সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ পড়াটা কেন জরুরী

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি
লিখেছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর (তারিখ: সোম, ২২/০২/২০১৬ - ৪:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


১.
আমি যে ইতিহাস নির্ভর উপন্যাসের ঘোরতর বিরোধী লোক, তা অন্তর্জালের আনাচে কানাচে একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে। আমি বরাবর এই পন্থার বিরোধীতা করে আসছি। কারন ইতিহাস নির্ভর গল্প বলার সুবিধা আর স্বাধীনতার অপব্যবহার করে অনেক অসত্য তথ্য মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যেখানে এমনিতেই ছড়িয়ে আছে প্রচুর বিভ্রান্তি। বছরের পর বছর ধরে স্বাধীনতাবিরোধীরা অসত্য ইতিহাস লোকের মগজে ছড়িয়ে দিয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছড়ানোর জন্য গল্প উপন্যাস খুবই বিপজ্জনক পন্থা। মেহেরজান তো এখনো দগদগে স্মৃতি। তাই এই ধারাটা জনপ্রিয় হোক চাই না।

কিন্তু এতো বলেও কাউকে থামানো যায় না, সবাই শুধু উপন্যাস পড়েই ইতিহাস জানতে চায়। তাও বেশি না, একটা বই পড়েই জানতে চায় সবটা। ‘ভাইয়া, একটা বইয়ের নাম বলেন না, যা পড়লে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে মোটামুটি একটা ঠিকঠাক ধারণা পাওয়া যাবে’। এতদিন খুব মুশকিল ছিলো এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। গতবছর থেকে ব্যাপারটা সোজা হয়ে গেছে। খুব ভাব নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে এখন বলি ‘শুধু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে জানলে তো হবে না, পরের পল্টিবাজীর ইতিহাসগুলোও জানতে হবে’। প্রশ্নকর্তা বা কর্তিনী তখন আরো অসহায় হয়ে বলে ‘এতোকিছু কিভাবে জানতে পারবো ভাইয়া? এতো বই কবে পড়বো?’ তখন আমি আরো বেশি জ্ঞানী ভাব নিয়ে বলি ‘একটা বই পড়লেই মোটামুটি একটা ঠিকঠাক ধারণা পাওয়া যাইতে পারে, পইড়া দেখতে পারেন’। তখন প্রশ্নকর্তা বা কর্তিনী খুব উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে ‘কী বই ভাইয়া? কী বই? কার লেখা বই ভাইয়া? কার লেখা বই?’ আমি তখন ততোধিক ভাব নিয়ে বলি ‘খালি তো হুমায়ুন আহমেদ আনিসুল হকদের বই পড়েন, তাইলে হবে? সুহান রিজওয়ানের সাক্ষী ছিলো শিরোস্ত্রাণ বইটা পইড়া দেইখেন, বিফলে মূল্য ফেরত’।
এক বছর পার হয়ে গেছে, এখনতক কাউকে মূল্য ফেরত দিতে হয় নাই। আশাকরী কষ্মিনকালেও দিতে হবে না। অতএব হে মহামান্য পাঠক, মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী ইতিহাসের মূল ধারাটা যদি ঠিকঠাক জানতে চান, তাইলে আর দেরি না করে সুহানের লেখা সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ বইটা পড়ে ফেলেন। আবারো বলি, বিফলে মূল্য ফেরত চোখ টিপি

