বে প্রথম থেকে শুরু করা এক প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। বিশেষ করে, আমরা এবং শিম্পাঞ্জীদের প্রোটিন কোডিং এর জন্য প্রায় একই জিন রয়েছে । কিন্তু আবার কোন জিনগুলোর বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হবে তা যেসব ডিএনএ নিয়ন্ত্রন করে তারা অনেকখানি আলাদা। অন্যভাবে বলতে গেলে, নিম্নস্তরের সাবরুটিন-গুলো তেমন পরিবর্তিত হয় না, কারণ অনেকজন সেগুলোর উপর নির্ভর করে, এবং খুব বেশী ব্যবহৃত হয়। কিন্তু উচুস্তরের, অপেক্ষাকৃত নতুন সফটোয়ার সহজেই পরিবর্তিত হতে পারে।

মাত্র পঞ্চাশ বছরে মানবসৃষ্ট প্রোগ্রামিং-এর পরিমন্ডল অত্যন্ত উচু-স্তরে উপনিত হয়েছেঃ এসেম্বলি লেভেলের অত্যন্ত জটিল প্রোগ্রাম থেকে গ্রাফিকাল ইউজার ইন্টারফেস ডেভেলপমেন্ট, ইন্টারনেট থেকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য আহরণের পদ্ধতি যেমন ওয়েব ব্রাউজারে ব্যবহৃত সার্ভার এবং ক্লায়েন্ট সাইডের কোড ইত্যাদি। এ ধরনের কাজের জন্য আজকের দিনে কেউই (সচরাচর) এসেম্বলি ভাষা ব্যবহার করে একেবারে গোড়া থেকে প্রোগ্রামিং শুরু করবেন না। আমরা আমাদের এই অত্যন্ত উচু-স্তরের প্রোগ্রামিং ভাষা আর প্রোগ্রামিং পরিমন্ডলকে এখন প্রায় শাশ্বত বলেই ধরে নেই। আবার প্রথম থেকে শুরু করা সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে। বর্তমান প্রযুক্তিতে আমাদের সিদ্ধান্ত সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। উদাহরনস্বরূপ বলা যেতে পারে, "qwerty” টাইপরাইটার কিবোর্ডের কথা যেটা ডিজাইন করা হয়েছিল এমনভাবে যাতে বেশী দ্রুত টাইপ করার ফলে টাইপরাইটার জ্যাম হয়ে না যায়। কিন্তু আজকের আধুনিক কিবোর্ডের তা জন্য কোন সমস্যা না হলেও বিপুল পরিমানে ব্যবহৃত এই লে-আউট এখন প্রতিস্থাপন করা এক প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।

টুরিং এর ১৯৩৬ সালের বিখ্যাত প্রবন্ধ "অন কম্পিউটেবল নাম্বারস" পরোক্ষভাবে আনবিক জীববিজ্ঞানের জন্মগ্রহনে বিশাল প্রভাব ফেলে। জন ভন নিউম্যানের স্ব-পুনোরুৎপাদনশীল অটোমাটা এর দ্বারে প্রভাবিত হয়। আবার ভন নিউম্যানের কাজ প্রভাবিত করে সিডনী ব্রেনারকে যার কাজ আবার প্রভাব ফেলে ফ্রান্সিস ক্রিকের গবেষনায়, সেই ওয়াটসন আর ক্রিক এর ফ্রান্সিস ক্রিক, যারা ডিএনে-এর আনবিক গঠন আবিস্কার করেন। তদুপরি, টুরিং এর ধারনাগুলো ভন নিউম্যান জীববিজ্ঞানে প্রয়োগ করে যা দেখিয়েছেন তা সাম্প্রতিক এভো-ডেভোর গবেষনাগুলো সুন্দরভাবে সমর্থন করে। এই গুরুত্বপূর্ণ ধারনাঃ ডিএনএ একটা কয়েকবিলিয়ন বছরের পুরোনো সফটওয়ার। কিন্তু আমরা তা চিন্তে পারিনি টুরিং এর ১৯৩৬ সালের পেপার প্রকাশিত হবার আগে, যে পেপার ভন নিউম্যানের মতে কম্পিউটার হার্ডওয়ার এবং সফটওয়ার এর ধারণা প্রবর্তন করে।

