মুভি রিভিউঃ লুপার

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী (তারিখ: রবি, ৩০/০৯/২০১২ - ৪:৩২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঠিক এই সময়ের সায়েন্স ফিকশন মুভিগুলার দুটা ভিন্ন রূপ খুব দেখা যাচ্ছে। প্রথম রূপটায় অসাধারণ গ্রাফিক্সের সাথে দুর্দান্ত এ্যাকশন থাকছে কিন্তু অনেক সময়ই গল্প খোঁড়া হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু যে ভালো গল্প থাকছে না, তা নয়। তবে অধিকাংশ সময়ই চাকচিক্যের সাথে গল্পের গভীরতার সরল রৈখিক সম্পর্ক দেখা যায় না। অন্যদিকে আরেকটা রূপ দেখা যাচ্ছে যেখানে গল্পই মুভির মূল উপজীব্য। মুভিকে চাকচিক্য দিয়ে সাজানোর দিকে পরিচালকের নজর তেমন একটা থাকে না। “ডিসস্ট্রিক্ট নাইন”-এর কথা হয়তো মনে আছে অনেকের। এরপর এসেছে “মুন”, “সোর্স কোড”, “সুপার এইট” কিম্বা একদম নূতন “লুপার”। এই মুভিগুলোতে সায়েন্স ফিকশনের মাধ্যমে শুধুই চাকচিক্য দেখানোর পরিবর্তে মানবিক আবেদনকে একটা বড় ফ্রেমে বাঁধিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

ভূমিকাটা মনে হয় বড় হয়ে যাচ্ছে। তাই কথা না বাড়িয়ে যে মুভির রিভিউ লিখতে বসেছি সেটা নিয়েই কথা বলা ভালো। হ্যা, লুপার এমনই একটা সায়েন্স ফিকশন। সাদাসিধে সেটে ২০৪৪ সন। “পৃথিবী অসাধারণ উন্নত হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে” না দেখিয়ে বরং ধনী ও গরীবের বৈষম্য যে আরো প্রকট হয়ে উঠবে সেটা নগ্ন ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তখনও মানুষ খাবারের জন্যে অন্যের কাছে হাত পাতে, তখনও সন্ত্রাস ছড়িয়ে আছে সমাজের বুকে। কিছু মানুষ কল্পনাতীত ধনী, তো কিছু মানুষ চরম দরিদ্র। ঠিক এরকম প্রেক্ষাপটে এক ধরনের কর্মজীবি মানুষের দেখা পাওয়া যায়। তাদের নাম “লুপার”। ২০৭৪ সনের একটা মাফিয়া সংস্থা রয়েছে চীনের সাংহাইতে। সে সময়ের সমাজে খুন করে ডেডবডি গায়েব করা প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু হত্যা-হানাহানি তো আর বন্ধ থাকতে পারে না! তাই “রেইনমেকার” বলে একজন একটা সমাধান বের করে। সমাধানটা এরকম – মাফিয়ারা ভিকটিমকে না মেরে বরং হাত-পা-মাথা বেঁধে টাইম মেশিনে করে ২০৪৪ সনের কেনসাস সিটিতে পাঠিয়ে দিত। সেখানে ভিকটিমকে মারার জন্য অস্ত্র হাতে প্রস্তুত থাকতো একজন, যার পরিচয় আগেই দেয়া হয়েছে, অর্থাৎ লুপার। সে ভিকটিমকে মেরে ডেডবডি পুড়িয়ে দিত। ভিকটিমকে ভবিষ্যত থেকে পাঠানোর সময় তার পিঠে বেঁধে দেয়া হত রূপার বার। ওটাই ছিল লুপারের পেমেন্ট। লুপারদের দেখাশোনা করতো ভবিষ্যত থেকে আসা একজন যে কঠিন হাতে নিয়ন্ত্রণ করতো পুরো ব্যবস্থাটা। প্রত্যেক লুপারের জন্যে সে একটা কঠিন শর্ত বেঁধে দিয়েছিল। ভিকটিম যেন কোন ভাবে মুক্তি না পায়, এমন কি ভিকটিম তার নিজের ভবিষ্যতের সংস্করণ হলেও!

