গ্লানি পর্ব (আমার সেই বন্ধুটির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা)

আরিফ জেবতিক এর ছবি
লিখেছেন আরিফ জেবতিক (তারিখ: শুক্র, ০৪/০৫/২০০৭ - ১২:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(উৎসর্গ: সহব্লগার শুভ আর আলভী।)

এক.
৩৩তম বি.এম.এ লং কোর্সের জন্য আমরা সবাই খুব উদগ্রীব ছিলাম।তখন ফরম ছিল না,সাদা কাগজে দরখাস্ত পাঠালেই ঝকঝকে ইন্টারভিউ কার্ড চলে আসতো নিজ ঠিকানায়। ১৯ বছরের এক কিশোরের কাছে জীবনে প্রথম ইন্টারভিউ কার্ড!কী উত্তেজনা,কী উত্তেজনা!!

আমরা অনেক খুজেঁ খুজেঁ বের করলাম আবিদ ভাইয়ের ঠিকানা।তিনি তখন সেকেন্ড লেফলেটেন্যান্ট।আমাদের
স্কুলের দুই ব্যাচ সিনিয়ার খুবই সাধারন স্টুডেন্ট।কিন্তু আর্মি অফিসার হিসেবে তার চাকচিক্য আমাদের মুগ্ধ করে অনুক্ষন।

দুইদিন পর আবিদ ভাই ফিরে যায় বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে।আমাদের উতসাহও ক্রমশ মিইয়ে যায়,আমরা ব্যস্ত হয়ে যাই কতো না আয়োজনে।উতসাহ মিইয়ে যাওয়ার কথাটা আমরা পরষ্পরের কাছে স্বীকার করি না।ঠোট উল্টে বলি,‘ধুর..আবিদ ভাই তো বলেছেই,স্মার্টনেসটাই ফ্যাক্টর,আর একটু ফটর ফটর ইংরেজী।কিছুটা সাধারন জ্ঞান।আর কিছু নয়।’

ওসব তো আমাদের আছেই।মফস্বল শহরে জিন্স পরা মানেই এক ধরনের স্মার্টনেস তখন,ওটা আমাদের বহুত দিনের অভ্যাস।আর হেডস্যার দরছ আলীর কাছে শেখা নিখুত গ্রামার,জেলা স্কুলের চকচকে ছাত্র আমরা,আমাদের ইংরেজীতে ভুল কোথায়? বাকি থাকলো সাধারন জ্ঞান।রোজ রোজ এতো যে রাজাউজির মারি,সেকি না জেনে মারি? লেবাননের প্রেসিডেন্টের নাম আর বিশ্বকাপে মারাদোনার গোলের সংখ্যা,বাংলাদেশের সব কজন রাষ্ট্রপতির নাম,কী জানি না ! আমাদের আর পায় কে,বাকি শুধু ভাটিয়ারিতে গিয়ে লেফট রাইট মারা।

তবু আমাদের বোকা বন্ধুটা এসব শুনে না।সে তিরিশ টাকা দিয়ে কিনে আনে ভর্তি গাইড।একটা ইংরেজী আর দুইটা বাংলা পত্রিকা রোজ মুখস্থ করে মনোযোগ দিয়ে।পাছে খানিকটা লালচে লাগে তাই একটা ঝকঝকে সাদা শার্ট কিনে ফেলে তিনশ টাকায়।তার বাবার টাই টা পরম আদরে ইস্ত্রী করে প্রস্তুত রাখে।সার্টিফিকেট গুলো নিয়ে য্ওায়ার জন্য মিতু আপার স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ফোল্ডারটা ধার করে এক সপ্তাহ আগে।চুল কাটিয়ে রাখে ছিমছাম।রোজ সকালে উঠে দৌড়ঝাপ করে..।আহা,তার বড়ো শখ ঐ জলপাই পোষাকের টিপটপ জীবনের জন্যে...।

দুই.
সকাল ৮টায় রিপোর্টিং সেরে জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্টের বড়ো একট ঘরে আমরা সবাই জড়ো হই।আমাদের উলঙ্গ করে দেখা হয় আগ পাশ তলা। পাছা উল্টে টর্চ মেরে কী দেখে জানি না,হয়তো দেখে নেয় কোন গোপন কৌমার্য।সেখানে উত্তীর্ণ হয় আমাদের সবাই,দুরবর্তী গ্রামের কিছু ছেলে কেন যেন বাদ পড়ে,তাদের সেই গোপন রোগের কথা আমাদের জানা হয় না আর।তাদের বিদায় নিতে হয় খালিমুখে,আর আমরা নাস্তা সারি গরম গরম সিঙারা আর ধোয়াঁ ্ওঠা চা দিয়ে।আমার বন্ধুটি চা খায় না,কোন কারনে যদি চা ছলকে উঠে ভিজিয়ে দেয় তার ফরসা শার্ট;সেই ভয়ে সে দূরে গিয়ে বসে।আমরা তাকে নিয়ে হাসি।আসন্ন পরীক্ষা নিয়ে আমাদের মাঝে কোন উত্তেজনা কাজ করে না।