মলিয়েরের লেখা কৌতুক নাট্য লা বুর্জোয়া জেন্টিলোম-এর মূল চরিত্র জরদেইন বিস্মিত হয়ে গেছিল যখন সে জানতে পেরেছিল তার সারাজীবন সে গদ্য আউড়ে গেছে । আমরাও অনেকটা যেন জরদেইন এর মতই। আমাদের দেহ সফটওয়ার দিয়ে পরিপূর্ন , সবসমই ছিলো, কিন্তু ডিএনএ-এ প্রাকৃতিক সফটওয়ার হিসেবে চিহ্নিত করার আগে আমাদেরকে কৃত্রিম সফটওয়ার এবং মানবসৃষ্ট কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর ভাষা আবিস্কার করতে হয়েছে। আমাদের চারপাশ সবসময়ি সফটওয়ার দ্বারা পরিবেষ্টিত, প্রতিটি কোষে অবস্থিত এক আদিম সফটওয়ার, কিন্তু যতদিন না আমরা নিজেরা সফটওয়ার আবিস্কার করতে পেরেছি ততদিন আমরা তা উপলব্ধি করতে পারিনি! উপরোন্ত এভো-ডেভো দেখিয়েছে, যেটা নেইল শুবিনের বই 'ইয়োর ইনার ফিশ' থেকে জানতে পারি, প্রাণ তার জৈবিক ইতিহাস নিজের মধ্যে নিয়ে বয়ে বেড়ায়, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে আছে সামুদ্রিক স্পঞ্জের তথ্য, উভচর প্রাণীর তথ্য। বায়োলজীকে বলা যেতে পারে এক অদ্ভুদ রকমের প্রত্নতত্ত্ব, সফটওয়ারের প্রত্নতত্ত্ব। যৌনসংগমের উদ্দেশ্য হলো পুরুষ সফটওয়ার (শুক্রানুর মধ্যে অবস্থিত) সাথে মহিলা সফটোয়ারের (ডিম্বানুতে অবস্থিত) সমন্বয়। তাহলে কি এই জন্যই মানুষ প্রেমে পড়ে? তারা তাদের সাবরুটিনগুলো মিলিত করতে চায় বলে ? তাই যদি হয় তাহলে রোমান্টিকভাবে বলতে গেলে, ভন নিউম্যান আবিস্কার করেছিলেন মানুষ কেন প্রেমে পড়ে!

