আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি,কার তাতে কী ?-(দ্বিতীয় এবং শেষ কিস্তি)

আরিফ জেবতিক এর ছবি
লিখেছেন আরিফ জেবতিক (তারিখ: সোম, ৩০/০৪/২০০৭ - ১২:০০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তিন.
কম্পিউটার টিপে টিপে আমার যে সামান্য কমনসেন্স জন্মেছে তাতে করে আমি নিশ্চিত জানি ইন্টারনেট একটি ফ্রি মাধ্যম এবং এখানে কোন কিছু সেন্সর করার কথা বলা অর্থহীণ।আমি সর্বভূক ধরনের প্রানী।ব্লগে আমি তাই চোরের ছড়া,রাসেলের শিশ্ন সমৃদ্ধ লেখা,ত্রিভুজের মহাজ্ঞানী লেখা হোসেইন আর রাগইমনের পাল্টাপাল্টি পোস্ট কোন কিছুকেই বাদ দেই না,সব গুলোই পড়ি। যেটা সঠিক মনে হয়,সেটাকে সমর্থন করি,যেটা ভুল মনে হয় সেটাও বলি আর যেটা বুঝতে সক্ষম হই না,সেটা থেকে নীরবে কেটে পড়ি।

ব্লগে অম্লীল শব্দ,বাক্য এগুলো বাদ দেয়া সম্ভব না জেনেই আমি ব্লগিংয়ের প্রথম দিকে সবার কাছে বিনীতভাবে জানিয়েছিলাম,আমার এসব ভালো লাগে না,এবং আমি এসব পড়া থেকে বিরত থাকি।আমি যেমন কারো লেখার অধিকারকে বন্ধ করে দিতে পারি না,তেমনি আমার পড়ার অধিকারেও নিশ্চয়ই কেউ বাগড়া বসাতে আসে না।

চার.
কথা আমি তুলিনি,তুলেছেন আরিল।ক্ষুদ্র ইংরেজী জ্ঞানে যতোটুকু বুঝেছি,তিনি ব্লগের যে বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দিয়ে পয়েন্ট আউট করেছেন,তার মধ্যে আছে অম্লীলতা এবং নুইসেন্স।ত্রিভুজ একটা পোস্ট দিয়ে চোরের একটি কমেন্টের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষন করলেন এবং চোরকে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনার জন্যও বললেন।আমি বেশকিছুদিন ধরে ব্লগে লগইন না করেই বসে বসে লেখা পড়ি,তো এই পর্যায়ে আমার মনে হলো যে অম্লীলতার সংজ্ঞা নির্ধারনের যে কথা উঠেছে,সেখানে আমারও কিছু বক্তব্য আছে এবং সেটা জানাতেই আমি আরিলকে একটা চিঠি লিখলাম। হোসেইনের কাছে ঝুমকার লেখা অম্লীল,ত্রিভুজের কাছে চোরের কমেন্ট অম্লীল আর আমার কাছে নিজামীর ছবি অম্লীল। এতে তো কোন সমস্যা থাকার কথা না।আমার মতো অনেক ব্লগারই আমার সাথে সহমত পোষন করলেন,এবং দেখতে দেখতে শখানেক কমেন্ট চলে আসলো।এখন অম্লীলতার সংজ্ঞা নির্ধারন করতে হলে আমাদের এতোজনের কথাকেও গুরুত্ব দিতে হবে বলে আমার বিশ্বাস।

পাচঁ.
কথা উঠেছে আমার অতিরিক্ত আবেগের বিষয় নিয়ে,সত্যি সত্যিই আমি আবেগ প্রবন মানুষ।
কোথাও কোথাও যুক্তিকে অফ করে,আবেগের ঠেলায় উথলে উঠলে কোন সমস্যা নেই।আমার বাবা চাচারা ছিলেন ভাসানী ন্যাপের তুমুল একটিভ কর্মী,তিনি কিন্তু চীনা পন্থি কমিউনিস্ট নেতাদের কথা শুনে ‘‘দুই কুকুরের কামড়া কামড়ি’’ বলে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন নি।আমার দাদা মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন,সিলেট আলীয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল,সে যুগের বেশ লেখাপড়া জানা মানুষ।তিনি অনেক যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিলেন যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পৃথিবীর সেরা সেনাবাহিনীর একটি,সেটার বিরুদ্ধে দুই তিনটা গুলি ফুটিয়ে কিছু হবে না,তিতুমীরের বাশের কেল্লার মতো আরেকটি বোকামি হচ্ছে,সিপাহী বিদ্রোহ করে অনর্থক হাজার হাজার মানুষ ফাসিতে ঝুলছে এবং আরো অনেক ইতং বিতং ব্যাপার। বাংলাদেশকে স্বাধীণতা পেতে হলে গান্ধীর মতোই নাকি অহিংসতা চালিয়ে যেতে হবে আর সেটাই মোক্ষম পন্থা।

