গল্প সংক্রান্ত অভিমান

নজমুল আলবাব এর ছবি
লিখেছেন নজমুল আলবাব (তারিখ: রবি, ১৮/০৯/২০১১ - ৫:৪৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাবা অসম্ভব মজা করে কথা বলে। যে শুনে সেই হাসে। হাসতে হাসতে পেট ফুলে যায়। আমাদের বাড়িতে যেই আসে সেই বলে, বাবার মতো মজার মানুষ কোনদিন সে দেখেনি। বাবা এতো চমৎকার সব কৌতুক জানে, মুখ এমন ভেংচি কাটতে পারে, না দেখলে না শুনলে কেউ সেটা বিশ্বাস করবে না কিংবা বুঝতে পারবে না।

বাবার অনেক রাগ, সেটা কিন্তু কেউ তেমনভাবে বুঝে না। আমরা বুঝি, বড় চাচা বুঝে। আমার এখন বাইশ বছর বয়েস, বন্ধু ছাড়ারই সাহস নেই, কিন্তু বাবা সেই বাইশ বছর বয়েসে ঘর ছেড়েছে, আর যায়নি। চাচার সাথে কক্ষনো কথা বলেনি। চাচা প্রতি বছর রুটিন করে দু'বার আমাদের দেখতে আসে, কান্নাকাটি করে, বাবা সেটা আমলেও নেয়না। বাবা আর কোনদিন বাড়ি যাবে না। কী তীব্র অভিমান!

ছোটবেলা থেকে সবাই বলে আমি নাকি বাবার মতো। আসলেও তাই। বাবা মাত্র সাড়ে পাঁচ ফুটি একটা মানুষ। আমিও তাই। বাবা দেখতে মোটামতো, আমিও তাই। তবে লোকজন এসব কারনে আমাদের বাপ বেটার মিল খুজে না। তারা আমার মজা করে কথা বলার ক্ষমতাটার কথা বলে। আমি এটা ঠিক জানি না, বুঝি না বা সচেতনভাবেও করি না। এম্নিতেই আমার কথা কিরকম মজা মজা হয়ে যায়। এক দিক দিয়ে আমি বাবার চে এগিয়ে। শরীর দুলিয়ে, গলা মিলিয়ে আমি নানান অভিব্যক্তি করতে পারি। অবিকল না হোক মোটামোটি কাছাকাছি নকল করতে পারি যে কাউকে। সেটা সম্ভবত অনেক উপভোগ্য হয়। আমি দেখেছি লোকজন আমাকে এ ওর বিরুদ্ধে উসকে দেয়, চেষ্টা করে নকলামি দেখতে। ক্রিকেট খেলা হোক বা না হোক, আমাকে ক্রিকেটের ধারাভাষ্য দিতেই হয়! হরতাল না হলেও বিটিভির হরতালের খবর পড়ে শোনাতে হয়। আমর মজাই লাগে।

এম্নিতে আমাদের কোন অনুষ্ঠান থাকলে বাড়ির কিংবা বন্ধুদের, জমানো কিছু করতে হলে সবাই আমাকে মনে করে। আর কিভাবে কিভাবে যেনো আমি জমিয়েও তুলি আসর। এইতো সেদিন নাচের অনুষ্ঠানটায় যেতে পারলাম না। কাজ ছিলো। অনুষ্ঠান শেষ হতেই ফোন আর ফোন। এ একবার তো সে একবার। ভাংগা অনুষ্ঠানে গেলাম। জুইকে নিয়ে একটার পর একটা ফাজলামি করলাম। সে চেয়ারে বসে বসে হাসতেই থাকলো। নড়তে চড়তে পারে না। পেটে হাত দিয়ে বলে, ওই তুব থামবি! আমারতো ব্যাথা শুরু হয়ে যাচ্ছে... আমি দৌড়ে দরোজায় চলে এলাম, তরপর থেমে বল্লাম, নারে বাবা আর থাকা যাবে না, শহরের সব লেডি ডাক্তার ক্ষেপে যাবে। এভাবে অপারেশন ছাড়া বাচ্চা পয়দা হতে থাকলে তারা আমারে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে দেবে! মোটর সাইকেল স্টার্ট দিতে দিতে আমি শুনি, ভেতরে হাসির চোটে গমগম করছে, সবকিছু উড়ে যাচ্ছে।