২.
বইটি নিয়ে অনেক কথা বলা যায়, কিন্তু সবচেয়ে বেশি যে কথাটা বলা যায় তা হলো এ একটা দারুণ সাহসী কাজ হয়েছে। অনেকগুলো বছর ধরেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে প্রচুর পড়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু যতোই জানি, ততোই যেন অজানা থেকে যায়। যুদ্ধ, যুদ্ধের রাজনীতি, পক্ষ প্রতিপক্ষ... জানতে জানতে হয়রান হয়ে যাই। এ যেন এক বিশাল ক্যানভাস, যার প্রতিটি ক্ষুদ্র ফোঁটার পেছনে রয়েছে আরো বিশাল সব ক্যানভাস। এই বিশাল প্রেক্ষাপট নিয়ে উপন্যাস লেখা চাট্টি চাট্টি আট্টি কিংবা আট্টি আট্টি ষোলটি কথাও না, তারচেয়ে বেশি কিছু। সুহান সেই বিশাল কাজটা করে ফেলেছে। মনগড়া কিছুও লেখেনি, একেবারে বইপত্র পড়ে ঠিক ইতিহাসটুকু জেনে সেগুলোকে সাজিয়েছে উপন্যাসের আদলে। এরকম একটা উপন্যাস লেখা তো দূরের কথা, চিন্তা করতেও বিশাল কলিজা লাগে। সুহান চিন্তা করে, কয়েক বছর একটানা খাটা খাটুনি করে, নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে, পড়াশোনা করে উপন্যাসটা লিখে প্রকাশও করে ফেলেছে। তাঁকে স্যালুট জানানো ছাড়া উপায় নেই।

৩.
এটুকু জোর দিয়ে বলা যায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সহজ করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য এরকম একটি বইয়ের খুব দরকার ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আরো অনেক কিছু করার আছে, যে পরিমান অপপ্রচার চালানো হয়েছে এবং হচ্ছে এখনো, তার বিরুদ্ধে লড়তে হবে অনেক অনেক বেশি। সেই লড়াইয়ে সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সংযোজন। পরবর্তী সুহানেরা এখান থেকে নতুন করে শুরু করতে পারবে।

৪.
এতক্ষণ ধরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলে এলেও সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ মূলত তাজউদ্দীন আহমেদের জীবনী। কিন্তু ২৫ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত যে তাজউদ্দীন আহমেদ, তাঁকে আঁকতে গেলে আসলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী ইতিহাসের পুরোটাই আঁকতে হয়। কারন তাজউদ্দীন আহমেদ এবং বাংলাদেশের ইতিহাস সমান্তরাল। সুহান তাই যতোই তাজউদ্দীন আহমেদের জীবনী লেখার চেষ্টা করুক, তা হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী বাংলাদেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়ের ইতিহাস।

৫.
বইয়ের নাম: সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ
লেখক: সুহান রিজওয়ান
বর্তমান প্রকাশক: ঐতিহ্য
একুশে বইমেলার স্টল নং: ২৬০
মূল্য: লেখা আছে ৭০০ টাকা, মেলার ছাড়ের পর ৫২৫ টাকা
প্রচ্ছদ: স্যাম'দা


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ শব্দটা হয়ত অতি ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গেছে, তারপরও বলি এই বইটা অসাধারণ। বইয়ে উল্লিখিত ইতিহাসগুলো ছাড়া ছাড়া ভাবে জানা থাকলেও একসাথে পড়ার অনুভূতিটা চমৎকার। এক বসায় বইটা পড়েছিলাম, মনে হয়েছিল কোন টানটান থ্রিলার পড়ছি।

- আতোকেন

অতিথি লেখক এর ছবি

বইটার কথা খুব শুনেছি। আপনার লেখাটা পড়ে বইটা পড়া এখন অিনিবার্য হয়ে উঠলো। ধন্যবাদ।

সোহেল ইমাম

অতিথি লেখক এর ছবি

কালকেই কিনে ফেলব।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ এতী সুন্দর রিভিউয়ের জন্যে। কেনা হয়ে গেছে, শুধু পড়া বাকি।

বলদ মানুষ

Hafiz এর ছবি

Sorry to type in English. I am just wondering - if I could buy the electronic version of this book from some website or not. Thank you.
- Hafiz