ভাগ্যিস,সেই মহান বিম্লেষন উপেক্ষা করে থ্রি নট থ্রি নিয়ে যুদ্ধে যেতে বাংলার কৃষক,শ্রমিক,ছাত্র,বেকারের কোন অসুবিধা হয় নি,আর তাই ৯ মাসের মাথাতেই অনেক বুঝদার মানুষের কথাবার্তাকে ভুল প্রমানিত করেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে।প্রচন্ড আবেগের যে শক্তি,তার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনী পরাজিত হয়েছিল।আর যারা বসে বসে বলছিলেন ‘বাঙালির আবেগ বেশি,ফালতু লাফায়’তারা অনেকেই গর্তে লুকালেন,আর বাকিরা মুখ চুন করে বসে থাকলেন।সেই বিশেষজ্ঞদের প্রতি আমার করুনা ছাড়া কিছুই নেই।

ছয়.
আমি হলাম,সেই বেকুব জনতার উত্তরসূরী।প্রচন্ড আশাবাদী একজন মানুষ।আমার দেশ নিয়ে,আমার কৃষ্টি নিয়ে আমার সাহিত্য নিয়ে আমার আশাবাদের শেষ নেই।ইউনূসের নোবেল পাওয়ার পর আমি কখনোই ভাবি না এটা শেষ নোবেল,আমি ভাবি এটা শুরু।কয়েক বছরের মাঝেই সাহিত্যে কিংবা পদার্থ বিদ্যায় আরো কোন বাংলাদেশী নিশ্চয়ই একটা সত্যিকারের নোবেল নিয়ে আসবে,্তারপর আরেকজন তারপর আবার...।

সাত.
আর সেই জন্মগত আশাবাদ থেকেই আমি বিশ্বাস করি এদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে।
আসলে মধ্যবিত্তের বেচে থাকার জন্য কোন না কোন স্বপ্ন লাগে,আমার স্বপ্নের এক বড়ো অংশ জুড়ে আছে রাজাকারের বিচার হওয়ার সম্ভাবনা।
শেখ মুজিবকে যখন হত্যা করা হয়,তখন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের সিলমোহর ভেঙ্গে সেই হত্যার বিচার করা যাবে,তেমনটি আমিও কোনদিন ভাবি নি,কিন্তু অনেকেই কিন্তু ভেবেছেন।তারেক রহমানকে কোনদিন জেলে পাঠানো যাবে,সেটা আমি কোনদিন ভাবিনি অন্তত এই মাস তিনেক আগেও,কিন্তু সেটা সম্ভব হয়েছে।উদীচি অনুষ্ঠানে বোমা মারার পর সেই জংলীদের ধরা যাবে,তা অনেকেই ভাবেন নি,কিন্তু সেই জংলীরা কিন্তু ঠিকই গলায় দড়ি পড়েছেন।
সুতরাং যারা ভাবছেন ‘পারবে বলেও মনে হয় না’তারা ভাবতে থাকুন।আমাদের স্বপ্ন দেখা তাতে কমে যাবে না।

সম্ভব।সবই সম্ভব।জাহানারা ইমামের ডাকে সাড়া দিতে ৯২ সালে বিনাভাড়ায় মালগাড়ি চড়ে ঢাকা এসেছি,তখনই জানতাম সম্ভব।উপড়ে ফেলে তো ৩০ থেকে ৩ সিটে নিয়ে এসেছিলেন জাহানারা ইমাম।আবারও আমি ,আমার মতো হাজার হাজার মানুষ ঠিকই ডাক শোনার অপেক্ষায় আছে।একজন নেতা কি আসবেন না ?আসবেন।