প্রাণের উদ্ভব কিভাবে হয়েছিলো তা এক গভীর রহস্যমন্ডিত প্রশ্ন, সেই প্রশ্নকে এখন আমরা ভিন্ন ভাবে করতে পারি - প্রাকৃতিক সফটওয়ারের উদ্ভব কিভাবে হলো ? স্টিফেন ওলফরামের 'আ নিউ কাইন্ড অব সায়েন্স' যেটাতে সেলুলার অটোমাটা এবং এই জাতীয় কম্পিউটেশনাল সিস্টেমের উপর আলোকপাত করা হয়েছে - কম্পিউটার বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে বইটাকে বলা যেতে পারে প্রাণের উৎস সম্পর্কিত বই। আ নিউ কাইন্ড অব সায়েন্স (এনকেএস) এর মূল বক্তব্য হচ্ছে গণনার প্রকৃতি অবশ্যই পরীক্ষামূলকভাবে অন্বেষণ করা উচিত, এবং এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল আমাদের কায়িক জগত সম্পর্কে বোঝার ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। ৩০-এর দশকে গণনা-বিজ্ঞানের যাত্রা শুরু থেকে দুটি মূল প্রথাগত দিক থেকে এগিয়েছেঃ প্রকৌশল, যে ক্ষেত্রে গণনাকে ব্যবহার করে ব্যবহারিক সিস্টেম তৈরী করার চেষ্টা করা হয়, এবং গাণিতিক, যেখানে গণনা বিষয়ক তত্ত্বের প্রমাণ খুজে বের করা হয়। তবে, ৭০-এর দশকের দিকে, গণনাকে গাণিতিক, প্রকৌশিলিক এবং ব্যবহারিক প্রথার এক সংযোগ সড়ক হিসেবে বর্ণিত হতে থাকে। ওলফরাম এক তৃতীয় প্রথার সূচনা করেন যেখানে ব্যবহারিকভাবে শধু গণনারই বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অনুসন্ধার করার চেষ্টা করা হয়। তাঁর মতে, এক সম্পূর্ন নতুন পদ্ধতির প্রয়োজন কারণ প্রথাগত গণিত অর্থপূর্ণভাবে জটিল সিস্টেমগুলি (complex system) বর্ণনা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এবং প্রত্যেক সিস্টেমেরি জটিলতার (complexity) একটি সর্বোচ্চ সীমা রয়েছে। প্রায় সব শ্রেণীর গণনাকারী সিস্টেমের ক্ষেত্রে, এর সরলতম অবস্থা থেকে অতি দ্রুত অতি জটিল অবস্থায় উপনিত হতে পারে বলে লক্ষ্য করা যায় (দুই বা তদোধিক বার সময়ের সাথে পুনরাবৃত্তির প্রেক্ষিতে, নিজের উপর একই সরল নিয়মের সেট প্রয়োগ করার পর)। সিস্টেমটা যেভাবেই শুরুতে দাড় করানো হোক না কেন এবং এর অংশগুলো যা-ই হোক না কেন এই ঘটনাটা সবসময়ই সত্য হিসেবে পরিগণিত হয়। সাধারণত, সরল প্রোগ্রাম-এর খুবি সরল বিমূর্ত কাঠামো থাকে (abstract framework)। সরল কোষীয় অটোমাটা, টুরিং যন্ত্র এবং এদের সম্মিলিতরূপ হচ্ছে এরকম কাঠামোর উদাহরন। প্রোগ্রামগুলির প্রায় যেকোন শ্রেণীর সমস্ত সম্ভাব্য প্রকরণগুলি ব্যবহার করে শুধু গণনা পরিচালন করেই দেখা যায় অন্তত একটা উদাহরনের ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। এখানে প্রশ্ন আসেঃ যদি প্রোগ্রামটা এত সরল হবে, তাহলে এই জটিলতা কোথা থেকে উদ্ভুত হচ্ছে? একভাবে বলতে গেলে, প্রোগ্রমের সংজ্ঞার মধ্যে সেই পরিমান জায়গা নেই যা সেই প্রোগ্রাম করে দেখাতে পারে। তাহলে, সরল প্রোগ্রামকে আবির্ভাব emergence) এর সরলীকৃত উদাহরন হিসেবে দেখা যেতে পারে।

স্টিফেন-এর অন্যতম মূল বক্তব্য ছিলো একটা কম্বিনেটরিয়াল সিম্বলিক সিস্টেমকে খুব সহজেই সার্বজনীন টুরিং মেশিন বা সাধারন ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য কম্পিউটারে পরিনত হতে পারা যায়। প্রায় সব বিচ্ছিন্ন গণিতের উপাদান দিয়ে কম্পিউটার তৈরী করা সম্ভব। এই বৈশিষ্ট্যের নাম দিয়েছেন তিনি - সর্বব্যাপী সার্বজনীনতা (ubiquity of universality)। দার্শনিক দৃষ্টিকোন থেকে এর অর্থ হলো প্রাণের আবির্ভাব তেমন আশ্চর্য কোন ঘটনা নয়। ১৯৫১ সালে ভন নিউম্যান, গোডেল এর ধারনা থেকে ধার করেন এই আপাত সহজ সমীকরনঃ জীবের অভ্যন্তরেই জীবের নীলনক্সা = জীব-এর গঠনপ্রকৃতির যাবতীয় তথ্য = বংশানুগতিক তথ্য = ডিজিটাল সফটওয়ার = ডিএনএ।

