বইপড়াকথা: মহাবিপদ সংকেত

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি
লিখেছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর (তারিখ: বুধ, ১৯/০৭/২০১৭ - ৫:০৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের সামরিক ঘটনাগুলো নিয়ে সকলের আগ্রহ। অনেক রহস্যে আবৃত থাকলেও এ সম্পর্কে তবু কিছুটা লেখালেখি হয়েছে। অনেকের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ, গবেষণার মাধ্যমে সময়টাকে এখন অনেকটা বোধের নাগালে আনা গেছে। চরিত্রগুলোকে চেনা গেছে।

কিন্তু তখন সামরিক বাহিনীতে যেমন চলছিলো প্রচণ্ড অস্থিরতা, ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ মরছিলো। ঠিক একই কাণ্ড ঘটছিলো আরেকটি সেক্টরে। দেশের শিক্ষিত কিশোর তরুণ যুবাদের একটা বড় অংশ বিপ্লবের নামে খতমের লাইনে মেতে উঠেছিলো। আর তাদেরকে সেই কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিলো একদল রাজনৈতিক নেতা। সেই ভুল বিপ্লবের খেসারত হিসেবে বাংলাদেশের অজস্র তরুণ তাজা প্রাণ ঝরে গেছে সেই সময়ে।

এই সময়টা নিয়ে লেখালেখি খুব বেশি হয়নি বাংলাদেশে। খুব বেশি হয়নি না বলে বলা উচিত 'একেবারেই হয়নি'। অথচ হওয়াটা ভীষণ জরুরী ছিলো।
বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রটি যাতে ভবিষ্যতে একটা লম্বা সময় বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতায় ভোগে, সেজন্য আল বদরদের সহায়তায় পাকিস্তানীরা বেছে বেছে হত্যা করেছিলো আমাদের সেরা সন্তানদের। আর যুদ্ধের পরে যে উদ্যমী তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিতে পারতো, সেই মেধাবী প্রজন্মর একটা বড় অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে স্বাধীনতা পরবর্তী ভুল বিপ্লবের বলি হয়ে।

একই কাজ পশ্চিমবঙ্গেও হয়েছে। চারু মজুমদারের নেতৃত্বে। মূলত তারই রেশ এসে পৌঁছেছিলো বাংলাদেশে। পশ্চিমবঙ্গে এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হলেও বাংলাদেশ যেন ভুলেই যেতে চেয়েছে এই অধ্যায়টি।
সামান্য যেটুকু লেখা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শাহরিয়ার কবির এর 'ওদের জানিয়ে দাও'। এই বইটি অনেক আগেই পড়া ছিলো, বড্ড প্রিয় বই। কিন্তু পড়া ছিলো না শাহরিয়ার কবিরের গল্পগ্রন্থ 'মহাবিপদ সংকেত'।

মহাবিপদ সংকেত, দূরত্ব, অবিচ্ছিন্ন দ্বীপ, পিতার শবানুগমন, বেঁচে থাকা... এই পাঁচটি গল্প নিয়ে বইটি। বিদ্যাপ্রকাশের ব্যানারে ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত। এই পাঁচটি গল্পে শাহরিয়ার কবির আঁকতে চেষ্টা করেছেন ঐ সময়ের চরিত্রগুলোকে। বিপ্লব যখন খতমের লাইনে হাঁটবে নাকি মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করে ক্ষেত্র তৈরির পথে হাঁটবে এই দ্বিধা এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বিভক্ত, পার্টির নির্দেশে নিজ হাতে হত্যা করতে হচ্ছে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে, অস্বীকার করতে হচ্ছে জন্মদাতা পিতাকে... সেই সময়ের গল্পগ্রন্থ 'মহাবিপদ সংকেত'।

গল্পগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রান্তিক কর্মীদের কথাই উঠে এসেছে। যাঁরা সাম্যবাদের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলো। কিন্তু তাঁদেরকে যারা ভুল বিপ্লবের দীক্ষা দিলো সেই নেতাদের চরিত্র গল্পগুলোতে তেমন আসেনি। এলে ভালো হতো বেশি। পাঠক সময়টাকে বুঝতে পারতো আরো ভালোভাবে। বা পাশাপাশি ঐ সময়ের বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি থাকতো গল্পগুলোতে, তাহলেও পাঠক সামগ্রিক চিত্রটা বুঝতে পারতো। হয়নি।