তবে লুপারদের জন্যে হত্যার কাজটা চলতেই থাকতো না। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তারা হত্যা করতো। ঐ নির্দিষ্ট সময়টাকে বলা হয় “লুপ ক্লোজ” করা। অর্থাৎ যখন তারা তাদের নিজেদের ভবিষ্যত সংস্করণকে হত্যা করে, তখন একটা লুপ বন্ধ হয়ে যায়। তাদের কাজেরও ছুটি তখন থেকে। এরপর তাদের জন্যে বিশেষ রিটায়ারমেন্ট প্যাকেজ থাকে। শেষ হত্যার জন্যে তারা রূপার পরিবর্তে পায় সোনার বার; এবং তারপর শুরু করে এক আয়েসী জীবন। চিন্তাহীন আনন্দময় জীবন। জো হচ্ছে এমনই এক লুপার যে এই আনন্দময় জীবনের অপেক্ষায় ছিল। রূপার বার দিয়ে সে তার ফ্ল্যাটের নীচে স্তুপ করে তুলছিল আর দিন গুনছিল সোনার বারের। এক সময় সেদিন এলো, কিন্তু সোনার বারেই ঘায়েল হলো জো। ভিকটিম ছিল জো-এর ২০৭৪ সংস্করণ। কিন্তু হাত-পা-মাথা বাঁধা থাকার পরিবর্তে ভিকটিম দিব্যি খোলামেলা অবস্থায় ২০৪৪-এ এসে ল্যান্ড করে। তারপর সোনার বার ছুড়ে মেরে প্রথমে জো কে ঘায়েল করে, তারপর এক পাঞ্চে অচেতন। জোর যখন জ্ঞান ফিরে তখন তার “মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল” অবস্থা। নিজের আরেক অস্তিত্বকে হত্যা না করলে ওকে হত্যা করবে মাফিয়ারা। আর অন্য দিকে জোর ভবিষ্যত সংস্করণ খুঁজতে থাকে এই পুরো প্রক্রিয়াটার মাস্টারমাইন্ড রেইনমেকারের শিশু সংস্করণকে; কেননা সে বিশ্বাস করে এই শিশুকে যদি হত্যা করা হয় তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরনের হত্যা-ব্যবস্থার প্রচলনই হবে না। অনেকে মনে করছেন হয়তো গল্পের অনেকটা বলে ফেলেছি। আসলে তা নয়। ঠিক যতটুকু বললে প্রেক্ষাপটটা পরিষ্কার হয়, ততটুকুই বলেছি। প্রশ্ন অনেকগুলো এরই মধ্যে উত্তর খুঁজে পায় নি। জোর ২০৭৪ সংস্করণ কেন হাত খোলা অবস্থায় ছিল? সে রেইনমেকারকে মেরে এই প্রক্রিয়াটা বন্ধ করতে চাচ্ছে কেন? এবং সবচেয়ে বড় যে প্রশ্ন – সে কি সফল হয়েছিল?

ঠিক এই সময়ে লাইমলাইটে থাকা – ডার্ক নাইট রাইজেস, প্রিমিয়াম রাশ, জি আই জো ২ এর মার্কিন অভিনেতা – জোসেফ গর্ডন-লিভিট ২০৪৪ সনের জোর ভূমিকার অভিনয় করেছে লুপারে। ব্রুস উইলিস অভিনয় করেছে জোর ২০৭৪ ভূমিকায় এবং ব্রিটিশ অভিনেত্রী এমিলি ব্লান্ট অভিনয় করেছে রেইনমেকারের মার ভূমিকায়। তবে সবচেয়ে দুর্দান্ত অভিনয় করেছে রেইনমেকারের শিশু ভূমিকায় পিয়ার্স গ্যাগনন। পিচ্চির যে এক্সপ্রেশন! পুরো সিনেমা হাসিতে ফেটে পড়ছিল একেক সময়। মাত্র ৩০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে মুভিটা। বক্স-অফিসের কথা জানি না, কিন্তু ক্রিটিকরা বেশ ভালো রিভিউ দিয়েছে। রোটেনটমাটো-তে ১৭০ জনের রিভিউতে ৯৩ শতাংশ পজেটিভ ভোট পেয়ে বসে আছে। ইউকে-তে কয়েকটা নাম করা ম্যাগাজিন দেখলাম পাঁচ তারা দাগিয়ে দিয়েছে লুপারকে।