ভন নিউম্যান-এর স্ব-পুনরুৎপাদন সম্পর্কিত কাজ কিন্তু রার ১৯৫১ সালের কিনেম্যাটিকাল মডেল দিয়েই শেষ হয়ে যায়নি, যেটা মূলত কায়িক বস্তুদ্বারা গঠিত যন্ত্রবিশেষ । স্টাস্লাভ উলাম-এর পরামর্শ অনুসারে ভন নিউম্যান সেই মডেলকে ভৌত জগত থেকে নিয়ে যান গ্রাফ কাগজের উপর অংখিত দ্বিমাত্রিক তলে বিভক্ত চতুর্ভুজ-এ। প্রত্যেক চৌকো একটি সসীম-অবস্থার যন্ত্র (finite state machine) , যাকে বলা হচ্ছে কোষীয় অটোমাটা (cellular automata)। ভন নিউম্যানের কোষীয় অটোমাটার জগতটা সবদিকে একইরকম, সম্পুর্ণ কৃত্রিম, যে জগতে সবকিছুই সফটওয়ার, তথ্য, কোন ধরনের ভৌত কাঠামো বিহীন - শুধু সুনির্দিষ্ট মন্ত্রবলে তৈরী করা সম্ভব যেকোন কিছু। এখানে রয়েছে এক সার্বজনীন নির্মাতা এবং এক সার্বজনীন কম্পিউটার। তবে এ শুধু কোন তাত্তিক মডেলই নয়, ভন নিউম্যানের স্ব-পুনরুৎপাদন এবং সার্বজনীন নির্মাতা-র রয়েছে প্রযুক্তিগত অবধানঃ যেমন ত্রিমাত্রিক প্রিন্টার, ত্রিমাত্রিক প্রিন্টার যা নিজেকেই প্রিন্ট করতে পারে ! হয়ত একদিন সার্বজনীন প্রস্ততকারক কারখানা তৈরী হবে যেখানে সবকিছু উৎপাদন করা সম্ভব। তাহলে দেখা যাচ্ছে, টুরিং এর প্রবন্ধ এক বিশাল প্রভাব ফেলেছিলো। কম্পিউটার শুধু একটি অত্যন্ত কাজের প্রযুক্তিই নয়, এ এক নতুন ধরনের বৈপ্লিক গণিত যার রয়েছে গভীর দার্শনিক গুরুত্ব। অবগুন্ঠন খুলে দিয়ে এ এক নতুন জগত তুলে ধরে আমাদের সামনে।

তবে ডিএনএ কোন প্রোগ্রামিং ভাষা নয়। এটি নিজেই একটি প্রোগ্রাম। এমিনো এসিড এবং প্রোটিন তৈরীর নির্দেশনা সম্বলিত একটি সফটওয়ার। কৃত্রিম কম্পিউটারের ভাষা হলো বাইনারী বা দুই সংকেত বিশিষ্ট, কিন্তু ডিএনে এর ভাষা কোয়ানটারনারী বা চার-সংকেত বিশিষ্ট (এ, টি, সি, জি)। যেখানে এক ডিজিটাল বাইট -এ থাকে ৮টি বাইনারি ডিজিট, ডিএনএ -এর বাইট - যাকে কোডন বলা হয় - তাতে থাকে তিন ডিজিট। যেহেতু ডিএনএ ডিজিট ২ এর বদলে ৪ রকম সংকেত থাকতে পারে, তাই একটি ডিএনে কোডন এর আছে ৬৪ রকম মান , যেখানে বাইনারঈ বাইটে-এর থাকে ২৫৬ রকম মান। একটা ডিএনএ অণুকে একটা ডিজিটাল স্মৃতি-সংরক্ষন যন্ত্র হিসেবে ভাবা যেতে পারে, ঠিক একটা ইউএসবি ড্রাইভ এর মত। এর কারন ? প্রাকৃতিক খেয়ালে নিউক্লিওবেজ-এর উৎপত্তি হয়েছে, ট্রানজিসটরের মত কিছু নয়।