তবু জাফর, নীনা, মিলন, খোকা, স্বপন, হাসনাত ভাই, খোকন, শেখ আমজাদ আলী, স্বাতী, তাপু, আসিফ, হালিম ভাই, টুকু, রফিক, কামাল, দিপু, মির্জা, ফরহাদ নামের মানুষগুলো পাঠককে নিয়ে যায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে দ্বন্দ্বমুখর সময়ে। এই যারা আজ আমরা ফেসবুকে বিপ্লব করে ফাটিয়ে ফেলছি, তাঁদের মুখোমুখি দাঁড় করায় হারিয়ে যাওয়া এক উত্তাল সময়কে। ঐ সময়ের মুখোমুখি হওয়াটা এখন আমাদের খুব জরুরী। নিজেকে চেনার জন্য, নিজের ইতিহাসকে জানার জন্য।

নানাবিধ অপ্রাপ্তি সত্ত্বেও তাই এই বইটি গুরুত্বপূর্ণ। ঐ সময়ের মানুষগুলো এখনো অনেকেই বেঁচে আছেন। মাথার ওপর রাষ্ট্রীয় হুলিয়া আর দলীয় খতমের আদেশ নিয়েও যাঁরা এখনো বেঁচে আছেন, তাঁদের স্মৃতিকথাগুলো ধরে রাখা খুব জরুরী। তালে হয়তো আজকের বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের হতাশার জবাবগুলো পাওয়া যাবে।

[বই কৃতজ্ঞতা: দূর্লভ নিবরাস আহমেদ]


মন্তব্য

Emran  এর ছবি

পূবের সূর্য এবং মহাবিপদ সংকেত পড়ে আমার কাছে শাহরিয়ার কবিরকে আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে মনে হয়নি। আওয়ামী লীগে তাঁর হিজরত ঠিক কোন দশকে ঘটলো?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

শাহরিয়ার কবির কি আওয়ামী লীগ বা তার কোন অঙ্গ সংগঠন বা সহযোগী সংগঠনের সদস্য? জানতে পারিনি। আপনার জানা থাকলে জানাবেন। তাঁকে কখনো আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডের অ্যাপোলজিস্ট হিসেবে আবির্ভূত হতেও দেখিনি। এর ব্যতিক্রম থাকলেও জানাবেন। বরং কিছু কিছু প্রশ্নে শাহরিয়ার কবিরকে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচক হিসেবেও দেখেছি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ইয়ামেন এর ছবি

যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবীর ইস্যুতে লীগের সাথে মতৈক্য হয়েছে, এই যা। এ ছাড়া জানামতে শাহরিয়ার কবির কখনও কোনকালে লীগের কোন সংগঠনের সদস্য আছেন বা ছিলেন বলে তো জানা নাই। জানার ভুল থাকলে আমিও সেই ভুল শুধরাতে ইচ্ছুক।

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার সুপাঠ্য আলোচনা পড়ে বইটার ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ জন্মেছে। দ্রুত জোগাড় করে পড়ে নেব।

তবে একটা বিষয় প্রায়ই আমাকে ভাবায়। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শাহরিয়ার কবির সাহেবের বয়স ছিল ২০-২১ বছর। টগবগে তরতাজা যুবক।

"এখন যৌবন যার,
যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়"

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্তাল নয় মাস সময় উনি কিভাবে কাটিয়েছেন এই ব্যাপারে কি উনি উনার কোন বইয়ে স্মৃতিচারনমূলক কোন বর্ননা দিয়েছেন? উনার মাপের একজন লেখক এই সময়টার নিজস্ব লেখনীতে ধারন করবেন না এটা ভাবতে আমার কষ্ট হয়। আপনার কি চোখে পড়েছে? সম্ভব হলে জানাবেন। আমার পড়ে নি।

ধন্যবাদ।

-ইকরাম ফরিদ চৌধুরী

নিঃসঙ্গ গ্রহচারী  এর ছবি

খুব সম্ভবত কলকাতায় ছিলেন। জহির রায়হানের এসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করেছেন স্টপ জেনোসাইডে। 'পূবের সূর্য'ও মনে হয় এসময় লেখা।

