বাধ ভাঙার এই আওয়াজ বোধহয় কারো কাম্য ছিল না (উৎসর্গ :বিদায়ী ধূসরছায়া বৃন্দ)

আরিফ জেবতিক এর ছবি
লিখেছেন আরিফ জেবতিক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৭/০৬/২০০৭ - ১১:২২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সাবেক গল্প:
প্রথম আলো বের হলো।আমাদেরই সাবেক সহকর্মীরা একটি ঝকঝকে এসি অফিসে,পায়ের নিচে কার্পেট নিয়ে,গদি আটা ইম্পোর্টেড চেয়ারে বসে বের করলেন সম্পুর্ণ রঙ্গীন ১৬ পৃষ্ঠার ঝকঝকে একটা পত্রিকা।

অপর পাশে আমরা আরেকদল যুদ্ধ শুরু করলাম সেই আম কাঠের হাতল ভাঙ্গা চেয়ারে বসে,২২ জন মানুষের জন্য ৩টা সিলিং ফ্যান ঘুরিয়ে,ট্যাপের পানি খেয়ে,সাদাকালো একটা ১২ পৃষ্ঠার পত্রিকা ভোরের কাগজকে বাচিঁয়ে রাখার যুদ্ধ।

দিন যায়,সপ্তাহ যায়,মাস যায়।প্রথম আলোর সার্কুলেশন ১২ থেকে ২০ হাজারে ঘুরেফিরে,আর আমরা ৯০ হাজার থেকে উঠে আসি ১ লক্ষ ৫ হাজারে।ভোরের কাগজের যে শক্তি,সেই পাঠকরা আমাদেরকে ঘিরে ধরে থাকেন।

সেই সময়ের কথা।কী নেই আমাদের।আমাদের আছেন অমিত হাবিব,অলক গুপ্ত,পুলক গুপ্ত,মইনুল হাসান সাবের,সঞ্জীব চৌধুরী,
মুন্নী সাহা,জ.ই.মামুন,অমুক তমুক...।

এক অন্ধ ডেডিকেশনে আমরা খাটতে থাকি প্রাণপন।
সাবের হোসেন চৌধুরী আমাদের মালিক,বনেদী পয়সাঅলা লোক,প্রতিমন্ত্রীর চেয়ারে আসীন,তিনি ভোরের কাগজের প্রকাশক।আমরা তার কাছে দেন দরবার করি ক্রমাগত,পত্রিকাটিকে রঙীন করে দেন,আমাদেরকে ১২ পৃষ্ঠার জায়গায় ১৬ পৃষ্ঠা করে দিন।আর কিছু চাই না,দেখবেন প্রথম আলোকে দৈনিক শ্যামবাজারের পর্যায়েই থামিয়ে রাখব,বাড়তে দিব না সহজে।

সাবের হোসেন শুনেন না।তিনি তখন ছিলেন মগন মন্ত্রীত্বের কাজে..।

তারপর মাস ঘুরে ২ মাস..৩ মাস...৪ মাস।
পাঠকদের চিঠি,এজেন্টদের করুন ফোন..ভাই রঙীন করুন..ভাই পৃষ্ঠা বাড়ান...।
আমরা চিৎকার করি,লাভ নেই।
এক সময় ধ্বস নামে খুব ধীরে।সার্কুলেশন কমে হয় ৮৫ হাজার,প্রথম আলো ৪০ হাজার।
মাসিক মিটিঙে তখন আমি বলেছিলাম,"আমাদের দৌড়ার ক্ষমতা ছিল,কিন্তু আমাদেরকে বস্তা দৌড়ে দেয়া হয়েছে,অথচ ট্র্যাকের বাকি সবাই দৌড়াচ্ছে ম্যারাথন।আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদের পা খুলে দিন।"