গণনা বা কম্পিউটেশন পদ্ধতি এক বিমূর্তরূপ হলো টুরিং মেশিন। ১৯৩৬ সালে লেখা তার সেই বিশ্বখ্যাত প্রবন্ধে বর্ণনা করেন তিনি এই পদ্ধতি। টুরিং মেশিন হলো সবচেয়ে সরলতম বিমূর্ত যন্ত্র যা কোন ধরনের গণনা করতে সক্ষম। যা কিনা একটা করে সংকেত পড়তে পারে, যেটা যন্ত্রের চলতি অবস্থার উপর প্রভাব ফেলতে অথবা নাও ফেলতে পারে। ব্যাস, এতটুকুই। কিন্তু এ যন্ত্রের তাৎপর্য কি ? তার জন্য আমাদের জানতে হবে চার্চ-টুরিং এর থিসিস সম্পর্কে, যেখানে বলে হয়েছে যেকোন ধরনের হিসেবপ্রক্রিয়া (calculation) তা যদি গণনাযোগ্য হয় (computable) তাহলে তা টুরিং যন্ত্র দিয়ে গণনা করা যাবে। এর মানে হলো যেকোন হিসেব, পদার্থবিদ্যা, প্রকৌশন অথবা অর্থনীতিগত, এমনকি যেসব গাণিতিক সমস্যা যেগুলো আমরা এখনো জানি না সমাধান সম্ভব কিনা সেগুলোও এই টুরিং মেশিন দারা গণনা করা সম্ভব। আরেকভাবে বলা যায়, টুরিং মেশিন হচ্ছে এমন একটা মৌলিক ধারনা যা বিমূর্তভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দেয় - "এই সমস্যা কি সমাধান করা সম্ভবপর ? " । এখনে ধর্তব্য বিষয় হচ্ছে সমাধান ছাড়াই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে এই উপায়।

এখন তাহলে প্রশ্ন হলো ডিএনএ কি একটি প্রকৃতিতে উদ্ভুত এক টুরিং যন্ত্র? হয়ত না, কিন্তু সেটি খুব সম্ভবত আংশিকভাবে টুরিং যন্ত্র। এই দুইয়ের গঠন কাঠামো তুলনা করে আমরা কিছু সামঞ্জস্য খুজে পাই।

টুরিং মেশিনে রয়েছে -
১। একটি টেপফিতা - যে টেপ ছোট ছোট চৌকনা কোষে বিভক্ত। প্রতিটি কোষ একটি নির্দিষ্ট সংকেত ধারন করার ক্ষমতা রাখে। সংকেতগুলো আবার কোন সসীম সংখক বর্ণমালার সেট থেকে আগত।
২। এক্টি হেড - এটি টেপের সমান্তরালে ডানে অথবা বামে অবস্থান পরিবর্তন করে সংকেত পাঠ করে।
৩। একটি স্টেট রেজিস্টের - যন্ত্রের অবস্থার তথ্য ধারন করে এই রেজিস্টার।
৪। নির্দেশনা টেবিল - যন্ত্রের অবস্থা এবং কোষে কোন সংকেত হেড পাঠ করছে তার উপর ভিত্তি করে এই টবিল থেকে একটি নির্দেশনা সম্পাদন করা হয়।

এখন যদি একে একটি জৈবিক কোষের সাথে তুলনা করি তাহলে কিন্তু অনেক বৈশিষ্ট্যই টুরিং মেশিনের সাথে মিল পাওয়া যায় -

টেপ <=> ডিএনএ
হেড <=> রাইবোজোম
স্টেট রেজিস্টার <=> আরএনএ
অবস্থা <=> এমিনো এসিড
নির্দেশনা টেবিল <=> ডিএনএ কোডন টেবিল
আউটপুট টেপ <=> প্রোটিন

আমাদের দেহের প্রতিটা কোষের মধে এক গভীর সামঞ্জস্য রয়েছেঃ এদের সবগুলোই হুবহু একই ডিএনএ ধারণ করে। এখন ডিএনএ যদি আমাদের দৈহিকগঠন, কোষকলা এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিভাবে তৈরী হবে সে সম্পর্কে তথ্য ধারন করে তাহলে স্নায়ু, পেশী, হাড় এসব ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় অবস্থিত কোষের মধ্যেকার ডিএনএ একরকম হবে ? এর উত্তর হচ্ছে, ডিএনএ খন্ডাংশ যাকে জিন বলা হয় সেগুলো সুইচের মত "অন" বা "অফ" করে দেওয়া হয় প্রতিটা কোষে। ত্বকের কোষ মস্তিস্কের নিউরণের থেকে ভিন্ন কারন ভিন্ন ভিন্ন জিন-কে চালু করা হয়েছে প্রত্যেক কোষে। যখন একটা জিনকে "অন" করা হয়, সেটা তখন এক ধরনের প্রোটিন উৎপন্ন করে যা কোষটা দেখতে কিরকম হবে এবং এর আচরন কিরূপ হবে তার উপর প্রভাব ফেলে। গর্ভধারনকালে, আমাদের অস্তিত্ব শুরু হয়ে একটামাত্র কোষ থেকে যাতে আমাদের দেহগঠন করার পুরো ডিএনএ-টা থাকে। পুরো দেহগঠনের পরিকল্পনার মোড়ক উম্মোচিত হয় এই একটি মাত্র আনুবিক্ষণিক কোষের মধ্যকার নির্দেশনাবলী থেকে। এই সাধারনবৈশিষ্ট্যধারী ডিম্বাণু থেকে পরিপূর্ন মানুষ তৈরী হবার জন্য ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন নির্দিষ্টপ্রকার বৈশিষ্ট্যধারী কোষ সঠিকভাবে সজ্জিত হতে হয়, এবং এর জন্য বিপুল সংখ্যক জিন-কে "অন" এবং "অফ" করতে হয় ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে, পরিবর্তনের নির্দিষ্ট ধাপে । অনেকটা ধ্রুপদী সংগীতের প্রতিটা নোট যেমন বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে বাজানো হয়ে থাকে, আমাদের দেহটা সেরকমি স্বতন্ত্র জীন-দের "অফ" আর "অন" হবার এক সুরসঙ্গীত, বেজে চলে আমাদের দৈহিক গঠনের সময় প্রতিটা কোষে কোষে। আর কোষের মধ্যকার ডিএনএ হলো সেই সংগীতের স্বরলিপি।