যারা কম্পিউটারের কীবোর্ড চেপে হিসাব কষে দেখাবেন,আসবেন না,তিনি অফ যান।তিনি আমার দাদার সাথে লুডু খেলুন।দাদার সাথেই তার যুক্তিবিদ্যায় জমবে ভালো,আমার সাথে না।আমি আমার আবেগ নিয়ে অপেক্ষা করে যাবো,রাজাকারের বিচার দেখার আগে আমি মরতে চাই না।

আট.
কথা উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের একটা ছবি আমি কেন ব্যবহার করেছি আমার পোস্টে।আমি চিঠি লিখছিলাম একজন বিদেশীকে ।তাকে বলছিলাম,আমার জাতির সেই গৌরব বেদনার কথা। আমি জানাতে চেয়েছিলাম কেন আমার কাছে কিছু ছবিকে অম্লীল মনে হয়,যে গুলো আমার কিছু বুদ্ধিমান ব্লগার বন্ধুদের কাছে শুধুই ‘রাজনৈতিক নেতাদের ছবি’।

আমি সেই চিঠিতে আমার আবেগ ঢেলে দিয়েছি,সেই আবেগের জন্মটা কোথায় সেটা বুঝাতে আমার বাবা চাচাদের গলিত দেহের একটা ছবি আমার চোখের সামনে তুলে ধরেছি,তথাকথিত ‘রাজনৈতিক নেতাদের’ প্রতি আমার তীব্র ঘৃণার জন্ম দেয় এই সব ছবি, একজন বিদেশীকে আমার ঘৃণার কারন বুঝাতে এই ছবি ব্যবহারে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে;তারা মুক্তিযুদ্ধকে ইতিহাসের বইয়ের পাতায় আবদ্ধ করে ষোলই ডিসেম্বর আর পচিশে মার্চ একটু নেড়েচেড়ে দেখুন,কিন্তু আমি আমার জাতির বেদনাকে আমার চোখের ভেতরে রাখতেই পছন্দ করি,আমার ঘৃণার কারন হিসেবে সেই ছবি লক্ষ লক্ষ দেশী বিদেশীকে দেখাতে আমি আপত্তি করি না।এই ছবি প্রদর্শনের জন্য আরিলের কাছে আমাকে ব্যান করার আবেদন জানাবেন না বলে আমাকে শান্তনা দেয়ার যে নিষ্ঠুর রসিকতা টুকু করেছেন তাতে আমার আপ্লুত হবার কিছু নেই,কারন আমি তার তিল মাত্র পরোয়া করি ভাবলে ভুল ভাবছেন।

আমার এই প্রচেষ্ঠাকে যাদের বেজায় ফাক মনে হয়,তাদের জানাই ;সত্যি সত্যিই আমার বুকের মাঝে বিশাল শূণ্যতা,পূর্ব পুরুষের রক্তে দাবী পূরনে ব্যর্থতার খা খা শূণ্যতা;সেই শূন্যতা পূরন করার কোন উপায় যেহেতু আমার জানা নেই,তাই আবেগ দিয়েই আমি সেটা ভরে রাখতে চাই।

দশ.
মুক্তিযুদ্ধে ‘নিহত’দের জন্য আপনারা প্রার্থনা করুন,সেটা করাই উচিত;মগবাজারে বিশেষ বিশেষ দিনে ‘রাজনৈতিক নেতা’ নিজামী এবং মুজাহিদও তাদের জন্য দোয়া করে থাকেন।তবে আমার কাছে তারা ‘নিহত’ নন,তারা ‘শহীদ’।সেই ‘শহীদ’রা যে শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন তা আমার কেন যেন মনে হয় না,আর তাই আমি ক্রমাগত তাদের কথা বলে যাই।

এটা আমার বোকামি বলুন,শস্তা আবেগ বলুন আর যাই বলুন;আমার কিছু যায় আসে না। নিহত আর শহীদের শাব্দিক অর্থ সমান,এটা ভাষা সৈনিক গোলাম আযম বুঝতে পারেন,আমার মতো ইমম্যাচুউর এবং স্বল্প শিক্ষিত পাবলিক সেটা বুঝবে না।আমাকে সেটা বুঝাবার চেষ্ঠা করে আসলেই কোন লাভ নেই।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।