মাসের বেতন বাকী পড়ে।এক মাস থেকে দুই মাস।তারপর তিন মাস।

প্রথম চাকরি ছাড়ে এক ছোট্ট জুনিয়ার সাবএডিটর।
তারপর লাইব্রেরিয়ান,তারপর একটা পিওন,তারপর এক শিক্ষনবীস রিপোর্টার।
সেই শুরু।আমাদের কোটিপতি মালিক আমাদের বেতন দেন না,পত্রিকা রঙীন করে দেন না,পৃষ্ঠা বাড়িয়ে দেন না।তার এক অন্ধ বিশ্বাস "ভোরের কাগজ"কে তার পাঠক ছেড়ে যাবে না।

কিন্তু কর্মীরা যায়,বাধ্য হয়েই যায়।ইটিভিতে চলে যায় এক ঝাঁক জাদরেল সাংবাদিক,এখানে ওখানে আরো কয়জন ভালো ভালো সুযোগ নিয়ে চলে যায়,আর ১৫ হাজার টাকার রিপোর্টারের শূণ্যস্থান পৌরন করা হয় ১৫শ টাকা বেতন দিয়ে কলেজ ছাত্রদের দিয়ে।

বাদবাকি ইতিহাস।
বহুদিন পরে ভোরের কাগজ রঙীন হয়,অফিস এসি হয়,নতুন নতুন ফিচার যোগ হয়।
শুধু ফিরে আসেনা সেই লক্ষ পাঠক।
ফিরে আসেনা সেই আবেদন,সেই ভালোবাসা।

বর্তমান গল্প:

এই দেশের একটি ব্লগিং সাইট।
ঝাকে ঝাকে তরুন লেখকরা রাতজেগে সেখানে লিখতে আসে।
নিজের খেয়ে একে তাকে এখানে লিখতে আমন্ত্রন জানিয়ে যায়।
হঠাৎই অজানা কারনেএক সময় এখানে বাড়তে থাকে তথাকথিত নষ্ট রাজনীতির মানুষরা।তারা তাদের নখের আচরে রক্তাক্ত করে মনিটর,কী বোর্ড,মাউস..।

আমরা ক্রমাগত এই দিকে সাইট মালিকের দৃষ্টি আকর্ষন করি।
ক্রমাগত তাদেরকে বুদ্ধি পরামর্শ দেই,প্রতিবাদ করি,প্রতিরোধের চেষ্টা করি।

সাইট মালিক চোখ মেলে তাকান না।

একজন জামাল ভাষ্কর চলে গেলেন,একজন অমিত আহমেদ লেখা বন্ধ করলেন,একজন হাসান মোরশেদ তার ব্লগ শিরোনামে লিখলেন "এই ব্লগে কোন মৌলিক লেখার দরকার নেই",একজন মিয়া মোহাম্মদ হুসাইনুজ্জামান ব্লগে লিখে গেছেন "এই খানে আর থাকলাম না,মন উঠে গেছে",একজন তাসনিম নুসরাত বিদায়ী পোস্ট দিলেন,একজন ধূসর ছায়ার লেখা আর ২০০ পোস্ট অতিক্রম করবে না।

আমি দেখছি সেই একই ইতিহাস আবার।
একদিন হয়তো সবই হবে,সেই ভোরের কাগজের মতোই তখন হয়তো খুব দেরী হয়ে যাবে।

এরকম আত্মহত্যার ইতিহাস দেখতে দেখতে আমি বড়ো ক্লান্ত।
কেন যে আমাদের মাথার উপরের মানুষগুলো বুঝেন না,
নদীর কোটীটাকার বাধ ভাঙা শুরু হয় কিন্তু ছোট্ট ইদুরের গর্ত থেকেই।

এখানে সেই গর্ত বড়ো হয়ে ফাটল হচ্ছে।
হয়তো এখনও খুব দেরী হয়ে যায় নি,তবে ক্রমাগত দেরী হয়ে যাচ্ছে।
বাধ ভাঙার এই আওয়াজ বোধহয় শোনা কারো কাম্য ছিল না।
কে জানে,কে বলতে পারে ?


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।