শুধু আমাদের দেহের ক্ষেত্রেই নয়। বিভিন্ন প্রাণী যেমন ইদুর, হাঙর এবং মাছির উপর গবেষনার পর গবেষনা করে দেখা গেছে সবধরনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, তা পাখনা হোক অথবা হাত-পা, এরা সবই একই ধরনের জীন থেকে তৈরী। এর মানে হলো, আমাদের জীবজগতের যে বিবর্তনীয় পরিবর্তনের মহাযজ্ঞ সাধিত হয়েছে, সেখানে পাখনা থেকে আঙ্গুল বিশিষ্ট হাত-পা তে বিবর্তনের জন্য কোন নতুন ডিএনএ-এর উৎপাদিত হয়নি।

প্রাণের ৪ বিলিয়ন বছরের ইতিহাস থেকে ঠিক পরিস্কার বোঝা যায় না ঠিক কবে থেকে ডিএনএ-এর যাত্রা শুরু হয়েছিলো। জীববিজ্ঞানীরা ধারনা করেন, প্রাণের আদিরূপগুলো খুব সম্ভবত আরএনএ ব্যবহার করত জীনগত উপাদান হিসেবে। তবে, আদিম জীনগত সিস্টেমের কোন সরাসরি তথ্য-উপাত্ত এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বেশীরভাগ জীবাশ্ম থেকে ডিএনএ উদ্ধার করা অসম্ভব ব্যাপার। এর কারন হলো ডিএনএ ১ মিলিয়ন বছরের বেশী পরিবেশে টিকে থাকতে পারেনা, আস্তে আস্তে ছোট ছোট অংশে ভেঙ্গে মিশে যায়। তবে ধারনা করা হয় ডিএনএ-এর গঠনে ব্যবহ্ররত উপাদানগুলো যেমনে এডিনাইন, গুয়ানাইন এবং অন্যান্য জৈবিক অণুগুলো খুব সম্ভবত পৃথিবীর বাইরে মহাশুন্যে গঠিত হয়েছিলো। ডিএনএ এবং আরএনএ জটিল জৈবযৌগ উরাসিল, সাইটোসিন এবং থাইমিন, এগুলো সবি ল্যাবরেটরীতে উৎপাদন করা গেছে মহাশুন্যের পরিবেশের অবস্থা তৈরী করে। প্রাথমিক রাসায়নিক উপাদান পাইরিমিডিন ব্যবহার করে যা উল্কাপিন্ডে পাওয়া যায়। পাইরিমিডিন, পলিসাইক্লিক এরম্যাটিক হাড্রোকার্বন বা পিএএইচ -এর মত, এই মহাবিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কার্বনধারী রাসায়নিক উপাদান এবং এটি খুব সম্ভবত উৎপন্ন হয়েছিলো লোহিত দানব নক্ষত্র অথবা মহাজাগতিক ধুলিকণা এবং গ্যাসের মেঘ থেকে।


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

অফিসে বসে বকেটু আধটু নেটে ঢোকা, পড়া বলতে চার-পাঁচ লাইন। কিন্তু আপনার লেখাটা পুরো না পড়ে থাকা গেলোনা। কাজে ফাঁকি দিয়ে পড়ে ফেললাম। চমৎকার লিখেছেন। আর ধন্যবাদ আরো একগুচ্ছ প্রসঙ্গের হদিস দেবার জন্য যা নিয়ে আরো পড়া যাবে। আশা করি আরো লিখবেন।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অবনীল এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

জটিলস্য সহজ বর্ণনা!