আমাদের নাটকের দলে বাঘা বাঘা সব অভিনেতা। এরা মানুষকে হাসায়, কাঁদায়, রাগায়। একবার একটা নাটকে আমাকে দেয়া হলো ভাড়ের চরিত্রটা। নাটকের শুরু থেকে শেষ অব্দি নেচে গেয়ে ধুন্দুমার বাধিয়ে দিলাম। ডিরেক্টর বল্লেন ওরতো অভিনয় করতে হয়নি, ন্যাচারাল, একেবারে চাচার সবকিছু পেয়েছে। হয়তো সত্যি, কিন্তু আমি আসলে অভিনয়টা মন দিয়েই করেছি, সবচে বেশি রিহার্সাল করেছি আমি, নাটকটা নিয়ে আর সবার চেয়ে বেশি ভেবে থাকলে সেও আমিই ভেবেছি। এর পরের নাটকটাতে আমার একটা ছোট্ট চরিত্র। মিনিট কয়েক। খুব কষ্টের সেটা। রিহার্সালে মোটামোটি চালিয়ে নিলাম। সবাই বল্ল এতেই চলবে। যেদিন নাটক হলো, সেদিন জানি না কি হলো আমার, এর আগে একদিনও রিহার্সেলে যা হয়নি, সেদিন না চাইতেই সেটা হয়ে গেল। আমার চোখ দিয়ে কখন কিভাবে টপ টপ করে পানি আসলো সেটা নিজেই জানি না। নাটক শেষ হবার পরও আমি কাঁদছিলাম। কিন্তু নাটক শেষে গ্রুপের মূল্যায়ন সভায় বিষয়টা সবাই বেমালুম এড়িয়ে গেলো। একজন বরং বল্লেন, আগের নাটকে দীর্ঘ ভাড়ের চরিত্রটা আমার ভুলে যাওয়া উচিত, তাহলে এই নাটকে আরো ভালো কাজ করতে পারবো।

ভাড় তকমাটা লেগে গেলে মানুষের এমনই হয়। সবাই ভাবে এরে দিয়ে সিরিয়াস কিছু হবে না। সবাই ভাবে এর ভেতর কোন রাগ নেই, কোন অভিমান নেই। এর ভেতর জেদ বলতে কিছু নেই। মানুষটা খুবি সহজ, জলের মতো। হয়তো তাই। সবাইতো আর বাবাকে ভালো করে চিনে না। আমি জানি আমার বাবাকে, তাই জানি এই যাওটাই শেষ যাওয়া, আমি আর দেশে ফিরবো না। কোনদিন না...


মন্তব্য

তানিম এহসান এর ছবি

বাবাকে নিয়ে আপনার মধ্যে যে তীব্র আবেগ কাজ করে তার প্রথম প্রমান পেয়েছিলাম আপনার বাবাকে নিয়ে একটা লেখায় কোন মন্তব্য না করতে পেরে। আপনার প্রোফাইল পিকে আপনাকে দেখি একটি দেবশিশুর হাত ধরে দাড়িয়ে আছেন, আপনার এই দেবশিশুও তার বাবার জন্য এমন তীব্র আবেগ নিয়ে বড় হোক, বাবার হাত ধরে সে যে পৃথিবীতে বড় হয়ে উঠছে সেখানে তার জন্য থাকুক সুষম উত্তরাধিকার!

আপনার বাবার আত্মা পরম প্রশান্তিতে থাকুক, আপনার এবং আপনার পৃথিবীর জন্য শুভকামনা।

কল্যাণF এর ছবি

ইয়ে, মানে...

কর্ণজয় এর ছবি

চুপচাপ ভাবছি... কি লিখবো... কিছু কথা থাকে কিছুই বলার থাকে না।

রিশাদ_ ময়ূখ এর ছবি

চুপচাপ পড়ে বসে আছি

আশালতা এর ছবি

ভালো লাগলো। সুন্দর লেখা। চলুক

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

সুজন চৌধুরী এর ছবি
বন্দনা কবীর এর ছবি

হাসিমুখো মানুষদের আসলেই অনেক যন্ত্রনা মন খারাপ

শুভকামনা।

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

মন খারাপ করেনা ভাইয়া! চাচা নিশ্চয়ই খুব ভালো আছেন, চাচাকে নিয়ে কষ্ট পেয়োনা ভাইয়া ... মন খারাপ

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

তাপস শর্মা এর ছবি

লেখাটা পড়ে খুব কষ্ট হচ্ছে। শুধু এতটুকুই বলতে পারি আপনি ভালো থাকবেন ভাই। আপনার মতো লোকের আজ বড় প্রয়োজন।

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

আপনি এত কম লেখেন কেন?

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

মর্ম এর ছবি

বাবাদের চিনতে পারাটা খানিকটা ভাগ্যের ব্যাপার! ওনারা নিজের আড়াল করে রাখতে এত তৎপর কেন সত্যিই বুঝতে পারি না কখনো কখনো!

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

সুমন তুরহান এর ছবি

নজমুল ভাই, আপনার লেখার শেষাংশ ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়ে গেলো, জোয়ারের স্রোতের মতো।

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

কল্যাণF এর ছবি

ও অপু ভাই...??

নজমুল আলবাব এর ছবি

পাঠক এবং মন্তব্যবাজ সবাইকে ধন্যবাদ

অতিথি লেখক এর ছবি

এত গভীর বিষাদ এই প্রহরে পড়লে দুদিন পর আমারো ব্লাড প্রেশার বেড়ে যাবে ।।।

আফরিন আহমেদ

দীপ্ত এর ছবি

ধাক্কা খেলাম পড়তে গিয়ে শেষে এসে । দুপুরটা কেমন বিষণ্ণ করে দিলেন। মন খারাপ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।