স্বপন মাহালির মৃতু্য আমাদেরকে যে ইঙিত দিচ্ছে...

আরিফ জেবতিক এর ছবি
লিখেছেন আরিফ জেবতিক (তারিখ: সোম, ১৯/০৩/২০০৭ - ৫:১৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজকাল মৃতু্য সংবাদ খুব একটা স্পর্শ করে না আমাকে। টিভির খবর খুললে মৃতু্য,সংবাদপত্রের পাতা খুললে মৃতু্য,মোবাইল ফোনের এস.এম.এস এ মৃতু্য...এতো মৃতু্য সংবাদ দেখতে দেখতে,জানতে জানতে একে যাপিত জীবনের অংশ হিসেবেই মেনে নিয়েছি ।

তবু স্বপন মাহালির মৃতু্য সংবাদ জেনে আমার মন খারাপ হচ্ছে খুব।

স্বপন কোন মহামানব ছিল না। বক্তৃতায় বিবৃতিতে,সভা কিংবা শোভাযাত্রায় তার উজ্জল উপস্থিতি ছিল না। সে ছিল শুধুই স্বপন,আমাদের প্রান্তিক চত্বরের এক ছোট্ট চায়ের দোকানের মালিক।
তবু সেই স্বপন কিভাবে যেন,আমাদের মনের অজান্তেই,এই ছোট্ট শহরের অজস্্র সংস্কৃতি কর্মীর বড়ো আপন হয়ে গিয়েছিলে।

একটা সময় ছিল এই শহরের। আমাদের নাটক,আমাদের গান আমাদের সাহিত্য তখন সবগুলো জেলা শহর আর রাজধানীর উৎকর্ষতাকে ছাড়িয়ে শিরদাড়া সোজা করে দাড়িয়ে থাকতো। এই শহরের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড তখন মানচিত্র ছাড়িয়ে ভারতের বিভিন্ন জেলা শহরে হানা দিত। নাটক আর গানের দল নিয়ে আমরা নিয়মিত ঘুরতে যেতাম শিলচর,শিলং সহ কতো না জায়গায়।

সেই সময়,এই শহরের সাংস্কৃতিক হৃদপিন্ড ছিল প্রান্তিক চত্বর। কোন এক কালে এই স্থানটির নাম ছিল 'স্কাউট ক্যাস্পাস'। বিশাল আর শান্ত মাঠ ঘিরে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘর। বিশাল সব শতবর্ষী রেনট্রি গাছ তাদের বাহু মেলে ছায়া দিত আমাদের।

সেখানেই দোচালা টিনের ঘরগুলোকে ঘিরে ছিল এই শহরের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। কোন ঘরে চলছে নাটকের দল 'কথাকলি'র রিহার্সেল,অন্য কক্ষে 'নাট্যায়ন' কিংবা 'নান্দিক' এর নাটক পড়া,'দর্পন'এর পাঠ চক্র,'আজালা'র গানের অনুষ্ঠান। সারা সকাল জুড়ে শিশুদের কলকাকলি। প্রান্তিক কচিকাচার মেলা বসিয়েছে নাচ,গান, ছবি আঁকার উৎসব। সবুজ মাঠে গোল হয়ে বসেছে 'ভোরের কাগজ পাঠক ফোরাম' কিংবা 'প্রথম আলো বন্ধুসভা'র তরুন লেখকদের তুমুল আড্ডা।

আর এই অজস্র মানুষের ভিড়ে এক ছোট্ট চায়ের দোকান নিয়ে ছিল ,স্বপন মাহালির রাজত্ব। যতো সাংস্কৃতিক কর্মী,ছেলে থেকে বুড়ো, তাদের সকলের মিলন স্থল। রাত জেগে স্টেজের কাজ করতে হবে,স্বপন তার কক্ষটি হাসিমুখে ছেড়ে দিয়ে সারা রাত কাটাচ্ছে নিন্দ্রাবিহীন। কারো জরুরি চিঠি পত্র আসবে,স্বপন পরম মমতায় সেটি পৌছে দিচ্ছে প্রাপকের কাছে। কারো জন্য খবর রাখা দরকার অথবা নাটকের টিকিট,স্বপনের কাছে বলে যাও,ঠিকই খবর পৌছে যাবে । রিহার্সাল এর ফাকে চা সিগারেট;কারোটা কড়া,কারো টা হালকা,কেউ আদা চা আর কেউ দুধ চা,কেউ জর্দা দিয়ে পান খান,কেউ আবার চা য়ের পরেই ধরান একটি বিদেশি সিগারেট...স্বপনের সবকিছুই মুখস্থ ছিল। শুধু খবর পাঠালেই হবে তার চায়ের দোকানে। মুখ ফুটে কেউ একজন জানাবেন,বাবু ভাই আর টুকু দা-র চা,ব্যস ঠিকই দুই ধরনের চা,একটা পান আর একটা সিগারেট পৌছে যাবে কথাকলির রিহার্সাল রুমে।
আমি মাঝে মাঝে অবাক হতাম,এই যে অতশত লোক,ছেলে-বুড়ো;তাদের সবার আলাদা আলাদা পছন্দের কথা কিভাবে মনে রাখতো সেই স্বাক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন লোকটি!