অবনীল এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- হাসি

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

শেহাব এর ছবি

পড়ে খুব ভাল লেগেছে। একটি ছোট্ট মন্তব্য। ট্যুরিং মেশিনের সার্বজনীনতা নিয়ে স্টিফেন উলফ্র্যামের উচ্ছ্বাস একটু শিশুসুলভ। পণ্ডিত লোকজন এটি নিয়ে নিয়মিত মজা করে। তবে এটি আপনার লেখার মূল বক্তব্য বা সাবলীলতা কোনটিরই ব্যাঘাত ঘটায় না।

অবনীল এর ছবি

মানুষটার একটু আমি আমি করার বাতিক আছে। একেএস এ এর প্রমাণ বিস্তর। যার জন্য অনেক মেইনস্ট্রীম পণ্ডিতগণ উনার উপর বিরক্ত। তারপরও কাজগুলো ইন্টারেস্টিং।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

ফারাবী এর ছবি

প্রকৃতির ব্যাপারটা আমার কাছে একটু অন্যরকম।

মানবসৃষ্ট সফটওয়্যার বা হার্ডওয়্যার-এর কার্যকারিতা "বাউন্ডারি কন্ডিশন" দিয়ে সীমাবদ্ধ। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে আইফোনের জন্য বানানো এপ এন্ড্রোয়েড ফোনে সম্পূর্ণ কাজ করবে না, কিংবা ১২০ ভোল্টের জন্য বানানো যন্ত্রাংশ ২২০ ভোল্টের সিস্টেমে ঠিকমতো কাজ করবে না। "বাউন্ডারি কন্ডিশন" -এর বাইরে চলে গেলে মানবসৃষ্ট যন্ত্রপাতি স্থবির হয়ে যায়, যদি না তাতে বাইরে থেকে হস্তক্ষেপ করা হয়।

অন্যদিকে প্রকৃতি একটা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। সব ধরণের কেসের জন্য প্রকৃতি সংজ্ঞায়িত; উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। পৃথিবীতে যেকোনো বস্তুর, জীব বা জড়, জীবনচক্র দেখলেই বোঝা যায় যে সব ধরণের পরিস্থিতির জন্য ওই বস্তু সংজ্ঞায়িত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বস্তুর গুনগত বিবর্তনও হতে পারে এবং সেটাও সজ্ঞায়িতই থাকে।

আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করি। প্রকৃতিতে যেকোনো বস্তুর সংজ্ঞায় হার্ডওয়্যার আর সফটওয়্যার (আমাদের ভাষায়) পরিস্থিতি অনুযায়ী একে অপরকে প্রতিক্রিয়া (ফিডব্যাক) দেয় এবং নিজেদেরকে হালনাগাদ (আপডেট) করে। ধরা যাক একজন ভদ্রলোক একটি দুর্ঘটনায় উনার বাম পা হারান। তখন উনার মস্তিস্ক (সফটওয়্যার) উনার নতুন এই বাহ্যিক অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রথমে নিজে আপডেট হয় (মানে বাম পা নামক অঙ্গটি এখন শরীরে অনুপস্থিত)। তারপর সম্ভাব্য নতুন পরিস্থিতির উনার শরীরকে প্রশিক্ষিত করে মস্তিস্ক। কোনো কোনো জীব আবার অঙ্গচ্ছেদের শিকার হলে পুনরায় প্রাকৃতিকভাবেই নিজেদের মেরামত করতে পারে (গাছের কথা বলা যায় এখানে)।

