আমরা বোধহয় মানুষ নই,মানুষগুলি অন্যরকম (জেবতিকের বিষাদময় প্রতিক্রিয়া পোস্ট)

আরিফ জেবতিক এর ছবি
লিখেছেন আরিফ জেবতিক (তারিখ: মঙ্গল, ১২/০৬/২০০৭ - ১১:৪৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এক.
আমরা খুব সেনসেটিভ,ভীষন স্পর্শকাতর।
আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আছে,ঘরে ও অফিসে নেট সহ পিসি আর ল্যাপটপ পোষার সামর্থ আছে।আমাদের স্পর্শকাতরতা তাই কীবোর্ড গড়িয়ে অন্য সবার ঘরে ঘরে উকি দেয়।

বিশ্বাস না হয় তো আমাকে একটা গালি দিয়ে দেখুন।৫ মিনিটের মাথায় আমি শুধু আপনাকে গালি দেব না,আপনার মা,খালাকেও জড়িয়ে গালি দিয়ে পাল্টা পোস্ট দেব।মুড খারাপ থাকলে আপনার বৃদ্ধা দাদী নানীকেও টেনে আনতে পারি।

আমাদের স্পর্শকাতরতা শুধু নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।আমরা
আমাদের দেশ,দল,রাজনীতি,অর্থনীতি,সমাজনীতি সব কিছু নিয়েই ভাবি।বিশ্বাস না হয় তো আমার নেতাকে "চোর" বলে দেখুন,আপনার নেতাযে সাধু পুরুষ নয়,সেটা তথ্য উপাত্ত সহ বিশ্লেষন করে মুখের ওপর ছুড়ে মারব।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বা বিপক্ষে আমার জন্মগত অবস্থান।যে পক্ষেই আমি থাকি না কেন,নিজের পক্ষকে ডিফেন করার জন্য আমি দরকার হলে রাত জেগে যুদ্ধ চালিয়ে যাবো,প্রয়োজনে পরদিন অফিস কামাই হয়,হোক।

আমি দুনিয়ার কোথায় কী হচ্ছে সবকিছু নখদর্পনে রাখি।অন্যদের জন্য সেই জ্ঞান বিতরনের জন্য মাঝে মাঝে পোস্ট দিয়ে আমি অমুক সাইটের লিংক,ইউটিউবের তমুক ভিডিও,কঙোর পপ গায়িকার দুর্লভ গানের লিরিক,মানস সরোবরের জলকেলিরত মাছেদের বৈজ্ঞানিক নাম,সব কিছু উগলে দেই।

দেশের সবগুলি টিভি নিউজ আর সংবাদ পত্র আমার মুখস্ত।পাছে অন্যরা কিছু মিস করে যায়,এ জন্য আমি মাঝে মাঝেই সেগুলো কাটপেস্ট করি।

দিনভর বৃষ্টিতে আপ্লুত হয়ে আমি গল্প নয়তো কবিতা লিখি।
অন্যের লেখা টপলিস্টে উঠলে আমি ঈর্ষান্বিত হই,হয় তাকে গালি দেই নয়তো নিজেই শ'য়ে শ'য়ে নিক বানিয়ে আমার আর আমার ভাই বেরাদরদের পোস্টগুলোকে ঠেলে টপ করে দিয়ে আসি।

অমুকের নিক কয়টা,তমুক কি আসলে হমুকের নিক,এই আবালটাকে কি মডারেটর বানিয়েছে এসব বিষয়ে আমার চিন্তার শেষ নেই।এমনকি সেই চিন্তাগুলোকে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়াও দুই মিনিটের মামলা।
১০ দিনে ৪৬টা পোস্ট না করলে আর ব্লগার কিসের!লেখার আইটেম না পেলে ছবি পোস্ট করব,নয়তো ভাত খাইতে আজ লবন কেন কম ছিল সেটাও ব্লগে জানাবো।

আমরা সেনসেটিভ।
আমরা বড়ো স্পর্শকাতর।
আমরা বড়ো কত্থক।
আমরা শুধু বলি আর বলি।

দুই.
আমাদের দেশে চব্বিশঘন্টা আগে প্রাকৃতিক দুর্যোগে মরে গেছে প্রায় একশজন মানুষ।দেশের সবগুলি মিডিয়ায় সেই খবর আছে।
আমরা যে টিভি চ্যানেল আর পত্রিকাগুলি মুখস্ত করি,সেগুলোতেও সেই খবর ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে।

কিন্তু চব্বিশ ঘন্টায় আমাদের মডারেটর মুক্ত ,বাক স্বাধীনতার অঙ্গীকারযুক্ত ডিসকাশন ফোরামে এটা নিয়ে আমরা একটাও কথা বলি না।বরং কাকে কিভাবে বাশঁ দিতে হবে,সেই বাশঁ কি সে এখানে নিচ্ছে না অন্যখানে নিচ্ছে এই সব বিতং বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পোস্টের পর পোস্ট ঝাড়ি।

আমরা সেই দুর্গত অসহায় বৃষ্টি ভেজা মানুষদের কথা বলতে ভুলে যাই।কারন তারা আমার সুরুচি আর সুক্ষ তর্ক জ্ঞানের বিষয় নয়।আমার কাছে দেশে মানেই একটি বিশাল বিষয়,দেশের মানুষ আমার কাছে গুরুত্ব পায় না।

যে ঘটনা সবাই জানে সেটা নিয়ে কিছু বলে আমি নিজেকে মূর্খ হিসেবে পরিচিত করতে চাই না।আমি বরং ওয়েব সাইট খুজেঁ বের করি মিয়ানমারের কোন গ্রামে কে অসহায় পড়ে আছে,উগান্ডায় কতোজন মরে ক্ষুধায় আর কতোজন মরে এইডসে।সেগুলো লিখলেই না আমার মগজ গরম হয়ে ,কপাল বেয়ে চুইয়ে পড়া সেনসেটিভনেস,স্পর্শকাতরতা প্রতিষ্ঠিত হবে,আমার জ্ঞান নিয়ে বাহবা আর পিঠচাপড়ানি পড়বে।

তিন.
চব্বিশঘন্টা পরে আমাদেরই এক সঙ্গী তার ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে আমাদেরকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দেন।আমরা একটু
আহা উহু করি।

ভাগ্যিস মনিটরে আয়না বসানো নেই।
নইলে দিনের ১৮ ঘন্টার এই মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকা আমরা হয়তো নিজের চেহারা দেখে আতঁকে উঠতাম।
আমরা হয়তো দেখতাম,আমাদের মাঝে মানুষটা সেই কবেই মরে গেছে ।আমরা এখন কৃত্রিম স্পর্শকাতরতাময় পশু হয়ে উঠেছি।

কে জানে,আরিল আমাদের গালে যে চড় মারলেন,
সেই চড়ের দাগ হয়তো আমাদের গালে ফুটে উঠেছে কি না,সেটাও আমরা এক ফাকে দেখে ফেলতাম।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।