তারপর ,একদিন সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে! তথাকথিত উন্নয়নের জোয়ারে ভাসে সিলেট শহর। এই শহরে মানুষের চেয়েও বেশি উৎপন্ন হয় বেনিয়ার দল। খালি জায়গা দেখলেই চোখ চকচক করে তাদের,মানসাংকে দেখে নেয় কয়টি মার্কেট হবে,সেই মার্কেট বেঁচে তাদের ব্যাংকে ঢুকবে কতো স্বর্ণমুদ্রা।সেই জোয়ার থেকে প্রান্তিক চত্বরটিকেও বাচিয়ে রাখা যায় না।

যে সবুজ মাঠে একদিন বৈশাখি মেলা বসতো,সেই মাঠ ঘিরে ফেলে লাল ইটের দেয়াল।
যেই উঠোনে বসে একদিন প্রতিঞ্জাবদ্ধ সাংস্কৃতিক কর্মীরা প্রশাসনের চোখ রাঙানোকে উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার গড়ার শপথ নিয়ে ছিলেন ,সেই উঠোন জুড়ে গড়ে উঠে সরকারী ভবন। প্রান্তিকের দোচালা ঘরটি একদিন বিনা নোটিশে গুড়িয়ে দেয় সরকারী আমলা আর তাদের মদদপুষ্ট কিছু বেনিয়ার দল।

দেয়ালের পর দেয়াল,খোপের পরে খোপ। কড়া গন্ডা মেপে সবাই ভাগজোক করে নেয় নিজ নিজ ভুমি। ঠিকানাচু্যত হয় সিলেটের সাংস্কৃতিক কর্মীর দল আর সেই সাথে ঠিকানাচু্যত হয় স্বপন মাহালি নামের এক দরিদ্র চা দোকানদার ।

চা শ্রমিকের এক পরিবার থেকে উঠে এসেছিল স্বপন মাহালি ।চা বাগানের সি্নগ্ধতা আর শ্রমিকের সরলতা নিয়ে এই সিলেট শহরে তার থাকবার কথা ছিল না। শুধু সংস্কৃতির শান্ত আবহ তাকে ধরে রেখেছিল এই শহরে। আর তাই ঠিকানাচুত্য স্বপন মাহালি আর এই উন্নয়নের জোয়ারে ভাসা শহরে নিজেকে অভিযোজিত করতে পারে নি। সে ফিরে যায় চা বাগানে ছাওয়া তার শান্ত গ্রামটিতে।সেখানেই বেকারত্বের সাথে ঝুজতে ঝুজতে সেই টগবগে যুবকটি মারা গেছে গত পরশু।সিলেটের সাংস্কৃতিক কর্মীরা সেই দূর গ্রামে গিয়ে পরম মমতায় স্বপন মাহালির শশ্বান বন্ধু হয়েছে ।

স্বপন মাহালির মৃতু্য আমাকে যতো না কাঁদাচ্ছে তার থেকে ভাবাচ্ছে বেশি।

মনের গভীরে জানতাম,স্বপন বেচে থাকবে না বেশিদিন। স্থানচু্যত হলেও আগাছারা বেচে থাকে,বৃক্ষ বাচে না।আগাগোড়া সরলতায় ভরা স্বপন ছিল সেই বৃক্ষ,উন্নয়নের চৌকাঠ ডিঙিয়ে যে নতুন করে বেচে থাকতে পারতো না।

স্বপনের এই মৃতু্য যেন এক প্রতিকী মৃতু্য। এই সিলেট শহরে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যেন মৃতু্য বরণ করছে এর সাথে। প্রান্তিক চু্যত সাংস্কৃতিক কর্মীদের জন্য এই শহরে একটুও ঠাই নেই।পাহাড় আর বন কেটে এই শহরে নতুন নতুন সরকারি দালান উঠছে ,সেই দালানগুলোর কোনটির কোন গলি ঘুপচিতেও একটু ঠাই হচ্ছে না এই শহরের সাংস্কৃতিক কর্মীদের।

এই শহর থেকে বিতাড়িত হচ্ছে কবিতা আর গান,নাটক আর মেলা,ছবির ক্যানভাস আর উৎসবের ঢোল, আর এই অবক্ষয়ের যুগে সেদিকে খেয়াল নেই কোন নগর কুতুবেরই।

এই সিলেটের সহস্্র বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আজ ধুকছে। একজন স্বপন মাহালির মতোই ,চুপিসারে একদিন তার মৃতু্য ঘটবে।

কে জানে তার হয়তো খুব বেশি আর দেরি নেই। স্বপন মাহালির অকাল মৃতু্য বোধহয় সেই ইঙিতই জানিয়ে গেল।

কৃতজ্ঞতা :নজমুল আলবাব এর দৈনিক সিলেট প্রতিদিন


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।