অবনীল এর ছবি

মানবসৃষ্ট সফটওয়্যার বা হার্ডওয়্যার-এর কার্যকারিতা "বাউন্ডারি কন্ডিশন" দিয়ে সীমাবদ্ধ। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে আইফোনের জন্য বানানো এপ এন্ড্রোয়েড ফোনে সম্পূর্ণ কাজ করবে না, কিংবা ১২০ ভোল্টের জন্য বানানো যন্ত্রাংশ ২২০ ভোল্টের সিস্টেমে ঠিকমতো কাজ করবে না।

এর সাথে কিন্তু প্রকৃতির একটা বৈশিষ্ট্যের সাথে দারুণ মিল আছে লক্ষ্য করেছেন কি ? যেমন ধরুন ঘোড়া এবং গাধা বা মিউল , এরা প্রায় একই রকম বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলেও প্রজননে অক্ষম, তাঁর মানে এদের ডিএনএ কোড কম্প্যাটিবল নয়। তাই এই বাউন্ডারি কন্ডিশান প্রকৃতিতেও বিদ্যমান এভাবে চিন্তা করলে।

আপনার দ্বিতীয় পর্যবেক্ষনের বিপক্ষে কিন্তু একটা প্রতি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সবকিছুই যদি সংজ্ঞায়িত হয়ে থাকে তাহলে আমরা প্রাণের কোন পর্যায় থেকে তাকে সচেতন (বা কন্সাস) বলবও ? একটা পরজীবী ব্যাকটেরিয়া বা একটা টিটোফাজ ভাইরাস কি সচেতন ? কিভাবে এর ত কোন নিউরনের বা নার্ভেরই উপস্থিতি নেই । তারপরও তারা পারিপার্হিকের সাথে এমনভাবে ইন্টারাক্ট করেছে যেন সেখানে সচেতন ইচ্ছার প্রতিভলন ঘটছে ? তাই জীব জড় এভাবে ভাগ করতে এখন বিজ্ঞানীরা নারাজ, বরং সচেতনতা একটা এক্সপেক্ট্রামে ফেলে বিচার করতে পছন্দ করেন। এ নিয়ে পরে আরও বিশদভাবে লেখার ইচ্ছে আছে।

এটা আরেকটা দারুণ টপিক টেনে এনেছেন। এটা নিয়েও নতুন গবেষণা গুলো চমকপ্রদ। শুধু হাত বা পা নয়ে। আপনার দৃষ্টের সাথে সম্পর্কিত নার্ভগুলো যদি ড্যামেজ হয়ে যায়, পরবর্তিতে দেখা যায় মস্তিষ্কের যে অংশটা দৃষ্টি প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত ছিল সেটা হয়ত কানের কার্যাবলীতে নিয়োজিত হয়ে গেছে। তারমানে আমাদের মস্তিক্সের অংশগুলোও সতন্ত্র নয় , নিম্নস্তএর এরা একইভাবে নিজেদেরকে শিখিয়ে বা পুনঃশিক্ষিত করতে পারে।

অংগপ্রতিস্থাপনের যে উদাহরণ দিলেন, সেটা নিয়ে দারুণ গবেষণা হচ্ছে এখন। এমনকি দেখা গেছে কোষএর আভ্যন্তরীণ কোডকে পরিবর্তন করে দুজোড়ার স্থানে তিঞ্জোড়া পা তইরী করা গেছে। একেবারে প্রফেসর হিজিবিজবিজ মার্কা অবস্থা। পড়ে সময়ে পেলে আরও বিস্তারিতভাবে লিখবো এ নিয়ে। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

এক লহমা এর ছবি

এই তত্ত্বটা আমার খুব পছন্দের। আমি জানতাম কেউ না কেউ আমার আগেই এটা নিয়ে লিখে ফেলবে। আর তারপর আপনারা সবাই সেটাকে নিয়ে মেতে উঠবেন। দেঁতো হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অবনীল এর ছবি

আমারও কিন্তু অনেকদিন ধরে ঘুরপাক খাচ্ছিল এ নিয়ে লিখবার ইচ্ছা। সময়করে উঠতে পারিনি। কমপক্ষে বছর পাঁচেক আগে প্ল্যান করে রেখেছিলাম। তারপর আর হয়ে ওঠেনি। আপনিও লিখুন আপনার মতো করে ! অনেককিছু ভাবার টপিক আছে এখানে। ধন্যবাদ ।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।