মেঘলা মানুষ এর ছবি

জীবনে আমি খুব বেশি বই পড়িনি, তবি আশ্চর্যজনকভাবে, এই বইটা পড়েছিলাম। শাহরিয়ার কবিরের একটা কিশোর উপন্যাস পড়েছিলাম 'র ন‌গরে আজব সার্কাস'। কিশোর উপন্যাস পড়ার বয়সে ছিল আমার, গোয়েন্দা কাহিনী আর দার্জিলিং এর মত ছবির বর্ণনা থাকায় বইটে মনে ধরেছিল খুব। সার্কাসের সঙ 'ফড়ে' -কে আজও মনে পড়ে। যেই ঝোঁকের বসে, বইমেলায় 'মহাবিপদ সংকেত' কিনে ফেলেছিলাম। তখন ক্লাস সেভেনে পড়া (সম্ভবত) কিশোরের কাছে এই বই 'মাথামুন্ডু হীন" লেগেছে, পড়ে বিরক্ত হয়েছি, কিছুই বুঝি নি। এবং ঠিক করেছিলাম, এই লেখকের বই আর কিনবো না রেগে টং । লেখকের বাইরে তার কোন পরিচয় আমার জানা ছিল না।

বইটা ঘরের কোণেই পড়ে ছিল অনেক বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর, পড়ার তৃষ্ণায় বইটা হাতে নিয়ে পড়তে গিয়ে সত্যি বলতে ধাক্কা খেয়েছিলাম। এরকম অন্য কোন বই আমার পড়া ছিল না। আর আগের বার বার/তের বছর বয়সে পড়ে আসলেই কিছু বুঝি নি, কিছুই বুঝি নি। আমার এক মামাস্থানীয় লোকও এই খতমের লাইনের সাথে ছিলেন, যেটা উনি আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর আমাদের বলেছিলেন। উনি শ্রেণী শত্রুর 'তদন্ত' করতেন, উপরে রিপোর্ট করতেন। উনি আবার অন্য জায়গায় তদন্তে যেতেন। রিপোর্ট অনুযায়ী উপর থেকে অন্য টিম পাঠানো হতো 'কাজ' শেষ করার জন্য।

বইয়ের সাহিত্যগুণ বিচার করার মত জ্ঞান আমার নেই, তবে চরিত্রগুলোর প্রতি মায়া জন্মেছিল। এত এত মৃত্যু, পদে পদে মৃত্যু কিংবা মৃত্যুভয়! সেফহাইজগুলো সেফ নাকি ফাঁদ -সেটা নিয়ে আমিও উৎকন্ঠিত হয়েছিলাম। খারাপ লেগেছিল ওদের জন্য।

আপনার সাথে একমত, এই বিষয়গুলো নিয়ে আামাদের কোন সাহিত্য নেই, গল্প নেই। যেন আমার ঐ মামার মত কারও অস্তিত্বই ছিল না এই দেশে।

শুভেচ্ছা হাসি

সোহেল ইমাম এর ছবি

বাংলাদেশের এই বিপ্লবীদের সম্পর্কে ভালো করে জানা নেই। আবছা কিছু ধারণা মাত্র আছে। এই বইটা দেখে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু গল্প গ্রন্থ দেখে একটু দমে গেছি। এ বিষয়ে একটু বড় আকারে ইতিহাস ভিত্তিক প্রবন্ধগ্রন্থ কি কি আছে? কমিউনিস্ট রাজনীতি বিষয়ক ইতহাস গ্রন্থ গুলোর মধ্যে কি পাওয়া যাবে? গল্পগ্রন্থ হলেও এই বইটাও পড়ে দেখার ইচ্ছে আছে। এই বইটার উল্লেখ করবার জন্য ধন্যবাদ নজরুল ভাই।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

ভালো লাগল গ্রন্থালোচনা। বইগুলোর কোনোটিই পড়া হয় নি। 'ওদের জানিয়ে দাও' কি নন-ফিকশান? এই বিষয়ে আর কয়েকটা নন-ফিকশান বইয়ের নাম জানতে চাই।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অতিথি লেখক এর ছবি

'ওদের জানিয়ে দাও' ফিকশন।

অনন্যা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।