তিন.
আবিদ ভাইয়ের বলে দেয়া কথা মতো আমি মনে মনে আঙুলে গুনে চলি ।দেখি কয়টা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেই।মফস্বলের ইংরেজী দিয়ে যদিও কথাবার্তা সামাল দেয়া যায়,কারন প্রশ্নকর্তার তুলনায় আমার গ্রামার সেন্স ভালো সেটা প্রথমেই বুঝে ফেলি;তবু সব প্রশ্নের উত্তর সঠিক দিতে পারি না।

আমি টের পাই,আমার হাতের মুঠি ক্রমশ আলগা হয়ে যাচ্ছে..প্রথম তিনটি পারলাম...দুইটা মিস...একটা পারলাম...চারটা মিস...এইটা বোধ হয় সামাল দেয়া গেল...এটা পেরেছি..নাহ,এবারেরটা হলো না।

তিরিশটার মধ্যে এগারোটা।বারোটাও হতে পারে,একটার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারি না।তবু আমি মনে মনে হাসি,আমার আগে পাভেল পেরেছে ৮টা,মোতাহির ৫টা পেরেছে বলে তার বিশ্বাস।

চার.
আমার সেই বন্ধুটি যখন ইন্টারভিউ রুম থেকে বেরিয়ে আসে তখন তার মুখের হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে যায় সারাটা ঘর।চব্বিশটা!!!!আমরা নিজেদের হতাশা ভুলে ধন্য ধন্য করে উঠি।আমাদের এই বন্ধুটি তাহলে আর্মি অফিসার হচ্ছে।সাবাশ পরিশ্রম,সাবাশ।

পাচঁ.
বিকেল ৪টা। দুই দল করা হয় নাম ডেকে ডেকে।একদলে আমাদের বাকি সবাই,আরেক দলে আরো গুটিকয় মানুষের সাথে আমার বন্ধুটি।আমরা তাদের দিকে তাকিয়ে গোপন ঈর্ষায় নীল হই।আহারে,জীবনের সোনালি দিন তাদের সামনে।

দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজর সাহেব আমাদের দলটার দিকে তাকান।আমি মনে মনে হাসি,এখুনি বোধহয় খেদিয়ে দিবে সকালের সেই দলটির মতো।বিকালের নাস্তাটা সাজানো হচ্ছে হলঘরের একপাশে।ইশ,খেয়ে গেলে হতো,এদের সিঙারাটা বড়ো চমতকার।মেজর সাহেব হাসি মুখে কথা বলে উঠেন।এবার বাংলা মিশিযে দেন।
'জেন্টলম্যান,প্রাথমিক ইন্টারভিউতে আপনারা সিলেক্টেড হয়েছেন।কনগ্রাচুলেশন্স।আপনাদের রিটেন পরীক্ষা নেয়া হবে আগামি ৩ তারিখ।সেম প্লেস।ইন্টারভিউ কার্ড নিয়ে ৮টার আগে প্রেজেন্ট থাকবেন।’

তারপর,সেই ছোট্ট দলটির দিকে তাকিয়ে বলেন একটা ছোট্ট বাক্য,‘স্যরি,মে বি নেক্সট টাইম।’ আমরা নিজেদের দিকে হতভম্ব তাকিয়ে থাকি।নিজেদের সাফল্যের আনন্দ কেন যেন ম্রিয়মান হয়ে যায় আমাদের সবার।
------------------------------

২০০৭ সাল
৪ মে,রাত ১২:১৬।

আমি আমার সেই সিলেক্ট না হওয়া বন্ধুটির কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। চব্বিশটা কেন ,তিরিশটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলেও তুই যে সে পরীক্ষায় পাশ করবি না,সেটা আমি জানতাম রে সুমন।আবিদ ভাই আমাকে আগেই বলেছিল।
বিশ্বাস করিনি,আর তাই বলতেও পারিনি তোকে।

তুই যতো ভালো ছাত্রই হয়ে থাক,যতো খাটাখাটনি করেই তুই প্রস্তুতি নিয়ে থাক,এক অঘোষিত কোটার মারপ্যাচে তখন তোর নাম বাদ পড়ে যাওয়ারই কথা ছিল।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক বন্ধুটি আমার,মাঝে মাঝে নিজের নামটিও শত্র“তা করে বসে।

আর তাই তোর সেই সাধের চাকরিটি করা হয় না হে সুমন কান্তি নন্দি...


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।