আমার ব্যক্তিগত রেটিং-এ পাঁচে অন্তত চার দেব আমি। পয়সা খরচ করে দেখলে পয়সা উসুল হবে, ঘরে বসে দেখলে সময় নষ্ট হয়েছে মনে হবে না মোটেও। বরং মুভিটা শেষ হলে একটা অনুভূতি কাজ করবে। ঐ যে শুরুতে বলেছিলাম, একটা মানবিক আবেদন। একটা প্রশ্ন মনের মাঝে ঘুরতে শুরু করবে। একটা শিশু ভবিষ্যতে কেমন হবে, খারাপ নাকি ভালো, সেটা কে নির্ধারণ করে – নিয়তি নাকি সমাজের হয়ে আমরা?

২৯ সেপ্টেম্বর ২০১২
গ্লাসগো, যুক্তরাজ্য।

ছবির ক্রেডিটঃ ছবিটা ফেয়ার ইউজ পলিসির অধিনে উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া।


মন্তব্য

রিসালাত বারী এর ছবি

রিভিউ চমৎকার হইছে। মুভিটা দেখার ব্যাপক আগ্রহ বোধ করছি।

চলুক

আচ্ছা, In Time দেখেছেন?

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

দেখলে ভালো লাগবে আশা করি।

ইন টাইম দেখি নি। কার মুভি?

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি এমনিতেই সাই ফাইয়ের চরম ভক্ত, তার উপরে যে রিভিউ দিয়েছেন - আজই দেখবো - যদি পাই।

ধন্যবাদ।

-অয়ন

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

এ সপ্তাহেই রিলিজ হলো। যদি ডাউনলোড করে দেখতে চান, তাহলে ভালো প্রিন্ট মনে হয় পাবেন না। একটু অপেক্ষা করে দেখাই ভালো।

নিলয় নন্দী এর ছবি

গ্রে---ই---ট !!!
দেখতেই হবে।
চলুক

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি
স্যাম এর ছবি

রিভিউ চলুক চলুক
দেখতেই হবে।

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ। দেখে কেমন লাগলো জানাবেন।

অবনীল এর ছবি

দারুন প্লট। এরকম সাই ফাইয়ের অপেক্ষায়ই তো ছিলাম। তার উপর দুই দুইজন মুভি আইকন। দেখতেই হবে।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

প্লটের জন্যই গল্পটা আমাকে বেশি আকর্ষণ করেছে। এমনিতে স্বল্প বাজেটের মুভি। কিন্তু গল্পের কারণে দারুণ হয়েছে।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

রিভিউ দারুন হয়েছে। হাসি

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ। মুভিটা দেখে ভালো লাগলো তাই দ্রুত একটা রিভিউ লিখে ফেললাম। পড়ালেখা নিয়ে একটু ব্যস্ততায় আছি, তাই যত্ন করে লিখতে পারি নি। তবু ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। হাসি

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

আগ্রহ জাগানিয়া দারুণ রিভিউ হয়েছে।
প্রথমে ভাবলাম, বলেই দিলেন নাকি পুরোটা... খাইছে

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অতিথি লেখক এর ছবি

রিভিউ পড়ে মুভিটি দেখতে ইচ্ছা করছে। মুভি দেখে জানাব আপনার বক্তব্যের সাথে একমত কিনা। হাসি

ইমা

অতিথি লেখক এর ছবি

inception মুভিটা দেখতে পারেন।আমার একটি প্রিয় মুভি।
বুনো পথিক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।