অতিথি লেখক এর ছবি

জ্বী, আপনি বইদ্বীপ থেকে কিনতে পারেন।

রানা মেহের এর ছবি

সুন্দর রিভিউ নজু ভাই কিন্তু একটু দ্বিমত করি।

প্রথমত - ফিকশন পড়ে ইতিহাস জানার চেষ্টা বিপজ্জনক অভ্যাস। যে সাক্ষী ছিল কিংবা ক্রাচের কর্ণেল পড়ে পচাত্তরের ইতিহাস জানতে চায় পরের ধাপে দেয়াল পড়ে ইতিহাস জানতে চাইবে। এই প্রবণতা খারাপ। ইতিহাস জানতে চাইলে ইতিহাস পড়তে হবে, ফিকশন না।

দ্বিতীয়ত - একটা বই পড়ে মুক্তিযুদ্ধের মতো বিশাল ক্যানভাস জানতে চাওয়াটা একটু বেশি।এই বইয়েরও নিশ্চই কোন্ না কোন খামতি আছে। সচলেই একটা লেখা এসেছিল এখানে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুকে খুব অল্প কথায় আনা হয়েছে। এখন শুধু এই বই যে পড়বে সে কি অসম্পুর্ন জানবেনা?

স্যরি ভাই সুহান, আমার কথাকে অন্যভাবে নেবেন না প্লিজ। এই বইটা পড়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি। শুধু শংকার কথাগুলো লিখলাম।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

হাসিব এর ছবি

প্রথম পয়েন্টটা আমার জন্য একটা বিগ অফ। দ্বিতীয়ত, গত বছর এরকম একটা সংকটজনক সময়ে এই বইয়ের লেখক বইটা রকমারিতে পাওয়া যাচ্ছে বলে বিজ্ঞাপন দিয়ে বেড়িয়েছেন। অভিজিত প্রসঙ্গে রকমারিকে যেখানে বয়কট করা হচ্ছিল তখন লেখকের এহেন অবস্থান খুবি পীড়াদায়ক ছিল। গত বইমেলাতেই আমার সিদ্ধান্ত রকমারির বিজ্ঞাপন দিয়ে যারা বই বেচে তাদের বই কিনব না।

রানা মেহের এর ছবি

লেখক বোধহয় রকমারী থেকে বই উইথড্র করে নিয়েছিলেন হাসিব ভাই।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

নীড় সন্ধানী এর ছবি

সুহান রিজওয়ান যে কাজটি করেছে বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখক সেটি করতে পারেনি। এই বইটি উপন্যাস হলেও ইতিহাসের অনিবার্য কিছু উপাদানের জন্য বইটি পড়া আবশ্যক। আমি বলবো যেসব আম জনতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়তে আগ্রহী, কিন্তু যাদের পক্ষে সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ বই যোগাড় করা সম্ভব না, তারা এখানে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে যাবেন। সেই কারণেই বইটি অনন্য। এটি একটি ফিকশন এটি মনে রেখে পড়লেও বইটার শেষে সংযোজিত তালিকা দেখে তথ্যসুত্র অনুসন্ধান করতে পারবে যে কোন পাঠক।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

দেবদ্যুতি এর ছবি

চলুক

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

ঈয়াসীন এর ছবি

চলুক

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

Ahmed  এর ছবি

First my apology for typing in English - I am very weak at using other available fonts.

My thanks for suggesting the book. In a similar note, have any of you read Mahbub Alam's "Guerilla Theke Shommukh Juddho"? I have found this to be the best (so far) to vividly describe the day to day operations of Muktibahini. It touches the training process, the training camps, have hand-drawn maps, the initial operations to find sources and links inside Panchagar area (4- miles inside border), 'take out' razakars and collaborators, destroy bridges and telephone comms, firefights with regular Pakistani troops. Trained by the BSF, until June-July they were camped in the Indian side of border. Later, for more impact, the group was ordered to move inside Bangladesh and have camp inside Bangladesh. Towards the end of the war, they went under the command of Bangladesh Army and had to go through vicious battles like regular troops. Very interesting read.

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।